রাজায় যা বোঝে রাখালেও তা বোঝে -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যখন ছোট ছিলাম, আমাদের বাড়িতে এক জ্ঞানবৃদ্ধ আসতেন। দু-চার দিন থাকতেন। আবার অনেক দিনের জন্য উধাও হতেন। বোধ হয় পারিবারিক কোনো বন্ধন তাঁর ছিল না। তাঁর বিদ্যাও বিশেষ ছিল না—বিত্ত তো নয়ই। কিন্তু তাঁর কথাবার্তা ছিল খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। কথায় কথায় প্রাচীনকালের বাঙালি জ্ঞানীদের অনেক প্রবচন তিনি পুনঃপ্রচার করতেন। যেমন একদিন কী প্রসঙ্গে আমার বাবাকে বলছিলেন, ‘রাজায় যা বোঝে রাখালেও তা বোঝে।’ তাঁর ওই কথাটি আমার মনে খুব ধরেছিল। তাই এত কাল পরও তা মনে আছে।
এই যে রাজা ও রাখালের বোঝার বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তা মহাজাগতিক কোনো রহস্য নয়, দর্শনতত্ত্ব নয়, গ্রহ-নক্ষত্রবিষয়ক কোনো জ্যোতির্বিদ্যাও নয়। স্রেফ জগত্-সংসার বা রাজ্যের ভালো-মন্দের ব্যাপার। যে যুগের কোনো জ্ঞানী এই প্রবচনের প্রবর্তক, সে সময়টি ছিল রাজতন্ত্রের। রাজ্য শাসন করতেন রাজা। রাখাল বলতে খুব নগণ্য প্রজাকে বোঝানো হয়েছে, যার বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় নিতান্ত কম।
আমরা এখন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। গণতন্ত্রে নাগরিকদের আক্কেলবুদ্ধিকে অবহেলা করার উপায় নেই। কারণ, যে নাগরিক তার রায়ের দ্বারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে এবং কাউকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে—তার ক্ষমতা কম কিসে। সে যে কিছুই বোঝে না, তা নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা যা বোঝেন, একজন সাধারণ নাগরিকও তা-ই বোঝে। একজন ফিকশন বা কল্পকাহিনির লেখক যা বোঝেন, হয়তো একজন কলাম লেখক তাঁর চেয়ে সামান্য কম বোঝেন। অর্থাৎ সবাই কমবেশি বোঝেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা, শীর্ষ আমলা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাটক ও সংগীতজগতের স্বনামধন্যরা, সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় লেখকেরা দেশের ভালো-মন্দ ও ভবিষ্যত্ নিয়ে যা বোঝেন, সাধারণ নাগরিকেরাও যে তা বোঝে না, তা নয়। পিলখানার পাশবিকতার কারণ ও পরিণতি নিয়ে বিডিআরের মহাপরিচালকের বোঝাই পরম বোঝা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর বিবেচনা আরও মূল্যবান। কিন্তু ওই বর্বরতায় যে সেনা কর্মকর্তা অথবা বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছেন, তাঁর বৃদ্ধ বাবাও গ্রামের বাড়িতে আমগাছতলায় বসে বসে ভাবেন। অনেক ‘কেন’-র উত্তর তিনি খোঁজেন। উত্তর পানও। বাড়ির ভেতর থেকে খিটখিটে মেজাজের বুড়ি অথবা বিধবা বউমা ভাত খাওয়ার জন্য ডাকেন। নাতনি এসে হাত ধরে টানে। পুত্রহারা বৃদ্ধ যে চোখের কোনা মুছে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর যাবেন সে শক্তি তাঁর পায়ে নেই। পুত্রকে তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবার শক্তি তিনি হারাননি।
স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সমাজে যুক্তিশীল বিচার-বিবেচনার বিষয়টি লোপ পায়। তার জায়গাটি দখল করেছে পামপট্টি বা স্তাবকতা। আজ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে পাম মারছে। মন্ত্রী-রাজনীতিকেরা পাম দিচ্ছেন তাঁদের ভোটারদের। আমলারা পামপট্টি দিচ্ছেন মন্ত্রীকে বা দাতা গোষ্ঠীর লোকদেরও শুধু নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও ক্যাডারদেরও। সংস্কৃতিজগতের কর্ণধারেরা তেল দিচ্ছেন ও পাম মারছেন সেই দপ্তরের আমলাদের, যারা বিদেশে ডেলিগেশন পাঠানোর তালিকা তৈরি করেন। প্রকাশক পাম মারছেন লেখককে, লেখক মারছেন প্রকাশককে। লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদককে পামপট্টি দিতে যান নতুন ও বুড়ো লেখকেরা। কেউ কাউকে তার ভুল ধরিয়ে না দিয়ে, তার ভুলের জন্য সমালোচনা না করে অযাচিতভাবে পাম দিচ্ছেন। পুরোনো প্রজন্মকে পাম দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের চালাকেরা। অন্যদিকে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য শাসন না করে নতুন প্রজন্মকে পাম দিচ্ছেন প্রবীণেরা। এ অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের গলদ দূর হবে কী করে?
নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমাদের অনেক মন্ত্রী, রাজনীতিক ও লেখক ভয়াবহ আশাবাদী। ‘নতুন প্রজন্ম’ কথাটি এমনভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, মনে হচ্ছে, বাঙালি জাতির আর যেন কোনো প্রজন্ম ছিল না। অন্তত পত্রিকা পড়ে তা-ই মনে হয়। ‘নতুন প্রজন্ম’কে মন-প্রাণ দিয়ে প্রশংসা করা হচ্ছে সম্ভবত এই জন্যও যে তারা মহাজোটের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। এবং ২০২১ সালের আগেই একটি শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ তারা গঠন করে ফেলবে—সে ব্যাপারে আশাবাদী তো কেউ হতেই পারেন।
দুর্ভাগ্যবশত আমার অবস্থান তাদের বিপরীতে। আমি পরম হতাশাবাদী। নতুন প্রজন্মকে ফুলিয়ে গদগদভাবে লিখতে পারি না বলে নিজের ওপরই রাগ হয়। স্বার্থপরের মতো আমি আমার নিজের প্রজন্ম ও তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম দিয়ে গর্বিত। আমি সেই প্রজন্ম নিয়ে গর্বিত যে প্রজন্মের যুবকেরা একটি ছেঁড়া শার্ট গায়ে দিয়ে অবাঙালি আধা-ঔপনিবেশিক শাসকদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়। যাঁরা পুলিশের রাইফেলের সামনে বায়ান্নতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি সেই প্রজন্মকে সালাম করি, যে প্রজন্ম প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৬২তে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রজন্মকে সম্মান করি, যারা ন্যায়সংগত দাবিতে রাজপথ উত্তাল করেছে, কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর করে যন্ত্রাংশগুলো লুট করত না। আমি আমার সেই প্রজন্মের জন্য অহংকার করি, যে প্রজন্মের মানুষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেই প্রজন্মের কথা বারবার স্মরণ করি, যে প্রজন্ম ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। সেই প্রজন্মের কাছে বারবার মাথা নত করি, যারা একাত্তরের স্রষ্টা।
দুই হাতে দুই কানে সেলফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়ে যে প্রজন্মের যুবক-যুবতী গাড়ির ধাক্কা খায়, সেই প্রজন্মকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখা আমার মতো ফোনহীন ও প্রেমহীন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরও হূদয় ছিল। তারাও প্রেম করেছে। ভালোবাসার ইতিবাচক সাড়া পেলেও প্রেয়সীকে ফুল দিয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হলেও একটি গোলাপ ও একটি চিরকুট দিয়ে শরিফ মিয়ার দোকানের পাশের বাগানে ঝিম মেরে বসে থেকেছে। অথবা লাইব্রেরিতে গিয়ে যাযাবরের দৃষ্টিপাত সেলফ থেকে নিয়ে পাতা উল্টে বারবার আবৃত্তি করেছে: ‘মিনি সাহেব, আমি ইডিয়টই বটে, আমি উপহাসকে মনে করি প্রেম, খেলাকে ভেবেছি সত্য।...’ অথবা যেদিন বজ্রপাতের মতো শুনেছে, ‘তুমি আর আমার সাথে মেলামেশা করো না, আব্বা-আম্মা পছন্দ করেন না, ছোট চাচাও খুব রাগী।’ আসলে মেয়েটি নিজেই ওকে বাতিল করেছে। এবং বিয়েও ঠিক হয়েছে নীলফামারীর সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক সুদর্শন সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। সেকালে তারা এ ধরনের বজ্রাঘাতে আহত হয়ে সোজা চলে যেত গুলিস্তান বা নিশাত সিনেমা হলে। এক সপ্তাহে এগারবার দেখেছে দ্বীপ জ্বেলে যাই, মেঘে ঢাকা তারা অথবা হারানো সুর।
যে প্রজন্ম সহপাঠীকে প্রেম নিবেদন ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে এসিড ছুড়ে দেয়, সে প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে তাদের স্নেহপ্রবণ শিক্ষকেরা আশাবাদী হতে পারেন, কিন্তু আমার মতো চিরকালের ছাত্র পারে না। যে প্রজন্ম পরীক্ষার তারিখ পছন্দমতো পেছানোর জন্য শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে, সে প্রজন্ম নিয়ে ‘ভীষণ আশাবাদী’ কীভাবে হই? ভর্তি ফি কমানোর জন্য টিভি ক্যামেরার সামনে উপাচার্যের মুখের কাছে জুতা নাচায় যে প্রজন্মের মানবসন্তান সে প্রজন্মকে প্রশংসা করি কীভাবে?
কোনো মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মাত্র ঝলসে উঠল প্রজন্মের পুরুষত্ব্ব। সহপাঠী বা পাড়ার মেয়েদের টান দিয়ে কামিজ ছিঁড়ে হায়েনার মতো গায়ে হাত দেয় যে প্রজন্ম, সে প্রজন্মের ২০২১ সালে সোনার বাংলা গড়ার সময় কোথায়? সেই প্রজন্ম নিয়ে প্রাচীনকালের সুফিদের মতো এত ‘স্বপ্ন’ দেখা কেন? যে প্রজন্ম সিট দখল করতে গিয়ে সহপাঠীর মাথা ফাটায় বা হাড্ডি গুঁড়া করে, টেন্ডারের বাক্স মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে নেতার বাড়িতে চলে যায়, ভর্তি-বাণিজ্যে কোটিপতি হয়, সে প্রজন্ম নিয়ে কি স্বপ্ন দেখা সম্ভব?
আমাদের প্রজন্মের ছাত্রনেতারা সবাই নির্মল ছিলেন তা বলব না। পরবর্তী জীবনে অনেকের পদস্খলন ঘটেছে। আমরা কোনো না কোনো সংগঠনের সমর্থক বা কর্মী ছিলাম। যে যে সংগঠনেরই হোন না কেন, নেতাদের আমরা সবাই শ্রদ্ধা করতাম। কারা ছিলেন আমাদের প্রজন্মের উজ্জ্বল ছাত্রনেতা যাঁদের ত্যাগ এখনো স্মরণ করি: কাজী জাফর আহমদ, সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্ত, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, পংকজ ভট্টাচার্য, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ, শামসুজ্জোহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং একটু পরেই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ শহীদুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, নূহ-উল আলম লেনিন প্রমুখ। ওই প্রজন্মের আরও পনেরোটি নাম উল্লেখ করলে শান্তি পেতাম।
ওই প্রজন্মের নেতা-কর্মীরা হলের সিট দখলে নেতৃত্ব দেননি, সারা রাত হলে হলে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়াও তাঁরা পছন্দ করতেন না। টেন্ডার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো সময়ই ছিল না তাঁদের। ভর্তি-বাণিজ্য শব্দটি তখন আবিষ্কৃত হয়নি। উপাচার্য বা অধ্যক্ষকে তালা মেরে জানালা দিয়ে গালিগালাজ করার রেওয়াজ তখন ছিল না। শিক্ষককে জুতাপেটা করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি। চাঁদাবাজি তখন ছিল না—প্রয়োজনে সামান্য কয়েক টাকা চাঁদা তোলা হতো। আমাদের প্রজন্মে কোনো মেয়ের মুখে এসিড ছোড়া হতো না। গুলি করে কোনো মেয়ের চোখ কানা করা হতো না। প্রতিবেশী মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করে তার স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করা হতো না বা তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হতো না। তারপর যেদিন ডাক এল, একটিমাত্র কাপড় নিয়ে গোটা প্রজন্মের মানুষ দেশের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। তা হলে কোন প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত ভালো?
আমি জানি, প্রজন্মের সবাই এসিড ছোড়ে না, নেশাও করে না, মেয়েদের উত্ত্যক্তও করে না, পাড়ার দোকানে চা-মিষ্টি খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যায় না, টেন্ডারবাজিও করে না। ওসব শতকরা পাঁচজন করতে পারে। কিন্তু কষ্টটা ওখানে যে, দলবদ্ধ প্রতিরোধ নেই কেন। পঁচানব্বই জনের ভূমিকাটা কী? ভোট দিয়েছে বলে প্রজন্ম যা খুশি তা-ই করবে? আইনের শাসন থাকলে খুনখারাবি, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বখাটেপনা, ধর্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারামারি, ভাঙচুর প্রভৃতি হতে পারত না।
কোনো অবস্থার সুবিধাভোগী ও ভুক্তভোগীর একই অনুভূতি হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনেরা সুবিধাভোগী আর সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী। বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো কী বলল, তা যদি সরকার গ্রাহ্য নাও করে, ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা এবং বিখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কী বলছেন, তা তো মূল্যহীন নয়। তাঁরা বলছেন, দেশ ভালো চলছে না এবং অনেক স্বাধীনতাবিরোধী নবম জাতীয় সংসদে আছেন, রয়েছেন মন্ত্রিসভায়ও। ওদিকে সরকার ও সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, সরকারের সমর্থনে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ।
অবিচারে নিমজ্জিত বাংলাদেশে ‘বিচার’ শব্দটি আজ খুবই উচ্চারিত। এবং বাংলাদেশে বিচার নয়, বিচারের রায়ই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচারের রায় কী হবে তা জানা চাই। বিচারের রায়ের চেয়েও জরুরি বিচারের রায় কার্যকর করা। এখন শুধু বিচার নয়, ‘দ্রুত বিচার’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এক প্রতিমন্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘ষোলোই ডিসেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হবে।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গত কয়েক মাসে বিডিআরের মহাপরিচালক ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অনেক রকমের বক্তব্য দিয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রতিটি গ্রামে ও ইউনিয়নে রাজাকারদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা শত্রুপক্ষের সহযোগিতা করেছে, খুনখারাবি করেছে তাদের বিচার ও শাস্তিই প্রাপ্য, তাদের নাম গ্রামের প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়াটা সভ্যজগতের নিয়ম নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে তা হয়নি। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার তা করে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব রাজাকারের নাম পাথরে খোদাই না করে যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র সুফল পাননি, তাদের কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
শত্রুমিত্র সকলের ক্ষেত্রে আইনের নিরপেক্ষ অনুশীলন ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না—আদর্শ রাষ্ট্র তো নয়ই। কোনো এক পত্রিকার জরিপে দেখেছি, আমাদের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে শতকরা ৭৭ জন নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই তাঁরা সবাই বিরোধী দলের নন। খুনখারাবি নয়, তুচ্ছ কোনো মন্তব্যের কারণে বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে রাশি রাশি মামলা হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে। মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমন জারি করতে মুহূর্ত দেরি করছেন না। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি লোকেরা নির্বিঘ্নে খালাস পাচ্ছেন প্রতিদিন। এর নাম আইনের শাসন নয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য শোনা যায়নি। এই নীরবতা অর্থহীন নয়। অন্যদিকে আমাদের ৪০তম স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আমেরিকার কংগ্রেস এক বিশেষ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ৩৮০-৭ ভোটে তা পাস হয়। প্রস্তাবে ‘তিক্ততা ভুলে রাজনৈতিক নেতাদের একত্রে কাজ চালিয়ে যেতে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।’ এই প্রস্তাব আমাদের সরকারের জন্য একটি বার্তা।
দেশে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট এখন সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ। মন্ত্রীরা অব্যাহতভাবে বলছেন, গত দুই সরকার ‘এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ’ ও ‘এক ফোঁটা পানি’র ব্যবস্থা করে যায়নি। তাই এই সংকট। সাধারণ মানুষের কাছে এর অর্থ: প্রত্যেক সরকার পরবর্তী সরকারের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ও প্রকাণ্ড পুষ্করিণীতে টলটলে পানি রেখে যাবে, পরবর্তী সরকার তা শুধু ঘড়ায় ঢেলে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করবে। বিদ্যুতের অভাবে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাক, কৃষকের সেচের পাম্প বন্ধ থাক, সিএনজি পাম্পও বন্ধ থাক, ঘরের বাতি না জ্বলুক—কিন্তু মধ্যবিত্তের ঘরে পাখাটি যদি না ঘোরে তাদের চাঁদি গরম হবে এবং ঘুরতে থাকবে বনবন করে মাথা। মাথা গরম হলে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।
সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা কি এখনো বিশ্লেষণ করে দেখেননি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ফলাফল, জেলা বারগুলোর নির্বাচনী ফলাফল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের নির্বাচনের ফল, তারা কি কাগজেও পড়েননি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির শ্রমিক অসন্তোষের খবর, পল্লীবিদ্যুৎ অফিসগুলোর ঘেরাওয়ের সংবাদ। এ-জাতীয় অমঙ্গলের তালিকা দিলে তা হবে দীর্ঘ। রাখালেও বোঝে, এসব সরকারের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার।
বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতা বাড়ায় আমেরিকা ও তার মিত্ররা, খালেদা জিয়ার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। এখন গণ-অসন্তোষের ফলে বাংলাদেশে উগ্র বাম বা মাওবাদী তৎপরতা বাড়লে আমেরিকা শুধু নয়, ভারতও শেখ হাসিনার সরকারের ওপর অপ্রসন্ন হবে। অন্ধ্র, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এসেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে কম নয়। পরিস্থিতির কারণে মাওবাদী তৎপরতা শুরু হলে শুধু জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে পার পাওয়া যাবে না। উগ্র বাম রাজনীতি জনপ্রিয় হলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ হাত গুটিয়ে নেবে। তখন ইসলামপন্থীদেরই পশ্চিমারা মদদ দেবে। চৌদ্দদলীয় মহাজোট তখন কী নিয়ে রাজনীতি করবে?
মানুষের দুর্দশা বাড়লে, বিদেশিদের সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি করলে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তরবঙ্গে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে, সেই কয়লা পানির দামে বিদেশিদের কাছে রপ্তানি করলে চরমপন্থী বাম আন্দোলন মাথা চাড়া দেবে। ইসলামি মৌলবাদীদের চেয়ে মাওবাদী চরমপন্থীদের পশ্চিমা বিশ্ব বেশি ভয় করে।
শুরুতে যা বলেছি, তা একটু বদলে বলতে চাই। কখনো কখনো রাখালেও যা বোঝে রাজাও তা বোঝার চেষ্টা করেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
এই যে রাজা ও রাখালের বোঝার বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, তা মহাজাগতিক কোনো রহস্য নয়, দর্শনতত্ত্ব নয়, গ্রহ-নক্ষত্রবিষয়ক কোনো জ্যোতির্বিদ্যাও নয়। স্রেফ জগত্-সংসার বা রাজ্যের ভালো-মন্দের ব্যাপার। যে যুগের কোনো জ্ঞানী এই প্রবচনের প্রবর্তক, সে সময়টি ছিল রাজতন্ত্রের। রাজ্য শাসন করতেন রাজা। রাখাল বলতে খুব নগণ্য প্রজাকে বোঝানো হয়েছে, যার বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় নিতান্ত কম।
আমরা এখন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের নাগরিক। গণতন্ত্রে নাগরিকদের আক্কেলবুদ্ধিকে অবহেলা করার উপায় নেই। কারণ, যে নাগরিক তার রায়ের দ্বারা কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে এবং কাউকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে—তার ক্ষমতা কম কিসে। সে যে কিছুই বোঝে না, তা নয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতরা যা বোঝেন, একজন সাধারণ নাগরিকও তা-ই বোঝে। একজন ফিকশন বা কল্পকাহিনির লেখক যা বোঝেন, হয়তো একজন কলাম লেখক তাঁর চেয়ে সামান্য কম বোঝেন। অর্থাৎ সবাই কমবেশি বোঝেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা, শীর্ষ আমলা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নাটক ও সংগীতজগতের স্বনামধন্যরা, সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয় লেখকেরা দেশের ভালো-মন্দ ও ভবিষ্যত্ নিয়ে যা বোঝেন, সাধারণ নাগরিকেরাও যে তা বোঝে না, তা নয়। পিলখানার পাশবিকতার কারণ ও পরিণতি নিয়ে বিডিআরের মহাপরিচালকের বোঝাই পরম বোঝা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর বিবেচনা আরও মূল্যবান। কিন্তু ওই বর্বরতায় যে সেনা কর্মকর্তা অথবা বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছেন, তাঁর বৃদ্ধ বাবাও গ্রামের বাড়িতে আমগাছতলায় বসে বসে ভাবেন। অনেক ‘কেন’-র উত্তর তিনি খোঁজেন। উত্তর পানও। বাড়ির ভেতর থেকে খিটখিটে মেজাজের বুড়ি অথবা বিধবা বউমা ভাত খাওয়ার জন্য ডাকেন। নাতনি এসে হাত ধরে টানে। পুত্রহারা বৃদ্ধ যে চোখের কোনা মুছে উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর যাবেন সে শক্তি তাঁর পায়ে নেই। পুত্রকে তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবার শক্তি তিনি হারাননি।
স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের সমাজে যুক্তিশীল বিচার-বিবেচনার বিষয়টি লোপ পায়। তার জায়গাটি দখল করেছে পামপট্টি বা স্তাবকতা। আজ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে পাম মারছে। মন্ত্রী-রাজনীতিকেরা পাম দিচ্ছেন তাঁদের ভোটারদের। আমলারা পামপট্টি দিচ্ছেন মন্ত্রীকে বা দাতা গোষ্ঠীর লোকদেরও শুধু নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও ক্যাডারদেরও। সংস্কৃতিজগতের কর্ণধারেরা তেল দিচ্ছেন ও পাম মারছেন সেই দপ্তরের আমলাদের, যারা বিদেশে ডেলিগেশন পাঠানোর তালিকা তৈরি করেন। প্রকাশক পাম মারছেন লেখককে, লেখক মারছেন প্রকাশককে। লেখা ছাপতে পত্রিকার সম্পাদককে পামপট্টি দিতে যান নতুন ও বুড়ো লেখকেরা। কেউ কাউকে তার ভুল ধরিয়ে না দিয়ে, তার ভুলের জন্য সমালোচনা না করে অযাচিতভাবে পাম দিচ্ছেন। পুরোনো প্রজন্মকে পাম দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের চালাকেরা। অন্যদিকে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য শাসন না করে নতুন প্রজন্মকে পাম দিচ্ছেন প্রবীণেরা। এ অবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রের গলদ দূর হবে কী করে?
নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমাদের অনেক মন্ত্রী, রাজনীতিক ও লেখক ভয়াবহ আশাবাদী। ‘নতুন প্রজন্ম’ কথাটি এমনভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, মনে হচ্ছে, বাঙালি জাতির আর যেন কোনো প্রজন্ম ছিল না। অন্তত পত্রিকা পড়ে তা-ই মনে হয়। ‘নতুন প্রজন্ম’কে মন-প্রাণ দিয়ে প্রশংসা করা হচ্ছে সম্ভবত এই জন্যও যে তারা মহাজোটের প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। এবং ২০২১ সালের আগেই একটি শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশ তারা গঠন করে ফেলবে—সে ব্যাপারে আশাবাদী তো কেউ হতেই পারেন।
দুর্ভাগ্যবশত আমার অবস্থান তাদের বিপরীতে। আমি পরম হতাশাবাদী। নতুন প্রজন্মকে ফুলিয়ে গদগদভাবে লিখতে পারি না বলে নিজের ওপরই রাগ হয়। স্বার্থপরের মতো আমি আমার নিজের প্রজন্ম ও তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম দিয়ে গর্বিত। আমি সেই প্রজন্ম নিয়ে গর্বিত যে প্রজন্মের যুবকেরা একটি ছেঁড়া শার্ট গায়ে দিয়ে অবাঙালি আধা-ঔপনিবেশিক শাসকদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দেয়। যাঁরা পুলিশের রাইফেলের সামনে বায়ান্নতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি সেই প্রজন্মকে সালাম করি, যে প্রজন্ম প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৬২তে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রজন্মকে সম্মান করি, যারা ন্যায়সংগত দাবিতে রাজপথ উত্তাল করেছে, কিন্তু গাড়ি ভাঙচুর করে যন্ত্রাংশগুলো লুট করত না। আমি আমার সেই প্রজন্মের জন্য অহংকার করি, যে প্রজন্মের মানুষ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেই প্রজন্মের কথা বারবার স্মরণ করি, যে প্রজন্ম ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। সেই প্রজন্মের কাছে বারবার মাথা নত করি, যারা একাত্তরের স্রষ্টা।
দুই হাতে দুই কানে সেলফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়ে যে প্রজন্মের যুবক-যুবতী গাড়ির ধাক্কা খায়, সেই প্রজন্মকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখা আমার মতো ফোনহীন ও প্রেমহীন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরও হূদয় ছিল। তারাও প্রেম করেছে। ভালোবাসার ইতিবাচক সাড়া পেলেও প্রেয়সীকে ফুল দিয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হলেও একটি গোলাপ ও একটি চিরকুট দিয়ে শরিফ মিয়ার দোকানের পাশের বাগানে ঝিম মেরে বসে থেকেছে। অথবা লাইব্রেরিতে গিয়ে যাযাবরের দৃষ্টিপাত সেলফ থেকে নিয়ে পাতা উল্টে বারবার আবৃত্তি করেছে: ‘মিনি সাহেব, আমি ইডিয়টই বটে, আমি উপহাসকে মনে করি প্রেম, খেলাকে ভেবেছি সত্য।...’ অথবা যেদিন বজ্রপাতের মতো শুনেছে, ‘তুমি আর আমার সাথে মেলামেশা করো না, আব্বা-আম্মা পছন্দ করেন না, ছোট চাচাও খুব রাগী।’ আসলে মেয়েটি নিজেই ওকে বাতিল করেছে। এবং বিয়েও ঠিক হয়েছে নীলফামারীর সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক সুদর্শন সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। সেকালে তারা এ ধরনের বজ্রাঘাতে আহত হয়ে সোজা চলে যেত গুলিস্তান বা নিশাত সিনেমা হলে। এক সপ্তাহে এগারবার দেখেছে দ্বীপ জ্বেলে যাই, মেঘে ঢাকা তারা অথবা হারানো সুর।
যে প্রজন্ম সহপাঠীকে প্রেম নিবেদন ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে এসিড ছুড়ে দেয়, সে প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে তাদের স্নেহপ্রবণ শিক্ষকেরা আশাবাদী হতে পারেন, কিন্তু আমার মতো চিরকালের ছাত্র পারে না। যে প্রজন্ম পরীক্ষার তারিখ পছন্দমতো পেছানোর জন্য শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে, সে প্রজন্ম নিয়ে ‘ভীষণ আশাবাদী’ কীভাবে হই? ভর্তি ফি কমানোর জন্য টিভি ক্যামেরার সামনে উপাচার্যের মুখের কাছে জুতা নাচায় যে প্রজন্মের মানবসন্তান সে প্রজন্মকে প্রশংসা করি কীভাবে?
কোনো মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মাত্র ঝলসে উঠল প্রজন্মের পুরুষত্ব্ব। সহপাঠী বা পাড়ার মেয়েদের টান দিয়ে কামিজ ছিঁড়ে হায়েনার মতো গায়ে হাত দেয় যে প্রজন্ম, সে প্রজন্মের ২০২১ সালে সোনার বাংলা গড়ার সময় কোথায়? সেই প্রজন্ম নিয়ে প্রাচীনকালের সুফিদের মতো এত ‘স্বপ্ন’ দেখা কেন? যে প্রজন্ম সিট দখল করতে গিয়ে সহপাঠীর মাথা ফাটায় বা হাড্ডি গুঁড়া করে, টেন্ডারের বাক্স মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে নেতার বাড়িতে চলে যায়, ভর্তি-বাণিজ্যে কোটিপতি হয়, সে প্রজন্ম নিয়ে কি স্বপ্ন দেখা সম্ভব?
আমাদের প্রজন্মের ছাত্রনেতারা সবাই নির্মল ছিলেন তা বলব না। পরবর্তী জীবনে অনেকের পদস্খলন ঘটেছে। আমরা কোনো না কোনো সংগঠনের সমর্থক বা কর্মী ছিলাম। যে যে সংগঠনেরই হোন না কেন, নেতাদের আমরা সবাই শ্রদ্ধা করতাম। কারা ছিলেন আমাদের প্রজন্মের উজ্জ্বল ছাত্রনেতা যাঁদের ত্যাগ এখনো স্মরণ করি: কাজী জাফর আহমদ, সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্ত, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, পংকজ ভট্টাচার্য, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ, শামসুজ্জোহা, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং একটু পরেই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, শেখ শহীদুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, নূহ-উল আলম লেনিন প্রমুখ। ওই প্রজন্মের আরও পনেরোটি নাম উল্লেখ করলে শান্তি পেতাম।
ওই প্রজন্মের নেতা-কর্মীরা হলের সিট দখলে নেতৃত্ব দেননি, সারা রাত হলে হলে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়াও তাঁরা পছন্দ করতেন না। টেন্ডার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো সময়ই ছিল না তাঁদের। ভর্তি-বাণিজ্য শব্দটি তখন আবিষ্কৃত হয়নি। উপাচার্য বা অধ্যক্ষকে তালা মেরে জানালা দিয়ে গালিগালাজ করার রেওয়াজ তখন ছিল না। শিক্ষককে জুতাপেটা করার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি। চাঁদাবাজি তখন ছিল না—প্রয়োজনে সামান্য কয়েক টাকা চাঁদা তোলা হতো। আমাদের প্রজন্মে কোনো মেয়ের মুখে এসিড ছোড়া হতো না। গুলি করে কোনো মেয়ের চোখ কানা করা হতো না। প্রতিবেশী মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করে তার স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করা হতো না বা তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হতো না। তারপর যেদিন ডাক এল, একটিমাত্র কাপড় নিয়ে গোটা প্রজন্মের মানুষ দেশের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। তা হলে কোন প্রজন্ম অপেক্ষাকৃত ভালো?
আমি জানি, প্রজন্মের সবাই এসিড ছোড়ে না, নেশাও করে না, মেয়েদের উত্ত্যক্তও করে না, পাড়ার দোকানে চা-মিষ্টি খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যায় না, টেন্ডারবাজিও করে না। ওসব শতকরা পাঁচজন করতে পারে। কিন্তু কষ্টটা ওখানে যে, দলবদ্ধ প্রতিরোধ নেই কেন। পঁচানব্বই জনের ভূমিকাটা কী? ভোট দিয়েছে বলে প্রজন্ম যা খুশি তা-ই করবে? আইনের শাসন থাকলে খুনখারাবি, ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার ছিনতাই, চাঁদাবাজি, বখাটেপনা, ধর্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারামারি, ভাঙচুর প্রভৃতি হতে পারত না।
কোনো অবস্থার সুবিধাভোগী ও ভুক্তভোগীর একই অনুভূতি হতে পারে না। একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনেরা সুবিধাভোগী আর সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী। বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো কী বলল, তা যদি সরকার গ্রাহ্য নাও করে, ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা এবং বিখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কী বলছেন, তা তো মূল্যহীন নয়। তাঁরা বলছেন, দেশ ভালো চলছে না এবং অনেক স্বাধীনতাবিরোধী নবম জাতীয় সংসদে আছেন, রয়েছেন মন্ত্রিসভায়ও। ওদিকে সরকার ও সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, সরকারের সমর্থনে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ।
অবিচারে নিমজ্জিত বাংলাদেশে ‘বিচার’ শব্দটি আজ খুবই উচ্চারিত। এবং বাংলাদেশে বিচার নয়, বিচারের রায়ই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচারের রায় কী হবে তা জানা চাই। বিচারের রায়ের চেয়েও জরুরি বিচারের রায় কার্যকর করা। এখন শুধু বিচার নয়, ‘দ্রুত বিচার’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এক প্রতিমন্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘ষোলোই ডিসেম্বরের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হবে।’
পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে গত কয়েক মাসে বিডিআরের মহাপরিচালক ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অনেক রকমের বক্তব্য দিয়েছেন। এক প্রতিমন্ত্রী বলছেন, প্রতিটি গ্রামে ও ইউনিয়নে রাজাকারদের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যারা শত্রুপক্ষের সহযোগিতা করেছে, খুনখারাবি করেছে তাদের বিচার ও শাস্তিই প্রাপ্য, তাদের নাম গ্রামের প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেওয়াটা সভ্যজগতের নিয়ম নয়। পৃথিবীর কোনো দেশে তা হয়নি। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার তা করে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব রাজাকারের নাম পাথরে খোদাই না করে যেসব স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র সুফল পাননি, তাদের কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
শত্রুমিত্র সকলের ক্ষেত্রে আইনের নিরপেক্ষ অনুশীলন ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না—আদর্শ রাষ্ট্র তো নয়ই। কোনো এক পত্রিকার জরিপে দেখেছি, আমাদের বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে শতকরা ৭৭ জন নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নিশ্চয়ই তাঁরা সবাই বিরোধী দলের নন। খুনখারাবি নয়, তুচ্ছ কোনো মন্তব্যের কারণে বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে রাশি রাশি মামলা হচ্ছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন আদালতে। মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমন জারি করতে মুহূর্ত দেরি করছেন না। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত সরকারি লোকেরা নির্বিঘ্নে খালাস পাচ্ছেন প্রতিদিন। এর নাম আইনের শাসন নয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য শোনা যায়নি। এই নীরবতা অর্থহীন নয়। অন্যদিকে আমাদের ৪০তম স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন আমেরিকার কংগ্রেস এক বিশেষ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান জোসেফ ক্রাউলি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। ৩৮০-৭ ভোটে তা পাস হয়। প্রস্তাবে ‘তিক্ততা ভুলে রাজনৈতিক নেতাদের একত্রে কাজ চালিয়ে যেতে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।’ এই প্রস্তাব আমাদের সরকারের জন্য একটি বার্তা।
দেশে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট এখন সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ। মন্ত্রীরা অব্যাহতভাবে বলছেন, গত দুই সরকার ‘এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ’ ও ‘এক ফোঁটা পানি’র ব্যবস্থা করে যায়নি। তাই এই সংকট। সাধারণ মানুষের কাছে এর অর্থ: প্রত্যেক সরকার পরবর্তী সরকারের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ ও প্রকাণ্ড পুষ্করিণীতে টলটলে পানি রেখে যাবে, পরবর্তী সরকার তা শুধু ঘড়ায় ঢেলে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করবে। বিদ্যুতের অভাবে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাক, কৃষকের সেচের পাম্প বন্ধ থাক, সিএনজি পাম্পও বন্ধ থাক, ঘরের বাতি না জ্বলুক—কিন্তু মধ্যবিত্তের ঘরে পাখাটি যদি না ঘোরে তাদের চাঁদি গরম হবে এবং ঘুরতে থাকবে বনবন করে মাথা। মাথা গরম হলে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।
সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা কি এখনো বিশ্লেষণ করে দেখেননি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ফলাফল, জেলা বারগুলোর নির্বাচনী ফলাফল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের নির্বাচনের ফল, তারা কি কাগজেও পড়েননি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির শ্রমিক অসন্তোষের খবর, পল্লীবিদ্যুৎ অফিসগুলোর ঘেরাওয়ের সংবাদ। এ-জাতীয় অমঙ্গলের তালিকা দিলে তা হবে দীর্ঘ। রাখালেও বোঝে, এসব সরকারের জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার।
বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতা বাড়ায় আমেরিকা ও তার মিত্ররা, খালেদা জিয়ার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। এখন গণ-অসন্তোষের ফলে বাংলাদেশে উগ্র বাম বা মাওবাদী তৎপরতা বাড়লে আমেরিকা শুধু নয়, ভারতও শেখ হাসিনার সরকারের ওপর অপ্রসন্ন হবে। অন্ধ্র, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে মাওবাদী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এসেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে কম নয়। পরিস্থিতির কারণে মাওবাদী তৎপরতা শুরু হলে শুধু জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে পার পাওয়া যাবে না। উগ্র বাম রাজনীতি জনপ্রিয় হলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ হাত গুটিয়ে নেবে। তখন ইসলামপন্থীদেরই পশ্চিমারা মদদ দেবে। চৌদ্দদলীয় মহাজোট তখন কী নিয়ে রাজনীতি করবে?
মানুষের দুর্দশা বাড়লে, বিদেশিদের সঙ্গে জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি করলে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তরবঙ্গে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে, সেই কয়লা পানির দামে বিদেশিদের কাছে রপ্তানি করলে চরমপন্থী বাম আন্দোলন মাথা চাড়া দেবে। ইসলামি মৌলবাদীদের চেয়ে মাওবাদী চরমপন্থীদের পশ্চিমা বিশ্ব বেশি ভয় করে।
শুরুতে যা বলেছি, তা একটু বদলে বলতে চাই। কখনো কখনো রাখালেও যা বোঝে রাজাও তা বোঝার চেষ্টা করেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments