সাবেক মন্ত্রী এমপিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে যেসব ফিরিস্তি তুলে ধরলেন চিফ প্রসিকিউটর by রাশিম মোল্লা

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রথমদিনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। তিনি আদালতকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা ছিলেন তার সহযোগী।

ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, গত ১লা জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-জনতা কর্তৃক সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংরক্ষণ পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ কর্মসূচি, কমপ্লিট শার্টডাউনসহ বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হয়। উক্ত কর্মসূচি থেকে তৎকালীন সরকারের প্রতি কোটা সংরক্ষণ পদ্ধতি সংস্কারের জোর দাবি জানানো হয়। উল্টো আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার হীন উদ্দেশ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪ই জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সংম্মেলনে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দেন। ভিন্নমত দমন করার উদ্দেশ্যে প্ররোচনা ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।  আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ ১৪ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার নির্দেশনা প্রদান করেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে কিছু গণমাধ্যমকর্মী আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে রাজাকার, সন্ত্রাসী এবং তাদের আন্দোলনকে তাণ্ডব আখ্যা দিয়ে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে নানান প্রশ্নের নামে প্ররোচনা ও উস্কানি প্রদান করে। গণমাধ্যমকর্মীদের উক্ত প্রশ্নের জবাবে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতিপুতি বলে তিরস্কার করে প্রকারান্তরে তাদের প্রতিহত করতে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ও আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গসংগঠন ও তাদের জোটভুক্ত ১৪ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়।
অভিযুক্ত সাবেক সেতুমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি একই উদ্দেশ্যে প্ররোচনা ও উস্কানিমূলক বক্তব্য ও নির্দেশনা প্রদান করেন। অভিযুক্ত ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারী প্রতিহত করার জন্য ‘ছাত্রলীগ-ই যথেষ্ট’। তিনি আরও বলেন, কারফিউ চলাকালে দেখামাত্র গুলি করা হবে ‘শুট অ্যাট সাইট হবে’। অভিযুক্ত তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে ‘মাদকাসক্ত’ বলে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালাতে প্ররোচনা ও উস্কানি দেন। তিনি ছাত্র-জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি বর্ষণকে উৎসাহিত ও প্ররোচিত করার জন্য বলেন যে, সরকার যদি প্রত্যেক সেকেন্ডে রাবার বুলেট ছোড়ে, তারপরও পাঁচ বছর লাগবে শেষ হতে। অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে জানমাল অনিশ্চয়তায় পড়লে পুলিশ বসে থাকবে না। আন্দোলনের কারণে সড়কে জানমালের নিরাপত্তা ব্যাহত হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশকে আমরা বলেছি, তাদের ডিমান্ড যেটা আছে, সেটা আমরা শুনবো। কিন্তু শোনারও একটা লিমিট বোধ হয় থাকে।’ এই সকল কথা বলে প্রকারান্তরে তিনি আসামিদের গণহত্যা চালাতে নির্দেশ দেন।

এছাড়াও আন্দোলনকারীদের হত্যা করে অভিযুক্ত ডিএমপি, ওয়ারী বিভাগের এডিসি ইকবাল তা মোবাইলে ধারণ করে অভিযুক্ত আসাদুজ্জামান খান কামাল, অভিযুক্ত তৎকালীন আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন ও অভিযুক্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর হোসেনকে দেখানো হয়। সেখানে বলা হয় ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা... বাকিডি যায় না স্যার’। এহেন কার্যক্রমের মাধ্যমে সেখানে উপস্থিত অভিযুক্তগণ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালাতে প্ররোচনা ও উস্কানি দেন এবং তা বন্ধের লক্ষ্যে কোনো নির্দেশনা দেননি।

তৎকালীন আইনমন্ত্রী অভিযুক্ত আনিসুল হক ও সাবেক মন্ত্রী অভিযুক্ত দীপু মনি আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মা উল্লেখ করে তাদের দমনে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালাতে প্ররোচনা ও উস্কানি দেন।
তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী অভিযুক্ত আ.ক.ম মোজাম্মেল হক আন্দোলনকারী ছাত্র- জনতাকে দুষ্কৃতিকারী উল্লেখ করে তাদের হুমকি প্রদান করে বলেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং কিন্তু জমা দেইনি, আমাদের চেতনা কিন্তু জমা দেইনি’ ৭১ সালে যাদের পরাজিত করেছিলাম ওই সময় তাদের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে পারি নাই। এবার তাদের পরাজিত করলেই হবে না তাদের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী অভিযুক্ত জুনায়েদ আহমেদ পলক আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দ্যশ্যে পূর্ব-পরিকল্পনা মোতাবেক দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করতঃ তথ্য গোপন এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহে বাধা প্রদান-পূর্বক মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালিয়ে যেতে প্ররোচনা দেন এবং সংঘটিত হত্যা এবং নৃশংসতা গণমাধ্যম তথা জনগণের কাছে আড়াল করতে সচেষ্ট ছিলেন।

শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ব্যাপক দলীয়করণ ও পরিবারতন্ত্র কায়েম করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মেগা প্রজেক্টের নামে নিজ পরিবারকে লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর শেখ হাসিনা ও তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহানা, শেখ ফজলুল হক সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলে শামস পরশ, শেখ সোহেল, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ শাহরান নাসের তন্ময়, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, সাদিক আব্দুল্লাহ, মুজিবুল হক নিক্সন চৌধুরী, লিটন চৌধুরীসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দেশব্যাপী হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।

অভিযুক্ত তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন প্রধান হারুন আর রশিদ, উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জেয়ারদার, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক র‌্যাব প্রধান মো. হারুন অর রশিদ, সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকীসহ আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী বাহিনীর তৎকালীন কর্মকর্তাগণের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ও পরিকল্পনায় মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেননি বিধায় দেশব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটন দিনের পর দিন অব্যাহত থাকে।

সাবেক বিচারপতি অভিযুক্ত এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একই উদ্দেশ্যে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত টকশোতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকারের বাচ্চা আখ্যা দেয়াসহ নানান আপত্তিকর ও উত্তেজনাকর কথা বলেন। তিনি আরও বলেন- তারা কখনোই জয় লাভ করবে না, পুলিশ অনেক ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছে বলে তিনি পুলিশকে গণহত্যা চালাতে প্ররোচনা ও উস্কানি দেন। অন্যান্য টকশোতেও তিনি একই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার আশ্রয় নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান করেন।
শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিযুক্ত মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল আন্দোলনের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে লিখেন, এই ছাত্র-ছাত্রীরা কি জানে, তাদের যে এই দেশের মাটিতে থাকার অধিকার নেই, তিনি আরও লিখেন, আমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাই না। ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলেই মনে হবে এরাই হয় তো সেই রাজাকার। আর যে কয়দিন বেঁচে আছি আমি কোনো রাজাকারের মুখ দেখতে চাই না। একটাইতো জীবন। সেই জীবনে আবার নতুন করে রাজাকারদের দেখতে হবে?’ এই কথার মাধ্যমে তিনি আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালাতে প্ররোচনা ও উস্কানি দেন।

কেন্দ্রীয় যুবলীগ সভাপতি শেখ ফজলে শাম্স পরশ ও সেক্রেটারি মইনুল ইসলাম খান নিখিল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও ছাত্রলীগের সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান সক্রিয়ভাবে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে তাদের সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী ঘাতক হেলমেট বাহিনীকে আদেশ দিয়ে এবং নিজেরা নেতৃত্বে থেকে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে। তাদের আদেশে ঢাকাসহ সারা দেশে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রসী বাহিনী বেপরোয়াভাবে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করে ও নিপীড়ন চালায়। একইভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে একই উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যবৃন্দ, সুবিধাভোগী তথা কথিত বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যগণের একাংশ কর্তৃক দুষ্কর্মে সহযোগিতা বা সায় দেয় বা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়  বা কার্যকর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ না করার মাধ্যমে পরোক্ষ সমর্থন জ্ঞাপন বা পৃষ্ঠপোষকতা, তৎকালীন সরকারের সুবিধাভোগী সাংস্কৃতিককর্মী, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও অতিউৎসাহী চাকরিরত/ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলাগণ বিভিন্ন বিবৃতি-বক্তৃতা, টকশো, কলাম লিখে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট ও মন্তব্য করে, উৎসাহ ও প্ররোচনা দিয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে অপরাধজনক কর্মকাণ্ড করতে বা তার অধীনস্তদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে বাধা না দিয়ে, অর্থায়ন করে, অসত্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে স্বৈরাচার কায়েমের লক্ষ্যে তথা কথিত উন্নয়নের ছদ্মাবরণে আর্থিকখাতে লুটপাট করে, লুটপাটের অর্থ দ্বারা গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করতে ঘাতক বাহিনীর নেতৃত্বকে অর্থায়নের মাধ্যমে বলিয়ান করতে, জবাবদিহিতার আওতায় না এনে লুটপাট করার সুযোগ দিয়ে বিনিময়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও সমর্থন দিয়ে সরাসরি ঘাতকের ভূমিকায় বা নেতৃত্বে থেকে বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত করে।

একইভাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে একই উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকারের হীন-পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন, বিজিবি, আনসারসহ সরকারের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ আটক, নির্যাতন, অপহরণ, গুম এবং প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত: নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত উক্তরূপ হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন ঢাকা থেকে শুরু হয়ে ব্যাপক মাত্রায় ও পদ্ধতিগতভাবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। উক্ত আন্দোলনকে দমন করার অভিপ্রায়ে আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের যৌথ সভায় দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার লক্ষ্যে উপরোল্লিখিত অভিযুক্তগণের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। একই দিনে আরও ৫ জনকে হত্যা করা হয়। উক্ত আক্রমণে দেশব্যাপী অসংখ্য সাধারণ ছাত্রীগণ যৌন নির্যাতনেরও শিকার হন।

উক্ত কোটা সংস্কারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-জনতা কর্তৃক দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ কর্মসূচি, ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’, ‘দেশব্যাপী কমপ্লিট শাটডাউন, অসহযোগ আন্দোলন’সহ বিভিন্ন কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়। উপরোক্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দমনে তৎকালীন সরকার নির্বিচারে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা, হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত ও অগণিত ছাত্র-জনতার ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালায়। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা সরকার পতনের এক-দফা দাবিতে গণভবনের উদ্দেশ্যে গত ৫ই আগস্ট ‘লং-মার্চ টু ঢাকা’- কর্মসূচির ডাক দেয়। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশব্যাপী সাধারণ ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং গণভবনের উদ্দেশ্যে লংমার্চ শুরু করে। উক্ত লংমার্চ কর্মসূচি প্রতিহত করতে অভিযুক্তগণের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালায়। এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আপামর জনতার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট মধ্যাহ্নে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যান। অন্য অভিযুক্তরা অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরেও পূর্ব-নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন সরকারি বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা ৫ই আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা চালিয়ে যায়।

এর ফলে এই গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক জখম, চিরতরে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ববরণ করে এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পরে। তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবন বিপন্ন ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। শতাধিক শিশু এই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করে নির্মম হত্যার শিকার হয় এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করেও ঘরে অবস্থানরত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু হত্যার শিকার হয়। হত্যা করেই ক্ষান্ত হননি। আলামত নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে পৈশাচিকতার আশ্রয়ে অভিযুক্তগণ কর্তৃক শহীদদের লাশের স্তূপ করে পুড়িয়ে দেয়, লাশ গুম করে বেওয়ারিশ হিসেবে মাটিচাপা দেয়। শহীদদের পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফনে বাধা প্রদান করে, ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী লাশ দাফন/সৎকারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত: তড়িঘড়ি করে লাশ দাফনে শহীদ পরিবারকে বাধ্য করে এবং গণঅভ্যুত্থানে আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে গণঅভ্যুত্থানে আহত বা নিহত নয় মর্মে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করে। ভয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা অসুস্থ গুরুতর জখমপ্রাপ্তদের এবং পরে মৃত্যুবরণকারী শহীদদের হাসপাতালে আনার সময় বা আনার পর মৃত্যুবরণকারী আন্দোলনকারীর লাশ হাসপাতালে রেখে আত্মগোপনে যান, ফলে এ ধরনের অসংখ্য লাশ সুরতহাল রিপোর্ট বা ময়নাতদন্ত ব্যতিরেকেই বে-ওয়ারিশ হিসেবে বিভিন্ন কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে শহীদ আন্দোলনকারীর মৃত্যুর বৃত্তান্ত হাসপাতালের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ না করেই পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ দলীয় দুর্বৃত্তদের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য লাশ নিয়ে চলে যান।

লাশবাহী এবং আহত রোগী বহনকারী এম্বুলেন্স ভাঙচুর করে গণসমাগমে বাধা প্রদান করে। আহতদের হাসপাতাল থেকে এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের জানাজারত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে। আন্দোলনরত জনতাকে নির্মূল করতে অভিযুক্তদের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহার করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠন করে।

অভিযুক্তদের নির্দেশে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য গোপন রেখে ভীতি ও গুজব ছড়িয়ে আন্দোলন দমনে চেষ্টা করে। বিগত সরকারের কতিপয় আজ্ঞাবহ সংবাদিক নেতৃবৃন্দের প্ররোচনায় ইলেকট্রনিক/প্রিন্ট মিডিয়া জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করে গণহত্যায় উস্কানি দেয় এবং সঠিক তথ্য জানতে বাধাগ্রস্ত করে। অভিযুক্ত তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন প্রধান হারুন অর রশিদ, যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক র‌্যাব প্রধান মো. হারুন অর রশিদ, সাবেক এনটিএমসি প্রধান সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা অব. মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ কতিপয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে আন্দোলন দমন করার অভিপ্রায়ে আন্দোলনরত নাহিদ ইসলাম ও আসিফ ভূঁইয়াসহ ছয় (৬) জন সমন্বয়ক ছাত্রনেতাসহ অনেককে বেআইনিভাবে ডিবি কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আটক করে রেখে তাদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে।

অভিযুক্তদের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় আন্দোলন দমন করার জন্য সারা দেশে ২৮৬ টি মিথ্যা মামলায় সাড়ে ৪ লাখ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে আসামি করে, তার মধ্যে ১২ (বার) হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রেখে তাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ, দলীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, বিশিষ্ট আমলা, বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ একই উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ে উপরোল্লিখিত অপরাধসমূহ সংঘটনে হুকুম প্রদান, অনুমতি ও সম্মতি প্রদান, প্রচেষ্টা, প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র, উস্কানি প্রদানসহ অধীনস্তদের নিয়ন্ত্রণে অথবা অপরাধ কর্মে বাধা প্রদানে ব্যর্থতা এবং নির্লিপ্ততার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.