সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি
দিন দিন যমুনা নদীর পানি আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে। বিগত সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে সিরাজগঞ্জের কাছে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে, সিরাজগঞ্জহ জেলার নদী তীরবর্তী ৫টি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এ উপজেলাগুলোর দুর্গম চরাঞ্চলের অবস্থা আরও নাজুক। গবাদি পশু, শিশু, বয়োবৃদ্ধ ও প্রসূতি মায়েদের নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে জেলার বন্যাদুর্গতরা। বন্যদুর্গত অঞ্চলে জ্বালানি, ওষুধ, ত্রাণ, সেনিটেশন ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে পানিবন্দি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এদিকে মরার উপর খরার ঘায়ের মতো চরাঞ্চলে রাতে ডাকাতের উৎপাত, দিনের বেলায় ঘরের মাঁচায় সাপসহ পোকা মাকড়ের ভয় এ অঞ্চলের মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জেলার বানভাসি মানুষেরা চরম দুর্ভোগে দিনাতিপাত করছে। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে বুধবার দুপুর ১২টায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে জেলার নদী তীরবর্তী সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ওইসব এলাকার মানুষজন গবাদি পশু ও নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে কেউ আশ্রয় নিয়েছেন ওয়াপদা বাঁধে, আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছেন দূরের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি অথবা নিরাপদ স্থানে। এমন পরিস্থিতিতে খেয়ে না খেয়ে নিজেদের জীবন যেনতেনভাবে বাঁচালেও গবাদি পশুর আশ্রয় ও খাবার সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন বানভাসি মানুষেরা। ফলে, এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র গোখাদ্য সংকটও। বেড়ে গেছে খর, খৈল, ভূষিসহ অন্যান্য খাবারের দাম। সরেজমিনে জেলার কয়েকটি বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব দুর্গত মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভূক্তভোগীরা জানান, সামনে কোরবানির ঈদ, আমাদের খাদ্য দিয়ে বাঁচানোর আগে গবাদি পশুগুলোকে খাদ্য দিয়ে বাঁচানোও জরুরি হয়ে পড়েছে। সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের বয়োবৃদ্ধ তারা মিয়া (৭০) বলেন- তিনদিন ধরে বাড়িতে বুক পানি। উপায়ান্তর না দেখে ওয়াপদা বাঁধে ৫টি গরুসহ পরিবারের ৯জন সদস্যকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি। নিজেরা কোনমতে শাক-পাতা খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু গরুগুলোকে খেতে দিতে পারছি না। কোথাও কোন খালি মাঠ নেই, যেখানে নিয়ে গরুগুলোকে খাওয়াবো। একই এলাকার ওবায়দুল (৪৭) জানান, সোমবার বিকালে বাড়িতে পানি ওঠে। এসময় আমার একটি গাভী বাচ্চা প্রসব করে। কিন্তু বাড়িতে কোনো শুকনো জায়গা না থাকায় বাচ্চাটি নদীর পানিতে পড়ে তখনই মারা যায়। পরে, পরিবারের ৫ সদস্যকে নিয়ে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। খোকশাবাড়ি পূর্বপাড়ার আছাতন বেওয়া (৭০) বলেন, শ্বশুরের দেয়া ৪ শতক জায়গায় দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতাম। বড় ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী, ছোট ছেলে ঢাকায় রিকশা চালায়। মেয়ে থাকে শ্বশুর বাড়ি। নিজের কর্মক্ষমতা না থাকায় পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে খাই। পানি ঢুকে ঘরদুয়ার ভেঙে তলিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। কখন যে পাত্তারি গোটাতে হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এখন আমি কি করবো? বাকি জীবন কিভাবে কাটবে জানি না। বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চলের মৃত হবিবর আলীর ছেলে আলম, এফরান আলীর ছেলে আমীর হোসেনসহ অনেকেই বলেন- আমরা চরাঞ্চলবাসী চরম দুর্ভোগ দিন কাটাচ্ছি। নৌকার অভাবে পাড়াপাড় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে দিনের বেলায় সাপ পোকা-মাকড়ের ভয় ও রাতে চোর-ডাকাতের ভয়ে নির্ধুম রাত কাটাচ্ছি। ঘরে কিছু খাদ্য থাকলেও জ্বালানি সংকটে রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের খুঁজে পাচ্ছি না। বিশুদ্ধ পানি, খাবার স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধ ও ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল হওয়ায় চরম সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর থেকে এ পর্যন্ত ১৭৫ মেট্টিকটন চাল ও নগদ প্রায় ২ লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখনও বেশ কিছু ত্রাণ মজুদ রয়েছে। এব্যাপারে খোকশাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ মোল্লা বুধবার বলেন, আমার ইউনিয়নের কমপক্ষে দেড় হাজার বাড়িঘর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এসব পরিবারের মধ্যে প্রায় চার থেকে পাঁচশ’ পরিবার ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। ৪টি আশ্রয় কেন্দ্র থাকলেও দূরত্বের কারণে কেউ সেখানে যেতে চান না। মঙ্গলবার বরাদ্দপ্রাপ্ত পাঁচ টন চাউল বুধবার সকালে দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ব্লিচিং পাউডার মজুদ রয়েছে।
No comments