অপ্রতুল ত্রাণ, দিশেহারা দুর্গতরা
ত্রাণ সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় বন্যদুর্গত এলাকার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ পৌঁছলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পানির তোড়ে পাকা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এখন উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলা। বন্যায় আমন ধান ক্ষেত, বীজতলা, শাকসবজির ক্ষেত, পানবরজ, আখক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। পানি প্রবেশ করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকার বন্যাকবলিত মানুষ এখন বাঁচার জন্য লড়াই করছে। এদিকে দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পানি প্রবাহের প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনায় পানির চাপ কমতে থাকায় এ মুহূর্তে দেশে ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের মতো দেশব্যাপী বড় বন্যার আশঙ্কা নেই। বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে শিশুসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীতে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী একে মনজুর হাসান বলেন, পদ্মায় পানি বাড়লেও বন্যার পানির প্রধান উৎস ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় উজান থেকে আসা পানির চাপ কমতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলে বন্যা যে পর্যায়ে গেছে তা সেখানকার জন্য ভয়াবহ। কিন্তু ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশে বন্যা হয়েছিল। এবার শুধু উত্তরাঞ্চলের ৯টি জেলা এখন পর্যন্ত আক্রান্ত। যেহেতু আসামে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় পানি আসার প্রবণতা কমেছে। সুরমা-কুশিয়ারায়ও উজান থেকে আগের পরিমাণে পানি আসছে না। এ দুই অববাহিকা থেকে দেশের ভেতরে পানি আসার পরিমাণও কমছে। অপরদিকে পদ্মায় পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার নিচে আছে। ফলে তিন অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই বড় বন্যারও আশঙ্কা নেই। তবে যেহেতু উজান থেকে ঢলের পানি আসা একেবারে বন্ধ হয়নি, তাই ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানির আরও ২৪ ঘণ্টা ধরে অল্প হারে পানি বাড়তে থাকবে। এতে উত্তরাঞ্চলে আরও ৪৮ ঘণ্টা ধরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যে চলে আসা বানের পানিতে ভাসছে উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এ পানিতে ডুবে আছে উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। সেই পানি কতদিনে নামবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে উত্তরের বানের পানি ক্রমান্বয়ে চলে আসছে দেশের মধ্য এবং দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুলে পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করেছে। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জের চর ও নিন্মাঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে। এ পানি ধেয়ে আসছে রাজধানীর দিকেও। ঢাকার আশপাশের পাঁচ নদীর পানি বাড়ছে। তবে আগামী ৩ দিনে বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, মঙ্গলবারও বাংলাদেশ অংশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বিপদসীমার অনেক ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে যমুনা বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। তখন পর্যন্ত এটি ২০.৮২ মিটারে ছিল। এরআগে ওই পয়েন্টে ২০.৭১ মিটার পর্যন্ত পানি উঠেছিল। আবার বাহাদুরাবাদসহ উজান থেকে পানি নামতে শুরু করায় সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ, কাজিপুর ও আরিচায় আগের দিনের তুলনায় পানি বেড়েছে। এফএফডব্লিউসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুল হোসেন বলেন, বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকলে এবং পানি নামার এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। পানি বাড়ছে ধলেশ্বরী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে। ঢাকায় পানি আসে এ দুই নদী দিয়ে। মঙ্গলবার সকাল থেকে ৬ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যায় গড়ে ১০ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে এ নদীগুলোর পানি এখনও বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার নিচে বইছে। গঙ্গা-পদ্মার পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার অনেক নিচে আছে। আরিচার পর যে দুই পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করেছে, তা মূলত যমুনা থেকে আসা। আর সুরমা-কুশিয়ারার পানি এসে এদিন নতুন করে তিতাসের পানি বিপদসীমার ওপরে নিয়ে গেছে। তবে সুরমা-যমুনায় ভারত থেকে নতুন পানি আসার হার কমেছে। এ কারণে মেঘনা অববাহিকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। একই ভাবে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি কময় সেখানেও বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়া নদীগুলো হচ্ছে- ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গুর, আত্রাই, ধলেশ্বরী, লক্ষ্যা, পুনর্ভবা, ইছ-যমুনা, ছোট যমুনা, পদ্মা, কপোতাক্ষ, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, কংস ও তিতাস। সোমবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২১ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে। সব মিলিয়ে মঙ্গলবার দেশের ৫৬ স্টেশনে পানি বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কতটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে গেছে তা দিয়ে বন্যার ভয়াবহতা নিরূপণ করা যাবে না। প্রধান উৎস যমুনা, পদ্মা এবং মেঘনার কি অবস্থা- তা দেখতে হবে। যেহেতু ওইগুলোতে উজান থেকে পানির হার কমতে শুরু করেছে, সেটাই ইতিবাচক। এ নদীগুলোর পানিই এখন দেশের অন্য নদীতে চলে যাচ্ছে। সারা দেশ থেকে যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
নওগাঁ : বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ৩ দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৪টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মান্দায় ৬টি স্থানে, রানীনগরে ৫টি স্থানে, আত্রাইয়ে ২টি ও পত্নীতলায় ১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে প্রায় দুই লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যার পানিতে জেলার রানীনগর, আত্রাই, মান্দা, পত্নীতলা, বদলগাছী ও ধামইরহাট উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধ উপচে পড়ছে। বাঁধের আউটলেট (নদী থেকে পানি বের করে দেয়ার নালা) দিয়ে পানি শহরের বেশ কিছু এলাকায়ও প্রবেশ করেছে। এদিকে ফসলের ক্ষেত ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। জেলার ৫টি উপজেলায় প্রায় ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদতরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বলেন, জেলায় রোপা ও আমন ২৩ হাজার ৭০০ হেক্টর, আউশ ৫ হাজার এবং সবজি ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
রাজশাহী : পদ্মার পানি বিপদ সীমার কাছাকাছি অবস্থান করায় শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। তবে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বালুর ব্যাগ ও ব্লক মজুদ রাখা হয়েছে। নগরবাসীর আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম টিপু জানান, সোমবার সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৬২ মিটার। যা দুপুরে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৬ দশমিক ৬৬ মিটারে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, শহর রক্ষা বাঁধ ভালোভাবে দেখভাল ও মনিটরিং করা হচ্ছে।
গাইবান্ধা : সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি ৩ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০৩ সেমি. ওপর দিয়ে, ঘাঘটের পানি ৩ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৫ সেমি. ওপর দিয়ে এবং করতোয়ার নদীর পানি ৪ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৪ ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন এবং গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় পানিতে ডুবে ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের জিগাবাড়ি গ্রামের বাবলু মিয়ার ছেলে হানিফ মিয়া (৫) মারা গেছে। মঙ্গলবার সকালে পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চেরেঙ্গা এলাকায় করতোয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙে যাওয়ায় ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এগুলো হল- চেরেঙ্গা, কিশামত চেরেঙ্গা, শালমারা, ঝাপো, দৌলতপুর, কড়িআটা, জগন্নাথপুর ও চাকলা। উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের টেংরারদহ এলাকায় করতোয়ার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০ মিটার ধসে যায়।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) : দ্বিতীয় দফা বন্যায় ভূঞাপুর উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এলাকার স্কুল, মাদ্রাসা, হাট-বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার ভোরে গোবিন্দসী-মাটিকাটা কষ্টাপাড়ায় পাকা সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ভূঞাপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বানভাসি ও ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র থাকা ছিন্নমূল পরিবারগুলো। এ পর্যন্ত দুর্গতদের কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জ : মঙ্গলবার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীতে প্রায় ২৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। শহরের রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজারসহ পাঁচ উপজেলার লাখো মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এ জেলায় ৭০০ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা এবং ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন নষ্ট হয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে হাজারও মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, বৃষ্টি বন্ধ হলে সুরমা নদীর পানি কমে বন্যা পারিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
বারহাট্টা (নেত্রকোনা) : কংস নদীর পানি বিপদসীমার ১৮২ সেমি ওপর দিয়ে এবং খড়মা, ধলাই, গোলামখালী, কাউনাই, বিষনাই প্রভৃতি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ৬২৫ একর রোপা আমন ও ৫০ একর বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা জানান, পানিবন্দি অবস্থায় নিন্ম আয়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। গ্রামগুলোতে জ্বালানি ও গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে।
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ৩০ হজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। নেতাই নদীর ভাঙনে গামারীতলা ও দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের ১০টি বাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। প্রশাসন ত্রাণ দিচ্ছে, তবে তা একবেলাও যায় না বলে দুর্গতদের অভিযোগ। এখানে বিশুদ্ধ পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
ঠাকুরগাঁও : বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ঠাকুরগাঁওয়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে কেন্দ্রে আসা দুর্গতরা। অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে, নিচু এলাকা থেকে পানি সরে না যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েছে তারা। এদিকে, তিন দিন আগে নিখোঁজ কলেজছাত্র রিয়াদের (২০) লাশ মঙ্গলবার সকালে টাঙ্গন নদীতে ভেসে উঠে।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) : টানা চার দিন বৃদ্ধির পর সোমবার রাত থেকে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার সব রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি এখনও পানির নিচে। এরই মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেছে একজন। পানির তোড়ে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কের পাটেশ্বরীর ক্লিনিকসংলগ্ন এলাকায় প্রায় দুইশত মিটার, কুড়ারপাড় এলাকায় প্রায় ৭০ মিটার ও পুরনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ৫০ মিটার সড়ক ভেঙে গেছে। এতে চার দিন ধরে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার। এদিকে, কুড়িগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য একেএম মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
দিনাজপুর : জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। একটি নদী বিপদসীমার কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সব নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া শহর রক্ষা বাঁধের মেরামত করা হয়নি। মঙ্গলবার আরও চারজন মারা গেছে। তারা হল- পার্বতীপুর উপজেলার নামাপাগড়া গ্রামের আতাবুর রহমান (৫৫), দিনাজপুর সদর উপজেলার সুইহারী রহমান পাড়ার আজাদ মিয়ার পুত্র হুমায়ুন আহমেদ (১৬), বিরল উপজেলার গড়বাড়ী গ্রামের সুরাই মুর্র্মুর মেয়ে মালিয়া মুর্মু (৫৯) এবং একই উপজেলার ভূমিগড় গ্রামের আফসার আলীর ছেলে মাসুদুর রহমান (১৫)। এ নিয়ে দিনাজপুরে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২২ জনে। এর আগে শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দিনাজপুরে বন্যায় ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে।
সিলেট : সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে ৯৭ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে বিকালে সুরমার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪ সেন্টিমিটার এবং শেওলায় কুশিয়ারা ৮০ সেন্টিমিটর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সবগুলো উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানি বেড়েছে সীমান্ত নদী ধলাই, পিয়াইন, বড়গাঙ, সারীতেও।
বগুড়া : সারিয়াকান্দির যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে কালিতলা হার্ড পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালিতলার উত্তর পাশে নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ৫০ মিটার অংশের ব্লক ২-৩ ইঞ্চি দেবে গেছে। এদিকে বিভিন্ন স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে ও বাঁধে আশ্রয় নেয়া জনগণের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। তাদের সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।
জামালপুর : ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় জেলার অন্তত সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। জামালপুর জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, জামালপুর সদর ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন ও ৫টি পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। মঙ্গলবার মেলান্দহের কুলিয় সুইস গেটে পানিতে ডুবে মো. কমল (১৭) নামে এক কলেজছাত্র মারা গেছে। কমল মেলান্দহের টনকী গ্রামের টাবু শেখের পুত্র। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, গোখাদ্য ও শিশু খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষ বিভিন্ন বাঁধ, উঁচুস্থান ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
রাঙ্গামাটি : কয়েক দিনের অবিরাম টানা বর্ষণে নামা পাহাড়ি ঢলে বন্যার পানিতে ভাসছে জেলার লংগদু ও সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। এ ছাড়া কাপ্তাই লেকের পানি বাড়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লেকসংলগ্ন কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়ির নিচু এলাকার অসংখ্য পরিবারের বাড়িঘর প্লাবিত হওয়ায় ১৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ২ হাজারের অধিক দুর্গত লোক আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এদিকে রাঙ্গামাটি শহরের শান্তিনগর, পুরানবস্তি, জুলুক্যাপাহাড়, মুসলিমপাড়া, গর্জনতলী, তবলছড়ির মাঝেরবস্তি, আসামবস্তিসহ লেকসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় কাপ্তাই লেকে কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানায় পৌর কর্তৃপক্ষ।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৬ হাজার পরিবার। এতে করে বন্যাদুর্গত দেবগ্রাম, দৌলতদিয়া, উজানচর ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ভাঙন। অসহায় হয়ে পড়েছে পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এসএম নুরুন্নবী জানান, অস্বাভাবিক গতিতে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোমবার সকাল ৯টায় গোয়ালন্দে পানি বিপদসীমার ৫২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বেলা ৩টার দিকে তা ৮৫ সেন্টিমিটারে পৌঁছায়। এখানে পানির বিপদসীমা ৮.৬৫ মিটার।
নওগাঁ : বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ৩ দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৪টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মান্দায় ৬টি স্থানে, রানীনগরে ৫টি স্থানে, আত্রাইয়ে ২টি ও পত্নীতলায় ১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে প্রায় দুই লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যার পানিতে জেলার রানীনগর, আত্রাই, মান্দা, পত্নীতলা, বদলগাছী ও ধামইরহাট উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া ছোট যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নওগাঁ শহর রক্ষা বাঁধ উপচে পড়ছে। বাঁধের আউটলেট (নদী থেকে পানি বের করে দেয়ার নালা) দিয়ে পানি শহরের বেশ কিছু এলাকায়ও প্রবেশ করেছে। এদিকে ফসলের ক্ষেত ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। জেলার ৫টি উপজেলায় প্রায় ৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদতরের উপ-পরিচালক মনোজিত কুমার মল্লিক বলেন, জেলায় রোপা ও আমন ২৩ হাজার ৭০০ হেক্টর, আউশ ৫ হাজার এবং সবজি ৫০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
রাজশাহী : পদ্মার পানি বিপদ সীমার কাছাকাছি অবস্থান করায় শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। তবে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত বালুর ব্যাগ ও ব্লক মজুদ রাখা হয়েছে। নগরবাসীর আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস সহকারী নজরুল ইসলাম টিপু জানান, সোমবার সকালে পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৬২ মিটার। যা দুপুরে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৬ দশমিক ৬৬ মিটারে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান বলেন, শহর রক্ষা বাঁধ ভালোভাবে দেখভাল ও মনিটরিং করা হচ্ছে।
গাইবান্ধা : সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি ৩ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০৩ সেমি. ওপর দিয়ে, ঘাঘটের পানি ৩ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৫ সেমি. ওপর দিয়ে এবং করতোয়ার নদীর পানি ৪ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৪ ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, পলাশবাড়ি, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪২টি ইউনিয়ন এবং গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় পানিতে ডুবে ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের জিগাবাড়ি গ্রামের বাবলু মিয়ার ছেলে হানিফ মিয়া (৫) মারা গেছে। মঙ্গলবার সকালে পলাশবাড়ী উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চেরেঙ্গা এলাকায় করতোয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙে যাওয়ায় ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এগুলো হল- চেরেঙ্গা, কিশামত চেরেঙ্গা, শালমারা, ঝাপো, দৌলতপুর, কড়িআটা, জগন্নাথপুর ও চাকলা। উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের টেংরারদহ এলাকায় করতোয়ার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫০ মিটার ধসে যায়।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) : দ্বিতীয় দফা বন্যায় ভূঞাপুর উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এলাকার স্কুল, মাদ্রাসা, হাট-বাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার ভোরে গোবিন্দসী-মাটিকাটা কষ্টাপাড়ায় পাকা সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ভূঞাপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বানভাসি ও ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র থাকা ছিন্নমূল পরিবারগুলো। এ পর্যন্ত দুর্গতদের কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।
সুনামগঞ্জ : মঙ্গলবার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীতে প্রায় ২৮ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। শহরের রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজারসহ পাঁচ উপজেলার লাখো মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এ জেলায় ৭০০ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা এবং ৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন নষ্ট হয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে হাজারও মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, বৃষ্টি বন্ধ হলে সুরমা নদীর পানি কমে বন্যা পারিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
বারহাট্টা (নেত্রকোনা) : কংস নদীর পানি বিপদসীমার ১৮২ সেমি ওপর দিয়ে এবং খড়মা, ধলাই, গোলামখালী, কাউনাই, বিষনাই প্রভৃতি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ৬২৫ একর রোপা আমন ও ৫০ একর বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকরা জানান, পানিবন্দি অবস্থায় নিন্ম আয়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। গ্রামগুলোতে জ্বালানি ও গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে।
ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) : বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নের প্রায় ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় ৩০ হজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অর্ধশতাধিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। নেতাই নদীর ভাঙনে গামারীতলা ও দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের ১০টি বাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। প্রশাসন ত্রাণ দিচ্ছে, তবে তা একবেলাও যায় না বলে দুর্গতদের অভিযোগ। এখানে বিশুদ্ধ পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
ঠাকুরগাঁও : বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ঠাকুরগাঁওয়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে কেন্দ্রে আসা দুর্গতরা। অনেকে বাড়ি ফিরে গেছেন। তবে, নিচু এলাকা থেকে পানি সরে না যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছে। এছাড়া বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েছে তারা। এদিকে, তিন দিন আগে নিখোঁজ কলেজছাত্র রিয়াদের (২০) লাশ মঙ্গলবার সকালে টাঙ্গন নদীতে ভেসে উঠে।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) : টানা চার দিন বৃদ্ধির পর সোমবার রাত থেকে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার সব রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি এখনও পানির নিচে। এরই মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেছে একজন। পানির তোড়ে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়কের পাটেশ্বরীর ক্লিনিকসংলগ্ন এলাকায় প্রায় দুইশত মিটার, কুড়ারপাড় এলাকায় প্রায় ৭০ মিটার ও পুরনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ৫০ মিটার সড়ক ভেঙে গেছে। এতে চার দিন ধরে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার। এদিকে, কুড়িগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য একেএম মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
দিনাজপুর : জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। একটি নদী বিপদসীমার কিছুটা নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও সব নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়েছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। বন্যার পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া শহর রক্ষা বাঁধের মেরামত করা হয়নি। মঙ্গলবার আরও চারজন মারা গেছে। তারা হল- পার্বতীপুর উপজেলার নামাপাগড়া গ্রামের আতাবুর রহমান (৫৫), দিনাজপুর সদর উপজেলার সুইহারী রহমান পাড়ার আজাদ মিয়ার পুত্র হুমায়ুন আহমেদ (১৬), বিরল উপজেলার গড়বাড়ী গ্রামের সুরাই মুর্র্মুর মেয়ে মালিয়া মুর্মু (৫৯) এবং একই উপজেলার ভূমিগড় গ্রামের আফসার আলীর ছেলে মাসুদুর রহমান (১৫)। এ নিয়ে দিনাজপুরে বন্যায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২২ জনে। এর আগে শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দিনাজপুরে বন্যায় ১৮ জনের মৃত্যু ঘটে।
সিলেট : সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে ৯৭ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জে বিকালে সুরমার পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৯৪ সেন্টিমিটার এবং শেওলায় কুশিয়ারা ৮০ সেন্টিমিটর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সবগুলো উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে চার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানি বেড়েছে সীমান্ত নদী ধলাই, পিয়াইন, বড়গাঙ, সারীতেও।
বগুড়া : সারিয়াকান্দির যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে কালিতলা হার্ড পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কালিতলার উত্তর পাশে নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ৫০ মিটার অংশের ব্লক ২-৩ ইঞ্চি দেবে গেছে। এদিকে বিভিন্ন স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে ও বাঁধে আশ্রয় নেয়া জনগণের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। তাদের সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি।
জামালপুর : ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় জেলার অন্তত সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। জামালপুর জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, জামালপুর সদর ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন ও ৫টি পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা বন্যাকবলিত হয়েছে। মঙ্গলবার মেলান্দহের কুলিয় সুইস গেটে পানিতে ডুবে মো. কমল (১৭) নামে এক কলেজছাত্র মারা গেছে। কমল মেলান্দহের টনকী গ্রামের টাবু শেখের পুত্র। বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, গোখাদ্য ও শিশু খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষ বিভিন্ন বাঁধ, উঁচুস্থান ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
রাঙ্গামাটি : কয়েক দিনের অবিরাম টানা বর্ষণে নামা পাহাড়ি ঢলে বন্যার পানিতে ভাসছে জেলার লংগদু ও সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা। এ ছাড়া কাপ্তাই লেকের পানি বাড়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লেকসংলগ্ন কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা বাঘাইছড়ির নিচু এলাকার অসংখ্য পরিবারের বাড়িঘর প্লাবিত হওয়ায় ১৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ২ হাজারের অধিক দুর্গত লোক আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এদিকে রাঙ্গামাটি শহরের শান্তিনগর, পুরানবস্তি, জুলুক্যাপাহাড়, মুসলিমপাড়া, গর্জনতলী, তবলছড়ির মাঝেরবস্তি, আসামবস্তিসহ লেকসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় কাপ্তাই লেকে কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানায় পৌর কর্তৃপক্ষ।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ২৪ ঘণ্টায় ৩৯ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১৬ হাজার পরিবার। এতে করে বন্যাদুর্গত দেবগ্রাম, দৌলতদিয়া, উজানচর ও ছোটভাকলা ইউনিয়নের বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দেবগ্রাম ও দৌলতদিয়া এলাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ভাঙন। অসহায় হয়ে পড়েছে পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজ রিডার এসএম নুরুন্নবী জানান, অস্বাভাবিক গতিতে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোমবার সকাল ৯টায় গোয়ালন্দে পানি বিপদসীমার ৫২ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বেলা ৩টার দিকে তা ৮৫ সেন্টিমিটারে পৌঁছায়। এখানে পানির বিপদসীমা ৮.৬৫ মিটার।
No comments