পাকিস্তান-ভারত বৈরিতা অবসানের জন্য by কুলদীপ নায়ার
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দর কুমার গুজরাল সব সময় বলতেন, পাকিস্তান ও ভারতের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের সমাধান স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে হবে; একজন জাদুকর যেমন করে থলের ভেতর থেকে খরগোশ বের করে এনে দর্শককে তাক লাগিয়ে দেন, তেমনভাবে জনগণের সামনে সমাধান হাজির করলে হবে না। তার এ কথায় যুক্তি আছে।
দুই পক্ষকেই সমাধানের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে, তারপর সমাধানটি দুই পক্ষকেই গিলতে হবে। এই প্রক্রিয়া ধীরগতির। ইটের পর ইট দাঁড় করিয়ে দালান নির্মাণের মতো। সুতরাং, যেসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে, কোনো ধরনের মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ ও বিতর্ক করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার রাস্তা হলো দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই যোগাযোগ সীমিত আছে শুধু তাদের মধ্যেই, যারা ভিসা পায় কিংবা ট্রেক-২ কমিটির সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। দুই দেশের সরকারই এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় না এবং সরকারের নড়াচড়া ধীরগতির।
দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের নামমাত্র সুযোগ তারা খোলা রেখেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘অনাকাঙ্ক্ষিতদের’ বাইরে রাখতে ভিসা পাওয়ার যোগ্যতার শর্তাবলি আরও কড়াকড়ি করতে যাচ্ছে। ভারতে ঢোকার ক্ষেত্রে আয়ের পরিমাণ ও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত জুড়ে দেওয়ার বিষয়ও বিবেচনাধীন আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে তার মানে দাঁড়াবে, শুধু অভিজাতদেরই ভারতে ঢোকার অনুমতি মিলবে।
ভারত ও পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে আলোচনা হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক একটি অগ্রগতি। তাঁরা কী বলেন আর কী পদক্ষেপ নেন, সেটা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর খুব শিগগির তাদের এটা করা উচিত, কেননা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে জনগণ আর সময়ের অপচয় দেখতে রাজি নয়।
তবে সবচেয়ে জরুরি হলো, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে উভয় পক্ষের ভ্রান্ত ধারণাগুলো মন থেকে তাড়ানো। দুই দেশেই জাতীয় সংহতির বোধ লালন করা হয় ‘প্রতিপক্ষের অপকর্মের’ ওপর জোর দিয়ে। যখন জাতীয়তাবাদের রসদ আসে ‘শত্রু’কে ধরাশায়ী করার ভাবনা থেকে, তখন তো আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির আশা ক্ষীণ। আসলে জাতীয়তাবাদ সব সময় পক্ষপাতদুষ্ট।
সমঝোতায় পৌঁছার বহু সফল প্রচেষ্টার পরও ভারত নিজেকে প্রতারিত বোধ করার কারণে পাকিস্তানের আন্তরিকতাকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন এবং যাচাই করে দেখার বিষয়ে মনমোহন সিং যে মন্তব্য করেছেন, তা হয়তো ন্যায্য। তবে এতে শুধু অবিশ্বাসের গভীরতাই মূর্ত হয়। কে যাচাই করবে, কী যাচাই করা হবে আর কেমন করে করবে—এসব বিষয়ে অস্পষ্টতা আছে। দুই দেশ যখন আলোচ্যসূচির রূপরেখাও দাঁড় করাতে পারেনি, তখন এগুলো উত্থাপন করা উচিত নয়।
উভয় দেশের জনগণকে দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে যেতে হবে। তখন যা ঘটেছিল তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এখনো প্রচারিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আমি শিয়ালকোট থেকে অমৃতসর গিয়েছিলাম। আমার সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অপর সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ চালানোর ক্ষেত্রে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।
দেশভাগের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হলো; প্রায় দুই কোটি পরিবার বাস্তুভিটা ছেড়ে গেল। পাকিস্তানের মূলধারা দেশভাগের একপাক্ষিক চিত্র উপস্থাপন করে, এটা আমাকে পীড়া দেয়। ওয়াগাহ সীমান্তে পাকিস্তান এক বোর্ড খাড়া করেছে, তাতে দেখানো হচ্ছে হিন্দু আর শিখদের হাতে মুসলমানেরা কীভাবে নিহত হয়েছে। মুসলমানেরাও তো তখন কোনো অংশে কম করেনি। দেশভাগের ট্রাজেডিকে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাসে এক বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য করাই ভালো হবে।
কিন্তু দেশভাগের সেই ট্র্যাজেডি ফিরে ফিরে আসে যখন পাকিস্তানের পাঠ্যবইগুলো ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। আগের মতো উঁচু স্বরে আর না বললেও এখনো ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খারাপ অভিসন্ধি’র কথা বলা হয়। বিদ্যালয়ে শিশুদের যা শেখানো হয়, তা তারা কেমন করে ভুলবে? সেই মনোজগৎ নিয়েই তারা বড় হয়ে ওঠে। এখন সময় এসেছে দুই দেশ মিলে পাঠ্যপুস্তকগুলো এবং সেগুলো তৈরি করতে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে একটি যৌথ কমিশন গঠন করার।
এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে শিশুকালে যে ঘৃণার বীজ বপন করা হয়, তা নিঃসন্দেহে পরিহার করা যাবে। তবে দেশভাগের ফলে ক্ষুদ্র আয়তনের রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের শঙ্কিত হওয়ার কারণ অনুধাবনযোগ্য। বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে পাকিস্তানকে বিপদের আশঙ্কাতে থাকতে হয়। আর রাষ্ট্র গঠনের ৬২ বছর পর এখনো অধিকাংশ পাকিস্তানি মনে করে, নয়াদিল্লি তাদের দেশকে ধ্বংস করতে চায়। এমন চিন্তাকেই আশ্রয় করে চরমপন্থী সংগঠনগুলো তাদের প্রচারণার কাজ চালায়। উভয় দেশের সুশীল সমাজকে এ মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে পাকিস্তান কি টিকে থাকতে পারবে? মনে পড়ছে, মিনার-ই-পাকিস্তানের দর্শনার্থী বইয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ি লিখেছিলেন: ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধির ওপর ভারতের অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।’
দুই দেশের শাসক ও আমলাদের মনোভাবের বাজে নজির বহন করছে দুই দেশেই আটকে থাকা পরদেশের বন্দীরা। ভারতীয় ও পাকিস্তানি বন্দীরা সাজা খাটার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও জেলখানায় খেটে মরছেন। বন্দীদের বেশির ভাগেরই অপরাধ হলো, তাঁরা পরদেশে ঢুকে পড়েছিলেন। ‘বৈরী’ পরিবেশে জেলেরা এর শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। ভারতের গুজরাট ও দিউ এবং পাকিস্তানের সিন্ধুতে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। না জেনে তাঁরা পরদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়েন; গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের কারাগারে এখন প্রায় ৫৬০ জন ভারতীয় জেলে আটকে আছেন আর ভারতের জেলখানায় আছেন ১৫০ জন পাকিস্তানি জেলে।
ভারতীয় বন্দীদের ৯৫ শতাংশ গুজরাট ও দিউয়ের আর পাকিস্তানি বন্দীদের বড় অংশ সিন্ধুর অধিবাসী। সাধারণত তাঁরা অন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে পণে পরিণত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন মনে করে, বন্দী মুক্তির সময়টা তাঁদের জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক, তখনই তাঁরা ছাড়া পান, তার আগে নয়। যদিও দুই দেশই স্বীকার করে, এঁরা নিরপরাধ, তবু এঁদের দীর্ঘ সময় বন্দী করে রাখা হয়।
উভয় দেশের কূটনৈতিক মিশনে অনেক ছদ্মবেশী গোয়েন্দা থাকেন, তাই এক ধরনের গোয়েন্দা যুদ্ধ চলতে দেখা যায়। এক দেশ যখন কোনো কর্মকর্তাকে তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য (পারসনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করে দেশ থেকে বের করে দেয়, তখন পাল্টা জবাব দেয় অন্য দেশ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে বড় মাত্রায় পারস্পরিক যোগাযোগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে; ভীতি, সন্দেহ ও অবিশ্বাস কমাবে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনা আমি দেখছি না। কারণ, সন্ত্রাসবাদ অনেক কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের শিকার। বহু মার্কিন প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, যে তালেবান পাকিস্তানের বিভিন্ন নগরে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থসহায়তা দেয় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ দেশের অভ্যন্তরেরই কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ যৌথভাবে এবং সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর সহায়তায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তালেবান নির্মূল করতে এক ধরনের কার্যকৌশল প্রণয়ন করা উচিত।
দ্য ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
দুই পক্ষকেই সমাধানের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হবে, তারপর সমাধানটি দুই পক্ষকেই গিলতে হবে। এই প্রক্রিয়া ধীরগতির। ইটের পর ইট দাঁড় করিয়ে দালান নির্মাণের মতো। সুতরাং, যেসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে, কোনো ধরনের মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ ও বিতর্ক করার ক্ষেত্রে পরিষ্কার রাস্তা হলো দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই যোগাযোগ সীমিত আছে শুধু তাদের মধ্যেই, যারা ভিসা পায় কিংবা ট্রেক-২ কমিটির সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করে। দুই দেশের সরকারই এ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয় না এবং সরকারের নড়াচড়া ধীরগতির।
দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের নামমাত্র সুযোগ তারা খোলা রেখেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘অনাকাঙ্ক্ষিতদের’ বাইরে রাখতে ভিসা পাওয়ার যোগ্যতার শর্তাবলি আরও কড়াকড়ি করতে যাচ্ছে। ভারতে ঢোকার ক্ষেত্রে আয়ের পরিমাণ ও ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত জুড়ে দেওয়ার বিষয়ও বিবেচনাধীন আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে তার মানে দাঁড়াবে, শুধু অভিজাতদেরই ভারতে ঢোকার অনুমতি মিলবে।
ভারত ও পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে আলোচনা হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক একটি অগ্রগতি। তাঁরা কী বলেন আর কী পদক্ষেপ নেন, সেটা দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর খুব শিগগির তাদের এটা করা উচিত, কেননা সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে জনগণ আর সময়ের অপচয় দেখতে রাজি নয়।
তবে সবচেয়ে জরুরি হলো, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে উভয় পক্ষের ভ্রান্ত ধারণাগুলো মন থেকে তাড়ানো। দুই দেশেই জাতীয় সংহতির বোধ লালন করা হয় ‘প্রতিপক্ষের অপকর্মের’ ওপর জোর দিয়ে। যখন জাতীয়তাবাদের রসদ আসে ‘শত্রু’কে ধরাশায়ী করার ভাবনা থেকে, তখন তো আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির আশা ক্ষীণ। আসলে জাতীয়তাবাদ সব সময় পক্ষপাতদুষ্ট।
সমঝোতায় পৌঁছার বহু সফল প্রচেষ্টার পরও ভারত নিজেকে প্রতারিত বোধ করার কারণে পাকিস্তানের আন্তরিকতাকে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন এবং যাচাই করে দেখার বিষয়ে মনমোহন সিং যে মন্তব্য করেছেন, তা হয়তো ন্যায্য। তবে এতে শুধু অবিশ্বাসের গভীরতাই মূর্ত হয়। কে যাচাই করবে, কী যাচাই করা হবে আর কেমন করে করবে—এসব বিষয়ে অস্পষ্টতা আছে। দুই দেশ যখন আলোচ্যসূচির রূপরেখাও দাঁড় করাতে পারেনি, তখন এগুলো উত্থাপন করা উচিত নয়।
উভয় দেশের জনগণকে দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে যেতে হবে। তখন যা ঘটেছিল তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এখনো প্রচারিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আমি শিয়ালকোট থেকে অমৃতসর গিয়েছিলাম। আমার সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অপর সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও লুটতরাজ চালানোর ক্ষেত্রে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না।
দেশভাগের সময় প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হলো; প্রায় দুই কোটি পরিবার বাস্তুভিটা ছেড়ে গেল। পাকিস্তানের মূলধারা দেশভাগের একপাক্ষিক চিত্র উপস্থাপন করে, এটা আমাকে পীড়া দেয়। ওয়াগাহ সীমান্তে পাকিস্তান এক বোর্ড খাড়া করেছে, তাতে দেখানো হচ্ছে হিন্দু আর শিখদের হাতে মুসলমানেরা কীভাবে নিহত হয়েছে। মুসলমানেরাও তো তখন কোনো অংশে কম করেনি। দেশভাগের ট্রাজেডিকে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাসে এক বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য করাই ভালো হবে।
কিন্তু দেশভাগের সেই ট্র্যাজেডি ফিরে ফিরে আসে যখন পাকিস্তানের পাঠ্যবইগুলো ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায়, ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। আগের মতো উঁচু স্বরে আর না বললেও এখনো ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খারাপ অভিসন্ধি’র কথা বলা হয়। বিদ্যালয়ে শিশুদের যা শেখানো হয়, তা তারা কেমন করে ভুলবে? সেই মনোজগৎ নিয়েই তারা বড় হয়ে ওঠে। এখন সময় এসেছে দুই দেশ মিলে পাঠ্যপুস্তকগুলো এবং সেগুলো তৈরি করতে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে একটি যৌথ কমিশন গঠন করার।
এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে শিশুকালে যে ঘৃণার বীজ বপন করা হয়, তা নিঃসন্দেহে পরিহার করা যাবে। তবে দেশভাগের ফলে ক্ষুদ্র আয়তনের রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের শঙ্কিত হওয়ার কারণ অনুধাবনযোগ্য। বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের কাছ থেকে পাকিস্তানকে বিপদের আশঙ্কাতে থাকতে হয়। আর রাষ্ট্র গঠনের ৬২ বছর পর এখনো অধিকাংশ পাকিস্তানি মনে করে, নয়াদিল্লি তাদের দেশকে ধ্বংস করতে চায়। এমন চিন্তাকেই আশ্রয় করে চরমপন্থী সংগঠনগুলো তাদের প্রচারণার কাজ চালায়। উভয় দেশের সুশীল সমাজকে এ মনোভাবের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে। বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠে পাকিস্তান কি টিকে থাকতে পারবে? মনে পড়ছে, মিনার-ই-পাকিস্তানের দর্শনার্থী বইয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ি লিখেছিলেন: ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধির ওপর ভারতের অখণ্ডতা ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।’
দুই দেশের শাসক ও আমলাদের মনোভাবের বাজে নজির বহন করছে দুই দেশেই আটকে থাকা পরদেশের বন্দীরা। ভারতীয় ও পাকিস্তানি বন্দীরা সাজা খাটার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও জেলখানায় খেটে মরছেন। বন্দীদের বেশির ভাগেরই অপরাধ হলো, তাঁরা পরদেশে ঢুকে পড়েছিলেন। ‘বৈরী’ পরিবেশে জেলেরা এর শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। ভারতের গুজরাট ও দিউ এবং পাকিস্তানের সিন্ধুতে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। না জেনে তাঁরা পরদেশের জলসীমায় ঢুকে পড়েন; গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের কারাগারে এখন প্রায় ৫৬০ জন ভারতীয় জেলে আটকে আছেন আর ভারতের জেলখানায় আছেন ১৫০ জন পাকিস্তানি জেলে।
ভারতীয় বন্দীদের ৯৫ শতাংশ গুজরাট ও দিউয়ের আর পাকিস্তানি বন্দীদের বড় অংশ সিন্ধুর অধিবাসী। সাধারণত তাঁরা অন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে পণে পরিণত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন মনে করে, বন্দী মুক্তির সময়টা তাঁদের জন্য রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক, তখনই তাঁরা ছাড়া পান, তার আগে নয়। যদিও দুই দেশই স্বীকার করে, এঁরা নিরপরাধ, তবু এঁদের দীর্ঘ সময় বন্দী করে রাখা হয়।
উভয় দেশের কূটনৈতিক মিশনে অনেক ছদ্মবেশী গোয়েন্দা থাকেন, তাই এক ধরনের গোয়েন্দা যুদ্ধ চলতে দেখা যায়। এক দেশ যখন কোনো কর্মকর্তাকে তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য (পারসনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করে দেশ থেকে বের করে দেয়, তখন পাল্টা জবাব দেয় অন্য দেশ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, দুই দেশের জনগণের মধ্যে বড় মাত্রায় পারস্পরিক যোগাযোগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে; ভীতি, সন্দেহ ও অবিশ্বাস কমাবে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সে সম্ভাবনা আমি দেখছি না। কারণ, সন্ত্রাসবাদ অনেক কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের শিকার। বহু মার্কিন প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, যে তালেবান পাকিস্তানের বিভিন্ন নগরে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থসহায়তা দেয় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইসহ দেশের অভ্যন্তরেরই কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ যৌথভাবে এবং সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর সহায়তায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়সংকল্প ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এখন তালেবান নির্মূল করতে এক ধরনের কার্যকৌশল প্রণয়ন করা উচিত।
দ্য ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments