চারদিক-মাগুরছড়ার আগুনকথা by আকমল হোসেন
প্রায় মধ্যরাত। নিঝুম পাহাড়। ঘুমরাজ্যে মানুষ। হঠাৎ পুরো বন-পাহাড় কাঁপিয়ে বিস্ফোরণের শব্দ। লাল আলোতে ভরে গেল রাতের আকাশ। মুহূর্তেই পাল্টে গেল একটি আরণ্যক বিন্যাস। দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে ঘন বন। আগুনের শিখা দাও দাও করে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠেছে।
আগুনের লেলিহান ক্ষুধাতুর জিবের কাছে, তাপদাহের কাছে নিমেষেই কাবু হয়ে যায় নিরিবিলি শান্ত বনটি।
সেদিন ছিল ১৪ জুন, ১৯৯৭ সাল। বহুজাতিক আমেরিকান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ খনন করছিল। মাত্র এক বছর আগে ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এক হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বর্ষারণ্যে দেশি-বিদেশি ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকদের শিক্ষা ও গবেষণাসহ ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তখন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে উদ্ভিদ ও প্রাণী বিষয়ে যে জরিপ ও গবেষণা হয়েছে, তাতে শনাক্ত করা এমন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা হচ্ছে— উদ্ভিদ ২৬০ প্রজাতি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ২০ প্রজাতি, পাখি ২৪২ প্রজাতি এবং সরীসৃপ ১০ প্রজাতি। তখনো বলা হয়েছে লাউয়াছড়ায় অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে, যা শনাক্ত করা যায়নি। এ বিষয়ে আরও জরিপ ও গবেষণা দরকার।
সেই লাউয়াছড়ায় কোথায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর জরিপ, গবেষণা বা শিক্ষা হবে; সেখানে শুরু হলো যন্ত্রদানবের দাপুটে চলাফেরা। যানের শব্দে পাখি কাঁপে, চমকে ওঠে বনের পশু। এই কাঁপা আর চমকে ওঠা ছিল ছুটে চলা যানবাহন এবং খনন কাজে ব্যবহূত যন্ত্রের হুঙ্কার। বনের নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশটি এতেই বিপন্ন হয়েছিল। তবু এই শব্দ-হুল্লোড়ের ভেতর পাখিরা সেই রাতে তাদের বাসাতেই ছিল। নিশাচর প্রাণীরা খাদ্যের অন্বেষণে বেরিয়েছিল চেনাজানা পথে। অনেক প্রাণী ঘুমিয়ে ছিল দিনের ক্লান্তি নিয়ে। কিন্তু সেই শান্তির আশ্রয়টকু মাঝরাতে তছনছ হয়ে যায়।
মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খনন চলাকালে সাড়ে আট শ ফুট গভীরে যাওয়ার পর হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। কূপের গ্যাসে আগুন ধরে যায়। অক্সিডেন্টালের সব আয়োজন তুচ্ছ করে আগুন প্রচণ্ড শব্দে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। প্রায় পাঁচ শ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠে আগুন। কূপের পাশেই মাগুরছড়া পানপুঞ্জি, ফুলবাড়ি চা-বাগান। সেখানকার ঘুমন্ত মানুষগুলো আকস্মিক ঘুমভাঙা চোখে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। দুই-তিন কিলোমিটার দূরের গ্রামগুলোতে ছিটকে পড়ে কূপের পাথরকণা। গাছে গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডাকতে থাকে। উড়তে থাকে। অনেক পাখি গাছের বাসায় আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাঁদর, উল্লুক, বন্য শূকরসহ অনেক পশুপাখি আতঙ্কিত হয়ে দিশা হারিয়ে যে-যেদিকে পারে ছুটতে গিয়ে মারা পড়ে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জাতীয় উদ্যানের বুক। যেখানে নির্বিঘ্নে বাড়ার কথা উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, বন্য প্রাণী চরে বেড়াবে তাদের মনের মতো করে; সেই বনটি হারিয়ে ফেলে তার আপন স্বভাব।
আগুনের প্রচণ্ড তাপে যে শুধু গাছ বা ঘাস পুড়েছে তা-ই না, ঢাকা-সিলেট রেল লাইনের লোহার পাত সাপের শরীরের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। পুড়ে গেছে বিদ্যুৎ লাইন। শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কপথ। রাতের বেলা বন হয়ে গিয়েছিল অনেকটা দিনের মতো। মাগুরছড়া গ্যাসকূপের কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না, আগুনের তাপ ছিল এতটাই ত্বকতাতানো। শত কিলোমিটার দূর থেকেও গ্যাসকূপের আগুন দেখা গেছে। সেই সময় ছুটে এসেছিলেন দেশি-বিদেশি নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরা। প্রশ্ন উঠেছিল, এমন একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গ্যাসকূপ খননের যৌক্তিকতা নিয়ে (এখনো চলছে সেই একই রকম জরিপ ও খননের উদ্যোগ)। এই গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে শুধু যে গ্যাস আর তেল পুড়ল তা তো না। ক্ষতি হলো পরিবেশের।
আমরা জানলাম গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান সেগুনগাছ, বাঁশ; অন্য প্রজাতির বৃক্ষ-বৃক্ষলতাদি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, তক্ষক, মায়ামৃগ, বন্য শূকর, উল্লুক, ছোট-বড় দুর্লভ প্রজাতির অনেক পাখির বাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃক্ষ, জীবজন্তু, মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গ আগুনে পুড়ে মারা গেছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পশুপাখি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক শোষণব্যবস্থা, প্রাকৃতিক উৎপাদন, পশুপাখির বসতি, ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ, ভূগর্ভের পানির স্তরের অধোগমন, প্রাণীবৈচিত্র্য, ভূমির অণুজীব এবং মৃত্তিকার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনর্বাসন ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে ৬০০ কোটি টাকা লাগবে। অক্সিডেন্টালের কাছে এই পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করা হয়।
কিন্তুু আজও পরিবেশের ক্ষতিপূরণ মেলেনি। যে পাখি, যে কীটপতঙ্গ হারিয়ে গেছে, ভূমির যে অণুজীব নষ্ট হয়েছে, যে দুর্লভ অচেনা উদ্ভিদটি হারিয়ে গেছে; তার খোঁজ হয়তো আর কখনোই পাওয়া যাবে না। এখন হয়তো ঘাসে মোড়ানো, হ্রদে শাপলা ফোটা মাগুরছড়া কূপের স্থানটি দেখে সেই ভয়াবহ রাত বা সময়ের কথা ভাবাই যাবে না। কত সহজেই কত কিছু আমরা ভুলে যাই। আর এ তো পরিবেশ—খালি চোখে যার ক্ষতির দিকটি চোখে পড়ে না। অনেক অনেক বছর পর তার মাশুল দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছে দেশ, দিচ্ছে বিশ্ব।
সেদিন ছিল ১৪ জুন, ১৯৯৭ সাল। বহুজাতিক আমেরিকান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ খনন করছিল। মাত্র এক বছর আগে ১৯৯৬ সালের ৭ জুলাই লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক) ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এক হাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বর্ষারণ্যে দেশি-বিদেশি ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকদের শিক্ষা ও গবেষণাসহ ইকো-ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তখন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে উদ্ভিদ ও প্রাণী বিষয়ে যে জরিপ ও গবেষণা হয়েছে, তাতে শনাক্ত করা এমন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা হচ্ছে— উদ্ভিদ ২৬০ প্রজাতি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ২০ প্রজাতি, পাখি ২৪২ প্রজাতি এবং সরীসৃপ ১০ প্রজাতি। তখনো বলা হয়েছে লাউয়াছড়ায় অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে, যা শনাক্ত করা যায়নি। এ বিষয়ে আরও জরিপ ও গবেষণা দরকার।
সেই লাউয়াছড়ায় কোথায় উদ্ভিদ ও প্রাণীর জরিপ, গবেষণা বা শিক্ষা হবে; সেখানে শুরু হলো যন্ত্রদানবের দাপুটে চলাফেরা। যানের শব্দে পাখি কাঁপে, চমকে ওঠে বনের পশু। এই কাঁপা আর চমকে ওঠা ছিল ছুটে চলা যানবাহন এবং খনন কাজে ব্যবহূত যন্ত্রের হুঙ্কার। বনের নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশটি এতেই বিপন্ন হয়েছিল। তবু এই শব্দ-হুল্লোড়ের ভেতর পাখিরা সেই রাতে তাদের বাসাতেই ছিল। নিশাচর প্রাণীরা খাদ্যের অন্বেষণে বেরিয়েছিল চেনাজানা পথে। অনেক প্রাণী ঘুমিয়ে ছিল দিনের ক্লান্তি নিয়ে। কিন্তু সেই শান্তির আশ্রয়টকু মাঝরাতে তছনছ হয়ে যায়।
মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খনন চলাকালে সাড়ে আট শ ফুট গভীরে যাওয়ার পর হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। কূপের গ্যাসে আগুন ধরে যায়। অক্সিডেন্টালের সব আয়োজন তুচ্ছ করে আগুন প্রচণ্ড শব্দে আকাশের দিকে উঠতে থাকে। প্রায় পাঁচ শ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠে আগুন। কূপের পাশেই মাগুরছড়া পানপুঞ্জি, ফুলবাড়ি চা-বাগান। সেখানকার ঘুমন্ত মানুষগুলো আকস্মিক ঘুমভাঙা চোখে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে। দুই-তিন কিলোমিটার দূরের গ্রামগুলোতে ছিটকে পড়ে কূপের পাথরকণা। গাছে গাছে ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডাকতে থাকে। উড়তে থাকে। অনেক পাখি গাছের বাসায় আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। বাঁদর, উল্লুক, বন্য শূকরসহ অনেক পশুপাখি আতঙ্কিত হয়ে দিশা হারিয়ে যে-যেদিকে পারে ছুটতে গিয়ে মারা পড়ে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জাতীয় উদ্যানের বুক। যেখানে নির্বিঘ্নে বাড়ার কথা উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, বন্য প্রাণী চরে বেড়াবে তাদের মনের মতো করে; সেই বনটি হারিয়ে ফেলে তার আপন স্বভাব।
আগুনের প্রচণ্ড তাপে যে শুধু গাছ বা ঘাস পুড়েছে তা-ই না, ঢাকা-সিলেট রেল লাইনের লোহার পাত সাপের শরীরের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। পুড়ে গেছে বিদ্যুৎ লাইন। শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কপথ। রাতের বেলা বন হয়ে গিয়েছিল অনেকটা দিনের মতো। মাগুরছড়া গ্যাসকূপের কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না, আগুনের তাপ ছিল এতটাই ত্বকতাতানো। শত কিলোমিটার দূর থেকেও গ্যাসকূপের আগুন দেখা গেছে। সেই সময় ছুটে এসেছিলেন দেশি-বিদেশি নানা স্তরের কর্তাব্যক্তিরা। প্রশ্ন উঠেছিল, এমন একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গ্যাসকূপ খননের যৌক্তিকতা নিয়ে (এখনো চলছে সেই একই রকম জরিপ ও খননের উদ্যোগ)। এই গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে শুধু যে গ্যাস আর তেল পুড়ল তা তো না। ক্ষতি হলো পরিবেশের।
আমরা জানলাম গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান সেগুনগাছ, বাঁশ; অন্য প্রজাতির বৃক্ষ-বৃক্ষলতাদি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, তক্ষক, মায়ামৃগ, বন্য শূকর, উল্লুক, ছোট-বড় দুর্লভ প্রজাতির অনেক পাখির বাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃক্ষ, জীবজন্তু, মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গ আগুনে পুড়ে মারা গেছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পশুপাখি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক শোষণব্যবস্থা, প্রাকৃতিক উৎপাদন, পশুপাখির বসতি, ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ, ভূগর্ভের পানির স্তরের অধোগমন, প্রাণীবৈচিত্র্য, ভূমির অণুজীব এবং মৃত্তিকার যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনর্বাসন ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে ৬০০ কোটি টাকা লাগবে। অক্সিডেন্টালের কাছে এই পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করা হয়।
কিন্তুু আজও পরিবেশের ক্ষতিপূরণ মেলেনি। যে পাখি, যে কীটপতঙ্গ হারিয়ে গেছে, ভূমির যে অণুজীব নষ্ট হয়েছে, যে দুর্লভ অচেনা উদ্ভিদটি হারিয়ে গেছে; তার খোঁজ হয়তো আর কখনোই পাওয়া যাবে না। এখন হয়তো ঘাসে মোড়ানো, হ্রদে শাপলা ফোটা মাগুরছড়া কূপের স্থানটি দেখে সেই ভয়াবহ রাত বা সময়ের কথা ভাবাই যাবে না। কত সহজেই কত কিছু আমরা ভুলে যাই। আর এ তো পরিবেশ—খালি চোখে যার ক্ষতির দিকটি চোখে পড়ে না। অনেক অনেক বছর পর তার মাশুল দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দিচ্ছে দেশ, দিচ্ছে বিশ্ব।
No comments