কৃষক ও কৃষির দিনবদল by আলী ইদ্রিস

১৫ কোটি মানুষের দেশে প্রায় তিন কোটি কৃষক পরিবার স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর প্রথমবারের মতো কৃষি উৎপাদনের ভর্তুকি নগদে পেতে যাচ্ছে। অর্থাৎ এখন থেকে সেচ, সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের জন্য সরকারের দেওয়া ভর্তুকি সরাসরি কৃষকের নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সেখান থেকে কৃষক নিজের ইচ্ছামতো টাকা তুলে কৃষি উপকরণ কিনতে পারবেন। ব্যাপারটা যেন স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো। সেচের মালিক এখন আর ইচ্ছামতো পানির দাম হাঁকতে পারবেন না বরং কৃষক দরকষাকষি করে পানি কিনতে পারবেন। সারের ডিলাররা এত দিন ইচ্ছামতো নিজের ভাই-ভাতিজা, বন্ধুবান্ধবের কাছে লুকিয়ে বা কালোবাজারে সার বিক্রি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতেন। এখন ভর্তুকির অর্থ কৃষক নিজের হাতে পাওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক দরে সারের ডিলারদের কাছ থেকে সার কিনতে পারবেন। সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, কৃষক স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে তাঁর একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হবে মাত্র ১০ টাকা খরচ করে এবং সে টাকা রেখে তিনি ইচ্ছামতো বাকি টাকা তুলতে পারবেন। এই পাওয়ার আনন্দ কৃষককে আরও অধিক দক্ষতার সঙ্গে এবং কম খরচে ফসল ফলাতে উদ্দীপনা জোগাবে। ফলে ফসলে মুনাফার পরিমাণ বাড়বে এবং সেই বর্ধিত মুনাফা তাঁর সঞ্চয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে। ফলে জাতীয়ভাবে কৃষি খাতে তথা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে এবং দারিদ্র্য কমবে।
দেড় কোটি পরিচয়পত্র ও ভর্তুকি বিতরণ: তিন কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় করে দেড় কোটি কৃষকের জন্য পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়েছে। এই পরিচয়পত্রে কৃষকের পরিচয় এবং বর্গাসহ নিজের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ, সেচযন্ত্রের অবস্থান, কোন মৌসুমে কৃষক কী কী ফসল ফলান, সার, সেচ, বীজ, কীটনাশ ইত্যাদি ব্যবহারের পরিমাণ ও অন্যান্য তথ্য সন্নিবেশিত থাকবে। এই পরিচয়পত্রের তথ্য নিয়ে তৈরি ডেটাবেইজ থেকে কৃষকদের ভর্তুকির পরিমাণ, ঋণের পরিমাণ ইত্যাদি নির্ধারণ করা হবে। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি শ্রেণীতে বিভক্ত প্রায় দেড় কোটি কৃষক পরিবারকে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ভর্তুকির টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে। এর আগে কৃষক মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন এবং পরিচয়পত্র দেখিয়ে সেখান থেকে ভর্তুকির টাকা তুলতে পারবেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের কবল থেকে কৃষক মুক্তি পাবেন। তা ছাড়া এই পরিচয়পত্র কৃষকের আত্মমর্যাদা বাড়াবে।
কৃষকের জন্য সুদবিহীন ঋণ: জোট সরকারের কর্মকর্তাদের বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রাষ্ট্রায়ত্ত কতিপয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সাধুবাদ জানাচ্ছি কৃষকের জন্য সুদবিহীন ঋণ চালু করার জন্য। কৃষকদের জন্য ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো। ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে, উেকাচ দিয়ে যে কৃষক ঋণের ব্যবস্থা করতে পারেননি, অনন্যোপায় হয়ে ফসল বন্ধক দিয়ে অথবা শতভাগ সুদে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিতেন, সেই কৃষককে ডেকে অথবা তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সরকারের প্রতিনিধিরা যদি কৃষকের হাতে সুদবিহীন ঋণ তুলে দেন, তাহলে সেটা স্বপ্নের মতোই মনে হওয়া উচিত। গত বছরের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর শেরপুর জেলার লঙ্গরপাড়া বাজারে ৬০৩ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে কৃষি ব্যাংকের পক্ষে দুই কোটি টাকা সুদবিহীন ঋণ বিতরণ করেন। এর পর থেকে কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় সুদমুক্ত কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০০৯-১০ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগ ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই টাকা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক এবং বেসরকারি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। সুদবিহীন ঋণ পেলে কৃষক কম খরচে অধিক জমিতে ফসল ফলাতে পারবেন। তাতে কৃষকের মুনাফা তথা সঞ্চয় বাড়লে ১০ কোটি মানুষের দারিদ্র্য হ্রাস পাবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে।
কৃষিযন্ত্র কেনায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকি: কৃষির উৎপাদন খরচ কমাতে, আধুনিকায়ন করতে এবং উৎপাদন বাড়াতে সরকার ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি যন্ত্র কেনার জন্য নিম্ন ও মধ্য আয়ের কৃষকদের ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২৫টি জেলার ২৭৩টি উপজেলায় ১৪৯ কোটি টাকার ভর্তুকি মঞ্জুর করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটাও মহাজোট সরকারের প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত। এতে অনুমানিক ৩৫ লাখ টন অতিরিক্ত ফসল পাওয়া যাবে, যা পল্লী অঞ্চলের কৃষকের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে।
হাইব্রিড বীজ, প্রাকৃতিক সার, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি: ভর্তুকি, সুদবিহীন ঋণ ইত্যাদি দেওয়ার পরও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণের জন্য হাইব্রিড বীজ, প্রাকৃতিক সার এবং সারা বছর ফসল ফলানো বা বহুমুখীকরণের পদ্ধতি কৃষকদের জানা উচিত। এখনো খাদ্যশস্যে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। এখনো ভারত, নেপাল ও অন্যান্য দেশ থেকে পিঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, ফল-ফলারি প্রচুর পরিমাণে আমদানি করতে হয়। এর কারণ, এ দেশে উন্নত এবং বছরব্যাপী চাষ করার মতো বীজ পাওয়া যায় না। হাইব্রিড বীজও আমদানি করতে হয়। সেই সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কৃষককে ঠকায়। পিঁয়াজ, রসুন, আদা, টমেটো, তরিতরকারি, ফল যদি ভারতে সারা বছর চাষ হতে পারে; তাহলে এ দেশে হবে না কেন? কৃষিতে গবেষণা এবং মাঠপর্যায়ে গবেষণার ফলকে বাস্তবায়ন করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগকে আরও অর্থ ও জনবল দিয়ে উদ্বুদ্ব করা উচিত। তাহলেই এ দেশের কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কৃষি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ঘটলে অর্থনীতিতেও প্রবৃদ্ধি ঘটবে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পাবে।
আলী ইদিরস: এফসিএ
aliidris@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.