লোডশেডিং আমাদের কী কী উপকারে লাগে by আনিসুল হক
প্রতিটি অন্ধকার জিনিসের নাকি একটা আলোকিত দিক আছে। মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। রাত্রি যত গভীর হয়, প্রভাত নাকি তত নিকটবর্তী হতে থাকে।
আসুন আমরা লোডশেডিং নামের অন্ধকার জিনিসটার আলোকিত দিকগুলো খুঁজতে থাকি। আলোর ইংরেজি হলো লাইট। ইংরেজি লাইটের আরেকটা মানে আছে—হালকা। লোডশেডিংয়ের মধ্যে লাইট যদি না-ও থাকে, লাইটার দিক নিশ্চয়ই রয়েছে।
পৃথিবীজুড়েই এখন কিছুক্ষণের জন্যে বাতি বন্ধ করে রাখাটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে ঘটা করে পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনার বাতি নিভিয়ে রাখা হলো খানিকক্ষণের জন্যে। নিউইয়র্কের এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, সিডনির অপেরা হাউস কিংবা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার—এ ধরনের স্থাপনার বাতি বন্ধ করে রাখা হলো ঘোষণা দিয়ে। কারণ বাতি জ্বালালে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়। কথাটা বেশি সোজা করে বলা হয়ে গেল। ঘুরিয়েই বলি—বাতি জ্বালাতে বিদ্যুৎ লাগে, বিদ্যুৎ বানাতে হলে কার্বন পোড়াতে হয়। এর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে, এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যায়, এর ফলে বরফ গলে যায়, এর ফলে ঘন ঘন সাইক্লোন ইত্যাদি হয়, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে, আর তাতে বাংলাদেশ ডুবে যায়। কাজেই আমাদের কর্তব্য হলো, যতটুকু পারা যায় বাতি বন্ধ করে রাখা, যত কম পারা যায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করা। আমরা সেটাই করছি। আমরা নতুন কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করব না বলে ঠিক করেছি। যা আছে, তা-ও একদিন না একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর মধ্যে ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন দেশ, যে দেশে এক ওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। জাতিসংঘের মহাসচিব সেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে নিশ্চয়ই একটা সোনার মেডেল দেবেন।
এই উদ্দেশ্য থেকেই আমাদের নাগরিকদের বিদ্যুিবহীন সবুজ জীবন যাপনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আগে লোডশেডিং ছিল এক ঘণ্টার জন্যে। এইভাবে দিনের মধ্যে কয়েকবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করত। এবার ঠিক করা হয়েছে—ঝামেলা করার দরকার নাই, দিনের মধ্যে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে, বাকি ২৩ ঘণ্টাই থাকবে না। তাতে লোকে বলতে পারবে না, এতবার কারেন্ট যায়— আজ সারা দিনে ১১ বার গিয়েছে।
বিদ্যুৎ না থাকার আরেকটা সুবিধা হলো পানি না থাকা। বিদ্যুৎ না থাকলে ঢাকা ওয়াসা তাদের অনেকগুলো গভীর নলকূপ চালাতে পারে না। ফলে ঢাকার গভীর তলদেশ থেকে পানি উত্তোলিত হয় না। এটারও একটা ভালো দিক আছে। আমরা পানি ছাড়া চলতে অভ্যস্ত হচ্ছি। যেমন মরুভূমির উট। উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ। পানি ছাড়াই সে বহু দিন চলতে পারে। বাঙালির অভিযোজনক্ষমতা বিস্ময়কর। পানি ছাড়া চলতে আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে। প্রতিবছর ঢাকার গভীর পানির স্তর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। এই শহরের পানি সরবরাহের ৮৭ শতাংশই আসে গভীর নলকূপ থেকে। ৫ বা ১০ বছর পরে এই শহরের নিচে কোনো পানি থাকবে না। তখন আমরা এক ফোঁটা পানিও পাব না। তখন আমরা বাঁচব কেমন করে? কিন্তু বাঙালি তো অমর প্রাণী। তারা মরবে না। আমরা সবাই উট হয়ে যাব। পানি ছাড়া বেশ চলতে-ফিরতে পারব। বছরে যখন বৃষ্টি হবে, তখন আমরা ছাদওয়ালাদের পয়সা দিয়ে ছাদে যাব, হা করে পানি পান করব, সেই পানি আমাদের শরীর ধরে রাখবে, বছরের বাকি দিনগুলো পানি পান না করেই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। আর আমাদের গোসল, টয়লেট ইত্যাদির কী হবে? গোসল? উট কি কখনো গোসল করে? আর টয়লেট? এটা সারতে হবে বাতাস দিয়ে! উড়োজাহাজের শৌচাগারে কিন্তু পানি লাগে না। ফ্লাশ হয় বাতাস দিয়ে। আমাদের ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে থাকবে আধুনিক সব হাওয়াচালিত কমোড। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে। এটা না পারার আমাদের কোনোই কারণ নেই।
লোডশেডিং আমাদের জীবনের নানা কাজে লাগে। যেমন লোডশেডিংয়ের সময়ে টেলিভিশন চলে না। এটা যে আমাদের জন্যে কত বড় একটা উপকার, তা বলে শেষ করা যাবে না। লোডশেডিং আমাদের টকশো শোনার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। আমাদের ঘরগুলোকে হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখে। হিন্দি সিরিয়াল থেকে আমাদের নারী ও শিশুরা যত দূরে থাকবে, ততই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে মঙ্গলজনক।
লোডশেডিং আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে বিশাল অবদান রাখে। যেমন—মোমবাতি, লণ্ঠন, হাতপাখা ইত্যাদির বিক্রি খুবই বেড়ে গেছে। হারিকেন কারখানার মালিকেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন—এত ভালো ব্যবসা এর আগে তাঁদের আর হয়নি। হে আল্লাহ, সরকারের ভালো করো। তাদের সব ইচ্ছা পূরণ করো। তারা যেন চিরকাল এমনি করে ক্ষমতায় থাকে, আর আমাদের জন্যে লোডশেডিংকে চিরস্থায়ী করে দেয়।
লোডশেডিং আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়। আমরা সেই কবে থেকে শুনে আসছি, একদিনে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্তত তিন-চার বছর লাগবে। তারপর কত চন্দ্রভুক লোডশেডিং গেল, সেই তিন-চার বছর আর ফুরোয় না। কিন্তু আমাদের ধৈর্যের বাঁধ তো ভাঙেনি।
জ্ঞানই আলো। আসুন, আমরা জ্ঞানের আলো জ্বালি চারদিকে। হূদয়ের আলোয় আলোকিত করি চারপাশ। কেন আমরা সারাক্ষণ বিদ্যুৎ বিভাগের আলোর জন্যে চেয়ে থাকি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আসুন আমরা লোডশেডিং নামের অন্ধকার জিনিসটার আলোকিত দিকগুলো খুঁজতে থাকি। আলোর ইংরেজি হলো লাইট। ইংরেজি লাইটের আরেকটা মানে আছে—হালকা। লোডশেডিংয়ের মধ্যে লাইট যদি না-ও থাকে, লাইটার দিক নিশ্চয়ই রয়েছে।
পৃথিবীজুড়েই এখন কিছুক্ষণের জন্যে বাতি বন্ধ করে রাখাটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগে ঘটা করে পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনার বাতি নিভিয়ে রাখা হলো খানিকক্ষণের জন্যে। নিউইয়র্কের এমপায়ার স্টেট বিল্ডিং, সিডনির অপেরা হাউস কিংবা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার—এ ধরনের স্থাপনার বাতি বন্ধ করে রাখা হলো ঘোষণা দিয়ে। কারণ বাতি জ্বালালে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়। কথাটা বেশি সোজা করে বলা হয়ে গেল। ঘুরিয়েই বলি—বাতি জ্বালাতে বিদ্যুৎ লাগে, বিদ্যুৎ বানাতে হলে কার্বন পোড়াতে হয়। এর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে, এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যায়, এর ফলে বরফ গলে যায়, এর ফলে ঘন ঘন সাইক্লোন ইত্যাদি হয়, অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ে, আর তাতে বাংলাদেশ ডুবে যায়। কাজেই আমাদের কর্তব্য হলো, যতটুকু পারা যায় বাতি বন্ধ করে রাখা, যত কম পারা যায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করা। আমরা সেটাই করছি। আমরা নতুন কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করব না বলে ঠিক করেছি। যা আছে, তা-ও একদিন না একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর মধ্যে ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন দেশ, যে দেশে এক ওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না। জাতিসংঘের মহাসচিব সেদিন আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে নিশ্চয়ই একটা সোনার মেডেল দেবেন।
এই উদ্দেশ্য থেকেই আমাদের নাগরিকদের বিদ্যুিবহীন সবুজ জীবন যাপনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আগে লোডশেডিং ছিল এক ঘণ্টার জন্যে। এইভাবে দিনের মধ্যে কয়েকবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করত। এবার ঠিক করা হয়েছে—ঝামেলা করার দরকার নাই, দিনের মধ্যে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে, বাকি ২৩ ঘণ্টাই থাকবে না। তাতে লোকে বলতে পারবে না, এতবার কারেন্ট যায়— আজ সারা দিনে ১১ বার গিয়েছে।
বিদ্যুৎ না থাকার আরেকটা সুবিধা হলো পানি না থাকা। বিদ্যুৎ না থাকলে ঢাকা ওয়াসা তাদের অনেকগুলো গভীর নলকূপ চালাতে পারে না। ফলে ঢাকার গভীর তলদেশ থেকে পানি উত্তোলিত হয় না। এটারও একটা ভালো দিক আছে। আমরা পানি ছাড়া চলতে অভ্যস্ত হচ্ছি। যেমন মরুভূমির উট। উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ। পানি ছাড়াই সে বহু দিন চলতে পারে। বাঙালির অভিযোজনক্ষমতা বিস্ময়কর। পানি ছাড়া চলতে আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে। প্রতিবছর ঢাকার গভীর পানির স্তর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। এই শহরের পানি সরবরাহের ৮৭ শতাংশই আসে গভীর নলকূপ থেকে। ৫ বা ১০ বছর পরে এই শহরের নিচে কোনো পানি থাকবে না। তখন আমরা এক ফোঁটা পানিও পাব না। তখন আমরা বাঁচব কেমন করে? কিন্তু বাঙালি তো অমর প্রাণী। তারা মরবে না। আমরা সবাই উট হয়ে যাব। পানি ছাড়া বেশ চলতে-ফিরতে পারব। বছরে যখন বৃষ্টি হবে, তখন আমরা ছাদওয়ালাদের পয়সা দিয়ে ছাদে যাব, হা করে পানি পান করব, সেই পানি আমাদের শরীর ধরে রাখবে, বছরের বাকি দিনগুলো পানি পান না করেই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। আর আমাদের গোসল, টয়লেট ইত্যাদির কী হবে? গোসল? উট কি কখনো গোসল করে? আর টয়লেট? এটা সারতে হবে বাতাস দিয়ে! উড়োজাহাজের শৌচাগারে কিন্তু পানি লাগে না। ফ্লাশ হয় বাতাস দিয়ে। আমাদের ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে থাকবে আধুনিক সব হাওয়াচালিত কমোড। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে। এটা না পারার আমাদের কোনোই কারণ নেই।
লোডশেডিং আমাদের জীবনের নানা কাজে লাগে। যেমন লোডশেডিংয়ের সময়ে টেলিভিশন চলে না। এটা যে আমাদের জন্যে কত বড় একটা উপকার, তা বলে শেষ করা যাবে না। লোডশেডিং আমাদের টকশো শোনার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। আমাদের ঘরগুলোকে হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখে। হিন্দি সিরিয়াল থেকে আমাদের নারী ও শিশুরা যত দূরে থাকবে, ততই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্যে মঙ্গলজনক।
লোডশেডিং আমাদের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে বিশাল অবদান রাখে। যেমন—মোমবাতি, লণ্ঠন, হাতপাখা ইত্যাদির বিক্রি খুবই বেড়ে গেছে। হারিকেন কারখানার মালিকেরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন—এত ভালো ব্যবসা এর আগে তাঁদের আর হয়নি। হে আল্লাহ, সরকারের ভালো করো। তাদের সব ইচ্ছা পূরণ করো। তারা যেন চিরকাল এমনি করে ক্ষমতায় থাকে, আর আমাদের জন্যে লোডশেডিংকে চিরস্থায়ী করে দেয়।
লোডশেডিং আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়। আমরা সেই কবে থেকে শুনে আসছি, একদিনে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। অন্তত তিন-চার বছর লাগবে। তারপর কত চন্দ্রভুক লোডশেডিং গেল, সেই তিন-চার বছর আর ফুরোয় না। কিন্তু আমাদের ধৈর্যের বাঁধ তো ভাঙেনি।
জ্ঞানই আলো। আসুন, আমরা জ্ঞানের আলো জ্বালি চারদিকে। হূদয়ের আলোয় আলোকিত করি চারপাশ। কেন আমরা সারাক্ষণ বিদ্যুৎ বিভাগের আলোর জন্যে চেয়ে থাকি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments