‘অধিনায়ক’ জাকারিয়া পিন্টুর চিরবিদায় by সামন হোসেন
তিন বছর আগে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দেয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ এবং পরবর্তী সময়ের নানা আক্ষেপ নিয়ে সেদিন জাকারিয়া পিন্টু বলেছিলেন, ‘আমার সৌভাগ্য যে, আজ আমরা সবাই একসঙ্গে বসেছি। এমন সৌভাগ্য আমার জীবনে বহুবার এসেছে। কাজী সালাউদ্দিনকে (তখনকার বাফুফে সাবেক সভাপতি) ধন্যবাদ, এমন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করার জন্য। অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার মাঝে-মধ্যে দেখা হয়েছে; আবার দেখাও হয়নি। আমি অধিনায়ক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব, সেটা পালন করার চেষ্টা করেছি।’ পিন্টুর মৃত্যুর পর সেটা স্বীকার করলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। গতকাল তিনি বলেন- পিন্টু ভাই আমাদের নেতা ছিলেন। আজ আমরা আমাদের নেতাকে হারালাম।
১৯৫৭ সালে ইস্টএন্ড দিয়ে ঢাকার শীর্ষ ফুটবলে শুরু জাকারিয়া পিন্টুর। পরের বছরও একই দলে খেলেন তিনি। ১৯৫৯-৬০ কাটান ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬১-৭৫ পর্যন্ত সময় মোহামেডানে। ১৯৬৮-৭৫ পর্যন্ত টানা আট বছর ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। যা ঘরোয়া ফুটবলে একটি রেকর্ড। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম ম্যাচ হয়েছিল। সে দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি একাদশের বিপক্ষে মুজিবনগর একাদশের অধিনায়কও ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। ওই বছরই একই মাঠে কলকাতার মোহনবাগানের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচে ছিলেন বাংলাদেশের নির্বাচিত একাদশের অধিনায়ক। আসামের গুয়াহাটিতে সর্বভারতীয় লোকপ্রিয় বরদুলই কাপে ঢাকা একাদশেরও অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৫৭ এর দিকে যখন জগন্নাথ কলেজে পড়তেন, তখনো দুই বছর কলেজটির অধিনায়ক ছিলেন। জীবনে কত ম্যাচে যে, অধিনায়কত্ব করেছেন, সেই হিসাব নিজের কাছেও ছিল না। খেলতেন স্টপার পজিশনে। তার কড়া মার্কিং পেরিয়ে স্ট্রাইকাররা বেরিয়ে যেতে পারতেন কমই। খেলোয়াড়ি জীবনের মাঝপথেই সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলে। ১৯৬৮ সালে তুরস্কের আরসিডি কাপে পাকিস্তানের জার্সিতে খেলেছেন। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত খেলেন ইরানের ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্ট, নেপালের রাজা মাহেন্দ্র কাপসহ আরও কিছু আসরে। পাকিস্তান জাতীয় দল আলোকিত করেন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ (অব.), প্রতাপ শংকর হাজরা গোলাম সারোয়ার টিপুরা। তবে তারা সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় দলে খেলেননি। যারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’টি জাতীয় দলেই খেলেছেন, তাদের অন্যতম জাকারিয়া পিন্টু। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের গোড়াপত্তনে তার নামটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। শুধু ফুটবলার নন, ১৯৭৭ ও ১৯৮৭ সালে কিছুদিন মোহামেডানকে কোচিংও করান জাকারিয়া পিন্টু। ১৯৭৯ সালে ঢাকা সফরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লাব দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে জাতীয় দলের কোচ ছিলেন।
১৯৮০ সালে কুয়েতে সপ্তম এশিয়া কাপের চূড়ান্ত পর্বে ছিলেন বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার। বর্ণময় এক ফুটবল ক্যারিয়ারই। যার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৮ সালে। এসব নিয়ে তার ছিল অনেক গর্ব। সবার কাছ থেকে পেতেন আলাদা সম্মান। সবার কাছে ছিলেন ‘পিন্টু ভাই’, বাংলাদেশের ফুটবলে অবিস্মরণীয় এক চরিত্র। ১৯৪৩ সালের ১লা জানুয়ারি নওগাঁয় তার জন্ম। বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, চিকিৎসকও। জাকারিয়া পিন্টু তার বড় ছেলে। জীবনের সংগ্রহশালায় দেড় হাজারের বেশি মাঠ ও মাঠের বাইরের ছবি রেখে গেছেন। ঢাকার ফার্মগেটে ইন্দিরা রোডের বাসায় শো- কেসে থরে থরে ট্রফি-ছবি সাজিয়ে রেখে চিরবিদায় নিলেন ‘পিন্টু ভাই’। কিন্তু তিনি থাকবেন। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে, ফুটবলে, বাঙালির মনে।
No comments