শেয়ারবাজার টালমাটাল: বিনিয়োগকারীদের কান্না
টালমাটাল
দেশের শেয়ারবাজার। অব্যাহত দর পতনে বিনিয়োগকারীদের কান্নায় ভারী হচ্ছে
বাতাস। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। দিন দিন পতন আরো
গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। প্রায় সব কোম্পানি ক্রমাগত দর হারাচ্ছে। ফলে ঢাকা
স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক প্রায় তিন বছর আগের অবস্থানে ফিরে
গেছে। একই সঙ্গে বাজার মূলধন, লেনদেনও তলানিতে নেমে যাচ্ছে। বাজারের
স্থিতিশীলতা ফেরাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও নিয়ন্ত্রক
সংস্থা-বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের আশ্বাস এবং তারল্য সংকট কাটাতে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগেও কোন কাজ হচ্ছে না।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসেও মূল্য সূচকের পতনেই লেনদেন শেষ হয়েছে পুঁজিবাজারে। এদিন ডিএসইতে লেনদেন কমেছে। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজারের বর্তমান অবস্থা ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের ধ্বসকেও হার মানিয়েছে। ওই দুই সময়ের ধ্বসে বড় ধরনের সংস্কার এবং প্রণোদনা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। এ অবস্থায় পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। ফলে নীরব কান্না চলছে শেয়ারবাজারে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কোনো বিনিয়োগকারীই পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না। নতুন করে বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো অনেকে বড় লোকসান দিয়ে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করছেন। যাদের লোকসান মাত্রাতিরিক্ত, তারাই লোকসান কমানোর আশায় এক শেয়ার বিক্রি করে অন্য শেয়ার কিনছেন। কিন্তু লোকসান তো কমছেই না, বরং পাল্লা বাড়ছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কারণ বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সূচক যেমন তলানিতে, আস্থাও তলানিতে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতিমূল্যায়িত আইপিও পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তুলেছে। অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বাজার প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, ডিএসইর প্রধান সূচকটি চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল গত ২৪শে জানুয়ারি। ওই দিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে ও বাজার মূলধন ছিল প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। গতকাল সেই সূচক নেমে এসেছে ৪ হাজার ৭৭০ পয়েন্টে আর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে সূচক কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ আর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৯ কোম্পানির মধ্যে ৪৬টি বা প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগই বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বাজারে এসেছে। অনুমোদন দেয়া নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, তারল্য সংকট, আর্থিক খাতের খারাপ অবস্থা এবং গ্রামীণফোনের সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সংকট আছে সেটা রয়ে গেছে। ব্যাংকের সুদের হার এখনও বেশি। এটার নেতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে আছে। গ্রামীণফোন পুঁজিবাজারের প্রায় ১০ শতাংশর মত। এটার সঙ্গে কর নিয়ে যে একটি সমস্যা সেটার সমাধান হয়নি। এর বড় প্রভাব ফেলছে বাজারে। শাকিল রিজভী মনে করেন, বাজারে এখন আস্থার সংকটই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর এই তিন সমস্যা দূর না হলে বাজারে আস্থা ফিরবে না। বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখি হবেন না। বাজার স্বাভাবিক হবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও শাকিল রিজভীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ব্যাংকিং খাত ঠিক না হলে শেয়ার বাজার ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার ডিএসই প্রধান বা ডিএসইএক্স সূচক ১০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৭৭০ পয়েন্টে। গত সোমবার ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিনিয়োগের ঘোষণার পর মঙ্গলবার বড় উত্থান হলেও বুধবার আবার পতনে ফিরেছে শেয়ারবাজার। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরিয়াহ সূচক ৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৪ পয়েন্টে এবং ডিএস ৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৭৯ পয়েন্টে। ডিএসইতে গতকাল টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৩১৩ কোটি টাকার। যা গত কার্যদিবস থেকে ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গতকাল ডিএসইতে ৩৫০টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৪৫টির, কমেছে ১৬২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৩টির।
অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৪ হাজার ৫১১ পয়েন্টে। সিএসইতে টাকার অংকে ১৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে সিএসইতে লেনদেনে অংশ নিয়েছে ২৫৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১০২ টির, কমেছে ১২৪টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৯টির।
বাজারের এমন আচরণে হতাশ সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও। সংশ্লিষ্টরা জানান, মঙ্গলবার গুঞ্জন ছিল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ পদে বড় রদবদল হচ্ছে। ওই দিন বিকালেই অবশ্য জানা যায়, এটি গুজব। বাজারের বিপরীতমুখী অবস্থার ক্ষেত্রে এ খবরের যোগসূত্র রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এদিকে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনছেন বিক্রি করে দিচ্ছেন তার চেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এখানে আশ্বস্ত করব সবাইকে যে, আমরা পুঁজিবাজারকে সুশাসন দেব এবং আমরা গর্ভন্যান্সে ভালো করব। এভাবে আমাদের পুঁজিবাজারকে আমরা একটি শক্তিশালী বাজারে রূপান্তরিত করব। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে নগদ অর্থ জোগান দেয়ার উদ্যোগ নেয়। এর বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবিকে। আইসিবি ওই টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব শিগগিরই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। কিছু ভালো লাভজনক প্রতিষ্ঠান দু-এক মাসের মধ্যেই বাজারে আসবে। এরপরও বাজারে পতন চলছেই। অর্থাৎ আস্থার সংকটে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করাই এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান কাজ।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খোদ স্টক ব্রোকার মালিকরা। তাদের ব্যবসা সংকোচনের নামে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছেন।
একজন ব্রোকার মালিক জানান, ২০১০ সালের পর দীর্ঘ সময়ে লোকসান দিয়ে হাউস পরিচালনা করেছেন। এর পর কোম্পানির রিজার্ভ থেকে কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করেছেন। এখন রিজার্ভের খাতা শূন্যের কোঠায় নামছে। ফলে বাধ্য হয়েই কর্মী ছাঁটাইয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শাকিল রিজভী বলেন, পরিস্থিতি ভালো না। প্রতিদিনই লোকসান দিতে দিতে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও এতটাই কমেছে যে, তারা এর দিকে ফিরে তাকাতেও বিরক্ত বোধ করছেন। অনেক ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কারণ শেয়ার কেনাবেচা থেকে যে কমিশন আয় হচ্ছে, তা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া তো দূরের কথা, দৈনন্দিন অফিস খরচই মেটাতে পারছে না। এভাবে কতদিন চলবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী সোহেল হাসান বলেন, কয়েক মাস আগে একটি কোম্পানির শেয়ার ৬ টাকা ৭০ পয়সায় কিনেছিলেন। এখন সেই শেয়ারের মূল্য কমে ৪ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছে। আলোচ্য সময়ে তিনি পুঁজি খুইয়েছেন ৩৩ শতাংশ। তিনি বলেন, কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য কমেছে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই।
হাসিবুল হাসিব নামের আরেক বিনিয়োগকারী একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন ৭৭ টাকা করে। সর্বশেষ সেই শেয়ারের মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকায়। আলোচ্য সময়ে তিনি পুঁজি হারিয়েছেন ৩৯ শতাংশ। আরেক বিনিয়োগকারী আতিকুল ইসলাম জাহিন স্পিনিংয়ের প্রতিটি শেয়ার কিনেছিলেন ৯ টাকা ৬০ পয়সায়। এখন সেই শেয়ারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৫ পয়সা। আলোচ্য সময়ে তার পুঁজি হারিয়েছে ৪৩ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে তাদের বিনিয়োগ করা পুঁজি খুইয়েছেন। তবে শেয়ারের এই মূল্য কমে যাওয়ার কোনো কারণ কোম্পানি বা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অব্যাহত দরপতনে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই এখন লোকসানে। লোকসান আরো বাড়বে এমন শঙ্কায় অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বিক্রির চাপ বেড়ে দরপতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিক্রির চাপ বাড়লেও তা সামাল দেয়ার জন্য যে সহায়তা দরকার, তা বাজারে নেই।
সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসেও মূল্য সূচকের পতনেই লেনদেন শেষ হয়েছে পুঁজিবাজারে। এদিন ডিএসইতে লেনদেন কমেছে। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক কমলেও লেনদেন বেড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজারের বর্তমান অবস্থা ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের ধ্বসকেও হার মানিয়েছে। ওই দুই সময়ের ধ্বসে বড় ধরনের সংস্কার এবং প্রণোদনা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। এ অবস্থায় পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। ফলে নীরব কান্না চলছে শেয়ারবাজারে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। কোনো বিনিয়োগকারীই পুঁজি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না। নতুন করে বিনিয়োগ তো আসছেই না, উল্টো অনেকে বড় লোকসান দিয়ে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করছেন। যাদের লোকসান মাত্রাতিরিক্ত, তারাই লোকসান কমানোর আশায় এক শেয়ার বিক্রি করে অন্য শেয়ার কিনছেন। কিন্তু লোকসান তো কমছেই না, বরং পাল্লা বাড়ছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই প্রধান সূচক প্রায় ৯ মাসে কমেছে ১ হাজার ২০০ পয়েন্ট। একই সময়ের ব্যবধানে বাজার মূলধন বা শেয়ারের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কারণ বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সূচক যেমন তলানিতে, আস্থাও তলানিতে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতিমূল্যায়িত আইপিও পুঁজিবাজারকে অস্থির করে তুলেছে। অন্যদিকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বাজার প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, ডিএসইর প্রধান সূচকটি চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল গত ২৪শে জানুয়ারি। ওই দিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে ও বাজার মূলধন ছিল প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। গতকাল সেই সূচক নেমে এসেছে ৪ হাজার ৭৭০ পয়েন্টে আর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে সূচক কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ আর বাজার মূলধন কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১৯ কোম্পানির মধ্যে ৪৬টি বা প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগই বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে বাজারে এসেছে। অনুমোদন দেয়া নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেছেন, তারল্য সংকট, আর্থিক খাতের খারাপ অবস্থা এবং গ্রামীণফোনের সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যে তারল্য সংকট আছে সেটা রয়ে গেছে। ব্যাংকের সুদের হার এখনও বেশি। এটার নেতিবাচক প্রভাব পুঁজিবাজারে আছে। গ্রামীণফোন পুঁজিবাজারের প্রায় ১০ শতাংশর মত। এটার সঙ্গে কর নিয়ে যে একটি সমস্যা সেটার সমাধান হয়নি। এর বড় প্রভাব ফেলছে বাজারে। শাকিল রিজভী মনে করেন, বাজারে এখন আস্থার সংকটই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর এই তিন সমস্যা দূর না হলে বাজারে আস্থা ফিরবে না। বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখি হবেন না। বাজার স্বাভাবিক হবে না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও শাকিল রিজভীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ব্যাংকিং খাত ঠিক না হলে শেয়ার বাজার ঠিক হবে না। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার ডিএসই প্রধান বা ডিএসইএক্স সূচক ১০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৭৭০ পয়েন্টে। গত সোমবার ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিনিয়োগের ঘোষণার পর মঙ্গলবার বড় উত্থান হলেও বুধবার আবার পতনে ফিরেছে শেয়ারবাজার। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরিয়াহ সূচক ৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৯৪ পয়েন্টে এবং ডিএস ৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৭৯ পয়েন্টে। ডিএসইতে গতকাল টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৩১৩ কোটি টাকার। যা গত কার্যদিবস থেকে ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা কম। এর আগের দিন লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। গতকাল ডিএসইতে ৩৫০টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১৪৫টির, কমেছে ১৬২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৩টির।
অপরদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৪৩ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৪ হাজার ৫১১ পয়েন্টে। সিএসইতে টাকার অংকে ১৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এ সময়ে সিএসইতে লেনদেনে অংশ নিয়েছে ২৫৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে দর বেড়েছে ১০২ টির, কমেছে ১২৪টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৯টির।
বাজারের এমন আচরণে হতাশ সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও। সংশ্লিষ্টরা জানান, মঙ্গলবার গুঞ্জন ছিল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ পদে বড় রদবদল হচ্ছে। ওই দিন বিকালেই অবশ্য জানা যায়, এটি গুজব। বাজারের বিপরীতমুখী অবস্থার ক্ষেত্রে এ খবরের যোগসূত্র রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এদিকে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ টাকার শেয়ার কিনছেন বিক্রি করে দিচ্ছেন তার চেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এখানে আশ্বস্ত করব সবাইকে যে, আমরা পুঁজিবাজারকে সুশাসন দেব এবং আমরা গর্ভন্যান্সে ভালো করব। এভাবে আমাদের পুঁজিবাজারকে আমরা একটি শক্তিশালী বাজারে রূপান্তরিত করব। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে নগদ অর্থ জোগান দেয়ার উদ্যোগ নেয়। এর বাইরে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবিকে। আইসিবি ওই টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
সর্বশেষ ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ’ অনুষ্ঠানে বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব শিগগিরই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। কিছু ভালো লাভজনক প্রতিষ্ঠান দু-এক মাসের মধ্যেই বাজারে আসবে। এরপরও বাজারে পতন চলছেই। অর্থাৎ আস্থার সংকটে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করাই এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান কাজ।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খোদ স্টক ব্রোকার মালিকরা। তাদের ব্যবসা সংকোচনের নামে কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছেন।
একজন ব্রোকার মালিক জানান, ২০১০ সালের পর দীর্ঘ সময়ে লোকসান দিয়ে হাউস পরিচালনা করেছেন। এর পর কোম্পানির রিজার্ভ থেকে কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করেছেন। এখন রিজার্ভের খাতা শূন্যের কোঠায় নামছে। ফলে বাধ্য হয়েই কর্মী ছাঁটাইয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শাকিল রিজভী বলেন, পরিস্থিতি ভালো না। প্রতিদিনই লোকসান দিতে দিতে বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও এতটাই কমেছে যে, তারা এর দিকে ফিরে তাকাতেও বিরক্ত বোধ করছেন। অনেক ব্রোকারেজ হাউস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কারণ শেয়ার কেনাবেচা থেকে যে কমিশন আয় হচ্ছে, তা নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া তো দূরের কথা, দৈনন্দিন অফিস খরচই মেটাতে পারছে না। এভাবে কতদিন চলবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী সোহেল হাসান বলেন, কয়েক মাস আগে একটি কোম্পানির শেয়ার ৬ টাকা ৭০ পয়সায় কিনেছিলেন। এখন সেই শেয়ারের মূল্য কমে ৪ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছে। আলোচ্য সময়ে তিনি পুঁজি খুইয়েছেন ৩৩ শতাংশ। তিনি বলেন, কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য কমেছে যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই।
হাসিবুল হাসিব নামের আরেক বিনিয়োগকারী একটি ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলেন ৭৭ টাকা করে। সর্বশেষ সেই শেয়ারের মূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪৭ টাকায়। আলোচ্য সময়ে তিনি পুঁজি হারিয়েছেন ৩৯ শতাংশ। আরেক বিনিয়োগকারী আতিকুল ইসলাম জাহিন স্পিনিংয়ের প্রতিটি শেয়ার কিনেছিলেন ৯ টাকা ৬০ পয়সায়। এখন সেই শেয়ারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৫ পয়সা। আলোচ্য সময়ে তার পুঁজি হারিয়েছে ৪৩ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে তাদের বিনিয়োগ করা পুঁজি খুইয়েছেন। তবে শেয়ারের এই মূল্য কমে যাওয়ার কোনো কারণ কোম্পানি বা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অব্যাহত দরপতনে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই এখন লোকসানে। লোকসান আরো বাড়বে এমন শঙ্কায় অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বিক্রির চাপ বেড়ে দরপতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিক্রির চাপ বাড়লেও তা সামাল দেয়ার জন্য যে সহায়তা দরকার, তা বাজারে নেই।
No comments