হুমকির কাছে আপস নয় by সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আবাসন ব্যবসায়ীদের হুমকিমূলক আচরণ অগ্রহণযোগ্য হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। বছরের পর বছর আইনকানুন অমান্য করে সরকারি কর্মকর্তাদের হাত করে তাঁরা অনেক ছাড় নিয়েছেন। সেই ধারা বজায় রাখতেই এখন তাঁরা মরিয়া।


এ জন্য তাঁরা তাঁদের সমর্থিত গণমাধ্যমকেও ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছেন না। বিস্ময় লাগে, সরকারি দলের একজন আইনপ্রণেতা, যিনি আবার রিহ্যাবেরও সদস্য, তিনি তাঁর সরকারের মন্ত্রীর সামনে কীভাবে এ রকম আচরণ সমর্থন করে যান? একজন মন্ত্রীকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা না করতে পারেন, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠানকে, তাঁর মন্ত্রণালয়কে তো প্রকাশ্যে অমান্য করা বা হেয় করা যায় না। অর্থ ও পেশিশক্তির জোরে এমন আচরণ অবশ্যই নিন্দনীয়।
আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে চলে এই আচরণ তারই ইঙ্গিত দেয়। সরকার ও প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করার এই দুঃসাহস এক দিনে হয়নি। আজকে অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মন্ত্রীকে শাসালে তার বিরুদ্ধে সরকার চরম ব্যবস্থা নিত এবং নিয়ে থাকে। তাই ব্যবসায়ীদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নেয় আমরা তা দেখার অপেক্ষায়। সরকার যেখানে নিজে অপমানিত ও মৌখিকভাবে আক্রান্ত, সেখানে আমরা দেখতে আগ্রহী যে সরকার আইনের পক্ষে। এই ঘটনাটা তাই সরকারের জন্য এসিড টেস্ট। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে পিছু হটলে চলবে না। বরং এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে স্রোতকে সঠিক খাতে বইয়ে দিতে হবে, যাতে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়। পেশিশক্তি ও অর্থশক্তির চাপ উপেক্ষা করে প্রস্তাবিত ড্যাপ পাস করানোর মাধ্যমেই সরকার প্রমাণ করবে যে তারা পারে।
ঢাকা নগর ও এর বসবাসের পরিবেশ রক্ষায় আবাসনশিল্পকে সংযত ও দায়িত্বশীল হতেই হবে—কথায় ও কাজে। একজন মন্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করে যদি তাঁরা পার পেয়ে যান, তাহলে যে কৃষকের জমি দখল করে হাউজিং ব্যবসায়ীরা প্লট বানান, তিনি কী করবেন? তাঁদের দাপটের সুবিচার সাধারণ মানুষ কোথায় পাবেন? জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে রিহ্যাব এবং বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর উচিত নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়া। এ রকম আচরণ ছাড় পেলে সরকারি ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় উবে যাবে। ব্যবসায়ীদের ধমক খেয়ে সরকার যদি ড্যাপ পাস করতে না পারলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্বের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আর সফল হলে যা খুশি তা করার মাধ্যমে তৈরি হওয়া জঞ্জাল সরানোয় সরকার বড় অবদান রাখতে পারবে, যা জনগণ অবশ্যই মনে রাখবে।
রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ নিয়ে রিহ্যাব নেতাদের উচ্চবাচ্য করার কোনো কারণ ছিল না। এটা তো হঠাৎ করা কোনো পরিকল্পনা নয়। ঢাকার মাস্টারপ্ল্যানের তিনটি অংশ: স্ট্রাকচার প্ল্যান, আরবান এরিয়া প্ল্যান এবং সর্বশেষটি ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান। নগরের কাঠামোটা কী হবে, তার ধরন, যাতায়াত, আবাসন, স্বাস্থ্যসুবিধা ইত্যাদি কী ধরনের হবে তা ঠিক করে স্ট্রাকচার প্ল্যান। এর আলোকেই প্রণীত হয় আরবান এরিয়া প্ল্যান, যেখানে থাকে কোনটা আবাসিক এলাকা, কোনটা বাণিজ্যিক এলাকা এবং এসব এলাকার প্রাথমিক বিবরণ। এরই ভিত্তিতে প্রণীত হয় ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান, যা বিভিন্ন এলাকার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। ফলে ড্যাপ বিদ্যমান পরিকল্পনারই বিস্তারিতকরণ।
যখন ড্যাপ প্রণীত হয় তখন রিহ্যাব এর পক্ষে ছিল। সে সময়ের রিহ্যাবের সভাপতি সরাসরি এই পরিকল্পনা তৈরিতে জড়িত ছিলেন এবং সুকৌশলে মাস্টারপ্ল্যানের বিধান এড়িয়ে নগরের বিস্তীর্ণ জলাভূমি আবাসনে আনার প্রস্তাব রাখেন। রাজউকের অনুমতি না নিয়ে জলাশয় ভরাট করা অনেক বেআইনীআবাসন প্রকল্পকে বৈধ দেখানোর প্রয়াসও করেন। পরিবেশবাদী, নগর পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরোধিতা হয়। খসড়া ড্যাপের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসব সুরাহার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সভাপতি করে রিভিউ কমিটি গঠন করে। সংগত কারণেই আবাসন কোম্পানিদের কেউ সে কমিটিতে ছিলেন না। কেননা, তাঁরা তো মূল পরিকল্পনা প্রণয়নে জড়িত এবং রাজউকের সঙ্গে মতবিনিময়ে খসড়া ড্যাপকে সমর্থনও করেন। রিভিউ কমিটি মূল মাস্টারপ্ল্যান সমুন্নত রাখতে পরামর্শকদের কিছু নীতিগত প্রস্তাব দেয়। রিভিউ কমিটি কারও বেআইনি ও মাস্টারপ্ল্যান পরিপন্থী কাজ বৈধতা দিতে পারে না। তা পারে সরকার। রিভিউ কমিটি যে যুক্তিতে রাজউকের ঝিলমিল-২ প্রকল্প আইনবিরোধী বলেছে, ঠিক একই যুক্তিতে বেসরকারি কিছু আবাসন প্রকল্পকেও আইনবিরোধী বলা হয়েছে। কোনো সরকারি প্রকল্প আইনবিরুদ্ধভাবে হলে তারও প্রতিকার করতে হবে। সরকারি প্রকল্পে সরকারের অনুমোদন থাকায় তা আইনসিদ্ধ দেখানোর সুযোগ থাকে। ৫০টি বেসরকারি প্রকল্পের মাত্র দুটির অনুমোদন রয়েছে, তা আইনসিদ্ধ করা হবে কীভাবে?
ঢাকা শহরের অস্তিত্ব ও বিকাশের চেয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ যেন প্রাধান্য না পায়, সেটিই ছিল মন্ত্রী মহোদয়ের আবেদন। কিন্তু কিছু কিছু পেশাজীবী যে ধর্মের কথা শোনে না, রিহ্যাব ও বিএলডিএর সদস্যদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তা-ই প্রমাণ করে। ভাবতে অবাক লাগে, কাদের কাছে আমরা জিম্মি। ড্যাপ এভাবে পাস হলে অনেক প্রকল্প অবৈধ হবে—এর দায় সরকার কেন নেবে? গণতান্ত্রিক সরকার অবৈধ কাজকে কেন বৈধতা দেবে? প্রতারণা করে অননুমোদিত প্রকল্পে প্লট বিক্রির দায় আবাসন প্রকল্পের মালিকদেরই নিতে হবে। এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সঠিক জবাব হবে শিগগিরই ড্যাপ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা, আইন অমান্যকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা এবং জনস্বার্থে জলাশয়গুলো রক্ষা করা।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি, ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির সদস্য।

No comments

Powered by Blogger.