‘তারা’ কি আরেক ‘সরকার’? by ইকবাল হাবিব
গত রোববার আমরা আমন্ত্রিত হিসেবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে হাজির হয়েছিলাম। রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে বলেই আমাদের ধারণা ছিল। আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের তালিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দুটি সংস্থা বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) ও রিহ্যাবের যথাক্রমে মহাসচিব ও সভাপতির নাম দেখে আমরা আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করি।
কারণ, কিছুদিন ধরেই সংগঠন দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ড্যাপ বিষয়ে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করছিল।
আমরা পর্যালোচনা কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশগুলোকে তার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নির্দিষ্ট সময়ে সচিবালয়ের সভাকক্ষে প্রবেশ করে হতবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বিএলডিএ ও রিহ্যাবের পক্ষ থেকে এক ডজনেরও বেশি মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার শুরুতেই বিএলডিএ সভাপতি ড্যাপবিষয়ক কোনো উপস্থাপনার আগেই তাঁদের বক্তব্য শোনার প্রস্তাব দেন। মন্ত্রী সেটি অনুমোদন করায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলম পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাঁর লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর প্রতিমন্ত্রী যখন তাঁদের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য পর্যালোচনা কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের আহ্বান করতে যাচ্ছিলেন, তখনই আগের কোনো সভায় মন্ত্রীর কোনো বক্তব্যের উল্লেখ করে এক অশালীন ও অসৌজন্যমূলক আচরণ শুরু হয়। শাহ আলমের পাশাপাশি বিএলডিএর মহাসচিব ও রিহ্যাবের সভাপতিও এতে সামিল হন। বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি, রিহ্যাবের সভাপতি, যিনি একজন সাংসদও বটে, কখনো সাংসদের এখতিয়ারে কখনো বা রিহ্যাবের ব্যবসায়ীদের প্রধান হিসেবে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছিলেন। তাঁর এই দ্বৈতচারিতার পাশাপাশি তাঁদের আস্তিনগোটানো অঙ্গভঙ্গি পর্যালোচনা কমিটির প্রধানসহ আমাদের নির্বাক শ্রোতায় পরিণত করে। পুরো কার্যক্রমে তাঁদের সঙ্গে আসা সাথিদের হাস্যরস সভাকে অভাবিত ঘটনায় পরিণত করে। এ পর্যায়ে মন্ত্রীর প্রতিবাদের পাশাপাশি আমরা তাঁদের দাবির বিপরীতে কিছু যৌক্তিক দিক উপস্থাপনের চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁদের চিৎকারের সেগুলো চাপা পড়ে যায়। একপর্যায়ে উপদেষ্টা কর্তৃক একটি উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হলে তাঁরা এ ধরনের উপস্থাপনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে চিৎকার করতে থাকেন। তাঁদেরকে কাগজপত্র, দলিলপত্র না দিয়ে এই ড্যাপ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে হুঙ্কার দেওয়া হয়। রিহ্যাব সভাপতি সাংসদ হিসেবে এটি বাস্তবায়ন না করতে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন।
গত কিছুদিন শোকের যে কালো মেঘ মহানগরকে ঢেকে রেখেছিল, তার কোনো ছাপ বা প্রভাব এই ব্যবসায়ী মহলকে এতটুকু নাড়া দিতে পারেনি। অবাক হয়েছি যখন তাঁরা ‘সারা বাংলাদেশের ৮০ ভাগ এলাকা জলাশয় বানানোর জন্য সরকারি প্রয়াস নেওয়া হয়েছে’ বলে এই মুহূর্তে বর্তমান সরকারপ্রধানের নীল ও সবুজ দেশ গড়ার অঙ্গীকারকে ভ্রুকুটি করছিলেন। ঢাকার চারপাশের নদী ও প্লাবন অঞ্চল মুক্ত করার ব্যাপারে সরকার ও আদালতের নির্দেশকে তির্যকবাণে বিদ্ধ করছিলেন, তখন ভাবছিলাম এঁরা কি সরকারের মধ্যে আরেক সরকার? এঁরা কি এতই ক্ষমতাধর যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিমন্ত্রীর যুক্তি খণ্ডনের প্রয়াসকে তাঁরা দুঃসাহস হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন? প্রতিমন্ত্রীর দায়বদ্ধ আচরণ করার আহ্বান জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে এই গোষ্ঠীর ‘অর্থনৈতিক অবদানের বিপরীতে মন্ত্রী তুচ্ছ’ এই কথা বলতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। তাঁদের আস্ফাালনের একপর্যায়ে এও মনে হচ্ছিল, তাঁরা হয়তো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী। জিডিপিতে তাঁদের বড়সড় অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অজুহাতে তাঁরা মন্ত্রণালয়ের গত দেড় বছরের সব কার্যক্রম শূন্য বলে ঘোষণা দেন। এই পর্যায়ে আমরা ঢাকা শহরের চারপাশের নদী ও প্লাবন অঞ্চল রক্ষায় বর্তমান সরকারপ্রধানের দৃঢ়তা মনে করিয়ে দিলে সরকারেরই একজন সাংসদ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা তা হেসে উড়িয়ে দেন।
মূলত ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সংসদে পাস হওয়া স্ট্রাকচার প্ল্যানের অনুসৃত নীতিতে নির্দেশিত শুধু বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে রক্ষা করার দৃঢ়প্রত্যয় এই পর্যালোচনা কমিটি নিয়েছিল। এর বাইরে অননুমোদিতভাবে এবং ১৯৯৭ সালের স্ট্রাকচার প্ল্যানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভূমিরূপে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলা ২৪ বর্গমাইলের ভেতর ২০.৮৭ বর্গমাইল ওভারলে হিসেবে ছাড় দিয়ে প্রস্তাব করার পাশাপাশি মাত্র ২.৫৭ বর্গমাইল বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবে অবমুক্ত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত দেয় পর্যালোচনা কমিটি। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অংশের মধ্যেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকারীদের প্রকল্প পড়ে যাওয়ার কারণেই তাঁরা সেদিন ছিলেন দুর্বিনীত। স্মরণ রাখা দরকার, এই বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলের অবমুক্তি ঢাকা মহানগরের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে দখলদারির পক্ষে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ জনগণের মন্ত্রী তথা জনগণের প্রতি করা হয়েছে, সেই গ্লানি মোচনের ব্যবস্থা কি জনগণকেই নিতে হবে? নাকি জনগণের নির্বাচিত সরকার দৃঢ় হাতে সরকারের মধ্যে আরেক সরকার হওয়ার এই অশুভ প্রয়াসকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার ব্যবস্থা নেবে—এই প্রশ্ন সবার।
ইকবালহাবিব: স্থপতি। ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির সদস্য।
আমরা পর্যালোচনা কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশগুলোকে তার প্রেক্ষাপট অনুযায়ী যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। নির্দিষ্ট সময়ে সচিবালয়ের সভাকক্ষে প্রবেশ করে হতবাক হয়ে লক্ষ করলাম, বিএলডিএ ও রিহ্যাবের পক্ষ থেকে এক ডজনেরও বেশি মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার শুরুতেই বিএলডিএ সভাপতি ড্যাপবিষয়ক কোনো উপস্থাপনার আগেই তাঁদের বক্তব্য শোনার প্রস্তাব দেন। মন্ত্রী সেটি অনুমোদন করায় বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলম পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাঁর লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর প্রতিমন্ত্রী যখন তাঁদের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য পর্যালোচনা কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের আহ্বান করতে যাচ্ছিলেন, তখনই আগের কোনো সভায় মন্ত্রীর কোনো বক্তব্যের উল্লেখ করে এক অশালীন ও অসৌজন্যমূলক আচরণ শুরু হয়। শাহ আলমের পাশাপাশি বিএলডিএর মহাসচিব ও রিহ্যাবের সভাপতিও এতে সামিল হন। বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করেছি, রিহ্যাবের সভাপতি, যিনি একজন সাংসদও বটে, কখনো সাংসদের এখতিয়ারে কখনো বা রিহ্যাবের ব্যবসায়ীদের প্রধান হিসেবে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছিলেন। তাঁর এই দ্বৈতচারিতার পাশাপাশি তাঁদের আস্তিনগোটানো অঙ্গভঙ্গি পর্যালোচনা কমিটির প্রধানসহ আমাদের নির্বাক শ্রোতায় পরিণত করে। পুরো কার্যক্রমে তাঁদের সঙ্গে আসা সাথিদের হাস্যরস সভাকে অভাবিত ঘটনায় পরিণত করে। এ পর্যায়ে মন্ত্রীর প্রতিবাদের পাশাপাশি আমরা তাঁদের দাবির বিপরীতে কিছু যৌক্তিক দিক উপস্থাপনের চেষ্টা করি। কিন্তু তাঁদের চিৎকারের সেগুলো চাপা পড়ে যায়। একপর্যায়ে উপদেষ্টা কর্তৃক একটি উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হলে তাঁরা এ ধরনের উপস্থাপনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে চিৎকার করতে থাকেন। তাঁদেরকে কাগজপত্র, দলিলপত্র না দিয়ে এই ড্যাপ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে হুঙ্কার দেওয়া হয়। রিহ্যাব সভাপতি সাংসদ হিসেবে এটি বাস্তবায়ন না করতে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করেন।
গত কিছুদিন শোকের যে কালো মেঘ মহানগরকে ঢেকে রেখেছিল, তার কোনো ছাপ বা প্রভাব এই ব্যবসায়ী মহলকে এতটুকু নাড়া দিতে পারেনি। অবাক হয়েছি যখন তাঁরা ‘সারা বাংলাদেশের ৮০ ভাগ এলাকা জলাশয় বানানোর জন্য সরকারি প্রয়াস নেওয়া হয়েছে’ বলে এই মুহূর্তে বর্তমান সরকারপ্রধানের নীল ও সবুজ দেশ গড়ার অঙ্গীকারকে ভ্রুকুটি করছিলেন। ঢাকার চারপাশের নদী ও প্লাবন অঞ্চল মুক্ত করার ব্যাপারে সরকার ও আদালতের নির্দেশকে তির্যকবাণে বিদ্ধ করছিলেন, তখন ভাবছিলাম এঁরা কি সরকারের মধ্যে আরেক সরকার? এঁরা কি এতই ক্ষমতাধর যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিমন্ত্রীর যুক্তি খণ্ডনের প্রয়াসকে তাঁরা দুঃসাহস হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন? প্রতিমন্ত্রীর দায়বদ্ধ আচরণ করার আহ্বান জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে এই গোষ্ঠীর ‘অর্থনৈতিক অবদানের বিপরীতে মন্ত্রী তুচ্ছ’ এই কথা বলতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। তাঁদের আস্ফাালনের একপর্যায়ে এও মনে হচ্ছিল, তাঁরা হয়তো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সবার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণকারী। জিডিপিতে তাঁদের বড়সড় অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির অজুহাতে তাঁরা মন্ত্রণালয়ের গত দেড় বছরের সব কার্যক্রম শূন্য বলে ঘোষণা দেন। এই পর্যায়ে আমরা ঢাকা শহরের চারপাশের নদী ও প্লাবন অঞ্চল রক্ষায় বর্তমান সরকারপ্রধানের দৃঢ়তা মনে করিয়ে দিলে সরকারেরই একজন সাংসদ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা তা হেসে উড়িয়ে দেন।
মূলত ১৯৯৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে সংসদে পাস হওয়া স্ট্রাকচার প্ল্যানের অনুসৃত নীতিতে নির্দেশিত শুধু বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে রক্ষা করার দৃঢ়প্রত্যয় এই পর্যালোচনা কমিটি নিয়েছিল। এর বাইরে অননুমোদিতভাবে এবং ১৯৯৭ সালের স্ট্রাকচার প্ল্যানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভূমিরূপে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলা ২৪ বর্গমাইলের ভেতর ২০.৮৭ বর্গমাইল ওভারলে হিসেবে ছাড় দিয়ে প্রস্তাব করার পাশাপাশি মাত্র ২.৫৭ বর্গমাইল বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবে অবমুক্ত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত দেয় পর্যালোচনা কমিটি। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অংশের মধ্যেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকারীদের প্রকল্প পড়ে যাওয়ার কারণেই তাঁরা সেদিন ছিলেন দুর্বিনীত। স্মরণ রাখা দরকার, এই বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলের অবমুক্তি ঢাকা মহানগরের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে দখলদারির পক্ষে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ জনগণের মন্ত্রী তথা জনগণের প্রতি করা হয়েছে, সেই গ্লানি মোচনের ব্যবস্থা কি জনগণকেই নিতে হবে? নাকি জনগণের নির্বাচিত সরকার দৃঢ় হাতে সরকারের মধ্যে আরেক সরকার হওয়ার এই অশুভ প্রয়াসকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার ব্যবস্থা নেবে—এই প্রশ্ন সবার।
ইকবালহাবিব: স্থপতি। ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির সদস্য।
No comments