৮৮ পাউন্ডের লুলুলেমন, নির্মাতারা নির্যাতিত by সারা মার্শ ও রেদোয়ান আহমেদ
লুলুলেমন
একটি পোশাকের ব্রান্ড নাম। মেয়েদের পোশাক লেগিন্স বিক্রি করে তারা । যারা
ইয়োগা করেন, তারা লেগিন্স পরেন। সেলিব্রিটিদের টপ ফেভারিট। যেসব
সেলিব্রিটি ইনস্টাগ্রামে ঝড় তোলেন তাদের গায়ে এই জমকালো লেগিন্স দেখা যায়।
৮৮ পাউন্ড দাম।
কিন্তু তাদের এই পোশাক কোত্থেকে আসছে, তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে , এই পোশাক তৈরি করেছেন যারা, তারা বাংলাদেশী কারখানায় কর্মরত নারী । যারা প্রায় নিয়মিতভাবে কারখানাগুলাতে প্রহৃত এবং শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন ।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্প্রতি কানাডিয় কোম্পানি লুলুলেমনের একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি সই হয়েছে।
যার লক্ষ্য হচ্ছে নারী সাহায্য কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করা । তাদের উপর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করা।
কিন্তু বাংলাদেশের কারখানায় কর্মরত মেয়ে কর্মীরা মজুরি বঞ্চনার এক দুঃখজনক উপাখ্যান তুলে ধরেছেন । তারা কম বেতন পান। শারীরিক সহিংসতার শিকার হন। আর তাদের যারা ম্যানেজার, তারা সবসময়ই তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। এমনকি হরহামেশা তাদেরকে বেশ্যা বলতেও তাদের বাধে না।
শ্রমিকরা যেসব অভিযোগ করেন:
কারখানা শ্রমিকরা যদি কখনো কোনো নিয়ম ভাঙ্গেন, অথবা প্রত্যাশিত সময়ের কাজ করার চেয়ে যদি আগে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে ম্যানেজাররা তাদেরকে বকাঝকা করেন। এমনকি চড়-থাপ্পড় দিতেও ছাড়েন না । অনেক শ্রমিক বলেছেন, ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও তাদেরকে অনেক সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
অনেক শ্রমিককে মাসে মাত্র ৮৫ পাউন্ড বা ৯১০০ টাকা পরিশোধ করা হয় । এটা হল একজোড়া লেগিন্সের চেয়ে কম। কারণ একজোড়া লেগিন্স কিনতে খরচ পড়ে ১৩৮ দশমিক ৫০ পাউন্ড। ইউনিয়নগুলো নূণ্যতম মজুরি হিসেবে দাবি করে ১৬ হাজার টাকা। সেই দাবি করা টাকা থেকেও এটা যথেষ্ট কম। আর তাদের ন্যায্য মজুরি হিসেবে যা অনুমান করা হয়, সেই হার থেকে ঢের কম।
তাদেরকে ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়, যাতে তারা টার্গেট পূরণ করতে পারে । এমনকি অনেক সময় উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করা না পর্যন্ত তারা কেউ অসুস্থ হলেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারে না।
লুলুলেমন অবশ্য বলেছে, কর্মস্থলে কি ধরনের আচরণ করা হবে, সেই বিষয়ে প্রণীত কোড অনুসরণে তারা অত্যন্ত সতর্ক থাকেন এবং এর কোনো লংঘন তারা সহ্য করেন না । কোম্পানিটি বলেছে, বাংলাদেশে যে এই অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তারা অনতিবিলম্বে তদন্ত শুরু করবে। একজন মুখপাত্র বলেছেন, অভিযুক্ত ফ্যাক্টরির জন্য বর্তমানে কোন ক্রয় ফরমায়েশ দেওয়া নেই। এবং আমরা তদন্তের ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি সব শ্রমিকদেরকেই সমানভাবে এবং ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহার করা হবে। এবং আমরা বাংলাদেশে লুলুলেমনের তদন্তের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ওই কারখানার একজন শ্রমিক দাবি করেছেন, একটু আগে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য তাকে থাপ্পড় মারা হয়েছিল । কারণ তার শরীর খারাপ লাগার কারণে সে আগে যেতে চেয়েছে। ওই নারী কর্মী বলেন, আমি আসলে অসুস্থ ছিলাম । একদিন আমি বিকেল পাঁচটায় কর্মস্থল ত্যাগ করি। কিন্তু আমি সেটা লাইন সুপারভাইজারকে জানিয়ে যাই । কিন্তু সে তার বসকে বলেছিল, আমি কাউকে কিছু না বলে কর্মস্থল ত্যাগ করেছি । পরের দিন আমি যখন কাজে যাই, আমার লাইন টেকনিশিয়ান আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল । সেই থাপ্পর এতটাই জোরালো ছিল যে , আমার গাল লাল হয়ে যায় এবং প্রত্যেকে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছে , কি ঘটেছে। আমি তাদের কাউকে বলিনি প্রকৃত কি ঘটেছে। আমি তাদের বলেছিলাম, আমার এলার্জি উঠেছে । ওই নারী শ্রমিক আরও দাবি করেছেন, তিনি এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি । কারণ তিনি জানেন, এ বিষয়ে অভিযোগ করে কোন লাভ নেই ।
ওই নারী কর্মীটি আরো বলেছেন , গত রমজানে কারখানাটি একটি নতুন লাইন তৈরি করে । আর সেজন্য তারা নতুন মেয়েদেরকে নিয়োগ দিয়েছিল । একদিন একজন টেকনিশিয়ান একজন লেবেল অপারেটরকে বুকে যথেষ্ট জোরালোভাবে আঘাত করেছিল । আমরা দেখেছি সারাদিন সে কিভাবে ব্যথায় কুঁকড়ে থেকেছে । লাইনের পেছনে সে কয়েক ঘন্টা শুয়ে থাকে। কিন্তু তার বিষয়ে আমাদের বসরা কোন কিছুই করেননি।
গত ৮ অক্টোবর জাতিসংঘ ফাউন্ডেশন (ইউএনএফ) এর সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বের চুক্তি করেছে লুলুলেমন । তারা বলেছে গত তিন বছর ধরে লেগিন্স কোম্পানি এবং ইউএনএফ একটি এভিডেন্স ভিত্তিক মাইন্ডফুলনেস ইয়োগা এবং সেলফ–কেয়ার প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ডেভলপ করার চেষ্টা করছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশের পাচশ জনেরও বেশি সাহায্যকর্মীদের উপরে তারা এই বিষয়ে পাইলট টেস্টিং করেছে।
লুলুলেমন সম্প্রতি তাদের ব্যবসা ভবিষ্যতে আরও কত বড় হবে, তার একটা ধারণা দিয়েছে । এই কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৯ সালের শেষে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে। ১৯৯৮ সালে ক্যানাডিয়ান বিজনেসম্যান চিপ উইলসন লুলুলেমন শুরু করেছিলেন । সেই থেকে তারা এই ব্যবসা ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত করে চলছে। কিন্তু তারা এই পোশাক কিনছেন এমন সব দেশ থেকে, যেখানে শ্রম সস্তা । আর এসব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা , কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম।
লুলুলেমন তার ওয়েবসাইটে বলেছে , আমাদের ভেন্ডর কোড অফ এথিক্স বাংলাদেশসহ যেখানেই পণ্য উৎপাদন হয়, সবার জন্য প্রযোজ্য এবং তা নিশ্চিত করছে যে আইনগত এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য নির্বিশেষে আমরা একটি অভিন্ন নীতি অনুসরণ করছি।
লুলুলেমন ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেফটি অ্যাকর্ড সই করতে মাসের-পর-মাস কাটানো নিয়ে সমালোচিত হয়েছিল । ১১৩৬ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায়। আর তার পরপরই ওই সেফটি চুক্তিতে তাকে সই করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । তখন একটা পিটিশন প্রকাশ করা হয়েছিল যাতে তারা তাদের ইথিকস এবং দায়িত্বশীলতার বিষয়ে সজাগ থাকে।
দি গার্ডিয়ান একজন পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে । ওই শ্রমিকটি দাবি করেছে, তিনি প্রত্যক্ষদর্শী যে, নারী শ্রমিকদেরকে সাধারনত ’’’প্রস্টিটিউট এবং হোর, স্লাট’’ হিসেবে ডাকা হয়ে থাকে । তার আরও অভিযোগ, পুরুষ কর্মীদেরকেও অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকে তারা। অনেক সময় তারা পুরুষ কর্মীদেরকে উপহাস করে । তার কথায়, আমি নিজে কখনো মার খাইনি কিন্তু অন্যদেরকে প্রহৃত হতে দেখেছি।
শ্রমিকরা আরও অভিযোগ করেছেন যে, তারা যখন কর্মক্ষেত্রে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন, তখন তারা চাইলেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন না । মেডিকেল টিম একটি মেয়েকে তার জন্ডিস হওয়ার কারণে তাকে কর্মবিরতির সুবিধা দেয়। তাকে বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তার প্রোডাকশন ম্যানেজার তাকে জানিয়ে দিয়েছে , তাকে অবশ্যই কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। শ্রমিকরা আরও দাবি করেছে, তারা অনেক সময় দেখতে পায় যে , তারা ইচ্ছে করে কম কর্মী নিয়োগ করে। তাদের উপরে তখন কাজের চাপ অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের প্রতি নির্দেশনা থাকে , তাদেরকে অবশ্যই টার্গেট পূরণ করতে হবে । একজন শ্রমিকের কথায়- সুতরাং শ্রমিকদের কোন উপায় থাকে না । তাদেরকে বাড়তি কাজ করতে হয়। তারা খাবার সময় পায়না। বিশ্রাম পায় না । যা খুবই খারাপ।
টুমো পুটিয়ানিন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলওর) কান্ট্রি ডিরেক্টর। তিনি বলেছেন, যেকোনো ধরনের বাংলাদেশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা মোকাবেলায় সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
লেবার বাহাইন্ড দ্যা লেভেল’’ একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ। এই সংগঠনের এ্যাডভোকেসি পরিচালক আন্না ব্রেহার। তার কথায়, একটি সাপ্লাই চেইনের একেবারে তলানিতে থাকা নারীদেরকে যেভাবে ফ্যাশন তৈরীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাদের শ্রম শুষে নেওয়া হয়, সেটা আসলেই একেবারে একটা অবসিন( অশ্লীল) ঘটনা। তার কথায়, এইসব গল্প খুবই মর্মান্তিক এবং তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । বাংলাদেশের যেসব নারীরা আমাদের জন্য কাপড় তৈরি করে তারা রুটিনমাফিক পদ্ধতিগতভাবে হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন । তিনি আরো বলেছেন,
আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর যারা বাংলাদেশে শ্রমিকদের কে ব্যবহার করে সস্তায় কাপড় তৈরি করেন, তাদের কর্মক্ষেত্রে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ ভাগ বাংলাদেশি শ্রমিক বলেছেন তারা কর্ম ক্ষেত্রে কোন না কোন ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
লুলুলেমন কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এবং এথিকসের প্রয়োজনে আমরা সজাগ। আমরা যেখান থেকেই আউটসোর্সিং করি না কেন, এথিক্স আমরা সমুন্নত রাখব। এটাই আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে সব থেকে শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ আমরা মেনে চলি। আমরা কখনোই এই কোডের ভায়োলেশন সহ্য করি না । বাংলাদেশে একটি কারখানা সম্পর্কে এ ধরনের রিপোর্ট জানতে পেরেই আমরা তদন্ত শুরু করেছি । বর্তমানে আমরা ওই কারখানাকে আর কোন ধরনের অর্ডার দেইনি । এবং তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এদিকে ইয়ংগাল কর্পোরেশন বলেছে, তারা কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ এবং সব ধরনের ন্যায্য আচার-আচরণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ । বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে কর্মীদেরকে তারা তাদের মতামত এবং তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার বিষয়টি উৎসাহিত করে থাকে । কোম্পানিটি আরো বলেছে ,যখন কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় , তারা তা প্রতিকারের উদ্যোগ নেন এবং শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন । যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
>>>দি গার্ডিয়ানে ১৪ অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তর্জমা
কিন্তু তাদের এই পোশাক কোত্থেকে আসছে, তার অনুসন্ধানে দেখা গেছে , এই পোশাক তৈরি করেছেন যারা, তারা বাংলাদেশী কারখানায় কর্মরত নারী । যারা প্রায় নিয়মিতভাবে কারখানাগুলাতে প্রহৃত এবং শারীরিকভাবে নির্যাতিত হন ।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সম্প্রতি কানাডিয় কোম্পানি লুলুলেমনের একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি সই হয়েছে।
যার লক্ষ্য হচ্ছে নারী সাহায্য কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করা । তাদের উপর মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করা।
কিন্তু বাংলাদেশের কারখানায় কর্মরত মেয়ে কর্মীরা মজুরি বঞ্চনার এক দুঃখজনক উপাখ্যান তুলে ধরেছেন । তারা কম বেতন পান। শারীরিক সহিংসতার শিকার হন। আর তাদের যারা ম্যানেজার, তারা সবসময়ই তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। এমনকি হরহামেশা তাদেরকে বেশ্যা বলতেও তাদের বাধে না।
শ্রমিকরা যেসব অভিযোগ করেন:
কারখানা শ্রমিকরা যদি কখনো কোনো নিয়ম ভাঙ্গেন, অথবা প্রত্যাশিত সময়ের কাজ করার চেয়ে যদি আগে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে ম্যানেজাররা তাদেরকে বকাঝকা করেন। এমনকি চড়-থাপ্পড় দিতেও ছাড়েন না । অনেক শ্রমিক বলেছেন, ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও তাদেরকে অনেক সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
অনেক শ্রমিককে মাসে মাত্র ৮৫ পাউন্ড বা ৯১০০ টাকা পরিশোধ করা হয় । এটা হল একজোড়া লেগিন্সের চেয়ে কম। কারণ একজোড়া লেগিন্স কিনতে খরচ পড়ে ১৩৮ দশমিক ৫০ পাউন্ড। ইউনিয়নগুলো নূণ্যতম মজুরি হিসেবে দাবি করে ১৬ হাজার টাকা। সেই দাবি করা টাকা থেকেও এটা যথেষ্ট কম। আর তাদের ন্যায্য মজুরি হিসেবে যা অনুমান করা হয়, সেই হার থেকে ঢের কম।
তাদেরকে ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়, যাতে তারা টার্গেট পূরণ করতে পারে । এমনকি অনেক সময় উৎপাদনের টার্গেট পূরণ করা না পর্যন্ত তারা কেউ অসুস্থ হলেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারে না।
লুলুলেমন অবশ্য বলেছে, কর্মস্থলে কি ধরনের আচরণ করা হবে, সেই বিষয়ে প্রণীত কোড অনুসরণে তারা অত্যন্ত সতর্ক থাকেন এবং এর কোনো লংঘন তারা সহ্য করেন না । কোম্পানিটি বলেছে, বাংলাদেশে যে এই অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে তারা অনতিবিলম্বে তদন্ত শুরু করবে। একজন মুখপাত্র বলেছেন, অভিযুক্ত ফ্যাক্টরির জন্য বর্তমানে কোন ক্রয় ফরমায়েশ দেওয়া নেই। এবং আমরা তদন্তের ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি সব শ্রমিকদেরকেই সমানভাবে এবং ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহার করা হবে। এবং আমরা বাংলাদেশে লুলুলেমনের তদন্তের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ওই কারখানার একজন শ্রমিক দাবি করেছেন, একটু আগে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার জন্য তাকে থাপ্পড় মারা হয়েছিল । কারণ তার শরীর খারাপ লাগার কারণে সে আগে যেতে চেয়েছে। ওই নারী কর্মী বলেন, আমি আসলে অসুস্থ ছিলাম । একদিন আমি বিকেল পাঁচটায় কর্মস্থল ত্যাগ করি। কিন্তু আমি সেটা লাইন সুপারভাইজারকে জানিয়ে যাই । কিন্তু সে তার বসকে বলেছিল, আমি কাউকে কিছু না বলে কর্মস্থল ত্যাগ করেছি । পরের দিন আমি যখন কাজে যাই, আমার লাইন টেকনিশিয়ান আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল । সেই থাপ্পর এতটাই জোরালো ছিল যে , আমার গাল লাল হয়ে যায় এবং প্রত্যেকে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছে , কি ঘটেছে। আমি তাদের কাউকে বলিনি প্রকৃত কি ঘটেছে। আমি তাদের বলেছিলাম, আমার এলার্জি উঠেছে । ওই নারী শ্রমিক আরও দাবি করেছেন, তিনি এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অভিযোগ করেননি । কারণ তিনি জানেন, এ বিষয়ে অভিযোগ করে কোন লাভ নেই ।
ওই নারী কর্মীটি আরো বলেছেন , গত রমজানে কারখানাটি একটি নতুন লাইন তৈরি করে । আর সেজন্য তারা নতুন মেয়েদেরকে নিয়োগ দিয়েছিল । একদিন একজন টেকনিশিয়ান একজন লেবেল অপারেটরকে বুকে যথেষ্ট জোরালোভাবে আঘাত করেছিল । আমরা দেখেছি সারাদিন সে কিভাবে ব্যথায় কুঁকড়ে থেকেছে । লাইনের পেছনে সে কয়েক ঘন্টা শুয়ে থাকে। কিন্তু তার বিষয়ে আমাদের বসরা কোন কিছুই করেননি।
গত ৮ অক্টোবর জাতিসংঘ ফাউন্ডেশন (ইউএনএফ) এর সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বের চুক্তি করেছে লুলুলেমন । তারা বলেছে গত তিন বছর ধরে লেগিন্স কোম্পানি এবং ইউএনএফ একটি এভিডেন্স ভিত্তিক মাইন্ডফুলনেস ইয়োগা এবং সেলফ–কেয়ার প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ডেভলপ করার চেষ্টা করছে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আটটি দেশের পাচশ জনেরও বেশি সাহায্যকর্মীদের উপরে তারা এই বিষয়ে পাইলট টেস্টিং করেছে।
লুলুলেমন সম্প্রতি তাদের ব্যবসা ভবিষ্যতে আরও কত বড় হবে, তার একটা ধারণা দিয়েছে । এই কোম্পানিটি তাদের ব্যবসা ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৯ সালের শেষে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারবে। ১৯৯৮ সালে ক্যানাডিয়ান বিজনেসম্যান চিপ উইলসন লুলুলেমন শুরু করেছিলেন । সেই থেকে তারা এই ব্যবসা ক্রমাগতভাবে সম্প্রসারিত করে চলছে। কিন্তু তারা এই পোশাক কিনছেন এমন সব দেশ থেকে, যেখানে শ্রম সস্তা । আর এসব দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা , কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম।
লুলুলেমন তার ওয়েবসাইটে বলেছে , আমাদের ভেন্ডর কোড অফ এথিক্স বাংলাদেশসহ যেখানেই পণ্য উৎপাদন হয়, সবার জন্য প্রযোজ্য এবং তা নিশ্চিত করছে যে আইনগত এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্য নির্বিশেষে আমরা একটি অভিন্ন নীতি অনুসরণ করছি।
লুলুলেমন ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সেফটি অ্যাকর্ড সই করতে মাসের-পর-মাস কাটানো নিয়ে সমালোচিত হয়েছিল । ১১৩৬ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায়। আর তার পরপরই ওই সেফটি চুক্তিতে তাকে সই করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । তখন একটা পিটিশন প্রকাশ করা হয়েছিল যাতে তারা তাদের ইথিকস এবং দায়িত্বশীলতার বিষয়ে সজাগ থাকে।
দি গার্ডিয়ান একজন পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে । ওই শ্রমিকটি দাবি করেছে, তিনি প্রত্যক্ষদর্শী যে, নারী শ্রমিকদেরকে সাধারনত ’’’প্রস্টিটিউট এবং হোর, স্লাট’’ হিসেবে ডাকা হয়ে থাকে । তার আরও অভিযোগ, পুরুষ কর্মীদেরকেও অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকে তারা। অনেক সময় তারা পুরুষ কর্মীদেরকে উপহাস করে । তার কথায়, আমি নিজে কখনো মার খাইনি কিন্তু অন্যদেরকে প্রহৃত হতে দেখেছি।
শ্রমিকরা আরও অভিযোগ করেছেন যে, তারা যখন কর্মক্ষেত্রে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন, তখন তারা চাইলেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেন না । মেডিকেল টিম একটি মেয়েকে তার জন্ডিস হওয়ার কারণে তাকে কর্মবিরতির সুবিধা দেয়। তাকে বিশ্রামের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তার প্রোডাকশন ম্যানেজার তাকে জানিয়ে দিয়েছে , তাকে অবশ্যই কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। শ্রমিকরা আরও দাবি করেছে, তারা অনেক সময় দেখতে পায় যে , তারা ইচ্ছে করে কম কর্মী নিয়োগ করে। তাদের উপরে তখন কাজের চাপ অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাদের প্রতি নির্দেশনা থাকে , তাদেরকে অবশ্যই টার্গেট পূরণ করতে হবে । একজন শ্রমিকের কথায়- সুতরাং শ্রমিকদের কোন উপায় থাকে না । তাদেরকে বাড়তি কাজ করতে হয়। তারা খাবার সময় পায়না। বিশ্রাম পায় না । যা খুবই খারাপ।
টুমো পুটিয়ানিন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলওর) কান্ট্রি ডিরেক্টর। তিনি বলেছেন, যেকোনো ধরনের বাংলাদেশ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটা মোকাবেলায় সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
লেবার বাহাইন্ড দ্যা লেভেল’’ একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ। এই সংগঠনের এ্যাডভোকেসি পরিচালক আন্না ব্রেহার। তার কথায়, একটি সাপ্লাই চেইনের একেবারে তলানিতে থাকা নারীদেরকে যেভাবে ফ্যাশন তৈরীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাদের শ্রম শুষে নেওয়া হয়, সেটা আসলেই একেবারে একটা অবসিন( অশ্লীল) ঘটনা। তার কথায়, এইসব গল্প খুবই মর্মান্তিক এবং তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । বাংলাদেশের যেসব নারীরা আমাদের জন্য কাপড় তৈরি করে তারা রুটিনমাফিক পদ্ধতিগতভাবে হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন । তিনি আরো বলেছেন,
আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর যারা বাংলাদেশে শ্রমিকদের কে ব্যবহার করে সস্তায় কাপড় তৈরি করেন, তাদের কর্মক্ষেত্রে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ ভাগ বাংলাদেশি শ্রমিক বলেছেন তারা কর্ম ক্ষেত্রে কোন না কোন ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
লুলুলেমন কোম্পানির একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমরা একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এবং এথিকসের প্রয়োজনে আমরা সজাগ। আমরা যেখান থেকেই আউটসোর্সিং করি না কেন, এথিক্স আমরা সমুন্নত রাখব। এটাই আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতে সব থেকে শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ আমরা মেনে চলি। আমরা কখনোই এই কোডের ভায়োলেশন সহ্য করি না । বাংলাদেশে একটি কারখানা সম্পর্কে এ ধরনের রিপোর্ট জানতে পেরেই আমরা তদন্ত শুরু করেছি । বর্তমানে আমরা ওই কারখানাকে আর কোন ধরনের অর্ডার দেইনি । এবং তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এদিকে ইয়ংগাল কর্পোরেশন বলেছে, তারা কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ এবং সব ধরনের ন্যায্য আচার-আচরণ বজায় রাখার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ । বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে কর্মীদেরকে তারা তাদের মতামত এবং তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার বিষয়টি উৎসাহিত করে থাকে । কোম্পানিটি আরো বলেছে ,যখন কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় , তারা তা প্রতিকারের উদ্যোগ নেন এবং শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন । যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
>>>দি গার্ডিয়ানে ১৪ অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তর্জমা
No comments