নিজামী-কাদের মোল্লার বিচার শুরু
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিচার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল সোমবার নিজামীর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন।
১ জুলাই থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।
একই দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার বিচারও শুরু হয়। গতকাল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে ২০ জুন।
নিজামীর বিচার শুরুর মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন চারটি মামলারই বিচার শুরু হলো। এর আগে এ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। আর ট্রাইব্যুনাল-২-এ শুরু হলো প্রথম মামলার বিচার।
ট্রাইব্যুনাল-১: সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমেই নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না—এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও এ কে এম জহির আহমেদ। নিজামীকে আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিয়ে বসানো হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান লিখিত আদেশ পড়া শুরু করেন।
আদেশের শুরুতেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভ্যুদয় এবং ওই সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। আসামির পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে নিজামী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ফাজিল ও ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। একাত্তরে তিনি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর প্রভৃতি গঠনে তিনি তৎকালীন জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযমকে সহায়তা করেছিলেন।
আদেশে বলা হয়, ২০১০ সালের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ গঠনের পক্ষে ও আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে। আদেশের এ পর্যায়ে দুই পক্ষের যুক্তি ও এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়। অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ পড়ে শোনান। এসব অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর কাছে জানতে চান, তিনি দোষী, না নির্দোষ। এ সময় সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে নিজামী বলেন, ‘আমি পরিষ্কার বলতে চাই, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মেধা রাজনীতির বাইরে অন্য কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিল না। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে আমি কথা বলেছি। ফলাফল অনুযায়ী, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়া তাকে ব্যবহার করেছে। অথবা তারা দুজন একজোট হয়ে কাজ করেছে। যে কারণে গণহত্যার অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
নিজামী দাবি করেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বরের পর তিনি আর ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন না। ১৬ নম্বর অভিযোগে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সে সময় তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যও ছিলেন না। সে সময় ছাত্রসংঘের যেসব খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার একটিতেও তাঁকে আলবদর কমান্ডার বলা হয়নি।
নিজামী বলেন, ‘আমি আল্লাহ ও বিবেকের কাছে পরিষ্কার। অভিযোগে যেসব ঘটনা বলা হয়েছে, এর একটিও আমার সামনে, আমার সম্মতিতে ঘটেনি। আমি অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বৃহত্তর পাবনার কোনো এলাকায় যাইনি। যেসব কাহিনি বানানো হয়েছে, তা ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার।’ তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে সাংসদ ও পরে মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সবার নজরে আসেন। ১৯৯২ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাঁকে সংসদে, সুপ্রিম কোর্টে, রাজপথে লড়াই করতে হয়েছে।
বক্তব্যের শেষ অংশে নিজামী আবার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার নায়ক ছিলেন ভুট্টো। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এলে তাঁকে নজিরবিহীন সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে থামতে বলেন। নিজামীর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, নিজামী নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
তবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক আদেশের পরে সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ নিজামীর বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ এনেছিলেন, ট্রাইব্যুনাল আরেকটি যোগ করেছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে আসামিপক্ষ কোনো যুক্তি দেয়নি, রাষ্ট্রপক্ষও কোনো যুক্তি দেয়নি। এই অভিযোগটি আনা সঠিক হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসামিপক্ষ আদেশ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবে।
ট্রাইব্যুনাল-২: কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়ও গতকাল অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে এ ট্রাইব্যুনাল গতকাল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও মো. শাহিনুর ইসলাম।
কার্যক্রমের শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি দেরি করে আসায় ট্রাইব্যুনাল অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলীর কাছে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, তিনি নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পরে কেন ট্রাইব্যুনালে এলেন। দেরিতে আসায় কৌঁসুলি দুঃখ প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল বলেন, দুঃখ প্রকাশ সব সময় যথেষ্ট নয়। না পারলে ছেড়ে দেন।
পরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লিখিত আদেশ পড়ে শোনান। আদেশের প্রথম দিকে এ ট্রাইব্যুনালের গঠন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রভৃতি তুলে ধরেন। আসামির পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৮ সালে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে কাদের মোল্লা জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্রসংঘে যোগ দেন। একাত্তরে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। আদেশের পরবর্তী অংশে অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি তুলে ধরেন।
আদেশের এ পর্যায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ পড়ে শোনান। অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার কাছে জানতে চান, তিনি নিজেকে দোষী, না নির্দোষ মনে করেন। জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, ‘এগুলো বলার জন্য আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।’ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আপনি এক কথায় জবাব দেন।’ কাদের মোল্লা বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ঢাকায় ছিলাম না। ১২ বা ১৩ মার্চ আমি ঢাকা ছেড়ে ফরিদপুর বাড়িতে গিয়েছি। জুলাই মাসে মাত্র দুই দিনের জন্য পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছি। পরীক্ষা শেষে আবার চলে গিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে করা এ মামলা ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটি প্রথমে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন ছিল। ওই ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল এ মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হলে নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। ২ থেকে ১৬ মে সাত কার্যদিবসে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি চলে। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলেন।
একই দিনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার বিচারও শুরু হয়। গতকাল তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে ২০ জুন।
নিজামীর বিচার শুরুর মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন চারটি মামলারই বিচার শুরু হলো। এর আগে এ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। আর ট্রাইব্যুনাল-২-এ শুরু হলো প্রথম মামলার বিচার।
ট্রাইব্যুনাল-১: সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমেই নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে কি না—এ বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক ও এ কে এম জহির আহমেদ। নিজামীকে আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় নিয়ে বসানো হয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান লিখিত আদেশ পড়া শুরু করেন।
আদেশের শুরুতেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভ্যুদয় এবং ওই সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়। আসামির পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে নিজামী জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে ফাজিল ও ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। একাত্তরে তিনি জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর প্রভৃতি গঠনে তিনি তৎকালীন জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযমকে সহায়তা করেছিলেন।
আদেশে বলা হয়, ২০১০ সালের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিজামীকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ গঠনের পক্ষে ও আসামিপক্ষ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে। আদেশের এ পর্যায়ে দুই পক্ষের যুক্তি ও এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়। অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করেন ট্রাইব্যুনাল।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ পড়ে শোনান। এসব অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল নিজামীর কাছে জানতে চান, তিনি দোষী, না নির্দোষ। এ সময় সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে নিজামী বলেন, ‘আমি পরিষ্কার বলতে চাই, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মেধা রাজনীতির বাইরে অন্য কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিল না। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে আমি কথা বলেছি। ফলাফল অনুযায়ী, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়া তাকে ব্যবহার করেছে। অথবা তারা দুজন একজোট হয়ে কাজ করেছে। যে কারণে গণহত্যার অভিযোগ করা হচ্ছে, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’
নিজামী দাবি করেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বরের পর তিনি আর ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন না। ১৬ নম্বর অভিযোগে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, সে সময় তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যও ছিলেন না। সে সময় ছাত্রসংঘের যেসব খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার একটিতেও তাঁকে আলবদর কমান্ডার বলা হয়নি।
নিজামী বলেন, ‘আমি আল্লাহ ও বিবেকের কাছে পরিষ্কার। অভিযোগে যেসব ঘটনা বলা হয়েছে, এর একটিও আমার সামনে, আমার সম্মতিতে ঘটেনি। আমি অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি বৃহত্তর পাবনার কোনো এলাকায় যাইনি। যেসব কাহিনি বানানো হয়েছে, তা ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার।’ তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে সাংসদ ও পরে মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি সবার নজরে আসেন। ১৯৯২ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাঁকে সংসদে, সুপ্রিম কোর্টে, রাজপথে লড়াই করতে হয়েছে।
বক্তব্যের শেষ অংশে নিজামী আবার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার নায়ক ছিলেন ভুট্টো। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এলে তাঁকে নজিরবিহীন সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে থামতে বলেন। নিজামীর আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে বলেন, নিজামী নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
তবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজামীর সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে আবদুর রাজ্জাক আদেশের পরে সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ নিজামীর বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ এনেছিলেন, ট্রাইব্যুনাল আরেকটি যোগ করেছেন। এই অভিযোগের বিষয়ে আসামিপক্ষ কোনো যুক্তি দেয়নি, রাষ্ট্রপক্ষও কোনো যুক্তি দেয়নি। এই অভিযোগটি আনা সঠিক হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসামিপক্ষ আদেশ পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবে।
ট্রাইব্যুনাল-২: কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়ও গতকাল অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে এ ট্রাইব্যুনাল গতকাল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ গঠন করে আদেশ দেন। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও মো. শাহিনুর ইসলাম।
কার্যক্রমের শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি দেরি করে আসায় ট্রাইব্যুনাল অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলীর কাছে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, তিনি নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পরে কেন ট্রাইব্যুনালে এলেন। দেরিতে আসায় কৌঁসুলি দুঃখ প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল বলেন, দুঃখ প্রকাশ সব সময় যথেষ্ট নয়। না পারলে ছেড়ে দেন।
পরে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান প্রায় এক ঘণ্টা ধরে লিখিত আদেশ পড়ে শোনান। আদেশের প্রথম দিকে এ ট্রাইব্যুনালের গঠন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রভৃতি তুলে ধরেন। আসামির পরিচিতিতে বলা হয়, ১৯৪৮ সালে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে কাদের মোল্লা জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্রসংঘে যোগ দেন। একাত্তরে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যদের দিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলেন। আদেশের পরবর্তী অংশে অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি তুলে ধরেন।
আদেশের এ পর্যায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি অভিযোগ পড়ে শোনান। অভিযোগ পড়ে শোনানো শেষে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার কাছে জানতে চান, তিনি নিজেকে দোষী, না নির্দোষ মনে করেন। জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, ‘এগুলো বলার জন্য আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।’ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আপনি এক কথায় জবাব দেন।’ কাদের মোল্লা বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ঢাকায় ছিলাম না। ১২ বা ১৩ মার্চ আমি ঢাকা ছেড়ে ফরিদপুর বাড়িতে গিয়েছি। জুলাই মাসে মাত্র দুই দিনের জন্য পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছি। পরীক্ষা শেষে আবার চলে গিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে করা এ মামলা ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাটি প্রথমে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন ছিল। ওই ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল এ মামলা ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হলে নতুন করে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। ২ থেকে ১৬ মে সাত কার্যদিবসে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি চলে। এরপর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করলেন।
No comments