ঢাকার আগ্রহ তিস্তায় দিল্লির চোখ প্রতিরক্ষায় by মিজানুর রহমান
অনিশ্চয়তার
ঘোর এখনও কাটেনি। তবুও আশাবাদী ঢাকা ও দিল্লি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী মাসের ভারত সফরকে ‘সর্বোচ্চ কার্যকর ও
ফলপ্রসূ’ করতেই পূর্ণ মনোযোগ উভয় পক্ষের। সরকার প্রধানের সফরে দীর্ঘ ১৮ বছর
ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির একটি গ্রহণযোগ্য সুরাহা চায়
ঢাকা। একই সঙ্গে দেশের মেগা প্রকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে ভারতের
সহযোগিতার স্পষ্ট ঘোষণা চায় বাংলাদেশ। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সফরে দিল্লির
চোখ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা (রূপরেখা চুক্তি) সইয়ে। দু’দেশের
প্রতিনিধি পর্যায়ে এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলছে।
সমপ্রতি হিন্দুস্তান টাইমসসহ দিল্লি ডেটলাইনে প্রকাশিত গণমাধ্যমের খবরে এটি বেশ খোলাসা হয়েই জনসমক্ষে এসেছে। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারাও এ নিয়ে এখন আর রাখঢাকা করছেন না। তারা অবশ্য এটাকে ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ না বলে ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক সমেঝোতা স্মারক বা এমওইউ’ বলাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেবল তিস্তা, গঙ্গা বা প্রতিরক্ষা-ই নয়, হাই প্রোফাইল ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ২০’র বেশি চুক্তি, সমঝোতা ও ডকুমেন্ট সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। যার মধ্যে- নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নিউক্লিয়ার, স্পেস, স্যাটেলাইট, বাণিজ্য সহযোগিতা ও বর্ডার হাট স্থাপন এবং উভয় দেশের জনগণের পর্যায়ে মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানোর সংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। ঢাকার কর্মকর্তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি কোনো শর্ত নয়, তারপরও প্রতীক্ষিত চুক্তিটি সইয়ে ব্যাপক আশাবাদী ঢাকা। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। চুক্তির কাঠামোও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। এটি যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের একান্ত চাওয়া সেটি দিল্লির নেতৃত্বও বুঝেন। ঢাকার তরফেও সময়ে সময়ে সেই বার্তা স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে দিল্লির নেতৃত্ব তার দেশের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে চুক্তিটি সইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে পারবে বলেও আশাবাদী বাংলাদেশ। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আগামী ৭-১০ই এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করবেন, এটি প্রায় চূড়ান্ত। আমরা এই সফরের দুই দেশের মধ্যেকার ঝুলে থাকা বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি চাইব। সেখানে তিস্তা আমাদের অগ্রাধিকার। পাশাপাশি বিদেশি সহযোগিতায় বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় থাকা গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পে সহায়তার বিষয়ে দিল্লির স্পষ্ট ঘোষণা আদায়ের চেষ্টা থাকবে। একই সঙ্গে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানির সুষম ব্যবহারে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকারের বিষয়টি আরো স্পষ্ট করতে মনোযোগ রয়েছে ঢাকার। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের ফিরতি সফরে এবার দিল্লি যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। নানা কারণে হাই প্রোফাইল ওই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এর রাজনৈতিক তৎপর্য রয়েছে বলেও মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিকরা। ওই সফর নিয়ে আলোচনায় গত নভেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক দিল্লি সফর করেছেন। আর গত মাসে ঢাকা সফর করেছেন দিল্লির বিদেশ সচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। ওই দুই সফরের মাঝে তড়িঘড়ি করে ঢাকা সফর করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকর। ভারতের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। দিল্লির ডেটলাইনে মনোহর পারিকরের ঢাকা সফরের যে বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ-চীন বিদ্যমান সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র খোজা হয়েছে। বলা হয়- প্রতিরক্ষা ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ঢাকার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা চুক্তি জরুরি ভিত্তিতে সেরে ফেলতে চায় ভারত। এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরেই এটি সই করতে চায় ভারত। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, আলোচনার অগ্রগতিও আছে, তবে এখনো সেই চুক্তির কাঠামো চূড়ান্ত হয়নি। মানবজমিনের জিজ্ঞাসার জবাবে ঢাকার কর্মকর্তারাও গতকাল এমনটাই বলেছেন। তাদের ভাষায়- আলোচনা চলছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, সমন্বিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি এমওইউ সইয়ের প্রস্তুতি রয়েছে। এটি সই হলে প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দু’দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা আরো জোরদার হবে। দিল্লির সূত্রগুলো অবশ্য বলছে, ঢাকার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার জন্য ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতেও আগ্রহী ভারত। এ নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব সমঝোতায় পৌঁছালে তা হবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা খাতে ভারতের দেয়া সব থেকে বড় অঙ্কের ঋণ। ভারতীয় গণমাধ্যমের রিপোর্টে গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং সেই সময়ে দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিও সমঝোতাগুলোর উদাহরণও টানা হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরে সম্পাদিত চুক্তি মতে, বাংলাদেশে ২৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে চীন।
গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে ভারতকে পাশে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, মেঘা প্রকল্প গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে সহযোগিতায় ভারতের পূর্ণ সমর্থন জরুরি। এটি নির্মাণে চীন জাপানসহ অনেকেই সহযোগিতায় আগ্রহী। তবে বড় ওই প্রকল্পে বিনিয়োগের আগে দিল্লির ইতিবাচক মনোভাব দেখতে চান বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করেন এ ব্যারাজ নির্মাণ হলে অববাহিকা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দল সমপ্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লির সফরের আগেই ভারতীয় টিম তাদের মূল্যায়ন দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় উপস্থাপান করবে। এটি বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে আশা করে তিনি বলেন, সরকার প্রধানের সফরে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা এবং স্পষ্ট ঘোষণা মিলবে বলেও ঢাকা আশাবাদী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের ভারত সফরে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো মেগাপ্রকল্প নিয়েও আলোচনা হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। এ সফরে প্রকল্পটির প্রাথমিক কাজের জন্য (কিছু অংশ) দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। কর্মকর্তাদের মতে, শেখ হাসিনার এবারের সফরে লাইন অব ক্রেডিট বা ঋণ চুক্তির বদলে প্রকল্পভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সহায়তার বিষয়টি আলোচনায় থাকছে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ২২টি চুক্তি, সমঝোতা ও ডকুমেন্ট সই হয়েছিল। ঐতিহাসিক ওই সফরে ‘নতুন প্রজন্ম, নয়া দিশা’ শীর্ষক যৌথ ঘোষণাও সই হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সঙ্গত কারণেই অতীতে শীর্ষ পর্যায়ের সফরগুলো বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির গত বছরের বাংলাদেশ সফরে সম্পাদিত চুক্তি, সমঝোতা ও ঘোষণার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের পরিবারকে সম্মাননা: স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী (শহীদ) ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পরিবারকে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। এ নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ চলছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে, ১৬৬৮ জন শহীদের নাম পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই তালিকা ধরে পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওই তালিকায় থাকা ৭ জন শহীদ যুদ্ধবন্ধুর পরিবারকে সম্মাননা জানাতে চায় বাংলাদেশ। সীমিত পরিসরে হলেও শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেয়ার আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এটি হবে শহীদ পরিবারগুলোকে বাংলাদেশের সম্মাননা জানানোর আনুষ্ঠানিক সূচনা। বাকিদের পর্যায়ক্রমে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত যোগাযোগে সম্মাননা জানাবে বাংলাদেশ।
সম্ভাব্য সফরসূচি: কূটনৈতিক সূত্রগুলোর দেয়া তথ্য মতে, সেখানে আগামী ৯ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি হতে পারে। সেখাবেই শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সফরের দিন-তারিখ ঠিক হলেও গতকাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা-মোদি বৈঠকের সময়ক্ষণ ঠিক হয়নি বলে দাবি করে এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সফরটি হবে ৩ দিনে। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির অতিথিশালায় থাকবেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এবারই ওই বিরল সম্মাননা জানাবে ভারত। সফরকালে প্রেসিডেন্ট মুখার্জির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা। দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গেও তার বৈঠক হতে পারে। এছাড়া, দিল্লির রাজঘাটস্থ গান্ধী সমাধিও পরিদর্শন এবং আজমীর শরিফ জেয়ারতে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
সমপ্রতি হিন্দুস্তান টাইমসসহ দিল্লি ডেটলাইনে প্রকাশিত গণমাধ্যমের খবরে এটি বেশ খোলাসা হয়েই জনসমক্ষে এসেছে। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারাও এ নিয়ে এখন আর রাখঢাকা করছেন না। তারা অবশ্য এটাকে ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’ না বলে ‘প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক সমেঝোতা স্মারক বা এমওইউ’ বলাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কেবল তিস্তা, গঙ্গা বা প্রতিরক্ষা-ই নয়, হাই প্রোফাইল ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত ২০’র বেশি চুক্তি, সমঝোতা ও ডকুমেন্ট সইয়ের প্রস্তুতি চলছে। যার মধ্যে- নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নিউক্লিয়ার, স্পেস, স্যাটেলাইট, বাণিজ্য সহযোগিতা ও বর্ডার হাট স্থাপন এবং উভয় দেশের জনগণের পর্যায়ে মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানোর সংক্রান্ত বিষয় রয়েছে। ঢাকার কর্মকর্তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি কোনো শর্ত নয়, তারপরও প্রতীক্ষিত চুক্তিটি সইয়ে ব্যাপক আশাবাদী ঢাকা। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। চুক্তির কাঠামোও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। এটি যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের একান্ত চাওয়া সেটি দিল্লির নেতৃত্বও বুঝেন। ঢাকার তরফেও সময়ে সময়ে সেই বার্তা স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে দিল্লির নেতৃত্ব তার দেশের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করে চুক্তিটি সইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে পারবে বলেও আশাবাদী বাংলাদেশ। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আগামী ৭-১০ই এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করবেন, এটি প্রায় চূড়ান্ত। আমরা এই সফরের দুই দেশের মধ্যেকার ঝুলে থাকা বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি চাইব। সেখানে তিস্তা আমাদের অগ্রাধিকার। পাশাপাশি বিদেশি সহযোগিতায় বাস্তবায়নের পরিকল্পনায় থাকা গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পে সহায়তার বিষয়ে দিল্লির স্পষ্ট ঘোষণা আদায়ের চেষ্টা থাকবে। একই সঙ্গে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর পানির সুষম ব্যবহারে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকারের বিষয়টি আরো স্পষ্ট করতে মনোযোগ রয়েছে ঢাকার। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের ফিরতি সফরে এবার দিল্লি যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। নানা কারণে হাই প্রোফাইল ওই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এর রাজনৈতিক তৎপর্য রয়েছে বলেও মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিকরা। ওই সফর নিয়ে আলোচনায় গত নভেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক দিল্লি সফর করেছেন। আর গত মাসে ঢাকা সফর করেছেন দিল্লির বিদেশ সচিব ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর। ওই দুই সফরের মাঝে তড়িঘড়ি করে ঢাকা সফর করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকর। ভারতের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম বাংলাদেশ সফর। দিল্লির ডেটলাইনে মনোহর পারিকরের ঢাকা সফরের যে বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ-চীন বিদ্যমান সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র খোজা হয়েছে। বলা হয়- প্রতিরক্ষা ইস্যুতে চীনের সঙ্গে ঢাকার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা চুক্তি জরুরি ভিত্তিতে সেরে ফেলতে চায় ভারত। এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরেই এটি সই করতে চায় ভারত। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, আলোচনার অগ্রগতিও আছে, তবে এখনো সেই চুক্তির কাঠামো চূড়ান্ত হয়নি। মানবজমিনের জিজ্ঞাসার জবাবে ঢাকার কর্মকর্তারাও গতকাল এমনটাই বলেছেন। তাদের ভাষায়- আলোচনা চলছে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, সমন্বিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি এমওইউ সইয়ের প্রস্তুতি রয়েছে। এটি সই হলে প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দু’দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা আরো জোরদার হবে। দিল্লির সূত্রগুলো অবশ্য বলছে, ঢাকার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার জন্য ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতেও আগ্রহী ভারত। এ নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব সমঝোতায় পৌঁছালে তা হবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা খাতে ভারতের দেয়া সব থেকে বড় অঙ্কের ঋণ। ভারতীয় গণমাধ্যমের রিপোর্টে গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং সেই সময়ে দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিও সমঝোতাগুলোর উদাহরণও টানা হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরে সম্পাদিত চুক্তি মতে, বাংলাদেশে ২৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে চীন।
গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণে ভারতকে পাশে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, মেঘা প্রকল্প গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে সহযোগিতায় ভারতের পূর্ণ সমর্থন জরুরি। এটি নির্মাণে চীন জাপানসহ অনেকেই সহযোগিতায় আগ্রহী। তবে বড় ওই প্রকল্পে বিনিয়োগের আগে দিল্লির ইতিবাচক মনোভাব দেখতে চান বন্ধু রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করেন এ ব্যারাজ নির্মাণ হলে অববাহিকা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের সমীক্ষার জন্য একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দল সমপ্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আশা করছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লির সফরের আগেই ভারতীয় টিম তাদের মূল্যায়ন দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় উপস্থাপান করবে। এটি বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে আশা করে তিনি বলেন, সরকার প্রধানের সফরে এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা এবং স্পষ্ট ঘোষণা মিলবে বলেও ঢাকা আশাবাদী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের ভারত সফরে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো মেগাপ্রকল্প নিয়েও আলোচনা হবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে ভারতের আগ্রহ রয়েছে। এ সফরে প্রকল্পটির প্রাথমিক কাজের জন্য (কিছু অংশ) দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। কর্মকর্তাদের মতে, শেখ হাসিনার এবারের সফরে লাইন অব ক্রেডিট বা ঋণ চুক্তির বদলে প্রকল্পভিত্তিক সুনির্দিষ্ট সহায়তার বিষয়টি আলোচনায় থাকছে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ২২টি চুক্তি, সমঝোতা ও ডকুমেন্ট সই হয়েছিল। ঐতিহাসিক ওই সফরে ‘নতুন প্রজন্ম, নয়া দিশা’ শীর্ষক যৌথ ঘোষণাও সই হয়েছিল। পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সঙ্গত কারণেই অতীতে শীর্ষ পর্যায়ের সফরগুলো বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদির গত বছরের বাংলাদেশ সফরে সম্পাদিত চুক্তি, সমঝোতা ও ঘোষণার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের পরিবারকে সম্মাননা: স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী (শহীদ) ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পরিবারকে সম্মাননা জানানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। এ নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ চলছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য মতে, ১৬৬৮ জন শহীদের নাম পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই তালিকা ধরে পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওই তালিকায় থাকা ৭ জন শহীদ যুদ্ধবন্ধুর পরিবারকে সম্মাননা জানাতে চায় বাংলাদেশ। সীমিত পরিসরে হলেও শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেয়ার আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এটি হবে শহীদ পরিবারগুলোকে বাংলাদেশের সম্মাননা জানানোর আনুষ্ঠানিক সূচনা। বাকিদের পর্যায়ক্রমে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত যোগাযোগে সম্মাননা জানাবে বাংলাদেশ।
সম্ভাব্য সফরসূচি: কূটনৈতিক সূত্রগুলোর দেয়া তথ্য মতে, সেখানে আগামী ৯ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি হতে পারে। সেখাবেই শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সফরের দিন-তারিখ ঠিক হলেও গতকাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা-মোদি বৈঠকের সময়ক্ষণ ঠিক হয়নি বলে দাবি করে এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, সফরটি হবে ৩ দিনে। ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির অতিথিশালায় থাকবেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে এবারই ওই বিরল সম্মাননা জানাবে ভারত। সফরকালে প্রেসিডেন্ট মুখার্জির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন শেখ হাসিনা। দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গেও তার বৈঠক হতে পারে। এছাড়া, দিল্লির রাজঘাটস্থ গান্ধী সমাধিও পরিদর্শন এবং আজমীর শরিফ জেয়ারতে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী।
No comments