আদালতের কৌটায় জামায়াতের প্রাণ by মিজানুর রহমান খান
সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে সংসদ ও সরকার। এত দিনে স্পষ্ট যে তারা সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী নয়। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা হয়তো তারা মুখেও আনত না। পঞ্চম সংশোধনীর রায় নিয়েও তাদের মুখে খই ফুটত না। এখন ফুটেছে, কারণ, ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উপাদান আছে এতে। তাই তারা আদালতের ওপর ভর করেছে। উদ্দেশ্য জামায়াত শিকার। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এত বড় সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না।
আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদের বক্তব্য বেশ ধারালো। এটা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, জামায়াত ইতিমধ্যে কোমায় চলে গেছে। এখন তারা কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। কোমায় যাওয়া রোগীরাও অবশ্য আশার সলতে জ্বালিয়ে রাখেন। কিন্তু জামায়াতের সামনে যেন সেটুকুও নেই। পঞ্চম সংশোধনী আপিল বিভাগেও বাতিল হয়েছে। সেই ভরসায় আইনমন্ত্রী বলছেন, তারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা।
আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন রাখি, কী করে এমন নিশ্চিন্তে এ কথা বলছেন। আপিল বিভাগ তো পরিমার্জন বা মডিফিকেশনের কথা বলেছেন। এখন যদি তাঁরা হাইকোর্টের রায়ের এ অংশটি উল্টে দেন? আইনমন্ত্রী যুক্তি দেন, সেটা কেমন করে হবে? পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের মূলনীতি তো এর ওপর দাঁড়িয়ে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় প্রধানত দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। প্রথমত, সামরিক শাসন জারি অবৈধ। তাই সামরিক শাসকদের সৃষ্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংসদও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলাতে পারে না। উভয় যুক্তি আমরা মানি। কিন্তু হাইকোর্ট যোগ-বিয়োগের নীতি নিয়েছেন। কিছু বিষয় মার্জনা করেছেন। যেমন, জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানের ফসল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এই কাউন্সিল ব্যবস্থাটি তো সামরিক শাসনবান্ধব। তা ছাড়া এটি বিচারপতিদের প্রকারান্তরে সরকারি কর্মচারী বানিয়ে রেখেছে। সচিবদের বিরুদ্ধে তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন (স্যাংশন) লাগত ও লাগবে। বিচারকদের ক্ষেত্রেও লাগে।
হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষতার মতো অনেক শক্তিশালী ও দরকারি মৌলিক কাঠামো হলো ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে না লিখেও ধর্মনিরপেক্ষ বা মুক্ত সমাজ গঠন করা চলে। ভারত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখানে একটি পরিহাসও আছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে বিচারপতি সায়েম ধর্মভিত্তিক দল চালু করতে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ তুলে দেন। তখনো সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা টিকে ছিল। সেই বছরেই ভারত ৪২তম সংশোধনী আনে। এর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির সংযোজন ঘটে। সুতরাং, ২৯ বছর তারা ধর্মনিরপেক্ষ ‘না থেকেও’ ধর্মনিরপেক্ষ থেকেছে। বিজেপির জন্ম আরও চার বছর পর ১৯৮০ সালে। তারা প্রমাণ করেছে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেও ধর্মভিত্তিক দল সরকার গঠন করতে পারে।
সাধারণ আইন দিয়ে রাজনৈতিক দলের সংবিধান ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তা অবশ্যই সংবিধানে থাকতে হবে। প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা মার্কিন সংবিধানের মতো করে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকার কথা লিখে দিতে হবে। অথচ সরকারি দল ও তাদের ভক্তরা সভা-সেমিনারে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কীর্তন গাইছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার কথা বলে গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে তাঁদের মুখে যথারীতি কুলুপ আঁটা।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সংবিধানের ১০টি মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করেছেন। এতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার ঠাঁই দিয়েছেন সবশেষে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসকগোষ্ঠী হয়তো একটুও মাথা ঘামাত না, যদি হাইকোর্টের রায়ে একটি বিশেষ জাদুমন্ত্র না থাকত। এই জাদুমন্ত্রই হলো আকর্ষণ। এটা হলো ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ। এই শর্তাংশ হলো রাক্ষসের প্রাণসংহারী সেই কৌটা।
জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর প্রাণভোমরা লুকানো এই কৌটায়। হাইকোর্ট কৌটার সন্ধান দিয়েছেন। এখন আপিল বিভাগ সেই কৌটা খুলবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন। তাঁরা তা খুলে প্রাণভোমরা মারতে পারেন। মারলে জামায়াত বর্তমান রূপে লুপ্ত হবে। অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনও অচল হবে। তারা তখন অন্য রূপে আসবে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার জটিল পটভূমিতে সেই রূপটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য ভালো হবে কি না, সে প্রশ্ন খুব জোরালো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মী নিহত হলে মন্ত্রীদের শূন্যগর্ভ চিত্কার ও আস্ফাালন আমরা শুনেছি। এ রকম ঘটনার সময় তাদের শিবির নিষিদ্ধের কথা মনে পড়ে। কিন্তু খুন তো খুন। যে যেভাবে সন্ত্রাস করুক, তার বিচার হতে হবে। কিন্তু তা প্রায় কখনো হয় না। এখন আদালতকে দিয়ে কৌটা খুলিয়ে জামায়াতের সঙ্গে শিবির বধ করার স্বপ্ন দেখছে ক্ষমতাসীন দল। অথচ তারা ঠিকই ছাত্রদের ব্যবহার করে যাবে। ছাত্রলীগকে তারা সামলাবে না। অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করবে না।
জামায়াতের সঙ্গে রাজপথের ঐক্য গড়ে তোলা, কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করা এবং জিয়া বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক নামকরণেও ধর্মের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ব্যবহারে আমরা ক্ষমতাসীনদের ম্যাকিয়াভেলীয় চরিত্র দেখতে পাই। মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ বলেছে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।’ সম্ভবত সে কারণেই আইনমন্ত্রী আমার প্রশ্নের জবাবে মত দেন যে এ বিধানটি জেগে উঠলেই হলো। ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধ করতে সরকারকে নতুন কোনো আইন করতে হবে না। তবে প্রশ্ন হলো, বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্র, যারা রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অর্জন করেছে, তাদের সংবিধানে এমন বিধান কি রয়েছে? বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ রকম খাপ খোলা তলোয়ার দিয়ে কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির রাক্ষসপুরীকে স্তব্ধ করা সম্ভব? একটা গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা দিতে যদি শাসক দল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠত, বা তাকে বিশ্বাস করা যেত, তখন না হয় একটা সান্ত্বনা মিলত।
সরকারি দলের সংকীর্ণ মনমানসিকতার আরেকটি পরিচয় হলো, তারা সংবিধান সংশোধনে ভালো প্রস্তুতি নিতে অনিচ্ছুক। একটা প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণাও দেখেছি। সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ তৈরিতে আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন কমিশনের সদস্যরা হয়তো কিছু দিন আশায় ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, বিরাট বড় একটা দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু কোথায় কী। এ সবই শঠতা। জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া তাঁদের মাথায় অন্য চিন্তা নেই। থাকলেও তার প্রমাণ পাই না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ক্ষমতা পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, না রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা—এর মধ্যে কোনটি আগে চান? আমি বলব, সবটাই একসঙ্গে। যদি বলা হয়, কোথায় অগ্রাধিকার? তাহলে বলব, ক্ষমতা পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায়। জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বিরাট শূন্যতা চলছে। মাসদার হোসেন মামলার কারণে আমরা বিচার বিভাগ পৃথক্করণ শিখেছি। এখনো ক্ষমতার পৃথক্করণ শিখিনি। বিচারপতি খায়রুল হক বর্ণিত ১০টি মৌলিক কাঠামো কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেওয়ার বিষয়। আদালত যখন রাজনৈতিক প্রশ্নের সুরাহা দেন, তখন তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেন। তবে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসায় আদালতকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট পারতপক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে চলেন। ১৮৫৭ সালে বিখ্যাত ড্রেড স্কট মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট দাসপ্রথাকে বৈধতা দিয়েছিলেন। কোর্ট বলেছিলেন, দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করতে কংগ্রেসের আইন তৈরির ক্ষমতা নেই। সেই টাইটানিক ভুলের অনুশোচনা তারা আজও করছেন।
আমরা পঞ্চম সংশোধনীর রায়কে স্বাগত জানিয়েছি। কারণ, এতে যথার্থই জিয়া, সায়েম, মোশতাককে জবরদখলকারী বলা হয়েছে। সামরিক শাসনকে অবৈধ বলা হয়েছে। আমরা আশায় ছিলাম, সংবিধানে গণমুখী পরিবর্তন আনা হবে। বাহাত্তরে তো ফিরবই। ঘাটতিও দূর হবে। সোনিয়া গান্ধী সংসদে নারীর জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করছেন। রাজ্যসভায় বিল পাস হলো। বাংলাদেশে টুঁ শব্দ নেই। অথচ নারীর জন্য ১০০ আসন বাড়াতে স্পষ্ট নির্বাচনী ওয়াদা রয়েছে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, আদালতের রায় বাস্তবায়ন ছাড়া তারা আদৌ আর কিছু করবে কি না।
সংবিধানে তারা হাত দিতে পারে। কিন্তু দেখার বিষয়, তাতে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটছে কি না। প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস কিংবা নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ কোনোভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হচ্ছে কি না। এটা আদালত করে দেবে না। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ সংসদ যেকোনো সময় ফিরিয়ে আনতে পারে। এ জন্য গণভোটও লাগবে না। সাধারণ একটা আইন দিয়ে যা সম্ভব, তা আদালতকে দিয়ে কেন। আমার তো মনে হয়, সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৮ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক কাঠামো হিসেবে মান্য করা চলে। কিন্তু সেই কারণে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ মৌলিক কাঠামো বলে গণ্য হতে পারে কি না, তা তলিয়ে দেখার দাবি রাখে।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখার চেয়ে সংবিধানে ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটানো অনেক বেশি উপকারী ও আরাধ্য। এটা পেলে রাষ্ট্র গঠনের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। রাজনীতিতে কেবল ধর্মের অপব্যবহার কেন, কালো টাকা ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধেও তা খুব কাজে আসবে।
এর আগের একটি লেখায় আমি জিয়াকে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক লিখেছিলাম। ই-মেইলে একজন পাঠক তার কারণ জানতে চান। প্রথমত, বাকশাল বিলোপ সায়েম করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, বহুদলীয় গণতন্ত্র বলতে পাশ্চাত্যের বহুত্ব (প্লুরালিজম) বোঝানো হয়। সেই বহুত্ব একটি সমন্বিত ধারণা। এতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্বাধীন সংসদ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হবে। এসব না থাকলে বহুদলীয় গণতন্ত্র পানসে। চতুর্থ সংশোধনীতে আসে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। জিয়া একে সুরক্ষা দেন। তিনি তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি। সংসদের অনুমতি ছাড়া যত খুশি অর্থ খরচে সংবিধানে নতুন বিধান আনেন। বিচারপতি খায়রুল হকের কথায় এভাবে তিনি মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের জেমস ও চার্লসদের লজ্জায় ফেলেন। কারণ, সংসদকে পদানত করার এমন ক্ষমতা মধ্যযুগের ওই নৃপতিরাও ভোগ করেননি।
কিন্তু কথা হলো এখন কী চলছে? বহুদলীয় বা সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। আসলে এটা ছদ্মবেশী রাজতন্ত্র বা ‘কতিপয়তন্ত্রে’র কাজে লাগছে। বর্তমানে বাকশাল নেই ঠিকই। কিন্তু বাকশালের মতো একটি ব্যবস্থায় আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। মাতৃস্নেহে অন্ধ জননী তাঁর কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখতে পারেন। বাংলাদেশের শাসকেরা হলেন সেই স্বৈর-স্নেহান্ধ জননী। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর তাঁরা বলেছেন, এই নাও বহুদলীয় গণতন্ত্র। এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মোলাকাত হয়েছিল। তখন তারা বলেছে, এই নাও সংসদীয় গণতন্ত্র। দুটোই মস্তবড় ধাপ্পা ও শঠতাপূর্ণ।
জামায়াতের প্রসঙ্গ টেনে শেষ করি। আদালত যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর দোহাই দেন, সরকারি দলের আপাতত কৌশলগত পছন্দনীয় বিষয় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেন, কিংবা তা না করলেও তাঁরা যেন সংবিধানের অধিক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাঠামোবিনাশী বিষয়গুলোর দিকে সদয় হন। তাঁরা যেন শাসকগোষ্ঠীর ভীষণ পছন্দনীয় ব্যবস্থা, যেমন—অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলোপ করে মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো ফিরিয়ে দেন। ডেনমার্কের রাজপুত্র ছাড়া হ্যামলেট মঞ্চায়ন সম্ভব নয়। চতুর্থ সংশোধনীতে মৌলিক কাঠামোর ধ্বংসযজ্ঞ পাশ কাটিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরাও সম্ভব নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
আইন ও বিচারমন্ত্রী শফিক আহমেদের বক্তব্য বেশ ধারালো। এটা বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, জামায়াত ইতিমধ্যে কোমায় চলে গেছে। এখন তারা কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। কোমায় যাওয়া রোগীরাও অবশ্য আশার সলতে জ্বালিয়ে রাখেন। কিন্তু জামায়াতের সামনে যেন সেটুকুও নেই। পঞ্চম সংশোধনী আপিল বিভাগেও বাতিল হয়েছে। সেই ভরসায় আইনমন্ত্রী বলছেন, তারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা।
আইনমন্ত্রীকে প্রশ্ন রাখি, কী করে এমন নিশ্চিন্তে এ কথা বলছেন। আপিল বিভাগ তো পরিমার্জন বা মডিফিকেশনের কথা বলেছেন। এখন যদি তাঁরা হাইকোর্টের রায়ের এ অংশটি উল্টে দেন? আইনমন্ত্রী যুক্তি দেন, সেটা কেমন করে হবে? পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ের মূলনীতি তো এর ওপর দাঁড়িয়ে। পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায় প্রধানত দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। প্রথমত, সামরিক শাসন জারি অবৈধ। তাই সামরিক শাসকদের সৃষ্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংসদও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদলাতে পারে না। উভয় যুক্তি আমরা মানি। কিন্তু হাইকোর্ট যোগ-বিয়োগের নীতি নিয়েছেন। কিছু বিষয় মার্জনা করেছেন। যেমন, জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানের ফসল সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এই কাউন্সিল ব্যবস্থাটি তো সামরিক শাসনবান্ধব। তা ছাড়া এটি বিচারপতিদের প্রকারান্তরে সরকারি কর্মচারী বানিয়ে রেখেছে। সচিবদের বিরুদ্ধে তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন (স্যাংশন) লাগত ও লাগবে। বিচারকদের ক্ষেত্রেও লাগে।
হাইকোর্টের রায়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে ক্ষমতার পৃথক্করণ (সেপারেশন অব পাওয়ার) ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষতার মতো অনেক শক্তিশালী ও দরকারি মৌলিক কাঠামো হলো ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে না লিখেও ধর্মনিরপেক্ষ বা মুক্ত সমাজ গঠন করা চলে। ভারত তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখানে একটি পরিহাসও আছে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে বিচারপতি সায়েম ধর্মভিত্তিক দল চালু করতে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ তুলে দেন। তখনো সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা টিকে ছিল। সেই বছরেই ভারত ৪২তম সংশোধনী আনে। এর মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির সংযোজন ঘটে। সুতরাং, ২৯ বছর তারা ধর্মনিরপেক্ষ ‘না থেকেও’ ধর্মনিরপেক্ষ থেকেছে। বিজেপির জন্ম আরও চার বছর পর ১৯৮০ সালে। তারা প্রমাণ করেছে, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেও ধর্মভিত্তিক দল সরকার গঠন করতে পারে।
সাধারণ আইন দিয়ে রাজনৈতিক দলের সংবিধান ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তা অবশ্যই সংবিধানে থাকতে হবে। প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা মার্কিন সংবিধানের মতো করে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকার কথা লিখে দিতে হবে। অথচ সরকারি দল ও তাদের ভক্তরা সভা-সেমিনারে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কীর্তন গাইছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার কথা বলে গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে তাঁদের মুখে যথারীতি কুলুপ আঁটা।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সংবিধানের ১০টি মৌলিক কাঠামো চিহ্নিত করেছেন। এতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার ঠাঁই দিয়েছেন সবশেষে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসকগোষ্ঠী হয়তো একটুও মাথা ঘামাত না, যদি হাইকোর্টের রায়ে একটি বিশেষ জাদুমন্ত্র না থাকত। এই জাদুমন্ত্রই হলো আকর্ষণ। এটা হলো ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ। এই শর্তাংশ হলো রাক্ষসের প্রাণসংহারী সেই কৌটা।
জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর প্রাণভোমরা লুকানো এই কৌটায়। হাইকোর্ট কৌটার সন্ধান দিয়েছেন। এখন আপিল বিভাগ সেই কৌটা খুলবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন। তাঁরা তা খুলে প্রাণভোমরা মারতে পারেন। মারলে জামায়াত বর্তমান রূপে লুপ্ত হবে। অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনও অচল হবে। তারা তখন অন্য রূপে আসবে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলার জটিল পটভূমিতে সেই রূপটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য ভালো হবে কি না, সে প্রশ্ন খুব জোরালো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মী নিহত হলে মন্ত্রীদের শূন্যগর্ভ চিত্কার ও আস্ফাালন আমরা শুনেছি। এ রকম ঘটনার সময় তাদের শিবির নিষিদ্ধের কথা মনে পড়ে। কিন্তু খুন তো খুন। যে যেভাবে সন্ত্রাস করুক, তার বিচার হতে হবে। কিন্তু তা প্রায় কখনো হয় না। এখন আদালতকে দিয়ে কৌটা খুলিয়ে জামায়াতের সঙ্গে শিবির বধ করার স্বপ্ন দেখছে ক্ষমতাসীন দল। অথচ তারা ঠিকই ছাত্রদের ব্যবহার করে যাবে। ছাত্রলীগকে তারা সামলাবে না। অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করবে না।
জামায়াতের সঙ্গে রাজপথের ঐক্য গড়ে তোলা, কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করা এবং জিয়া বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক নামকরণেও ধর্মের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক ব্যবহারে আমরা ক্ষমতাসীনদের ম্যাকিয়াভেলীয় চরিত্র দেখতে পাই। মূল সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ বলেছে, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনো প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।’ সম্ভবত সে কারণেই আইনমন্ত্রী আমার প্রশ্নের জবাবে মত দেন যে এ বিধানটি জেগে উঠলেই হলো। ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধ করতে সরকারকে নতুন কোনো আইন করতে হবে না। তবে প্রশ্ন হলো, বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্র, যারা রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অর্জন করেছে, তাদের সংবিধানে এমন বিধান কি রয়েছে? বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ রকম খাপ খোলা তলোয়ার দিয়ে কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির রাক্ষসপুরীকে স্তব্ধ করা সম্ভব? একটা গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা দিতে যদি শাসক দল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠত, বা তাকে বিশ্বাস করা যেত, তখন না হয় একটা সান্ত্বনা মিলত।
সরকারি দলের সংকীর্ণ মনমানসিকতার আরেকটি পরিচয় হলো, তারা সংবিধান সংশোধনে ভালো প্রস্তুতি নিতে অনিচ্ছুক। একটা প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণাও দেখেছি। সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ তৈরিতে আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন কমিশনের সদস্যরা হয়তো কিছু দিন আশায় ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, বিরাট বড় একটা দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু কোথায় কী। এ সবই শঠতা। জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া তাঁদের মাথায় অন্য চিন্তা নেই। থাকলেও তার প্রমাণ পাই না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন, ক্ষমতা পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, না রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা—এর মধ্যে কোনটি আগে চান? আমি বলব, সবটাই একসঙ্গে। যদি বলা হয়, কোথায় অগ্রাধিকার? তাহলে বলব, ক্ষমতা পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায়। জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বিরাট শূন্যতা চলছে। মাসদার হোসেন মামলার কারণে আমরা বিচার বিভাগ পৃথক্করণ শিখেছি। এখনো ক্ষমতার পৃথক্করণ শিখিনি। বিচারপতি খায়রুল হক বর্ণিত ১০টি মৌলিক কাঠামো কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নেওয়ার বিষয়। আদালত যখন রাজনৈতিক প্রশ্নের সুরাহা দেন, তখন তাঁরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেন। তবে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসায় আদালতকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট পারতপক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে চলেন। ১৮৫৭ সালে বিখ্যাত ড্রেড স্কট মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট দাসপ্রথাকে বৈধতা দিয়েছিলেন। কোর্ট বলেছিলেন, দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করতে কংগ্রেসের আইন তৈরির ক্ষমতা নেই। সেই টাইটানিক ভুলের অনুশোচনা তারা আজও করছেন।
আমরা পঞ্চম সংশোধনীর রায়কে স্বাগত জানিয়েছি। কারণ, এতে যথার্থই জিয়া, সায়েম, মোশতাককে জবরদখলকারী বলা হয়েছে। সামরিক শাসনকে অবৈধ বলা হয়েছে। আমরা আশায় ছিলাম, সংবিধানে গণমুখী পরিবর্তন আনা হবে। বাহাত্তরে তো ফিরবই। ঘাটতিও দূর হবে। সোনিয়া গান্ধী সংসদে নারীর জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করছেন। রাজ্যসভায় বিল পাস হলো। বাংলাদেশে টুঁ শব্দ নেই। অথচ নারীর জন্য ১০০ আসন বাড়াতে স্পষ্ট নির্বাচনী ওয়াদা রয়েছে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, আদালতের রায় বাস্তবায়ন ছাড়া তারা আদৌ আর কিছু করবে কি না।
সংবিধানে তারা হাত দিতে পারে। কিন্তু দেখার বিষয়, তাতে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটছে কি না। প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস কিংবা নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ কোনোভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হচ্ছে কি না। এটা আদালত করে দেবে না। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ সংসদ যেকোনো সময় ফিরিয়ে আনতে পারে। এ জন্য গণভোটও লাগবে না। সাধারণ একটা আইন দিয়ে যা সম্ভব, তা আদালতকে দিয়ে কেন। আমার তো মনে হয়, সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৮ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক কাঠামো হিসেবে মান্য করা চলে। কিন্তু সেই কারণে ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ মৌলিক কাঠামো বলে গণ্য হতে পারে কি না, তা তলিয়ে দেখার দাবি রাখে।
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখার চেয়ে সংবিধানে ক্ষমতার পৃথক্করণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটানো অনেক বেশি উপকারী ও আরাধ্য। এটা পেলে রাষ্ট্র গঠনের কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। রাজনীতিতে কেবল ধর্মের অপব্যবহার কেন, কালো টাকা ও ক্ষমতার অপব্যবহার রোধেও তা খুব কাজে আসবে।
এর আগের একটি লেখায় আমি জিয়াকে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক লিখেছিলাম। ই-মেইলে একজন পাঠক তার কারণ জানতে চান। প্রথমত, বাকশাল বিলোপ সায়েম করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, বহুদলীয় গণতন্ত্র বলতে পাশ্চাত্যের বহুত্ব (প্লুরালিজম) বোঝানো হয়। সেই বহুত্ব একটি সমন্বিত ধারণা। এতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্বাধীন সংসদ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হবে। এসব না থাকলে বহুদলীয় গণতন্ত্র পানসে। চতুর্থ সংশোধনীতে আসে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। জিয়া একে সুরক্ষা দেন। তিনি তাতেই ক্ষান্ত থাকেননি। সংসদের অনুমতি ছাড়া যত খুশি অর্থ খরচে সংবিধানে নতুন বিধান আনেন। বিচারপতি খায়রুল হকের কথায় এভাবে তিনি মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের জেমস ও চার্লসদের লজ্জায় ফেলেন। কারণ, সংসদকে পদানত করার এমন ক্ষমতা মধ্যযুগের ওই নৃপতিরাও ভোগ করেননি।
কিন্তু কথা হলো এখন কী চলছে? বহুদলীয় বা সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। আসলে এটা ছদ্মবেশী রাজতন্ত্র বা ‘কতিপয়তন্ত্রে’র কাজে লাগছে। বর্তমানে বাকশাল নেই ঠিকই। কিন্তু বাকশালের মতো একটি ব্যবস্থায় আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। মাতৃস্নেহে অন্ধ জননী তাঁর কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখতে পারেন। বাংলাদেশের শাসকেরা হলেন সেই স্বৈর-স্নেহান্ধ জননী। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর তাঁরা বলেছেন, এই নাও বহুদলীয় গণতন্ত্র। এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মোলাকাত হয়েছিল। তখন তারা বলেছে, এই নাও সংসদীয় গণতন্ত্র। দুটোই মস্তবড় ধাপ্পা ও শঠতাপূর্ণ।
জামায়াতের প্রসঙ্গ টেনে শেষ করি। আদালত যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর দোহাই দেন, সরকারি দলের আপাতত কৌশলগত পছন্দনীয় বিষয় জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করেন, কিংবা তা না করলেও তাঁরা যেন সংবিধানের অধিক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাঠামোবিনাশী বিষয়গুলোর দিকে সদয় হন। তাঁরা যেন শাসকগোষ্ঠীর ভীষণ পছন্দনীয় ব্যবস্থা, যেমন—অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলোপ করে মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো ফিরিয়ে দেন। ডেনমার্কের রাজপুত্র ছাড়া হ্যামলেট মঞ্চায়ন সম্ভব নয়। চতুর্থ সংশোধনীতে মৌলিক কাঠামোর ধ্বংসযজ্ঞ পাশ কাটিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরাও সম্ভব নয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments