স্মরণ- শহীদ আসাদ প্রেরণার উৎস by সুরঞ্জিত বৈদ্য
যে মৃত্যু আজও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে শিহরণ জাগায়, রাজপথে আন্দোলনে ধাবিত করে, মনের অজান্তেই বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে দেয়, অগ্নিগিরির মতো গর্জে ওঠে নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতার বক্ষ; সেটা প্রকৃতপক্ষে শুধু মৃত্যু নয়—একটি ইতিহাস, একটি সংগ্রাম। আর সেই সংগ্রামের নায়ক ছিলেন শহীদ আসাদ।
যিনি যৌবনের প্রথম পরতেই উপলব্ধি করেছিলেন তার প্রিয় স্বদেশভূমি অরক্ষিত। যার মাটি ও মানুষের ভাগ্য নিয়ে নিত্য ছিনিমিনি খেলছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী।
তাইতো নরসিংদীর হাতিরদিয়ার এক সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয়া আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস অনার্সসহ এমএ পাস করে পারিবারিক ও ব্যক্তি সুখের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদ ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে মনোনিবেশ করেন কৃষক সংগঠন গড়ার কাজে। ভাসানীর অনুসারী আসাদ মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা ও নরসিংদী অঞ্চলে কৃষক সমিতি গড়ে তোলেন। তার অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা মওলানা ভাসানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আসাদ যে কত বড় সাহসী ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা বাংলার হাটবাজারে হরতাল আহ্বান করেন। আসাদ সেদিন কয়েক শ কৃষককর্মী নিয়ে হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল সফল করার কাজে লেগে যান। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের একপর্যায়ে পুলিশ বিনা উস্কানিতে পিকেটারদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে সিদ্দিক মাস্টার, হাসান আলী ও মিয়াচাঁদ নামে তিনজন কর্মী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আসাদ নিজেও সেদিন পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হন। আহত অবস্থায় সাইকেলযোগে ঢাকায় আসার পথে তিনি ঘোড়াশালের কাছে রাতের আঁধারে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে একজন কৃষককর্মীর সহায়তায় ঢাকায় আসেন এবং সব পত্রিকা অফিসে গিয়ে হাতিরদিয়ার ঘটনার বিবরণ দেন। পরদিন সব পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে হাতির দিয়ার ঘটনা প্রকাশিত এবং আকাশবাণী থেকে হাতিরদিয়ার ঘটনা সম্প্রচার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বৈরাচারী আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তখনই চতুর্দিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তত দিনে আসাদ নিজেকে পরিণত করেছিলেন একজন পেশাদার বিপ্লবী হিসেবে। তাই গ্রামের ভাগ্যাহত কৃষকদের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন কৃষক সমিতি। আবার শহরে গেলে থাকতেন ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগে। যার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি উত্তাল সেই রক্তঝরা দিনটিতে।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি অনুযায়ী এক সভা আহ্বান করে। সভায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যোগদান করে। তারা সভাশেষে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে একটি মিছিল বের করে। মিছিলের এক অংশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা ধরে চানখারপুলের দিকে অগ্রসর হলে সেখানে অবস্থানরত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বেলা দুটোর দিকে মূল ঘটনাস্থলের অনতিদূরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্বদিকের গেটের পাশে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা ডিএসপি বাহাউদ্দিনের পিস্তলের গুলি আসাদের বক্ষ বিদীর্ণ করে। আসাদ থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি ঊর্ধ্বে তুলে সবার উদ্দেশে কি যেন বলতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হওয়ার আগেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চারদিক থেকে তার সহকর্মীরা এসে ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রী একে অন্যকে জড়িয়ে চিত্কার করতে থাকে এবং আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলে—‘আসাদের মন্ত্র জনগণ তন্ত্র, স্বৈরাচারী আইয়ুব খান নিপাত যাক, নিপাত যাক।’
বস্তুত আমরা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটি পেয়েছি, তার প্রেক্ষাপট রচয়িতা শহীদ আসাদ। আসাদের মৃত্যুই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। অথচ সেই আসাদকে ইতিহাসের পাতায় এখনও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। আজ আসাদের ৪১তম মৃত্যু দিবস। তার মৃত্যুর ৪১ বছর পর এসে মনে হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম এখনও সঠিকভাবে জানতে পারেনি—কে এই আসাদ? জানতে পারেনি আসাদ গেট, আসাদ এভিনিউ, আসাদ পার্ক কীভাবে হলো, কেন হলো? যারা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তাদের বিভিন্ন উপাধি দেয়া হয়েছে। পুনর্নির্মাণ করা হয়নি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে আসাদের স্মৃতি ভাস্কর্যটি। পাঠ্যপুস্তকেও তার সম্পর্কে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই। সরকারের উচিত শহীদ আসাদসহ সব শহীদকে সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও আন্তরিক সদিচ্ছা।
No comments