গুলিতে ওয়াদুদের মৃত্যু: ৮ বছরের শিশুটি এখন অসহায় by ফাহিমা আক্তার সুমি

‘কী করবো, কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো, কী হবে আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ? আমার আট বছরের শিশুটি বাবাহারা হয়ে গেল। ওর বাবা তাকে অনেক ভালোবাসতো। সে সারাক্ষণ বুলেট-রক্ত, পুলিশের ছবি আঁকে, ছবি এঁকে তার ভেতরের কষ্টগুলো প্রকাশ করে। যখন বাবার জন্য কষ্ট হয় তখন বুকে হাত দিয়ে আমাকে দেখায়। বাবাকে ছাড়া নীরব হয়ে গিয়েছে আমার সন্তানটি। এভাবে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৪৫ বছর বয়সী আব্দুল ওয়াদুদের স্ত্রী। গত ১৯শে জুলাই বিকালের দিকে নিউমার্কেট এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার মাথায় গুলিটি বিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ওয়াদুদ কাপড়ের ব্যবসা করতেন। হুজাইফা তাদের একমাত্র সন্তান। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ওয়াদুদের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন।

ওয়াদুদের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন মানবজমিনকে বলেন, একজন নারীর স্বামী চলে গেলে তার পুরো পৃথিবীটাই শূন্য হয়ে যায়। আমার সংসারটি একেবারে শেষ হয়ে গেছে আর কিছু নেই। আমার সন্তানটি এতিম, অসহায় হয়ে গেছে। এখন আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে কিছু একটা চেষ্টা করতে হবে। এখন আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। চাকরি না করলে আমি আমার সন্তানকে কীভাবে বড় করবো। তাকে কীভাবে মানুষ করবো? আমার বাবা-মা বয়স্ক, তাদেরও ইনকাম সোর্স বন্ধ হয়ে গেছে। আমি জানি না কীভাবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবো। আমি আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচারে ডিপ্লোমা কমপ্লিট করেছি। এরপর বিএসসি মাঝামাঝি এসে নানাবিধ সমস্যার কারণে আর শেষ করতে পারিনি। কিছুদিন একটি বেসরকারি কনসালটেশন ফার্মে চাকরি করেছিলাম। সন্তান হওয়ার পরে চাকরিটা ছেড়ে দেই। এই পরিস্থিতিতে আমার একটা চাকরি খুব দরকার। এখন যদি আমি চাকরি না করি তাহলে আমার সন্তানটিকে নিয়ে ভেসে যেতে হবে। সরকারের কাছে আমি এতটুকু চাই আমার একটা পুর্নবাসন হোক, একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হোক।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমার স্বামী কাপড়ের ব্যবসা করতেন নিউমার্কেটে। আমরা আজিমপুর কলোনিতে থাকি। ১৯শে জুলাই শুক্রবার কলোনির ভেতর দিয়ে নিউমার্কেট ১ নম্বর গেটের অপজিটে যায়। সেখান থেকে মসজিদে নামাজ পড়ে মার্কেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। সেখানে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল। আমার সঙ্গে কথা বলে মাত্র লাইনটা কেটেছে মোবাইলটা পকেটে রাখেনি। এসময় হঠাৎ করে পুলিশ নীলক্ষেতের দিক থেকে বিকালে গুলি করা শুরু করেছে। সেখানে ৫০-৬০ জনের মতো লোক দাঁড়িয়ে ছিল; এরমধ্যে ৫-৬ জন লোক স্পটে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যায়, তারমধ্যে আমার স্বামী ছিল একজন। আহত অবস্থায় তাকে ধরে লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার স্বামী চেয়েছিল সেখান থেকে যদি পরিস্থিতি ভালো মনে হয় তাহলে সে মার্কেটের দিকে যাবে না হলে বাসায় চলে আসবে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় রাস্তায়। মোবাইলটি নিয়ে সেখানে থাকা এক ভাই আমার নাম্বারে শেষ ডায়াল দেখে আমাকে কল করে ঘটনাটি জানান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ২-৩ মিনিট আগে আমার সঙ্গে কথা হয়। খবর শুনে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। প্রথমে আমরা কোন হাসপাতালে নিয়েছে এটি জানতে পারিনি। পরে আমার ভাইকে বললে সে দৌড়ে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চলে যায় সেখানে গিয়ে দেখে আমার স্বামীর চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালে নেয়ার আধাঘণ্টা পরে সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। আমি গিয়ে আমার স্বামীকে আর দেখতে পাইনি। মৃত্যুর তিন দিন পরে তার মরদেহ আমরা হাসপাতাল থেকে পাই। পরে তাকে গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাখরগঞ্জে নিয়ে দাফন করা হয়।

শাহনাজ পারভীন বলেন, আমার শ্বশুর আমাদের বিয়ের আগে মারা যান। তিনি খুলনা জুটমিলে চাকরি করতেন। আমি আজিমপুরে আমার বাবার সঙ্গে আছি। গ্রামে গেলে সেখানে আমাদের দেখার কেউ নেই, আমার সন্তানের পড়াশোনাও ঠিকমতো হবে না। সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আমার বাবা এ বছর অবসরে এসেছেন। কোনোমতে আমাদের দিন যাচ্ছে। আমি তো কোথাও চাকরি করি না, আমার স্বামীই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সে যা আয় করতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। আমরা দুই ভাইবোন। আমার ভাইও তেমন কিছু করে না। যা চাপ যাচ্ছে সব আমার বাবার উপর দিয়ে। একসময় হয়তো বাবা এই সাপোর্টটি দিতে পারবে না। আমাদের একটা মাত্র সন্তান, ওর বাবা তাকে অনেক ভালোবাসতো। কখনো সন্তানের গায়ে হাত দেয়নি, ধমক দিয়ে কথা বলেনি। অনেক ভালো বাবা ছিল সে। আমার ছেলে সব সময় বলে আম্মু আমার বাবাকে মেরে ফেলছে। সে সারাক্ষণ ছবি আঁকে। ছবির মাধ্যমে তার ভেতরের কষ্টগুলো প্রকাশ করে। বাবার জন্য তার কষ্ট হয়; বুক দেখিয়ে বলে এখানে কষ্ট হয়। ওর বাবার দাফনের সময় কবরে প্রথম মাটিটুকু ওর হাত দিয়ে দিয়েছে। ওর বাবা যে আর ফিরে আসবে না সে এতটুকুই বুঝে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.