যে কারণে ডুবছে হজ ব্যবস্থাপনা
যথেচ্ছ হজ লাইসেন্স প্রদান মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ডুবছে হজ ব্যবস্থাপনা। এজেন্সি মালিকেরা নির্ধারিত হজ প্যাকেজ থেকে হাতে কম টাকা পাওয়ায় ভিসা, সৌদিতে বাড়ি ভাড়া, মোয়াল্লেম ফি পরিশোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে খরচ বাঁচাতে সময়ক্ষেপণ করেন। যার বিরূপ প্রভাব পড়ে পুরো হজ ব্যবস্থাপনার ওপর। ঘটতে থাকে একের পর এক ফ্লাইট বিপর্যয়সহ নানা অনিয়ম। এতে দুর্ভোগের শিকার হন হজযাত্রীরা। বর্তমানে দেশে বেসরকারি হজ এজেন্সির সংখ্যা ১২৫৪টি। বিশ্বের কোনো দেশে এত সংখ্যক বেসরকারি এজেন্সি নেই বলে জানা গেছে। বেসরকারি হজ এজেন্সিদের সংগঠনÑ হাব সূত্রে জানা যায়, হাব প্রতিষ্ঠার সময় ২০০১ সালে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১১৩টি। এরপর প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০০২ সালে ১৩৩টি, ২০০৩ সালে ১৬৬টি, ২০০৪ সালে ৩৬৩টি। ২০০৫ সালে আবার কমতে থাকে। এ বছর ছিল ৩৬১টি। ২০০৬ সালে আরো কমে হয় ৩৪৪টি, ২০০৭ সালে হয় ৩২৬টি, ২০০৮ সালে হয় ৩২৪টি। এরপর আবার বাড়তে থাকে। ২০০৯ সালে হয় ৩৩২টি, ২০১০ সালে হয় ৩৩৭টি, ২০১১ সালে হয় ৪০১টি, ২০১২ সালে হয় ৪০২টি। হজ ব্যবসায় লাভজনক হওয়ায় এর পরের বছর থেকে এজেন্সির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা এক লাফে গিয়ে দাঁড়ায় ১১৪৯টিতে। অর্থাৎ এক বছরেই বেড়ে যায় ৭৪৭টি। পরের বছর হয় ১১৯২টি, ২০১৫ সালে হয় ১২০৫টি আর সর্বশেষ ২০১৬ সালে হয় ১২৫৪টি। এক ব্যক্তির একটি থেকে ৫-৬টি পর্যন্ত এজেন্সি রয়েছে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের নামে এজেন্সির নিবন্ধন নিয়েছেন তারা। হজ অফিস সূত্রে জানা যায়, হাবের সদস্য ১২৫৪টি থাকলেও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে ১১৬২টি এজেন্সির। এর মধ্যে ২০১৭ সালের হজে অংশ নিচ্ছে ১০৯৭টি। এর মধ্যে শতাধিক এজেন্সি এ বছর কোনো হজযাত্রীর নিবন্ধন করাতে পারেনি। বাকিদেরও অনেকে কোটা পূরণ করতে না পারায় ৬৩৫টি এজেন্সি মোনাজ্জেম হিসেবে কাজ করছে। যাদের লিড এজেন্সিও বলা হয়। এ বছর হজে যাচ্ছে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারিভাবে যাচ্ছেন ৪ হাজার ২০০ জন এবং বেসরকারিভাবে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৯৮ জন। কিন্তু এ বছর প্রাক-নিবন্ধন করেছেন ২ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি। এ কারণে এ বছর প্রাক-নিবন্ধন করেও হজে যেতে পারছেন না ১ লাখ ৩৬ হাজারের মতো হজযাত্রী। যাদের আগামী বছরের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। দেশে এভাবে হজযাত্রী বাড়তে থাকায় হাজারের অধিক এজেন্সির মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রতি এজেন্সির জন্য ৩০০ হাজি পাঠানোর সুযোগ থাকলেও এ বছর বেসরকারি কোটায় প্রথমে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ জন নিবন্ধনের সুযোগ দেয়ায় ১১৬২ এজেন্সির জন্য গড়ে ১০০ হাজী পড়ে। এ জন্য একটি হজ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকেই পরবর্তী হজের জন্য হাজী সংগ্রহে নেমে পড়ে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো। গ্রামে গঞ্জে থাকা মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, মাদরাসা শিক্ষক, কারিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে একত্রে নিয়োজিত করে তারা। অনেকে ইচ্ছা করেও এজেন্সিগুলোর সাথে যোগাযোগ করেন। হজযাত্রী ও বেসরকারি এজেন্সিগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করেন তারা। সরকার হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর তারা হজযাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এজেন্সিগুলোকে প্রদান করেন। যে এজেন্সির কাছ থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি সুবিধা পান তাদের হাজী সরবরাহ করেন। এ বছর সরকার দুইটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে। প্যাকেজ-১ এ ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫০৮ টাকা এবং প্যাকেজ-২ এ ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকা। হজ নীতিমালা অনুসারে বেসরকারি এজেন্সিগুলো ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ টাকার নিচে হজযাত্রীদের কাছ থেকে নিতে পারবে না। তবে হজযাত্রী ও এজেন্সি মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে এজেন্সিগুলো ২ লাখ ৪০ হাজার টাকাতেও হজে পাঠাতে চুক্তিবদ্ধ হয়। অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীরা হজযাত্রীদের কাছ থেকে প্যাকেজের সমান টাকা আনলেও এজেন্সিগুলোকে কম দেন। অনেকে বিনা টাকায় হজে যাওয়ার জন্য কিছু হাজী সংগ্রহ করে এজেন্সিগুলোকে দেন। তবে সামর্থ্যবান হজযাত্রীরা ৩ লাখ ১৯ হাজার থেকে শুরু করে ২০ লাখ টাকা ব্যয় করেও হজ করেন। তাদের সুযোগ-সুবিধাও থাকে সে মানের। সৌদিতে হোটেল সুবিধা, খাওয়া, গাড়ি, ঘোরাঘুরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হয়। তাদের হজ ফ্লাইটসহ কোনো ক্ষেত্রেই তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু যারা প্যাকেজ নির্ধারিত টাকা থেকে কম দিয়ে হজে যেতে চান তাদের ক্ষেত্রেই সমস্যা সৃষ্টি হয়। হাজীদের প্যাকেজের টাকার মধ্যে বিমান ভাড়া, সৌদিতে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ, পরিবহন ফি, সিটি চেন ইন চার্জ, ব্যাংক গ্যারান্টি, ট্রলি ব্যাগ, জমজমের পানি, প্রশিক্ষণ ফি, কল্যাণ তহবিল, হোটেলে থাকাখাওয়া, সৌদির মোয়াল্লেম ফি অন্যতম। প্রতি বছরই এ টাকা বাড়তে থাকে। কম টাকা দেয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলো কম সুবিধার ব্যবস্থা খুঁজতে থাকে। জানা যায়, এ বছর মোয়াল্লেমের মূল সার্ভিস চার্জ ১০৮৯ রিয়াল। আর চারটি প্যাকেজ অনুসারে অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ ৩৯৫০ রিয়াল, ১৯০০ রিয়াল, ১৫০০ রিয়াল এবং সর্বনিম্ন ৭২০ রিয়াল। যেসব হাজী কম টাকা দেন এজেন্সিগুলো তাদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মোয়াল্লেম ফি দিয়ে চুক্তি করার চেষ্টা করে। যেখানে সুযোগ-সুবিধাও কম থাকে। কিন্তু এ বছর দেশে নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় ৯১টি এজেন্সি তাদের কম টাকা দেয়া ১৪ হাজার হাজীর জন্য সর্বনিম্ন ৭২০ রিয়ালে চুক্তি করতে পারেনি। তাদের ১৫০০ রিয়ালে চুক্তি করতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। যার পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় হাজী প্রতি ১৭ হাজার ৩১৬ টাকা। এ কারণে অনেক এজেন্সি এ টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খায়। পরে প্রাথমিকভাবে এক হাজার রিয়াল দিয়ে তারা চুক্তিবদ্ধ হয়। তাদের পরে আরো ৫০০ রিয়াল পরিশোধ করতে হবে। মোয়াল্লেম ফির ক্ষেত্রে বেশি টাকা ব্যয় হয়ে যাওয়ায় এজেন্সিগুলো ঘর ভাড়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি শুরু করে। টাকা বাঁচাতে অনেক এজেন্সি অনেক দূরে ঘর ভাড়া করে। আর অনেকে এখনো ঘর ভাড়াই করেনি। তারা ২০ আগস্টের পর কম মূল্যে ঘর পাবে এ আশায় রয়েছে। এ কারণে এসব হজযাত্রীর ভিসার আবেদন করেনি তারা। আবার যাদের ভিসা হয়েছে তাদের বিমান টিকিট কেনা হয়নি। এ কারণে হাজী সঙ্কটে একের পর এক ফ্লাইট বিপর্যয় ঘটতে থাকে। ফলে ২৩ দিন পার হলেও কেবল অর্ধেক হাজী যেতে পেরেছেন। যার সংখ্যা ৬৫ হাজার ৭৮৪ জন। ফলে আগামী ১১ দিনে আরো ৫৯ হাজার হজযাত্রী পরিবহনে ব্যাপক সমস্যা দেখা দেবে। অন্য দিকে এখন পর্যন্ত ভিসা পাওয়া গেছে ১ লাখ ১১ হাজার ৫৯৯ জনের। এখনো ভিসা হয়নি ১৫ হাজারের বেশি হজযাত্রীর। এসব হজযাত্রীর পাসপোর্টই জমা দেয়া হয়নি। যাদের হজ অফিস আগামীকালের মধ্যে ভিসার আবেদন করতে বলেছে। কিন্তু এসব হজযাত্রী আবেদন করবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ফলে এদের হজযাত্রাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে হজে গিয়েও সমস্যায় পড়তে পারেন ১০ হাজারের মতো হজযাত্রী। মোয়াল্লেম ফির বাকি ৫০০ রিয়াল পরিশোধে এজেন্সিগুলো অনীহার কারণেই এ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেসরকারি হজ এজেন্সি ইউরো এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মালিক মাওলানা মাহমুদুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই হজযাত্রায় সমস্যা দেখা দেয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা এজেন্সিগুলোকে প্যাকেজ নির্ধারিত টাকা পরিশোধ করে না। পরে তারা ওই টাকা পোষাতে কম সুবিধা খুঁজতে থাকে। তখনই ফ্লাইট বিপর্যয়সহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ হজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের নয়া দিগন্তকে বলেন, হজের মতো পবিত্র কাজে মধ্যস্বত্বভোগী তথা দালালদের প্রতিহত করা উচিত। তাদের কারণেই সব সমস্যা। এ ব্যাপারে হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের কাছে সেসব হজযাত্রী অভিযোগ নিয়ে আসেন তাদের বেশির ভাগই দেখা যায় স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে হজে যাওয়ার চুক্তি করেছেন। তারা প্যাকেজ থেকে কম টাকায় হজে যেতে চান। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলেই মধ্যস্বত্বভোগী কেটে পড়ে। তারা এজেন্সি মালিককেও অনেক সময় চেনে না। তিনি বলেন, হজ ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো না গেলে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়।
No comments