তিতাশ চৌধুরী: জন্মদিনের শুভেচ্ছা by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
সাহিত্যের অঙ্গনে তিতাশ চৌধুরীর পদচারণ বহু বছরের। দীর্ঘ অধ্যাপনা-জীবনের শেষে তাঁর এক পরিচয়, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। পেশাজীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন কুমিল্লা শহরে। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কুমিল্লার সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। কুমিল্লা জেলার ইতিহাস ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন ‘কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি, প্রেম ও পরিণয়’, ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস’, ‘কুমিল্লা জেলার লোকসাহিত্য’। তাঁর গবেষণা ও সাহিত্যকর্মে কুমিল্লার একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা রয়েছে। কুমিল্লাবাসী কুমিল্লার প্রতি তাঁর এই আগ্রহ, অনুরাগ ও আনুগত্যের সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁকে। সম্মাননা ও সংবর্ধনা দিয়ে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করেছে। তিনি অলক্ত নামের একটি মানসম্মত পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কুমিল্লা থেকেই। স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে। মফস্বল থেকে প্রকাশিত আর কোনো পত্রিকা—উচ্চমানের পত্রিকা—এত দীর্ঘকাল টিকে থাকার নজির বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই। একই কথা বলা যায় অলক্তর সঙ্গে জড়িত ও তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রবর্তিত ‘অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার’ সম্পর্কেও। ১৯৮১ থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, সেই তালিকা থেকে যে কেউ ধারণা করতে পারবেন। কোনো সংকীর্ণ বিবেচনা প্রশ্রয় পায়নি এই পুরস্কারের মানোন্নয়নে। পুরস্কারের অর্থমূল্য নয়, সোনার মেডেলে কতটা সোনা আছে, তাও বিবেচ্য নয়, একমাত্র বিচেনার বিষয়, কোন মানদণ্ডে নির্বাচন করা হয়েছে পুরস্কৃত জনকে। ব্যক্তি উদ্যোগে ও বেসরকারি পর্যায়ে এদিক দিয়ে অলক্ত পুরস্কারের সঙ্গে তুলনীয় একমাত্র ফরিদপুরের আলাওল পুরস্কার। আলাওল পুরস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে কি না জানি না, তবে শত অসুবিধার মধ্যেও যেভাবে তিতাশ চৌধুরী একদিকে অলক্ত পত্রিকা, একই সঙ্গে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার—দুটিকে পিতৃস্নেহে লালন করছেন, তার প্রশংসার ভাষা আমার জানা নেই।
তিতাশ চৌধুরীর পরিচয় যে জন্মসূত্রে বা কর্মসূত্রে নয়, তাঁর স্বভাবের মর্মকেন্দ্রে, সে তাঁর সাহিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, কালক্রমে কবিতা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন গদ্যে, প্রবন্ধে, গবেষণায়। গবেষণায় জায়গা করে নিয়েছে কুমিল্লা—তার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে, তার প্রিয় অতিথি নজরুলকে নিয়ে, তার গর্বের প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া কলেজকে নিয়ে। কুমিল্লার ইতিহাস হয়তো সম্পূর্ণতার দাবি করতে পারবে না, তবে কলেজের ইতিহাস রচনায় তিনি প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। এমন তথ্যবহুল ও একই সঙ্গে আকর্ষণীয় কোনো কলেজের ইতিহাস রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
একাডেমিক সমালোচনায় তিতাশ চৌধুরী কতটা আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ তাঁর একজন সাহিত্য-স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের বাইরের পরিচয়ে। এই ধারায় তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা অন্যরকম রবীন্দ্রনাথ। কবি পরিবারের বাইরে রবীন্দ্রনাথের যে নানামুখী পরিচয়, সেটি তিনি তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ জীবনে নানাভাবে চিত্রিত, নানারূপে, রঙে ও রেখায় বর্ণিত, বিচিত্র বর্ণে ও কর্মে স্পন্দিত এবং প্রত্যেক মানুষের জীবনের সর্বগ্রাসী মননপিপাসা নিবারণে নন্দিত। তবু যে রবীন্দ্রনাথকে আমি এখানে পাঠক দরবারে ভীরু পদক্ষেপে হাজির করেছি—সে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের বাইরে থেকেও “চিত্ররূপময়”—বিচিত্র বর্ণাঢ্য এক অপরূপ রবীন্দ্রনাথ। এ রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরচেনা রবীন্দ্রনাথ থেকে একটু ভিন্ন হলেও তাঁকে চিনে নিতে কারও ভুল হওয়ার কথা নয়। বস্তুত তিনি অন্য খ্যাতিতে ভাস্বর এক অন্য রকম রবীন্দ্রনাথ।’
তিতাশ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি, তবু মানুষ রবীন্দ্রনাথকে তিনি চিনেছেন ও চিনিয়েছেন। যাঁদের দেখেছেন, যাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁদের নিয়ে তাঁর বই দেখা অদেখার স্মৃতি। ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বইয়ের বিষয়; তবে তিতাশ চৌধুরীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তাঁরা যেভাবে ধরা দিয়েছেন, তাঁদের সেই খণ্ডিত পরিচয়ে। ১৪ জনের মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে দুজনকে বাদ দিলে (প্রবোধচন্দ্র সেন, আহমদ শরীফ) বাকি ১২ জনই হয় কবি বা গল্পকার। দেখা অদেখার স্মৃতির পাতায় আমরা তিতাশ চৌধুরীর যে পরিচয় পাই, তাঁর সংবেদনশীলতা, তাঁর গুণগ্রাহিতা, প্রতিভার প্রতি বিনম্র প্রণতি—তা এ বইয়ের আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
তিতাশ চৌধুরী আত্মজীবনী লেখেননি, তবে তাঁর অনেক রচনায় নিজেকেই তিনি কিছুটা পরোক্ষভাবে তুলে ধরেছেন। জীবনের যে অনেক কৌতুকপ্রদ দিক রয়েছে, সে বিষয়ে তিনি সজাগচক্ষু। তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথের কৌতুকপ্রিয়তা নিয়ে লেখেন, একইভাবে তাঁর নিজের পরিচ্ছন্ন কৌতুকপ্রিয়তার প্রকাশ ঘটান রঙ্গরসের গল্প লিখে। সংবাদপত্রের কলাম লেখার তাগিদে তাঁর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে ওঠে, তাঁর স্মৃতি শাণিত হয়ে ওঠে, তাঁর বিচারবুদ্ধি নানা প্রসঙ্গে ধাবিত হয়। হালকা ভঙ্গিতে লেখা হলেও তাঁর কলামভিত্তিক বই আপনভুবন তাঁকে সমকালের একজন বোদ্ধা দর্শক ও বিচারক পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবেই কুমিল্লার সঙ্গে নাড়ির বন্ধনে বাঁধা তিতাশ চৌধুরী হয়ে ওঠেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ।
একজন পরিশ্রমী ও নিবেদিত সাহিত্যকর্মী তিতাশ চৌধুরী কখনো আত্মপ্রচারের পথে চলেননি। তাঁর পরিচয় তবু পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যকর্মে। বিচিত্র এই সাহিত্যকর্ম। গতকাল ছিল তাঁর ৬৫তম জন্মদিন। তাঁকে তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এই সামান্য রচনা।
তিতাশ চৌধুরীর পরিচয় যে জন্মসূত্রে বা কর্মসূত্রে নয়, তাঁর স্বভাবের মর্মকেন্দ্রে, সে তাঁর সাহিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, কালক্রমে কবিতা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন গদ্যে, প্রবন্ধে, গবেষণায়। গবেষণায় জায়গা করে নিয়েছে কুমিল্লা—তার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে, তার প্রিয় অতিথি নজরুলকে নিয়ে, তার গর্বের প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরিয়া কলেজকে নিয়ে। কুমিল্লার ইতিহাস হয়তো সম্পূর্ণতার দাবি করতে পারবে না, তবে কলেজের ইতিহাস রচনায় তিনি প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। এমন তথ্যবহুল ও একই সঙ্গে আকর্ষণীয় কোনো কলেজের ইতিহাস রচিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
একাডেমিক সমালোচনায় তিতাশ চৌধুরী কতটা আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ তাঁর একজন সাহিত্য-স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মের বাইরের পরিচয়ে। এই ধারায় তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা অন্যরকম রবীন্দ্রনাথ। কবি পরিবারের বাইরে রবীন্দ্রনাথের যে নানামুখী পরিচয়, সেটি তিনি তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘রবীন্দ্রনাথ জীবনে নানাভাবে চিত্রিত, নানারূপে, রঙে ও রেখায় বর্ণিত, বিচিত্র বর্ণে ও কর্মে স্পন্দিত এবং প্রত্যেক মানুষের জীবনের সর্বগ্রাসী মননপিপাসা নিবারণে নন্দিত। তবু যে রবীন্দ্রনাথকে আমি এখানে পাঠক দরবারে ভীরু পদক্ষেপে হাজির করেছি—সে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের বাইরে থেকেও “চিত্ররূপময়”—বিচিত্র বর্ণাঢ্য এক অপরূপ রবীন্দ্রনাথ। এ রবীন্দ্রনাথ আমাদের চিরচেনা রবীন্দ্রনাথ থেকে একটু ভিন্ন হলেও তাঁকে চিনে নিতে কারও ভুল হওয়ার কথা নয়। বস্তুত তিনি অন্য খ্যাতিতে ভাস্বর এক অন্য রকম রবীন্দ্রনাথ।’
তিতাশ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি, তবু মানুষ রবীন্দ্রনাথকে তিনি চিনেছেন ও চিনিয়েছেন। যাঁদের দেখেছেন, যাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভ করেছেন, তাঁদের নিয়ে তাঁর বই দেখা অদেখার স্মৃতি। ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বইয়ের বিষয়; তবে তিতাশ চৌধুরীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তাঁরা যেভাবে ধরা দিয়েছেন, তাঁদের সেই খণ্ডিত পরিচয়ে। ১৪ জনের মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে দুজনকে বাদ দিলে (প্রবোধচন্দ্র সেন, আহমদ শরীফ) বাকি ১২ জনই হয় কবি বা গল্পকার। দেখা অদেখার স্মৃতির পাতায় আমরা তিতাশ চৌধুরীর যে পরিচয় পাই, তাঁর সংবেদনশীলতা, তাঁর গুণগ্রাহিতা, প্রতিভার প্রতি বিনম্র প্রণতি—তা এ বইয়ের আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
তিতাশ চৌধুরী আত্মজীবনী লেখেননি, তবে তাঁর অনেক রচনায় নিজেকেই তিনি কিছুটা পরোক্ষভাবে তুলে ধরেছেন। জীবনের যে অনেক কৌতুকপ্রদ দিক রয়েছে, সে বিষয়ে তিনি সজাগচক্ষু। তিনি যেমন রবীন্দ্রনাথের কৌতুকপ্রিয়তা নিয়ে লেখেন, একইভাবে তাঁর নিজের পরিচ্ছন্ন কৌতুকপ্রিয়তার প্রকাশ ঘটান রঙ্গরসের গল্প লিখে। সংবাদপত্রের কলাম লেখার তাগিদে তাঁর দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে ওঠে, তাঁর স্মৃতি শাণিত হয়ে ওঠে, তাঁর বিচারবুদ্ধি নানা প্রসঙ্গে ধাবিত হয়। হালকা ভঙ্গিতে লেখা হলেও তাঁর কলামভিত্তিক বই আপনভুবন তাঁকে সমকালের একজন বোদ্ধা দর্শক ও বিচারক পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে। এভাবেই কুমিল্লার সঙ্গে নাড়ির বন্ধনে বাঁধা তিতাশ চৌধুরী হয়ে ওঠেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ।
একজন পরিশ্রমী ও নিবেদিত সাহিত্যকর্মী তিতাশ চৌধুরী কখনো আত্মপ্রচারের পথে চলেননি। তাঁর পরিচয় তবু পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যকর্মে। বিচিত্র এই সাহিত্যকর্ম। গতকাল ছিল তাঁর ৬৫তম জন্মদিন। তাঁকে তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এই সামান্য রচনা।
No comments