আওয়ামী লীগ-বিএনপি একমত হতে পারবে কি -যুদ্ধাপরাধের বিচার by সোহরাব হাসান
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পরে হলেও সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, কতিপয় মতলববাজ ও অপরাধী ছাড়া সবাই তাকে স্বাগত জানিয়েছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত। কোন সরকারের আমলে বিচার হচ্ছে, এর চেয়েও জরুরি হলো বিচারটি কেমন হবে, প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি না, দেশে-বিদেশে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে কি না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার যে বিচার হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে অনেকের তা পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু বিচারের বিরোধিতা করতে পারেননি। কারণ বিচার-প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। বিচার হয়েছে প্রচলিত আইনে, আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন। যে কারণে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদও বলতে বাধ্য হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারকে শুরু থেকে একটি বিশেষ মহল প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ যে অমূলক, সেটি প্রমাণ করতেই সরকারকে এগোতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও দেশবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, বিচার-প্রক্রিয়া শতভাগ আন্তর্জাতিক মানের হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করার জন্য বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয়, বিএনপিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়।’
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, ‘যদি সত্যিকার অপরাধীদের নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হয়, আর যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়রানি না করা হয়, তাহলে তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই সমর্থন করবে। সরকার যদি সত্যিকার তদন্ত করে, তাহলে আমাদের আপত্তির কোনো কারণ নেই।’ দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিএনপির আপত্তি নেই, তবে এ বিচার-প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ।’ কিন্তু তাদের কথা ও কাজে মিল থাকবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চট্টগ্রামে বেগম খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদের পক্ষে যেভাবে সাফাই গেয়েছেন, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারিনা।
রাজনৈতিক মত ও পথ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিরোধ থাকা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, বিএনপি মুসলিম চেতনার মোড়কে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। আওয়ামী লীগ মুখে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, ধর্মনিরপেক্ষতা বিএনপির একদম অপছন্দ। এসবের পরও কিছু বিষয়ে তো দুটি দলের মধ্যে মতৈক্য থাকা প্রয়োজন, যদি তারা গণতান্ত্রিক হয়, যদি তারা দলের চেয়ে দেশকে বড় মনে করে। সেগুলো হলো—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও নাগরিকদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ইত্যাদি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ন্যায় ও মানবাধিকারেরই অংশ। নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকুক বা না থাকুক, কোনো গণতান্ত্রিক দলই এ প্রত্যয় থেকে সরে যেতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দলীয় রাজনীতি কাম্য হতে পারে না। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আট ধরনের অপরাধকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে: নিরস্ত্র ও বেসামরিক নাগরিককে হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বন্দীর ওপর নির্যাতন চালানো এবং বিপক্ষের হয়ে তাকে অস্ত্র ধারণে বাধ্য করা।
কথা হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। অবশ্যই হয়েছে। কারা করেছে? দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরেরা। আরও খোলাসা করে বললে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যরা। কেউ সরাসরি এসব অপরাধ করেছে, কেউ প্ররোচিত করেছে। দুই পক্ষই অপরাধী।
যুদ্ধাপরাধ যত পুরোনো হোক না কেন, অপরাধী যে দেশেই থাকুক না কেন, তার বিচারে বাধা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ৬৫ বছর হলো। এখনো নািস বাহিনীর সদস্যদের বিচার হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ৯০ বছর বয়সী এক নািস সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার হচ্ছে কম্বোডিয়ার পলপট সমর্থকদের। বিচার হচ্ছে সার্বীয় বাহিনীর সদস্যদের। বিচার চলাকালে মারা গেছেন সার্বীয় নেতা মিলোসেভিচ। তাঁর সহযোগীরা এখনো বিচারের সম্মুখীন।
সে ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া খুবই জরুরি। একই সঙ্গে এ প্রশ্নও আসবে, বিচারটি এত দিন কেন হলো না? যুদ্ধাপরাধের বিচারের দায় কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়, সমগ্র জাতির। সে দায়িত্ব পালনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ ব্যর্থতা অকপটে স্বীকার করতে হবে। রাজাকার, আলবদররাও বিচার ঠেকিয়ে রাখেনি। সে ক্ষমতাও তাদের নেই। ঠেকিয়ে রেখেছে পূর্বাপর সরকার ও বিভেদের রাজনীতি। অনেকে বলবেন, জিয়াউর রহমানই প্রথম স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। পুনর্বাসন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। সে সময় ধর্মবাদী কোনো দলের অস্তিত্ব না থাকলেও সে সব দলের নেতা-কর্মীরা ঠিকই ছিলেন। তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়েন। এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী জাসদ মাওলানা মতিনের মতো স্বাধীনতাবিরোধীকে দলে নিয়েছিল এবং নির্বাচনেও প্রার্থী করেছিল।
যদ্ধাপরাধের বিচার অত্যন্ত জটিল বিষয়। বাংলাদেশের জন্য এটি নতুনও বটে। আওয়ামী লীগ সরকার বিচারটি শুরু করেছে, এ জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু যদি তারা বিচার কাজটি শেষ করে যেতে না পারে, তাহলে কী হবে? আগামী নির্বাচনে যদি তারা ক্ষমতায় না আসতে পারে? বিএনপি এসে সব কিছু উল্টে দেবে? কি এত উদ্যোগ-আয়োজন, এত আবেগ-উচ্ছ্বাস, এত কান্না আর অশ্রু—সব বিফলে যাবে? এ কারণেই আমরা চাই, রাজনীতির মঞ্চে যত বিভেদই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব গণতান্ত্রিক দল অন্তত একটি বিষয়ে একমত হোক, তা হর যুদ্ধাপরাধের বিচার । উত্তম হতো, সরকারের এ উদ্যোগকে যদি বিএনপি স্বেচ্ছায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিত। সে কাজটি তারা করেনি বলে সরকার কেন দরজা বন্ধ করে রাখবে? বিএনপি ক্রমশ ডান দিকে ঝুঁকে পড়লেও দলটিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সরকার তাঁদের সহায়তা নেবে না কেন?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে সরকার হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের আদালত গঠন করেছে। নিয়োগ দিয়েছে সাত সদস্যের তদন্তকারী দল এবং ১২ সদস্যের আইনজীবী প্যানেল। সর্বস্তরের মানুষ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন, এটি সরকারের প্রধান শক্তি। পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে জরুরি অকাট্য তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্য। রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিচারের কাজ খুব এগোবে না। ধারণা করা যাচ্ছে, সরকার দ্বিতীয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য বিমানবন্দর ও সীমান্তে স্থলবন্দরের বহির্গমন বিভাগে তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সরকার তালিকা পাঠানোর আগেই ঢাকা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে উষ্ণ বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন এক সন্দেহভাজন ব্যক্তি, একাত্তরে যাঁর বিরুদ্ধে বহু হত্যা-অপকর্মের অভিযোগ ছিল।
বিচার-প্রক্রিয়াকে রাখতে হবে সব রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। এ কথাগুলো বললাম এ জন্য যে, স্বাধীনতার পরও দালাল আইনে বিচার নিয়ে নানা রকম বুজরুকি কাণ্ড ঘটেছে। বাঘা বাঘা দালালকে বাদ দিয়ে চিকন আলীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য নানা কসরত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চিকন আলীও ছাড়া পেয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে বিচার হয়েছে নামকাওয়াস্তে। নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে কে কী করেছেন, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত আছেন কি নেই, বিচারে সেসব বিবেচ্য হতে পারে না। সেটি রাজনীতির বিচার। আদালতে বিচার হবে একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের ভিত্তিতে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে মন্ত্রীরাও ওলটপালট কথাবার্তা বলে চলেছেন। কেউ বলছেন, সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে না, প্রতীকী বিচার হবে। কেউ বলছেন, অমুক দলকে দেশ থেকে নির্মূল করতে হবে। কাউকে নির্মূল করতে চাইলে সেও নিশ্চয় বসে থাকবেনা। দন্ড হোক আদালতে, মন্ত্রী-নেতাদের বাক্যবানে নয়। বিচারের এখতিয়ার ঠিক করবে আদালত। তদন্ত করবে রাষ্ট্র-নিয়োজিত তদন্তকারী দল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নতুন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ। ১৯৭২-৭৫ সালে দালাল আইনে যাদের বিচার হয়েছে, সেটি দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইন প্রণয়ন করা হলেও এর ভিত্তিতে বিচার হয়নি। দালাল আইনে নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত অনেকেই উচ্চ আদালতে গিয়ে খালাস পেয়েছিলেন। এবার যুদ্ধাপরাধের বিচারে কোনো রকম ত্রুটি বা অসংগতি রাখা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির মামলাগুলো উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে তাঁরা সব ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন বলে নয়, মামলার প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে। যেখানে একজন আসামির বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা, সেখানে তদন্তকারী কর্মকর্তা দিয়েছেন ৯৫ বা ১০০ দিনে। এ কারণে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় না যে অভিযুক্ত নিরপরাধ। যুদ্ধাপরাধ বিচারে তদন্তকারী দল ও আইনজীবীরা বিষয়গুলোর প্রতি সুতীক্ষ দৃষ্টি রাখবেন আশা করি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলেই মনে করি। কিন্তু তাঁদের মনে কী আছে আল্লাহ মালুম। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেছেন। বিএনপির নেতারা বিচার-প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার দাবি জানিয়েছেন। দুই তরফের কথাতেই যুক্তি আছে। এ যুক্তিই হতে পারে ঐকমত্যের ভিত্তি। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করলেও দলের সবাই তাদের রাজনৈতিক দর্শনে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছেন বলা যাবে না। বিএনপিতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা নেতা-কর্মীরাও রাজাকার হয়ে যাননি। এ কারণেই দলের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে মীর শওকত আলী সেক্টর কমান্ডারস ফোরামে যুক্ত হয়েছেন। বিএনপিতে তার মত ভিন্ন মতের লোকও কম নেই। তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা চালাতে হবে। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার শুরুতে বিএনপিও সমর্থন জানিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার রাজনীতির মেরুকরণের নামে তারা সে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। আশা করি এবার যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে একই ভুল তারা করবে না।
যুদ্ধাপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। নিজের দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ। এই অপরাধের বিচার হওয়া দরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকেরা ব্যর্থ হলে, পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদে বিচার প্রলম্বিত কিংবা বানচাল হলে, জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। অন্তত এই একটি বিষয়ে আপনারা একমত হোন। আদালতের বিভক্ত রায় কখনও কখনও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করলেও বিভক্ত জাতি কখনও জয়ী হতে পারেনা।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বঙ্গবন্ধু হত্যার যে বিচার হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে অনেকের তা পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু বিচারের বিরোধিতা করতে পারেননি। কারণ বিচার-প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বচ্ছতা ছিল না। বিচার হয়েছে প্রচলিত আইনে, আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছেন। যে কারণে বিএনপির নেতা মওদুদ আহমদও বলতে বাধ্য হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারকে শুরু থেকে একটি বিশেষ মহল প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। রাজনৈতিক হয়রানির অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ যে অমূলক, সেটি প্রমাণ করতেই সরকারকে এগোতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও দেশবাসীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, বিচার-প্রক্রিয়া শতভাগ আন্তর্জাতিক মানের হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করার জন্য বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, ‘আমার তো মনে হয়, বিএনপিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়।’
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, ‘যদি সত্যিকার অপরাধীদের নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হয়, আর যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়রানি না করা হয়, তাহলে তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই সমর্থন করবে। সরকার যদি সত্যিকার তদন্ত করে, তাহলে আমাদের আপত্তির কোনো কারণ নেই।’ দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিএনপির আপত্তি নেই, তবে এ বিচার-প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ।’ কিন্তু তাদের কথা ও কাজে মিল থাকবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চট্টগ্রামে বেগম খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদের পক্ষে যেভাবে সাফাই গেয়েছেন, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারিনা।
রাজনৈতিক মত ও পথ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিরোধ থাকা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, বিএনপি মুসলিম চেতনার মোড়কে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। আওয়ামী লীগ মুখে হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে, ধর্মনিরপেক্ষতা বিএনপির একদম অপছন্দ। এসবের পরও কিছু বিষয়ে তো দুটি দলের মধ্যে মতৈক্য থাকা প্রয়োজন, যদি তারা গণতান্ত্রিক হয়, যদি তারা দলের চেয়ে দেশকে বড় মনে করে। সেগুলো হলো—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও নাগরিকদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ইত্যাদি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার ন্যায় ও মানবাধিকারেরই অংশ। নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকুক বা না থাকুক, কোনো গণতান্ত্রিক দলই এ প্রত্যয় থেকে সরে যেতে পারে না।
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দলীয় রাজনীতি কাম্য হতে পারে না। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আট ধরনের অপরাধকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে: নিরস্ত্র ও বেসামরিক নাগরিককে হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, বন্দীর ওপর নির্যাতন চালানো এবং বিপক্ষের হয়ে তাকে অস্ত্র ধারণে বাধ্য করা।
কথা হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। অবশ্যই হয়েছে। কারা করেছে? দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরেরা। আরও খোলাসা করে বললে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্যরা। কেউ সরাসরি এসব অপরাধ করেছে, কেউ প্ররোচিত করেছে। দুই পক্ষই অপরাধী।
যুদ্ধাপরাধ যত পুরোনো হোক না কেন, অপরাধী যে দেশেই থাকুক না কেন, তার বিচারে বাধা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ৬৫ বছর হলো। এখনো নািস বাহিনীর সদস্যদের বিচার হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ৯০ বছর বয়সী এক নািস সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার হচ্ছে কম্বোডিয়ার পলপট সমর্থকদের। বিচার হচ্ছে সার্বীয় বাহিনীর সদস্যদের। বিচার চলাকালে মারা গেছেন সার্বীয় নেতা মিলোসেভিচ। তাঁর সহযোগীরা এখনো বিচারের সম্মুখীন।
সে ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া খুবই জরুরি। একই সঙ্গে এ প্রশ্নও আসবে, বিচারটি এত দিন কেন হলো না? যুদ্ধাপরাধের বিচারের দায় কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়, সমগ্র জাতির। সে দায়িত্ব পালনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ ব্যর্থতা অকপটে স্বীকার করতে হবে। রাজাকার, আলবদররাও বিচার ঠেকিয়ে রাখেনি। সে ক্ষমতাও তাদের নেই। ঠেকিয়ে রেখেছে পূর্বাপর সরকার ও বিভেদের রাজনীতি। অনেকে বলবেন, জিয়াউর রহমানই প্রথম স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছেন। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। পুনর্বাসন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। সে সময় ধর্মবাদী কোনো দলের অস্তিত্ব না থাকলেও সে সব দলের নেতা-কর্মীরা ঠিকই ছিলেন। তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়েন। এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী জাসদ মাওলানা মতিনের মতো স্বাধীনতাবিরোধীকে দলে নিয়েছিল এবং নির্বাচনেও প্রার্থী করেছিল।
যদ্ধাপরাধের বিচার অত্যন্ত জটিল বিষয়। বাংলাদেশের জন্য এটি নতুনও বটে। আওয়ামী লীগ সরকার বিচারটি শুরু করেছে, এ জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু যদি তারা বিচার কাজটি শেষ করে যেতে না পারে, তাহলে কী হবে? আগামী নির্বাচনে যদি তারা ক্ষমতায় না আসতে পারে? বিএনপি এসে সব কিছু উল্টে দেবে? কি এত উদ্যোগ-আয়োজন, এত আবেগ-উচ্ছ্বাস, এত কান্না আর অশ্রু—সব বিফলে যাবে? এ কারণেই আমরা চাই, রাজনীতির মঞ্চে যত বিভেদই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব গণতান্ত্রিক দল অন্তত একটি বিষয়ে একমত হোক, তা হর যুদ্ধাপরাধের বিচার । উত্তম হতো, সরকারের এ উদ্যোগকে যদি বিএনপি স্বেচ্ছায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিত। সে কাজটি তারা করেনি বলে সরকার কেন দরজা বন্ধ করে রাখবে? বিএনপি ক্রমশ ডান দিকে ঝুঁকে পড়লেও দলটিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সরকার তাঁদের সহায়তা নেবে না কেন?
যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে সরকার হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যের আদালত গঠন করেছে। নিয়োগ দিয়েছে সাত সদস্যের তদন্তকারী দল এবং ১২ সদস্যের আইনজীবী প্যানেল। সর্বস্তরের মানুষ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন, এটি সরকারের প্রধান শক্তি। পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে জরুরি অকাট্য তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্য। রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিচারের কাজ খুব এগোবে না। ধারণা করা যাচ্ছে, সরকার দ্বিতীয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে, সে জন্য বিমানবন্দর ও সীমান্তে স্থলবন্দরের বহির্গমন বিভাগে তালিকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সরকার তালিকা পাঠানোর আগেই ঢাকা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে উষ্ণ বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন এক সন্দেহভাজন ব্যক্তি, একাত্তরে যাঁর বিরুদ্ধে বহু হত্যা-অপকর্মের অভিযোগ ছিল।
বিচার-প্রক্রিয়াকে রাখতে হবে সব রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আইন সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। এ কথাগুলো বললাম এ জন্য যে, স্বাধীনতার পরও দালাল আইনে বিচার নিয়ে নানা রকম বুজরুকি কাণ্ড ঘটেছে। বাঘা বাঘা দালালকে বাদ দিয়ে চিকন আলীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য নানা কসরত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চিকন আলীও ছাড়া পেয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে বিচার হয়েছে নামকাওয়াস্তে। নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে কে কী করেছেন, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত আছেন কি নেই, বিচারে সেসব বিবেচ্য হতে পারে না। সেটি রাজনীতির বিচার। আদালতে বিচার হবে একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের ভিত্তিতে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে মন্ত্রীরাও ওলটপালট কথাবার্তা বলে চলেছেন। কেউ বলছেন, সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে না, প্রতীকী বিচার হবে। কেউ বলছেন, অমুক দলকে দেশ থেকে নির্মূল করতে হবে। কাউকে নির্মূল করতে চাইলে সেও নিশ্চয় বসে থাকবেনা। দন্ড হোক আদালতে, মন্ত্রী-নেতাদের বাক্যবানে নয়। বিচারের এখতিয়ার ঠিক করবে আদালত। তদন্ত করবে রাষ্ট্র-নিয়োজিত তদন্তকারী দল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নতুন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ। ১৯৭২-৭৫ সালে দালাল আইনে যাদের বিচার হয়েছে, সেটি দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে। যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়নি। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইন প্রণয়ন করা হলেও এর ভিত্তিতে বিচার হয়নি। দালাল আইনে নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত অনেকেই উচ্চ আদালতে গিয়ে খালাস পেয়েছিলেন। এবার যুদ্ধাপরাধের বিচারে কোনো রকম ত্রুটি বা অসংগতি রাখা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির মামলাগুলো উচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে গেছে তাঁরা সব ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন বলে নয়, মামলার প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে। যেখানে একজন আসামির বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার কথা, সেখানে তদন্তকারী কর্মকর্তা দিয়েছেন ৯৫ বা ১০০ দিনে। এ কারণে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় না যে অভিযুক্ত নিরপরাধ। যুদ্ধাপরাধ বিচারে তদন্তকারী দল ও আইনজীবীরা বিষয়গুলোর প্রতি সুতীক্ষ দৃষ্টি রাখবেন আশা করি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলেই মনে করি। কিন্তু তাঁদের মনে কী আছে আল্লাহ মালুম। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেছেন। বিএনপির নেতারা বিচার-প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার দাবি জানিয়েছেন। দুই তরফের কথাতেই যুক্তি আছে। এ যুক্তিই হতে পারে ঐকমত্যের ভিত্তি। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করলেও দলের সবাই তাদের রাজনৈতিক দর্শনে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছেন বলা যাবে না। বিএনপিতে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা নেতা-কর্মীরাও রাজাকার হয়ে যাননি। এ কারণেই দলের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে মীর শওকত আলী সেক্টর কমান্ডারস ফোরামে যুক্ত হয়েছেন। বিএনপিতে তার মত ভিন্ন মতের লোকও কম নেই। তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা চালাতে হবে। ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার শুরুতে বিএনপিও সমর্থন জানিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার রাজনীতির মেরুকরণের নামে তারা সে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। আশা করি এবার যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করে একই ভুল তারা করবে না।
যুদ্ধাপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। নিজের দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ। এই অপরাধের বিচার হওয়া দরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকেরা ব্যর্থ হলে, পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদে বিচার প্রলম্বিত কিংবা বানচাল হলে, জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। অন্তত এই একটি বিষয়ে আপনারা একমত হোন। আদালতের বিভক্ত রায় কখনও কখনও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করলেও বিভক্ত জাতি কখনও জয়ী হতে পারেনা।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments