নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট সাড়ে ১৪ টাকা

শিল্প প্রতিষ্ঠানের আগ্রহীদের জন্য প্রতি ইউনিটের মূল্য গড়ে সাড়ে ১৪ টাকা ধরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। লোডশেডিংবিহীন এই বিদ্যুতের দাম সাধারণ সরবরাহের দামের আড়াই গুণের বেশি।


তিনটি ভোল্টেজ লেভেলে এই সেবা আগামী ১ জুন থেকে কার্যকর হবে। তবে যাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন এই বিদ্যুতের ব্যবস্থা, সেই ব্যবসায়ী-শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বেশি দাম দিয়ে এই বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নন বলে জানা গেছে।

গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই শ্রেণীর বিদ্যুতের দাম ঘোষণা করেন কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন। তিনি বলেন, তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ অনেক বেশি। এই তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ যদি আগ্রহী গ্রাহকদের সরবরাহ করা যায় তাহলে পিডিবির রাজস্ব বাড়বে।
যাঁরা পুরনো গ্রাহক, তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অঙ্গীকার না করে ব্যবসায়ীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ওয়াদা কেন করছেন- এ প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ ইউসুফ হোসেন বলেন, 'কোথাও অঙ্গীকার করা হয়নি পুরনো গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে হবে।'
বর্তমানে ১১ কেভি, ৩৩ কেভি ও ১৩২ কেভি লাইনের জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহক গড়ে সাড়ে পাঁচ টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনছেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে গ্রাহকদের ১১ কেভি লাইনের জন্য প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) ১৪ টাকা ৯৯ পয়সা ও ৩৩ কেভি লাইনের জন্য ১৪ টাকা ৪৫ পয়সা দিতে হবে। এ ছাড়া ১১ কেভি লাইনের জন্য প্রতি মাসে ৪০০ টাকা সার্ভিস চার্জ এবং ৪৫ টাকা ডিমান্ড চার্জ, ৩৩ কেভি লাইনের জন্য ৪৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ এবং ৪০ টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হবে।
আর গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট চাহিদার জন্য বিতরণকারী সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন তাহলে তিনটি ভোল্টেজ লেভেলেই এসব চার্জের পাশাপাশি মাসে ৮০ টাকা করে ন্যূনতম চার্জ দিতে হবে। অন্যদিকে ১৩২ কেভি লাইনের জন্য ইউনিটপ্রতি ১৩ টাকা ৮৮ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা সার্ভিস চার্জ এবং ৪০ টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হবে।
এই বিদ্যুতের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) শিল্পাঞ্চলে আলাদা লাইনের সংযোগ দেবে। শিল্পাঞ্চলের বাইরে কেউ সংযোগ নিতে চাইলে তাঁকে আলাদা লাইন করার খরচ দিতে হবে। একটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি মোট আটটি ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
বিইআরসি জানিয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে হলে আগের সংযোগ ছেড়ে দিতে হবে। একই গ্রাহক দুই ধরনের সংযোগ একসঙ্গে নিতে পারবেন না।
সব ধরনের গ্রাহকের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের এই সেবা চালুর প্রস্তাব দেওয়া হলেও আপাতত শ্রমঘন এবং রপ্তানিমুখী শিল্প গ্রাহকদের জন্য এ সেবা চালু হচ্ছে। এ ব্যাপারে কমিশন চেয়ারম্যান ইউসুফ হোসেন বলেন, 'পরবর্তী সময়ে আবাসিক গ্রাহকদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।'
গত ১৫ এপ্রিল পিডিবি বিভিন্ন 'ভোল্টেজ লেভেলে' নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি নতুন মূল্যহার (ট্যারিফ কাঠামো) প্রস্তাব করে। ওই প্রস্তাবের ওপর গত ২ মে গণশুনানি হয়। পিডিবির প্রস্তাবে এই মূল্যহারকে উল্লেখ করা হয়েছে 'কিউ' শ্রেণীর ট্যারিফ কাঠামো হিসেবে। 'কিউ' শ্রেণী বলতে বোঝানো হয়েছে 'কোয়ালিটি পাওয়ার' অর্থাৎ মানসম্মত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। বর্তমানে খুচরা বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণে 'এ' থেকে 'জে' পর্যন্ত ১০টি শ্রেণী রয়েছে।

পিডিবি ওই প্রস্তাব পাঠানোর আগে গত ১০ এপ্রিল বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বেশি দামে শিল্প ও বাসাবাড়িতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পিডিবির প্রস্তাবে বলা হয়, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তেলভিত্তিক আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন করা হবে। এই ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা দেশের বিতরণ সংস্থা/কম্পানি সংশ্লিষ্ট এলাকায় সরবরাহ করবে।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পিডিবির বিতরণ অঞ্চল ২৭৫ মেগাওয়াট, ডিপিডিসি ১৫০ মেগাওয়াট, ডেসকো ১০ মেগাওয়াট, আরইবি ৫০ মেগাওয়াট, ওজোপাডিকো ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বরাদ্দ পাবে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন এসব তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ ও সদস্য মো. ইমাদুল হক।
ব্যবসায়ীরা আগ্রহী নন
কিউ শ্রেণীর বিদ্যুতের এ দাম সম্পর্কে আগেই ধারণা পেয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) প্রেসিডেন্ট সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, 'আমরা বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনব না। ব্যবসায়ীরা নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করবে। এর জন্য সরকারকে কম সুদে ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি শুল্ক ফ্রি জেনারেটর আমদানির সুযোগ দিতে হবে।' তিনি আরো বলেন, 'বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফার জন্য আমরা বেশি দামে কেন বিদ্যুৎ কিনব? আমাদের সুযোগ দিলে আমরা পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকার মধ্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব।'
ব্যবসায়ীদের মত, এত বেশি দামে বিদ্যুৎ দিয়ে উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। এ কারণে তাঁরা কিউ শ্রেণীর বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী নন। ব্যবসায়ীরা নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করতে চান। সে ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটরের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা চান।
এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ এঙ্পোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সালাম মুর্শেদী বলেন, 'যদি বিদ্যুতের দাম বাড়ে তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে কোনোভাবেই আমরা টিকে থাকতে পারব না। আমাদের শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন, তার জন্য আমরা বাড়তি দাম দিতে প্রস্তুত কিন্তু তার তো একটা সীমা থাকবে। যেখানে বিদেশি মালিকানাধীন ইপিজেড এলাকায় বিদ্যুৎ কম দামে দেওয়া হয়, সেখানে আমরা এত বেশি দামের বিদ্যুৎ কেন কিনব?'

No comments

Powered by Blogger.