সমকালীন প্রসঙ্গ-সিরিয়ায় ন্যাটো সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত এগিয়ে চলেছে by বদরুদ্দীন উমর

সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল নেই। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার গুরুত্ব অনেক। ইসরায়েল সিরিয়ার ঘোরতর শত্রু। কাজেই সিরিয়ার বর্তমান সরকার উচ্ছেদ ইসরায়েলের হাত শক্ত করার জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, লেবাননের সঙ্গে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
সিরিয়ার বর্তমান সরকার ফেলে দিতে পারলে এরপর তারা সহজেই লেবাননের ওপর সামরিকভাবে চড়াও হতে পারে। তা ছাড়া ইরান তো অবশ্যই আছে। সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার সরকার উৎখাত হলে ইরান খুব ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হবে। এসব দিক দিয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজনীয়

ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের এবং সৌদি আরব ও কাতারের যৌথ উদ্যোগে গঠিত সরকারবিরোধী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মধ্য সিরিয়ার হুলা শহরে ২৫ মে ৯০ জন নিহত হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশই হলো শিশু। এ চক্রান্তমূলক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার দায়দায়িত্ব বাশার আল আসাদের সরকারের ওপর চাপিয়ে তাদের দ্বারা গঠিত তথাকথিত সিরিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতারা এখন জাতিসংঘের সামরিক হামলার মাধ্যমে সিরিয়ার সরকার উচ্ছেদের আওয়াজ তুলেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে সিএনএন, বিবিসি এবং কাতারের আল জাজিরা টেলিভিশন এবং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত পত্রপত্রিকা সিরিয়া সরকারের ক্রাইম হিসেবে অভিহিত করে প্রচার চালাচ্ছে। তারা অনেক লাশের ছবি টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা লিবিয়ায় একই কায়দায় যে কাজ করেছিল সিরিয়ায়ও তাই করছে। ইয়েমেনি সরকারের গুলিতে নিহত লোকদের ছবি টেলিভিশনে দেখিয়ে সেটা গাদ্দাফির সেনাবাহিনীর কাজ বলে তারা প্রচার করেছিল। এ ধরনের ধাপ্পাবাজি করতে তারা অভ্যস্ত এবং এর যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও তাদের আছে। শুক্রবারের হত্যাকাণ্ড সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কাজ বলে তারা প্রচার করলেও সিরিয়া সরকার এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা সরকারবিরোধীদের কাজ। (উধরষু ঝঃধৎ ২৮.৫.২০১২) নিজেরা এ কাজ করে সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং এর ছুতো করে তারা জাতিসংঘকে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এটা করেছে।
সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বসে নেই। তারা অবশ্যই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী আক্রমণ করছে। তাতে বেসামরিক নিরীহ লোকজনও মারা যাচ্ছে; কিন্তু এটা অবশ্যই লক্ষ্য করতে হবে যে, সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে এ কাজে একভাবে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণ সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট ও তাদের দ্বারা প্ররোচিত সশস্ত্র বাহিনী সরকারি বাহিনী, বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এবং সরকার সমর্থক জনগণের ওপরও সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করছে। এর ফলে বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বহু লোকও হতাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো সরকারই যে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য।
লিবিয়াতেও ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এভাবেই বেনগাজিতে এক সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিল তাদের অর্থ, অস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহায়তার অর্থ ছিল মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে এক ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারণা চালানো। সে কাজে তারা পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল, কারণ বিশ্বজোড়া বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত প্রচারমাধ্যমই তাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সেই ভাড়াটে বিদ্রোহী বাহিনীকে দিয়ে গাদ্দাফিকে পরাস্ত করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। এটা উপলব্ধি করেই তারা লিবিয়ায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ঘড় ভষু তড়হব দাবি করে নিরাপত্তা পরিষদে। প্রস্তাবের সীমা সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে তারা লিবিয়ায় ন্যাটো বাহিনীকে দিয়ে বোমাবর্ষণ করিয়েছিল। এর মাধ্যমে তারা গাদ্দাফির বিশাল বাহিনী তো ধ্বংস করেছিলই, তার ওপর তাদের স্থলবাহিনীকে প্রায় নির্মূল করেছিল।
কিন্তু তাদের এ আক্রমণের সব থেকে অপরাধমূলক দিক ছিল হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর বোমাবর্ষণ করে তাদের হত্যা করা। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ তারা করেছিল তার বহুগুণ হত্যা ন্যাটোর বিমান আক্রমণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদীরা করেছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রচারমাধ্যমের শক্তি এত বেশি যে তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফিকে হত্যা এবং লিবিয়ায় তার শাসন উচ্ছেদ করে, লিবিয়াকে এমন আইনের পদানত করে, তাদের তেলসম্পদ ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন করছে।
এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বলা দরকার যে, লিবিয়ার এই অবস্থা হতো না যদি রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদে নো ফ্লাই জোনের বিরুদ্ধে ভেটো দিত। কিন্তু সেটা না দিয়ে তারা ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছিল। এভাবে হাত মেলানোর ফলে শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই পায়নি। তাদের হাতে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র তামাক খেয়েছে। কোন বুদ্ধি ও বিবেচনার বশবর্তী হয়ে তারা এ কাজ করেছিল তা বোঝা মুশকিল। কোন অভিজ্ঞতার কথাই বা তারা চিন্তা করেছিল, সেটাও জানা নেই। কিন্তু লিবিয়ায় তাদের এ অভিজ্ঞতার পর তারা এখন সাবধান হয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক লিবিয়ার মতো সিরিয়ায় নো ফ্লাই জোন চালু করার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে। তাদের এই ভেটো ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। কাজেই এখন সরাসরি সিরিয়া আক্রমণ করতে না পেরে তারা তাদের দ্বারা সংগঠিত সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে নিযুক্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কিছু সাফল্য এসেছে, কিন্তু এ কাজ করে সিরিয়া সরকারকে যেভাবে তারা ফেলে দেওয়ার চিন্তা করেছিল সেটা হয়নি।
সিরিয়ায় লিবিয়ার মতো তেল নেই। কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার গুরুত্ব অনেক। ইসরায়েল সিরিয়ার ঘোরতর শত্রু। কাজেই সিরিয়ার বর্তমান সরকার উচ্ছেদ ইসরায়েলের হাত শক্ত করার জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, লেবাননের সঙ্গে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সিরিয়ার বর্তমান সরকার ফেলে দিতে পারলে এরপর তারা সহজেই লেবাননের ওপর সামরিকভাবে চড়াও হতে পারে। তা ছাড়া ইরান তো অবশ্যই আছে। সিরিয়ার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার সরকার উৎখাত হলে ইরান খুব ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল হবে। এসব দিক দিয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজনীয়।
আরব লীগ নামে যে সংগঠনটি আছে এটি সব সময়ই ইঙ্গ-মার্কিন-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগত হিসেবেই কাজ করেছে এবং এখনও করছে। এটাই একটা বড় কারণ, যে জন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। শুধু তাই নয়, সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রটি ইসরায়েলবিরোধী অনেক কথাবার্তা বললেও যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেই চলে। এসব দিক বিবেচনা করলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে বেশ কঠিনই বলতে হবে। এ পরিস্থিতিতে ন্যাটোভুক্ত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ও তাদের পদানত আরব লীগ এখন সিরিয়ায় গণহত্যার কথা বলে ব্যাপকভাবে এসব প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক লোক, নারী-শিশু-বৃদ্ধ হত্যা করলেও তার বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া কোনো বড় আকারের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা দেখা যায় না। এর কারণ বর্তমান বিশ্বে জনমত খুব চাতুর্যের সঙ্গে প্রচারমাধ্যমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এই প্রচারমাধ্যম হলো সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের মক্কেল দেশগুলোর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
২৮.৫.২০১২

No comments

Powered by Blogger.