২০০৯-এর সাত-পাঁচঃ শেষপর্ব by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
‘বোঝ রে ব্যাটা বোঝ—
আমার কথা ফাঁস করা নয় অতটা সহজ।
আমার হাতে হামলা আছে
হামলা করার কামলা আছে
গামলা ভরা মামলা আছে
মামলা রুজুর আমলা আছে—
সামলা দেখি কত দিকে সামাল দিবি রোজ
তবু যদি না থামিস তো থাকবে না তোর খোঁজ—’
ঘটনাটা ঘটেছিল গত বছরের শেষের দিকে। ঘটনায় ‘প্রশান্তি’ লাভ করা যার পক্ষে সম্ভব, তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘পরিচয়বিহীন বেনামি অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে’ পত্রিকায় ‘শোরগোল’ তোলা। কিন্তু ‘আমার দেশ’-এর রিপোর্টটি তো কোনো পত্রের ভিত্তিতে নয়। গত ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও জ্বালানি উপদেষ্টা-সংক্রান্ত রিপোর্টটি ছিল পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে উেকাচ গ্রহণ-সংক্রান্ত তদন্তের ফাইল চালাচালির ওপর ভিত্তি করে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় কি বেনামি? ‘প্রশান্তি’ লাভকারীর চোখে—‘জনগণ তা আমলে নেয়নি’ কথাটি যদি সত্যি হয়, তাহলে প্রতিবেদকের ওপর হামলা হলো কেন? পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ করা হলো কেন? এজেন্ট ও হকারদের দোকানে ভাংচুর এবং আগুন দেয়া হলো কেন? বিশ্ব রেকর্ড গড়ার মতো ৭০ হাজার কোটি টাকার মানহানির ক্ষতিপূরণ দাবি করা হলো কেন? সরকারের মন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা হুমকি-ধমকি শুরু করলেন কেন? ঘটনার সূত্রে, একটি বিদেশি কোম্পানিকে বিনা টেন্ডারে অপ্রয়োজনীয় কম্প্রেসার বসানোর কাজ পাইয়ে দেয়াটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। এমন কিছু ঘটলে তার পেছনে সন্দেহজনক আরও কিছু বিষয় তো থাকেই। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকেই অবশ্য দেশজুড়ে রেকর্ডসংখ্যক হামলা-মামলার ঘটনা ঘটেছে সাংবাদিকদের ওপর। ২০০৮-এর শেষ দিনে যশোরের গ্রামের কাগজের স্টাফ রিপোর্টারকে কোপানোর মধ্য দিয়ে বর্ষ বিদায় করে ২০০৯-কে স্বাগত জানানোর পর থেকে যশোর, ময়মনসিংহ, পাবনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, চট্টগ্রাম, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, বগুড়া, নওগাঁ, নড়াইল, খুলনা, খাগড়াছড়ি, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মাগুরা, রংপুর, গাইবান্ধা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুরসহ সারাদেশে সাংবাদিকদের ওপর বেপরোয়া হামলা-মামলার ‘প্রশান্তিকর’ মহোত্সব চলেছে।
২০০৯-এর সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার হলো—‘বর্তমান সরকারের হাতে কোনো প্রচার মাধ্যম নেই।’ এ তথ্যটির আবিষ্কারক কোনো ‘যদু-মধু’, কোনো হরিজন নয়। ‘মিথ’ ও মিথ্যা নির্মাণ পারদর্শী প্রবাসী এক অতিমানব তিনি। হামিদুল হক চৌধুরী কর্তৃক চালিত ‘পূর্বদেশ’ পরে ‘জনপদ’ পত্রিকা কর্তৃক শীলিত, ভারতীয় ‘আনন্দবাজার’ কর্তৃক লালিত এই মহাত্মা প্রবাসে কার অর্থায়নে পালিত তা নিয়ে অবশ্য নানা কথা চলিত আছে। তবে তা নিয়ে তিনি বিচলিত নন। তিনি ‘গাঁয়ের মাঝ দিয়েই হাঁটেন সুবিধামত সময় এলে। তো সেই তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন, এ দেশের সব প্রচার মাধ্যম বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এ কথা শোনার পর সরকারি বেতার ও টিভি কর্মকর্তারা আত্মহত্যার কথা ভাবছেন কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। আর গোটাকয়েক ছাড়া বাকি যে ডজন কয়েক পত্রিকা দিন-রাত সরকারের গুণগান লিখতে লিখতে হাতে কড়া ফেলে দিল, সেগুলোর সম্পাদক-প্রতিবেদক ও উপসম্পাদকীয় রচনাকারী মহাজনেরা কতবার হাত কামড়েছেন সে দৃশ্য এবং সেই মুখগুলোর ‘বদল’-এর অবস্থাও কল্পনা করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, এমন তথ্য আবিষ্কারের উদ্দেশ্য আবিষ্কার করে সরকার কেন—ওই মহাত্মাকে কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল চালু করতে অর্থায়ন করছে না? সরকার তা না করলে যে ২০০৯-এর সেরা ‘আবিষ্কার’টি ২০০৯-এর সেরা ‘কৌতুক’ হয়ে রয়ে যাবে। তা মানুষ হাসাতে পারাও একটা বড় কাজ বৈকি! গোপাল ভাঁড় কি ওই মহাত্মার চেয়ে বিখ্যাত নন?
২০০৯ জুড়ে আর যেসব প্রসঙ্গ নিয়ে দেশের মানুষ উচ্চকিত ছিলেন তার মধ্যে একটি হলো, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলন এবং এ কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের ওপর হামলা ও লাঠিপেটা করে তার পা ভেঙে দেয়া। জাতীয় স্বার্থে আন্দোলনরত এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একদিকে যেমন ভারতীয় হাইকমিশনার ব্যঙ্গ করেছেন ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে; তেমনি তাদের প্রতি সরকারি বিরোধিতাও প্রমাণিত হয়েছে পুলিশি অ্যাকশানে। ‘টিপাইমুখ বাঁধ’ ছিল আরেকটি জ্বলন্ত প্রসঙ্গ। পদ্মা-তিস্তার করুণ অবস্থা ও মরুকরণসহ এসব নদীর শাখা নদীগুলোর মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা থেকে, সুরমা-কুশিয়ারার ওপর হামলার উদ্যোগে শঙ্কিত হয়ে পড়ে দেশের মানুষ। পক্ষান্তরে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ভারতের পক্ষাবলম্বনসহ টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশ কত উপকৃত হবে, তার আজগুবি কল্পকথা প্রচারিত হতে থাকে। যদিও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ১৬ জানুয়ারি ২০১০-এর সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বলেছেন, টিপাইমুখে যে কী হচ্ছে তা তিনি নিজেই জানেন না! তিনি যা জানেন না, তার প্রতিনিধিরা তা নিয়ে কথা বলেন; তবে কোন্ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে? আমরা আমাদের নদীগুলোর মৃত্যু দেখতে, আর বিগত বছরে অনেক কিছু বদলাতে দেখেছি। বদলে দেয়া হয়েছে ছেলেমেয়েদের পাঠ্যপুস্তকের অনেক তথ্য। এবার একটি কবিতাও বদলে দেয়া দরকার। ছাপা হওয়া দরকার—
‘আমাদের ছোট নদী চলে নাতো আর,
বৈশাখ দূরে থাক ভাদ্রেও তার
থাকে না তো হাঁটুজল তলানিতে ধরা
আঁকে-বাঁকে কাঁদে শুধু চরা আর জ্বরা।
উজানের ডাইনিটা খেয়ে ফেলে জল
সেই সুখে হাঁক ছাড়ে শিয়ালের দল।’
লেখক : গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments