দুঃখে যাদের জীবন গড়া... by মীর মাহমুদুল হাসান
পাথর ভাঙছে মনজুর। ছয় বছর বয়স ওর। স্কুলে যাওয়া হয় না। তাই বুকের জগদ্দল পাথরটি সরানোর চেষ্টায় পাথরের সঙ্গেই মিতালি পাতাতে হয়েছে ওকে। কোমল হাতে এই পাথর ভেঙেই চালাতে হয় পেট।
বাবা আবদুল বুদার পাথর পরিবহনের ট্রলিতে কাজ করেন। মা মনজিলাও ছেলের মতো পাথর ভাঙার কাজ করেন। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলা সদরের গয়াবাড়ী ইউনিয়নের সুটিবাড়ী বাজারের অদূরে একটি পতিত জমিতে বসে পাথর ভাঙছিল বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ-শিশু।
গয়াবাড়ী গ্রামে মনজুরদের বাড়ি। জমিজমা বলতে কিছুই নেই তাদের। যা ছিল সব গ্রাস করেছে রাক্ষুসী তিস্তা।
‘তুমি স্কুলে যাও না?’
‘এবার স্কুলে ভর্তি হইছি। সারা দিন পাথর ভাঙ্গি ১০ টাকা পাই।’
‘স্কুলে না গিয়ে পাথর ভাঙছ কেন?’
‘হামার যে অভাব, এই জন্য মাও ভাঙ্গির কয়।’
‘পাথর ভাঙতে কষ্ট হয় না?’
‘আগে বেশি হতো, এখন কম হয়।’
হাতের বেশ কিছু জায়গায় হাতুড়ির আঘাতে থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন দেখিয়ে বলে, ‘এগুলো ব্যথা করে। কিন্তু কাম না কইরলে মাও গাইল দেয়।’
‘সারা দিনে কত টাকা আয় হয়?’
‘এক ফেরা ভাঙ্গির পাইরলে ১০ টাকা পাই।’
‘টাকা কী কর?’
‘মাও নিয়া চাউল আনে। মোর একটা বন্ধু আছে। অর নাম জহুরুল। তায়ও স্কুল না জায়য়া পাথর ভাঙ্গে।’
মনজুর গয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। মনজুরের মা মনজিলা বেগম (৩৫) বলেন, ‘মনজুর মাঝেমধ্যে স্কুলেও যায় পাথরও ভাঙ্গে। গরিব মানুষ কাম না শিখলে খাবে কী?’
মনজিলা জানান, তাঁর স্বামী ট্রলিতে পাথর ওঠানো-নামানোর কাজ করে ৮০-৯০ টাকা পান। কাজ না থাকলে বসে থাকতে হয়। তিনি প্রতিদিন তিন-চার ফেরা পাথর ভেঙে ৩০-৪০ টাকা আয় করেন। যখন কাজ থাকে না তখন সবাই বসা। ঋণ-মহাজন করে অথবা আগাম কাজের জন্য মজুরি নিয়ে খেতে হয়। সঞ্চয় বলে তাঁদের কিছু থাকে না।
মনজিলা বলেন, ‘পাথর ভাঙার কাম তো সব সময় থাকে না। নদীর পানি শুকি গেইলেও হামার কষ্ট, আবার বেশি বাইরলেও হামার কষ্ট। তা ছাড়া এলাকার পাথর তোলা মেশিনগুলো মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়। তখনো কাম থাকে না।’
এবার দুঃখের কথা বলতে অন্যরাও এসে যোগ দেয়। মিনি বেগম (৩৫) বলেন, ‘স্বামী রশিদুল ইসলাম ট্রলিতে লেবারি করে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ টাকা পান। যেখানে পাথর ওঠানোর মেশিন আছে সেখান থেকে পাথর আনেন। আর হামরা পাথর ভাঙ্গি ১০ টাকা করি ফেরা। সারা দিনে দুই-তিন ফেরার বেশি ভাঙ্গা যায় না। জমিজমা নাই। পাথর ভাঙ্গি খাই, মেশিন বন্ধ হইলে হামার কামও বন্ধ হয়।’
আছিয়া, কল্পনা, রশিদাসহ কয়েকজন জানান, তাঁদের স্বামীরা মজুরি পান ৭০ থেকে ১০০ টাকা আর তাঁরা ৩০ থেকে ৪০ টাকা। রশিদা বলেন, ‘৪০ টাকা কামাই কইরতে জুলুম হয়। সব জিনিসের এত দাম বাড়ে, কিন্তু হামার দাম বাড়ে না, আরও কমায়।’
চোখ ফেরাতেই দেখি তিন বছর বয়সী সুমিও পাথর ভাঙছে।
এ সময় পাথর ব্যবসায়ী আবদুল করিম বলেন, ‘এখানে প্রায় ২৫-৩০ জন পাথর কিনি বিক্রি করি। পাথরের সাইজ অনুযায়ী ২০ টাকা থেকে ২৯ টাকা সিএফটি কিনি। আবার ভাঙ্গার পর ২১ টাকা থেকে ৪২ টাকা পর্যন্ত সিএফটি বিক্রি করি।’ প্রতিটি সাইটে ৩০-৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান তিনি।
ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, খগাখরিবাড়ী, গয়াবাড়ী ইউনিয়নের নদীভাঙা প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক নদী থেকে পাথর তুলে ও পাথর ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের মজুরি কম হওয়ার কারণে পরিবারের সব সদস্য কাজ করেও সচ্ছলভাবে চলতে পারেন না। তাঁদের অনেকের নিজের ভিটেটুকুও নেই। বাঁধের ধারে কোনোভাবে দিন যাপন করেন। এখানে আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকায় এই শক্ত কাজটাই করতে হয় তাঁদের।
শিশু মনজুর আর সুমীর দিকে তাকাই। ওরা তখন আবার ফিরে গেছে পাথর ভাঙতে।
বাবা আবদুল বুদার পাথর পরিবহনের ট্রলিতে কাজ করেন। মা মনজিলাও ছেলের মতো পাথর ভাঙার কাজ করেন। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলা সদরের গয়াবাড়ী ইউনিয়নের সুটিবাড়ী বাজারের অদূরে একটি পতিত জমিতে বসে পাথর ভাঙছিল বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ-শিশু।
গয়াবাড়ী গ্রামে মনজুরদের বাড়ি। জমিজমা বলতে কিছুই নেই তাদের। যা ছিল সব গ্রাস করেছে রাক্ষুসী তিস্তা।
‘তুমি স্কুলে যাও না?’
‘এবার স্কুলে ভর্তি হইছি। সারা দিন পাথর ভাঙ্গি ১০ টাকা পাই।’
‘স্কুলে না গিয়ে পাথর ভাঙছ কেন?’
‘হামার যে অভাব, এই জন্য মাও ভাঙ্গির কয়।’
‘পাথর ভাঙতে কষ্ট হয় না?’
‘আগে বেশি হতো, এখন কম হয়।’
হাতের বেশ কিছু জায়গায় হাতুড়ির আঘাতে থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন দেখিয়ে বলে, ‘এগুলো ব্যথা করে। কিন্তু কাম না কইরলে মাও গাইল দেয়।’
‘সারা দিনে কত টাকা আয় হয়?’
‘এক ফেরা ভাঙ্গির পাইরলে ১০ টাকা পাই।’
‘টাকা কী কর?’
‘মাও নিয়া চাউল আনে। মোর একটা বন্ধু আছে। অর নাম জহুরুল। তায়ও স্কুল না জায়য়া পাথর ভাঙ্গে।’
মনজুর গয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। মনজুরের মা মনজিলা বেগম (৩৫) বলেন, ‘মনজুর মাঝেমধ্যে স্কুলেও যায় পাথরও ভাঙ্গে। গরিব মানুষ কাম না শিখলে খাবে কী?’
মনজিলা জানান, তাঁর স্বামী ট্রলিতে পাথর ওঠানো-নামানোর কাজ করে ৮০-৯০ টাকা পান। কাজ না থাকলে বসে থাকতে হয়। তিনি প্রতিদিন তিন-চার ফেরা পাথর ভেঙে ৩০-৪০ টাকা আয় করেন। যখন কাজ থাকে না তখন সবাই বসা। ঋণ-মহাজন করে অথবা আগাম কাজের জন্য মজুরি নিয়ে খেতে হয়। সঞ্চয় বলে তাঁদের কিছু থাকে না।
মনজিলা বলেন, ‘পাথর ভাঙার কাম তো সব সময় থাকে না। নদীর পানি শুকি গেইলেও হামার কষ্ট, আবার বেশি বাইরলেও হামার কষ্ট। তা ছাড়া এলাকার পাথর তোলা মেশিনগুলো মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়। তখনো কাম থাকে না।’
এবার দুঃখের কথা বলতে অন্যরাও এসে যোগ দেয়। মিনি বেগম (৩৫) বলেন, ‘স্বামী রশিদুল ইসলাম ট্রলিতে লেবারি করে প্রতিদিন ৯০ থেকে ১০০ টাকা পান। যেখানে পাথর ওঠানোর মেশিন আছে সেখান থেকে পাথর আনেন। আর হামরা পাথর ভাঙ্গি ১০ টাকা করি ফেরা। সারা দিনে দুই-তিন ফেরার বেশি ভাঙ্গা যায় না। জমিজমা নাই। পাথর ভাঙ্গি খাই, মেশিন বন্ধ হইলে হামার কামও বন্ধ হয়।’
আছিয়া, কল্পনা, রশিদাসহ কয়েকজন জানান, তাঁদের স্বামীরা মজুরি পান ৭০ থেকে ১০০ টাকা আর তাঁরা ৩০ থেকে ৪০ টাকা। রশিদা বলেন, ‘৪০ টাকা কামাই কইরতে জুলুম হয়। সব জিনিসের এত দাম বাড়ে, কিন্তু হামার দাম বাড়ে না, আরও কমায়।’
চোখ ফেরাতেই দেখি তিন বছর বয়সী সুমিও পাথর ভাঙছে।
এ সময় পাথর ব্যবসায়ী আবদুল করিম বলেন, ‘এখানে প্রায় ২৫-৩০ জন পাথর কিনি বিক্রি করি। পাথরের সাইজ অনুযায়ী ২০ টাকা থেকে ২৯ টাকা সিএফটি কিনি। আবার ভাঙ্গার পর ২১ টাকা থেকে ৪২ টাকা পর্যন্ত সিএফটি বিক্রি করি।’ প্রতিটি সাইটে ৩০-৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান তিনি।
ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, খগাখরিবাড়ী, গয়াবাড়ী ইউনিয়নের নদীভাঙা প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক নদী থেকে পাথর তুলে ও পাথর ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁদের মজুরি কম হওয়ার কারণে পরিবারের সব সদস্য কাজ করেও সচ্ছলভাবে চলতে পারেন না। তাঁদের অনেকের নিজের ভিটেটুকুও নেই। বাঁধের ধারে কোনোভাবে দিন যাপন করেন। এখানে আয়ের অন্য কোনো পথ না থাকায় এই শক্ত কাজটাই করতে হয় তাঁদের।
শিশু মনজুর আর সুমীর দিকে তাকাই। ওরা তখন আবার ফিরে গেছে পাথর ভাঙতে।
No comments