হলিউড কেমন করে যুদ্ধের বিভীষিকা আড়াল করে by স্লাভো জিজেক
জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার ছবিকে পেছনে ফেলে ক্যাথরিন বিগেলোর দ্য হার্ট লকার প্রধান প্রধান অস্কার পুরস্কার জিতে নিল। হলিউডের বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য এ বিজয়কে একটি ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়েছে। মাঝারি খরচের এই চলচ্চিত্রটি স্পষ্টত বিধ্বস্ত করল অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রযোজনাকে, যার কৌশলগত অসাধারণত্ব কাহিনির বৈচিত্র্যহীন সরলতাকে ঢাকতে পারেনি। দ্য হার্ট লকার-এর বিজয়ের মানে কি হলিউড শুধু এক ব্লকবাস্টার তৈরির যন্ত্র নয়, হলিউড এখনো প্রান্তের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করতে জানে? হয়তো—কিন্তু এই ‘হয়তো’ অনেক জোরালো।
সব রহস্যময়তা সত্ত্বেও অ্যাভাটার-এর পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টত বৈশ্বিক মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিরোধীদের প্রতি। অ্যাভাটার-এ প্রচণ্ড শক্তিধর সেনাবাহিনী বড় বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত বর্বর বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন এক বাহিনী হিসেবে উপস্থিত। অন্যদিকে দ্য হার্ট লকার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর যে চিত্র আঁকে, তা অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ মানবিক হস্তক্ষেপ ও সমরবাদী শান্তি আন্দোলনের এই সময়ে সেনাবাহিনীর সর্বজনীন প্রতিচ্ছবির সঙ্গে।
দ্য হার্ট লকার ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের মতো বড় ধরনের বিতর্ককে অনেকাংশে অগ্রাহ্য করে গেছে। ঝুঁকি ও ধ্বংসাত্মক বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হওয়া সাধারণ সেনারা প্রতিদিন যেসব অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তাতেই কেন্দ্রীভূত ছবিটির মনোযোগ। আপাত-প্রামাণ্যচিত্রশৈলী ব্যবহার করে এ ছবিতে বলা হয়েছে একটি এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল (ইওডি) স্কোয়াডের গল্প। স্কোয়াডের সদস্যরা পেতে রাখা বোমা নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাব্য প্রাণঘাতী কাজ করে চলে। গল্পটি বাছাই গভীর ইঙ্গিতবহ—যদিও তারা সেনা, তবুও হত্যা করে না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা বোমা নিষ্ক্রিয় করতে জীবনের ঝুঁকি নেয়। এসব বোমা জীবন্ত থাকলে বেসামরিক লোকজন মারা পড়বে। দর্শকের উদার সংবেদনশীলতার প্রতি এর চেয়ে সহানুভূতিশীল আর কিছু হতে পারে? সন্ত্রাসবিরোধী চলমান যুদ্ধে পশ্চিমা সেনারা শেষতক ইওডি স্কোয়াডের মতোই নয় কি? এমনকি, যখন তারা বোমা হামলা করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখনো বেসামরিক মানুষের জীবন অধিকতর নিরাপদ করার জন্য তারা কি ধৈর্যসহকারে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক ধ্বংসের কাজ করে চলে না?
ছবিটির আরও গুরুতর কিছু দিক আছে। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধের ওপর নির্মিত আরি ফোলম্যানের অ্যানিমেটেড ডকুমেন্টারি ওয়ালত্স উইথ বশির এবং স্যামুয়েল মাওজের লেবানন-এর মতো সাম্প্রতিক ইসরায়েলি ছবি দুটির সাফল্যের পেছনে যে প্রবণতা কাজ করছে, সেই প্রবণতাই হলিউডে নিয়ে এসেছে দ্য হার্ট লকার।
তরুণ বয়সে মাওজের সেনাবাহিনীতে কাজ করার স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে লেবানন। ছবিটির অধিকাংশ অ্যাকশন ট্যাংকের ভেতর থেকে চিত্রায়নের মাধ্যমে যুদ্ধের ভীতিকর দিক এবং আবদ্ধ থাকার আতঙ্কজনিত ব্যাধির রূপদান করা হয়েছে। এ ছবিতে চার অনভিজ্ঞ সেনা ট্যাংকের ভেতর বসে লেবাননের এক শহরে শত্রু খতম করার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই চার সেনাকেই অনুসরণ করা হয় ছবিটিতে। যে শহরে তারা শত্রু নিধনে নিয়োজিত, সেটি এরই মধ্যে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত। মাওজের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা ইওয়াভ দোনাত ২০০৯ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সবে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘ওই ছবি দর্শকের মনে এমন ভাবনা জাগাবে না, “আমি শুধু একটি ছবি দেখলাম।” এই ছবি আপনার মধ্যে এমন অনুভূতি তৈরি করবে, যেন আপনি নিজেই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত।’ একইভাবে ওয়ালত্স উইথ বশির ছবিটিও ইসরায়েলি সেনাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১৯৮২ সালের সংঘাতের বিভীষিকা রূপায়িত করে।
মাওজ বলেন, ইসরায়েলি নীতির নিন্দা নয়, তাঁর ছবিটি একজন সেনা কী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, তার ব্যক্তিগত বিবরণ। ‘ছবির নামটি লেবানন রাখা ঠিক হয়নি। কারণ, লেবাননের যুদ্ধ সারবস্তুর দিক থেকে অন্য কোনো যুদ্ধের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার কোনো চেষ্টা ছবিটির ধার কমিয়ে দিত।’ এ বক্তব্য বিশুদ্ধভাবে মতাদর্শিক। অপরাধ সংঘটনকারীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা পুনরায় মনোযোগে আনার কাজটি সংঘাতের নৈতিক-রাজনৈতিক পুরো পটভূমি মুছে ফেলা সম্ভব করে তোলে। লেবাননের গভীরে ঢুকে ইসরায়েলি বাহিনী কী করেছিল, তা আড়াল করা যায়। এভাবে ‘মানবিকীকরণ’ আচ্ছন্নতা তৈরি করে: রাজনৈতিক-সামরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা কী করছি এবং আমাদের ঝুঁকির জায়গাগুলো কী, তা নির্দয়ভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আমাদের রাজনৈতিক-সামরিক সংগ্রাম যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অন্তরঙ্গ জমিনে ভয়াবহ ব্যাঘাত ঘটায় তা কোনো জড় ইতিহাস নয়। এসব সংগ্রামে আমরা পূর্ণ মাত্রায় অংশগ্রহণ করি।
আরও সরলভাবে বলা যায়, এভাবে কোনো সেনার চরিত্রের ‘মানবিকীকরণ’ (মানুষ মাত্রেই ভুল হয়—এই প্রবাদের মতো) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতাদর্শিক (আত্ম)উপস্থাপনের প্রধান উপাদান। ইসরায়েলি গণমাধ্যম তাদের সেনাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও মানসিক আঘাতের বিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করে। পছন্দ করে তাদেরকে উপস্থাপন করতে নিখুঁত সামরিক যন্ত্র বা অতিমানবিক বীর হিসেবে নয়, বরং সাধারণ মানুষ হিসেবে, যারা ইতিহাস ও যুদ্ধের ময়দানের মর্মান্তিক বিভীষিকার মধ্যে থেকেও যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো ভুল করে এবং হারিয়ে যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী সন্দেহভাজন এক সন্ত্রাসীর পারিবারিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়। তারা কাজটি সম্পাদন করে অত্যন্ত সদয়চিত্তে, এমনকি বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে বাড়ির আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজে পরিবারটিকে সাহায্য করে। তারও আগে ইসরায়েলি গণমাধ্যম একই ধরনের আরেকটি ঘটনার খবর প্রচারিত করেছিল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খোঁজে এক ফিলিস্তিনির বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছিল এক ইসরায়েলি সেনা। তখন সেই পরিবারের মা তার আতঙ্কিত মেয়েকে শান্ত থাকার জন্য তাঁর নাম ধরে ডাকেন। সেই সেনাটির মেয়ের নামও একই ছিল। মেয়েটির নাম শুনে সেনার হূদয়ানুভূতি জেগে ওঠে। সে তার ওয়ালেট বের করে ফিলিস্তিনি মাকে তার মেয়ের ছবি দেখায়।
অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এমন আচরণের মধ্যে মিথ্যা প্রতারণামূলক দিক আছে—এটা উপলব্ধি করা সহজ। রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও আমরা সবাই মানুষ, একই ধরনের ভালোবাসা আর উদ্বেগ আমাদের আছে—এমন ভাবনা এ মুহূর্তে সেনাটি যে কাজ কার্যকরভাবে সম্পাদন করছে, সেটির প্রভাব নিয়ে ভাবতে উত্সাহী করে না। সেই মায়ের একমাত্র যথার্থ জবাব হওয়া উচিত, সেই সেনার কাছে একটি প্রশ্নের জবাব চাওয়া: ‘তুমিও যদি আমার মতোই মানুষ, তবে কেন তুমি এখন এই কাজটি করছো?’ সেনাটি তখন তাঁর ওপর চাপানো দায়িত্বের দোহাই দিতে পারে, ‘আমি এই কাজ পছন্দ করি না, কিন্তু এটা করার জন্য আমার ওপর নির্দেশ আছে।’ এভাবে সে তার নিজের কর্মকাণ্ডের দায় নিজে না নিয়ে অন্যের ওপর চাপাতে পারে।
এমন মানবিকীকরণের মর্ম হচ্ছে, ব্যক্তির জটিল জীবনবাস্তবতা এবং সেই জীবনে সে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে যা যা করতে বাধ্য হয়, এ দুয়ের মধ্যকার তফাতটাকে গুরুত্ব দেওয়া। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর নির্মিত ক্লদ লেনজম্যানের একটি প্রামাণ্যচিত্রে একজন সেনা কর্মকর্তা, যিনি কখনো সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবেননি, তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমার পরিবারের কোনো জেনেটিক ব্যাপার নয়।’
এ প্রসঙ্গে আবার দ্য হার্ট লকার-এ ফিরে আসি। যুদ্ধের ময়দানে কাজ করার দৈনন্দিন বিভীষিকা ও মানসিক যন্ত্রণার প্রভাব চিত্রায়ন ছবিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকার আবেগগত উদ্যাপন থেকে বহু দূরে ঠেলে দেয় বলে মনে হয়। জন ওয়েইনির কুখ্যাত চলচ্চিত্র গ্রিন বেরেটস-এ সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকার যে হূদয়কাড়া উপস্থাপনা, তা থেকে দ্য হার্ট লকার অনেক দূরে। তবে সবসময় আমাদের মনে রাখা উচিত, দ্য হার্ট লকার-এ যুদ্ধের উদ্ভটতার বাহুল্যবর্জিত বাস্তববাদী উপস্থাপনও আচ্ছন্নতা তৈরি করে। আর এ ছবির নায়কেরা গ্রিন বেরেটস ছবির নায়কদের মতো একই ভূমিকা রেখে চলে। মতাদর্শের অদৃশ্যমানতার মধ্যেই মতাদর্শ উপস্থিত, এ উপস্থিতি যেকোনো সময়ের থেকে তীব্র: দর্শকেরা যুদ্ধের ময়দানে সেনাদের সঙ্গে নিজেও চলে যায়, সেনাদের আতঙ্ক ও নিদারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে দর্শক একাত্মতা বোধ করে। সেই যুদ্ধে তারা কী করছে সেই প্রশ্ন আর জাগে না।
ইন দিজ টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
স্লাভো জিজেক: স্লোভেনীয় দার্শনিক।
সব রহস্যময়তা সত্ত্বেও অ্যাভাটার-এর পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টত বৈশ্বিক মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিরোধীদের প্রতি। অ্যাভাটার-এ প্রচণ্ড শক্তিধর সেনাবাহিনী বড় বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত বর্বর বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন এক বাহিনী হিসেবে উপস্থিত। অন্যদিকে দ্য হার্ট লকার যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর যে চিত্র আঁকে, তা অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ মানবিক হস্তক্ষেপ ও সমরবাদী শান্তি আন্দোলনের এই সময়ে সেনাবাহিনীর সর্বজনীন প্রতিচ্ছবির সঙ্গে।
দ্য হার্ট লকার ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের মতো বড় ধরনের বিতর্ককে অনেকাংশে অগ্রাহ্য করে গেছে। ঝুঁকি ও ধ্বংসাত্মক বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হওয়া সাধারণ সেনারা প্রতিদিন যেসব অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তাতেই কেন্দ্রীভূত ছবিটির মনোযোগ। আপাত-প্রামাণ্যচিত্রশৈলী ব্যবহার করে এ ছবিতে বলা হয়েছে একটি এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোজাল (ইওডি) স্কোয়াডের গল্প। স্কোয়াডের সদস্যরা পেতে রাখা বোমা নিষ্ক্রিয় করার সম্ভাব্য প্রাণঘাতী কাজ করে চলে। গল্পটি বাছাই গভীর ইঙ্গিতবহ—যদিও তারা সেনা, তবুও হত্যা করে না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ত্রাসীদের পুঁতে রাখা বোমা নিষ্ক্রিয় করতে জীবনের ঝুঁকি নেয়। এসব বোমা জীবন্ত থাকলে বেসামরিক লোকজন মারা পড়বে। দর্শকের উদার সংবেদনশীলতার প্রতি এর চেয়ে সহানুভূতিশীল আর কিছু হতে পারে? সন্ত্রাসবিরোধী চলমান যুদ্ধে পশ্চিমা সেনারা শেষতক ইওডি স্কোয়াডের মতোই নয় কি? এমনকি, যখন তারা বোমা হামলা করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখনো বেসামরিক মানুষের জীবন অধিকতর নিরাপদ করার জন্য তারা কি ধৈর্যসহকারে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক ধ্বংসের কাজ করে চলে না?
ছবিটির আরও গুরুতর কিছু দিক আছে। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধের ওপর নির্মিত আরি ফোলম্যানের অ্যানিমেটেড ডকুমেন্টারি ওয়ালত্স উইথ বশির এবং স্যামুয়েল মাওজের লেবানন-এর মতো সাম্প্রতিক ইসরায়েলি ছবি দুটির সাফল্যের পেছনে যে প্রবণতা কাজ করছে, সেই প্রবণতাই হলিউডে নিয়ে এসেছে দ্য হার্ট লকার।
তরুণ বয়সে মাওজের সেনাবাহিনীতে কাজ করার স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে লেবানন। ছবিটির অধিকাংশ অ্যাকশন ট্যাংকের ভেতর থেকে চিত্রায়নের মাধ্যমে যুদ্ধের ভীতিকর দিক এবং আবদ্ধ থাকার আতঙ্কজনিত ব্যাধির রূপদান করা হয়েছে। এ ছবিতে চার অনভিজ্ঞ সেনা ট্যাংকের ভেতর বসে লেবাননের এক শহরে শত্রু খতম করার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই চার সেনাকেই অনুসরণ করা হয় ছবিটিতে। যে শহরে তারা শত্রু নিধনে নিয়োজিত, সেটি এরই মধ্যে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে বিধ্বস্ত। মাওজের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা ইওয়াভ দোনাত ২০০৯ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সবে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘ওই ছবি দর্শকের মনে এমন ভাবনা জাগাবে না, “আমি শুধু একটি ছবি দেখলাম।” এই ছবি আপনার মধ্যে এমন অনুভূতি তৈরি করবে, যেন আপনি নিজেই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত।’ একইভাবে ওয়ালত্স উইথ বশির ছবিটিও ইসরায়েলি সেনাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ১৯৮২ সালের সংঘাতের বিভীষিকা রূপায়িত করে।
মাওজ বলেন, ইসরায়েলি নীতির নিন্দা নয়, তাঁর ছবিটি একজন সেনা কী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, তার ব্যক্তিগত বিবরণ। ‘ছবির নামটি লেবানন রাখা ঠিক হয়নি। কারণ, লেবাননের যুদ্ধ সারবস্তুর দিক থেকে অন্য কোনো যুদ্ধের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ার কোনো চেষ্টা ছবিটির ধার কমিয়ে দিত।’ এ বক্তব্য বিশুদ্ধভাবে মতাদর্শিক। অপরাধ সংঘটনকারীর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা পুনরায় মনোযোগে আনার কাজটি সংঘাতের নৈতিক-রাজনৈতিক পুরো পটভূমি মুছে ফেলা সম্ভব করে তোলে। লেবাননের গভীরে ঢুকে ইসরায়েলি বাহিনী কী করেছিল, তা আড়াল করা যায়। এভাবে ‘মানবিকীকরণ’ আচ্ছন্নতা তৈরি করে: রাজনৈতিক-সামরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা কী করছি এবং আমাদের ঝুঁকির জায়গাগুলো কী, তা নির্দয়ভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আমাদের রাজনৈতিক-সামরিক সংগ্রাম যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অন্তরঙ্গ জমিনে ভয়াবহ ব্যাঘাত ঘটায় তা কোনো জড় ইতিহাস নয়। এসব সংগ্রামে আমরা পূর্ণ মাত্রায় অংশগ্রহণ করি।
আরও সরলভাবে বলা যায়, এভাবে কোনো সেনার চরিত্রের ‘মানবিকীকরণ’ (মানুষ মাত্রেই ভুল হয়—এই প্রবাদের মতো) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতাদর্শিক (আত্ম)উপস্থাপনের প্রধান উপাদান। ইসরায়েলি গণমাধ্যম তাদের সেনাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও মানসিক আঘাতের বিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করে। পছন্দ করে তাদেরকে উপস্থাপন করতে নিখুঁত সামরিক যন্ত্র বা অতিমানবিক বীর হিসেবে নয়, বরং সাধারণ মানুষ হিসেবে, যারা ইতিহাস ও যুদ্ধের ময়দানের মর্মান্তিক বিভীষিকার মধ্যে থেকেও যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো ভুল করে এবং হারিয়ে যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী সন্দেহভাজন এক সন্ত্রাসীর পারিবারিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়। তারা কাজটি সম্পাদন করে অত্যন্ত সদয়চিত্তে, এমনকি বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে বাড়ির আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার কাজে পরিবারটিকে সাহায্য করে। তারও আগে ইসরায়েলি গণমাধ্যম একই ধরনের আরেকটি ঘটনার খবর প্রচারিত করেছিল। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খোঁজে এক ফিলিস্তিনির বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছিল এক ইসরায়েলি সেনা। তখন সেই পরিবারের মা তার আতঙ্কিত মেয়েকে শান্ত থাকার জন্য তাঁর নাম ধরে ডাকেন। সেই সেনাটির মেয়ের নামও একই ছিল। মেয়েটির নাম শুনে সেনার হূদয়ানুভূতি জেগে ওঠে। সে তার ওয়ালেট বের করে ফিলিস্তিনি মাকে তার মেয়ের ছবি দেখায়।
অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এমন আচরণের মধ্যে মিথ্যা প্রতারণামূলক দিক আছে—এটা উপলব্ধি করা সহজ। রাজনৈতিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও আমরা সবাই মানুষ, একই ধরনের ভালোবাসা আর উদ্বেগ আমাদের আছে—এমন ভাবনা এ মুহূর্তে সেনাটি যে কাজ কার্যকরভাবে সম্পাদন করছে, সেটির প্রভাব নিয়ে ভাবতে উত্সাহী করে না। সেই মায়ের একমাত্র যথার্থ জবাব হওয়া উচিত, সেই সেনার কাছে একটি প্রশ্নের জবাব চাওয়া: ‘তুমিও যদি আমার মতোই মানুষ, তবে কেন তুমি এখন এই কাজটি করছো?’ সেনাটি তখন তাঁর ওপর চাপানো দায়িত্বের দোহাই দিতে পারে, ‘আমি এই কাজ পছন্দ করি না, কিন্তু এটা করার জন্য আমার ওপর নির্দেশ আছে।’ এভাবে সে তার নিজের কর্মকাণ্ডের দায় নিজে না নিয়ে অন্যের ওপর চাপাতে পারে।
এমন মানবিকীকরণের মর্ম হচ্ছে, ব্যক্তির জটিল জীবনবাস্তবতা এবং সেই জীবনে সে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে যা যা করতে বাধ্য হয়, এ দুয়ের মধ্যকার তফাতটাকে গুরুত্ব দেওয়া। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর নির্মিত ক্লদ লেনজম্যানের একটি প্রামাণ্যচিত্রে একজন সেনা কর্মকর্তা, যিনি কখনো সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবেননি, তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমার পরিবারের কোনো জেনেটিক ব্যাপার নয়।’
এ প্রসঙ্গে আবার দ্য হার্ট লকার-এ ফিরে আসি। যুদ্ধের ময়দানে কাজ করার দৈনন্দিন বিভীষিকা ও মানসিক যন্ত্রণার প্রভাব চিত্রায়ন ছবিটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকার আবেগগত উদ্যাপন থেকে বহু দূরে ঠেলে দেয় বলে মনে হয়। জন ওয়েইনির কুখ্যাত চলচ্চিত্র গ্রিন বেরেটস-এ সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকার যে হূদয়কাড়া উপস্থাপনা, তা থেকে দ্য হার্ট লকার অনেক দূরে। তবে সবসময় আমাদের মনে রাখা উচিত, দ্য হার্ট লকার-এ যুদ্ধের উদ্ভটতার বাহুল্যবর্জিত বাস্তববাদী উপস্থাপনও আচ্ছন্নতা তৈরি করে। আর এ ছবির নায়কেরা গ্রিন বেরেটস ছবির নায়কদের মতো একই ভূমিকা রেখে চলে। মতাদর্শের অদৃশ্যমানতার মধ্যেই মতাদর্শ উপস্থিত, এ উপস্থিতি যেকোনো সময়ের থেকে তীব্র: দর্শকেরা যুদ্ধের ময়দানে সেনাদের সঙ্গে নিজেও চলে যায়, সেনাদের আতঙ্ক ও নিদারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে দর্শক একাত্মতা বোধ করে। সেই যুদ্ধে তারা কী করছে সেই প্রশ্ন আর জাগে না।
ইন দিজ টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
স্লাভো জিজেক: স্লোভেনীয় দার্শনিক।
No comments