সময়ের কথা-ফার্স্টটাইম ভোটারদের কি ভুলে গেলেন? by অজয় দাশগুপ্ত
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নিয়ে দেখুন_ অনেক বেশি সাড়া পাবেন। এখন সভা-সমাবেশে 'আদুভাই নেতারা' জবরদস্তি করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসে। প্রকৃত ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন ছড়িয়ে পড়লে তারাই প্রয়োজনে রাজপথে আসবে।
অতীতের যেসব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছে, সন্ত্রাসী কিংবা পুলিশ-মিলিটারি তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখনও পারবে না
আড়াই বছর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুলভাবে সমর্থন দিয়েছিল। নির্বাচনের আগের কয়েকটি দিন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের আলোচনায় 'ফার্স্টটাইম ভোটার' বা প্রথমবারের মতো ভোটার যারা হয়েছে তাদের মতামত বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের তারা বিচার চেয়েছে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত এগিয়ে চলুক, সেটা চেয়েছে কায়মনোপ্রাণে। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রত্যাশা করেছে প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি। অর্থনৈতিক উন্নতি তো অবশ্যই চেয়েছে। এটা না ঘটলে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বেশিরভাগ অপূর্ণ থেকে যায়। যে তরুণ প্রজন্ম ২০০৭ সালের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্মি ক্যাম্প চায়নি, তারাই কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এই প্রজন্মের প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে? বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ ও ১১ জুলাই, ২০১১। সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত এ সংগঠনের কয়েকজন সক্রিয় নেতা ও কর্মীর কাছে জানতে চেয়েছি_ তাদের কী এজেন্ডা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন এ সম্মেলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কী আলোচনা করবে? সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যবইকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার তাগিদ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ফজলুল হক আমিনীর দল এবং আরও কয়েকটি ধর্মান্ধ দল এ শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন হতে দিতে চায় না। তারা 'জিহাদের' হুমকি দিয়েছে। ছাত্রলীগের সম্মেলনে কি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার পর ইতিকর্তব্য নির্ধারিত হবে? বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গৌরবের। '৫২, '৬২, '৬৯, '৭১, '৮২, '৯০, ২০০৭_ অনেকগুলো মাইলফলক বছরের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। এসব আন্দোলনের পেছনে ছাত্র সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতা ও কর্মীর ভূমিকা ছিল ত্যাগ ও সাহসের। আবার গত দুই দশকের সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের শাসনামলে ক্ষমতাসীন দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের তুলে ধরেছে ভিন্ন পরিচয়ে_ তারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে এবং এ জন্য অনৈতিক সুবিধা আদায়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করেছে। তারা প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে। আবার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এখন এ দুটি 'বড়' ছাত্র সংগঠন বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন। যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তাদের ছাত্র সংগঠন প্রতিপক্ষকে কোনো ক্যাম্পাসেই স্থান দিতে রাজি নয়। এর একটি কারণ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায়। তারা শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য করে। নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের কাছ থেকে বখরা আদায় করে কিংবা অর্থের বিনিময়ে কাউকে কাউকে কাজ পাইয়ে দেয়। আশির দশকে এইচএম এরশাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজের নেতাকর্মীদের এসব বদভ্যাস ছিল। ষাটের দশকে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন এনএসএফের নেতাকর্মীরা ছিল মূর্তিমান দানব। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের কখনও পাত্তা দেয়নি। বরং এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। অথচ এ দুটি ছাত্র সংগঠনের কারণেই গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এখন যে বাস্তবতা তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তাতে 'রক্তপাত নিশ্চিত' বলে ধরা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্রলীগের পক্ষে অংশগ্রহণ আদৌ সম্ভব ছিল না। তারা ক্যাম্পাসগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়ন করে দিয়েছিল। তারপর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী ক্যাম্পাস থেকে ভয়ে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের আগস্টে ঢাকা ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রবল ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের ভূমিকা আদৌ লক্ষ্য করা যায়নি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিপীড়ন সহ্য করেছে। অনেক শিক্ষক ও ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে ফিরে আসা আরও বিলম্বিত হয়েছে। এখন চলছে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব। তারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীর সঙ্গে গত কয়েকদিনে আলোচনা করেছি তাদের প্রতি একটি প্রশ্ন ছিল_ এখন ডাকসু নির্বাচন হলে কোন সংগঠন জয়ী হবে। উত্তরে প্রায় সবাই নিশ্চুপ ছিলেন। কেবল দু'একজন বলেছেন, 'ভালো প্রার্থী দিলে আমরা জয়ী হবো।' ভালো প্রার্থীর সংজ্ঞা কী? তাদের কাছে আরও প্রশ্ন ছিল_ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে হলে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৯ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হয় ১৮ বছরে। তারপর ৫ বছরে মাস্টার্স কোর্স শেষ হওয়ার কথা। বয়স তখন ২৩। সন্ত্রাসসহ নানা কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটির জন্য যদি তাদের শিক্ষাজীবন দুই বছরের জন্যও বিলম্বিত হয় তাহলেও ২৫ বছরের পর কারও ঢাকা বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সুযোগ নেই। একটু বেশি বয়সে যারা ভর্তি হয় তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আসবে তাদের কারোরই কিন্তু ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সুযোগ নেই। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে বয়সসীমা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য যারা দারুণ তৎপর, তারা কি এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর আচরণে আদৌ সন্তুষ্ট নন এবং তা প্রকাশ্যেই বলেছেন। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগে 'তার কথাই শেষ কথা'। সর্বোচ্চ বয়সসীমা তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটা যেন কোনোভাবেই রক্ষা করা না হয় সে জন্য তদবির-লবি-হুমকি কোনো কিছুরই কমতি নেই। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সন্তান স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। বয়সের মানদণ্ডে তারা ছাত্রলীগের চেয়ে এগিয়ে। নির্বাচনের সময়ে কিংবা রাজপথের আন্দোলনে ছাত্রদলের বেশি বয়সীরা যখন পেশিশক্তির দাপট দেখাবে, তখন ছাত্রলীগের 'কচিকাঁচারা' তাদের সঙ্গে পারবে কীভাবে? মোক্ষম যুক্তি বটে! বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড় নয়_ বেঁচে থাক মাস্তানতন্ত্র হয়ে চিরজীবী!
সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন। এখন ছাত্রলীগের মতো সংগঠনের অনেক নেতাও রয়েছেন আন্দোলনে_ ছাত্রছাত্রীদের কোনো সমস্যা নিয়ে নয় বরং নিজেদের অতি সংকীর্ণ স্বার্থে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কিছু ছবি এখনও সংবাদপত্রের পাতায় এবং টিভি পর্দায় দেখানো হয়। তাদের কচি মুখগুলোর প্রতি কি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও জানেন, তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হয়েছিলেন নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে। এই নিয়মিত শিক্ষার্থীরা রাজপথ কাঁপিয়েছেন। প্রবল প্রতাপশালী সামরিক ও স্বৈরশাসকদের উচ্ছেদ করেছেন। ঊনসত্তরের আন্দোলনের নেতা তোফায়েল আহমেদের সে সময় বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। ১৯৭২ সালে ডাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম_ বয়স তখন ২২। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কারণে একটি বছর শিক্ষাজীবন বিঘি্নত না হলে ২১ বছর বয়সেই তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। একাত্তরে এমন হাজার হাজার ছাত্র এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তরুণরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল যাদের বয়স ছিল ১৫-২০ বছরের মধ্যে। জীবনে এর চেয়ে স্মরণীয় সময় ক'জনেরই-বা আসে। এমন সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন এবং ঝুঁকি গ্রহণের সময়ও কিন্তু তারা বড় ভাইদের তুলনায় একটুও পিছিয়ে থাকেনি। তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজে কেন আদুভাইদের হাতে ছাত্র নেতৃত্ব তুলে দেওয়া?
ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেই শিক্ষাঙ্গনের কোনো ইস্যু নিয়ে আলোচনা নেই। তাদের ব্যস্ততা কমিটিতে থাকা নিয়ে। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ সাড়ে পাঁচ বছর। এ সময় কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভা প্রকৃতপক্ষে হয়নি। শীর্ষ নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তাদের ২৯ বছরের খাড়া পড়লে ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেছিলেন, আপনি চাইলে আমাদের সংগঠনের সভাপতি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একশ' প্রাইভেটকার ও জিপ হাজির করতে পারেন। ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতাও নিশ্চয়ই পারেন। ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের মোকাবেলার কাজেও তাদের দক্ষতা রয়েছে বলে মেনে নিচ্ছি। প্রতিপক্ষ সক্রিয় না থাকলেও সমস্যা নেই_ ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই হতেই পারে এবং তাতে পেশিশক্তি প্রদর্শনে কোনো বাধা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে_ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কেন এটা চলতে দেবেন? তারা কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে তৎপর হবেন না? মাত্র আড়াই বছর আগের চিত্র তাদের নিশ্চয়ই স্মরণে রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রক্তচক্ষুর কারণে ছাত্রলীগের অনেক 'রাজপথের অকুতোভয় সৈনিক' ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যেতে সাহস করেনি। তাদের ভয় ছিল গ্রেফতারের। ফার্স্টটাইম ভোটাররাই নির্বাচনে আওয়ামী লীগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তরুণ প্রজন্ম যে একাত্তরকে এমনভাবে স্মরণে রেখেছে, সেটা তারা বুঝতে পারেননি। হাওয়া ভবনকেও এ প্রজন্ম মেনে নেয়নি। সঙ্গত কারণেই ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের দাপট-দৌরাত্ম্যও তাদের দারুণ অপছন্দ। তাহলে এই তরুণ প্রজন্মের দ্বারস্থ কেন হবে না আওয়ামী লীগ? প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নিয়ে দেখুন_ অনেক বেশি সাড়া পাবেন। এখন সভা-সমাবেশে 'আদুভাই নেতারা' জবরদস্তি করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসে। প্রকৃত ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন ছড়িয়ে পড়লে তারাই প্রয়োজনে রাজপথে আসবে। অতীতের যেসব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছে, সন্ত্রাসী কিংবা পুলিশ-মিলিটারি তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখনও পারবে না। দেশের কাজে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যম ও সৃজনক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে এর বিকল্প নেই।
শুধু ছাত্র সংগঠন নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকার এমন আইন করুক যাতে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরাই কেবল প্রার্থী হতে পারবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের দাপট অনেক কমে যাবে বলেই আমার ধারণা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও এ ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হোক। তাতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটতে পারবে।
এর বিপরীতে এখন যেভাবে চলছে সেটা চলতে থাকলে ছাত্রদলের নেতাদের ডাকা ধর্মঘটে তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া সন্তানরা পড়বে সেশনজটে, আর ছাত্রলীগের আদুভাই নেতাদের দাপটে শেখ হাসিনার চমকের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং দিনবদলের সনদের স্লোগান নিয়ে চলবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। বাষট্টি বছরের আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ কি তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃজনশীল ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
আড়াই বছর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুলভাবে সমর্থন দিয়েছিল। নির্বাচনের আগের কয়েকটি দিন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের আলোচনায় 'ফার্স্টটাইম ভোটার' বা প্রথমবারের মতো ভোটার যারা হয়েছে তাদের মতামত বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসরদের তারা বিচার চেয়েছে। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত এগিয়ে চলুক, সেটা চেয়েছে কায়মনোপ্রাণে। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রত্যাশা করেছে প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি। অর্থনৈতিক উন্নতি তো অবশ্যই চেয়েছে। এটা না ঘটলে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বেশিরভাগ অপূর্ণ থেকে যায়। যে তরুণ প্রজন্ম ২০০৭ সালের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্মি ক্যাম্প চায়নি, তারাই কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ সমর্থনে রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
এই প্রজন্মের প্রত্যাশার কতটা পূরণ হয়েছে? বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ ও ১১ জুলাই, ২০১১। সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত এ সংগঠনের কয়েকজন সক্রিয় নেতা ও কর্মীর কাছে জানতে চেয়েছি_ তাদের কী এজেন্ডা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন এ সম্মেলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কী আলোচনা করবে? সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীকে বিনামূল্যে বই দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যবইকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার তাগিদ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ফজলুল হক আমিনীর দল এবং আরও কয়েকটি ধর্মান্ধ দল এ শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন হতে দিতে চায় না। তারা 'জিহাদের' হুমকি দিয়েছে। ছাত্রলীগের সম্মেলনে কি এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার পর ইতিকর্তব্য নির্ধারিত হবে? বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস গৌরবের। '৫২, '৬২, '৬৯, '৭১, '৮২, '৯০, ২০০৭_ অনেকগুলো মাইলফলক বছরের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। এসব আন্দোলনের পেছনে ছাত্র সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতা ও কর্মীর ভূমিকা ছিল ত্যাগ ও সাহসের। আবার গত দুই দশকের সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের শাসনামলে ক্ষমতাসীন দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশ নিজেদের তুলে ধরেছে ভিন্ন পরিচয়ে_ তারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে এবং এ জন্য অনৈতিক সুবিধা আদায়ে পেশিশক্তি ব্যবহার করেছে। তারা প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে। আবার নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এখন এ দুটি 'বড়' ছাত্র সংগঠন বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন। যখন যে দল ক্ষমতায়, তখন তাদের ছাত্র সংগঠন প্রতিপক্ষকে কোনো ক্যাম্পাসেই স্থান দিতে রাজি নয়। এর একটি কারণ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা আদায়। তারা শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য করে। নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের কাছ থেকে বখরা আদায় করে কিংবা অর্থের বিনিময়ে কাউকে কাউকে কাজ পাইয়ে দেয়। আশির দশকে এইচএম এরশাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজের নেতাকর্মীদের এসব বদভ্যাস ছিল। ষাটের দশকে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন এনএসএফের নেতাকর্মীরা ছিল মূর্তিমান দানব। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা তাদের কখনও পাত্তা দেয়নি। বরং এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। অথচ এ দুটি ছাত্র সংগঠনের কারণেই গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এখন যে বাস্তবতা তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তাতে 'রক্তপাত নিশ্চিত' বলে ধরা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্রলীগের পক্ষে অংশগ্রহণ আদৌ সম্ভব ছিল না। তারা ক্যাম্পাসগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়ন করে দিয়েছিল। তারপর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী ক্যাম্পাস থেকে ভয়ে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিল। ২০০৮ সালের আগস্টে ঢাকা ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রবল ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের ভূমিকা আদৌ লক্ষ্য করা যায়নি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিপীড়ন সহ্য করেছে। অনেক শিক্ষক ও ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পর ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে ফিরে আসা আরও বিলম্বিত হয়েছে। এখন চলছে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব। তারা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মীর সঙ্গে গত কয়েকদিনে আলোচনা করেছি তাদের প্রতি একটি প্রশ্ন ছিল_ এখন ডাকসু নির্বাচন হলে কোন সংগঠন জয়ী হবে। উত্তরে প্রায় সবাই নিশ্চুপ ছিলেন। কেবল দু'একজন বলেছেন, 'ভালো প্রার্থী দিলে আমরা জয়ী হবো।' ভালো প্রার্থীর সংজ্ঞা কী? তাদের কাছে আরও প্রশ্ন ছিল_ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে হলে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৯ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হয় ১৮ বছরে। তারপর ৫ বছরে মাস্টার্স কোর্স শেষ হওয়ার কথা। বয়স তখন ২৩। সন্ত্রাসসহ নানা কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটির জন্য যদি তাদের শিক্ষাজীবন দুই বছরের জন্যও বিলম্বিত হয় তাহলেও ২৫ বছরের পর কারও ঢাকা বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সুযোগ নেই। একটু বেশি বয়সে যারা ভর্তি হয় তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আসবে তাদের কারোরই কিন্তু ঢাকা কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সুযোগ নেই। ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে বয়সসীমা বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য যারা দারুণ তৎপর, তারা কি এ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর আচরণে আদৌ সন্তুষ্ট নন এবং তা প্রকাশ্যেই বলেছেন। কিন্তু তারপরও ছাত্রলীগে 'তার কথাই শেষ কথা'। সর্বোচ্চ বয়সসীমা তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটা যেন কোনোভাবেই রক্ষা করা না হয় সে জন্য তদবির-লবি-হুমকি কোনো কিছুরই কমতি নেই। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সন্তান স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। বয়সের মানদণ্ডে তারা ছাত্রলীগের চেয়ে এগিয়ে। নির্বাচনের সময়ে কিংবা রাজপথের আন্দোলনে ছাত্রদলের বেশি বয়সীরা যখন পেশিশক্তির দাপট দেখাবে, তখন ছাত্রলীগের 'কচিকাঁচারা' তাদের সঙ্গে পারবে কীভাবে? মোক্ষম যুক্তি বটে! বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড় নয়_ বেঁচে থাক মাস্তানতন্ত্র হয়ে চিরজীবী!
সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছেন। এখন ছাত্রলীগের মতো সংগঠনের অনেক নেতাও রয়েছেন আন্দোলনে_ ছাত্রছাত্রীদের কোনো সমস্যা নিয়ে নয় বরং নিজেদের অতি সংকীর্ণ স্বার্থে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের কিছু ছবি এখনও সংবাদপত্রের পাতায় এবং টিভি পর্দায় দেখানো হয়। তাদের কচি মুখগুলোর প্রতি কি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও জানেন, তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হয়েছিলেন নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে। এই নিয়মিত শিক্ষার্থীরা রাজপথ কাঁপিয়েছেন। প্রবল প্রতাপশালী সামরিক ও স্বৈরশাসকদের উচ্ছেদ করেছেন। ঊনসত্তরের আন্দোলনের নেতা তোফায়েল আহমেদের সে সময় বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। ১৯৭২ সালে ডাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম_ বয়স তখন ২২। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কারণে একটি বছর শিক্ষাজীবন বিঘি্নত না হলে ২১ বছর বয়সেই তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। একাত্তরে এমন হাজার হাজার ছাত্র এবং শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তরুণরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল যাদের বয়স ছিল ১৫-২০ বছরের মধ্যে। জীবনে এর চেয়ে স্মরণীয় সময় ক'জনেরই-বা আসে। এমন সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন এবং ঝুঁকি গ্রহণের সময়ও কিন্তু তারা বড় ভাইদের তুলনায় একটুও পিছিয়ে থাকেনি। তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজে কেন আদুভাইদের হাতে ছাত্র নেতৃত্ব তুলে দেওয়া?
ছাত্রলীগের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেই শিক্ষাঙ্গনের কোনো ইস্যু নিয়ে আলোচনা নেই। তাদের ব্যস্ততা কমিটিতে থাকা নিয়ে। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ সাড়ে পাঁচ বছর। এ সময় কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভা প্রকৃতপক্ষে হয়নি। শীর্ষ নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তাদের ২৯ বছরের খাড়া পড়লে ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেছিলেন, আপনি চাইলে আমাদের সংগঠনের সভাপতি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একশ' প্রাইভেটকার ও জিপ হাজির করতে পারেন। ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতাও নিশ্চয়ই পারেন। ক্যাম্পাসে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের মোকাবেলার কাজেও তাদের দক্ষতা রয়েছে বলে মেনে নিচ্ছি। প্রতিপক্ষ সক্রিয় না থাকলেও সমস্যা নেই_ ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই হতেই পারে এবং তাতে পেশিশক্তি প্রদর্শনে কোনো বাধা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে_ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কেন এটা চলতে দেবেন? তারা কেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে তৎপর হবেন না? মাত্র আড়াই বছর আগের চিত্র তাদের নিশ্চয়ই স্মরণে রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রক্তচক্ষুর কারণে ছাত্রলীগের অনেক 'রাজপথের অকুতোভয় সৈনিক' ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যেতে সাহস করেনি। তাদের ভয় ছিল গ্রেফতারের। ফার্স্টটাইম ভোটাররাই নির্বাচনে আওয়ামী লীগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, তরুণ প্রজন্ম যে একাত্তরকে এমনভাবে স্মরণে রেখেছে, সেটা তারা বুঝতে পারেননি। হাওয়া ভবনকেও এ প্রজন্ম মেনে নেয়নি। সঙ্গত কারণেই ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের দাপট-দৌরাত্ম্যও তাদের দারুণ অপছন্দ। তাহলে এই তরুণ প্রজন্মের দ্বারস্থ কেন হবে না আওয়ামী লীগ? প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নিয়ে দেখুন_ অনেক বেশি সাড়া পাবেন। এখন সভা-সমাবেশে 'আদুভাই নেতারা' জবরদস্তি করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসে। প্রকৃত ছাত্রদের মধ্যে সংগঠন ছড়িয়ে পড়লে তারাই প্রয়োজনে রাজপথে আসবে। অতীতের যেসব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছে, সন্ত্রাসী কিংবা পুলিশ-মিলিটারি তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখনও পারবে না। দেশের কাজে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যম ও সৃজনক্ষমতা কাজে লাগাতে হলে এর বিকল্প নেই।
শুধু ছাত্র সংগঠন নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য সরকার এমন আইন করুক যাতে নিয়মিত ছাত্রছাত্রীরাই কেবল প্রার্থী হতে পারবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের দাপট অনেক কমে যাবে বলেই আমার ধারণা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও এ ধরনের ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হোক। তাতে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণের বিকাশ ঘটতে পারবে।
এর বিপরীতে এখন যেভাবে চলছে সেটা চলতে থাকলে ছাত্রদলের নেতাদের ডাকা ধর্মঘটে তাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া সন্তানরা পড়বে সেশনজটে, আর ছাত্রলীগের আদুভাই নেতাদের দাপটে শেখ হাসিনার চমকের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং দিনবদলের সনদের স্লোগান নিয়ে চলবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। বাষট্টি বছরের আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগ কি তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃজনশীল ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না?
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments