মারফতি মামা by শামীমুল হক
এ এক মারফতি শক্তি। আপদে-বিপদে, চলনে-বলনে, কাজে-কর্মে, অফিস-আদালতে, রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে, গাড়ি-ঘোড়ায়, আকাশে-বাতাসে সর্বত্র এ শক্তির প্রভাব। পান থেকে চুন খসলেও সেখানে তার কেরামতি। কঠিন বিষয়কে সহজ করে নেয়া, সহজ বিষয়কে আবার কঠিনে পরিণত করাও তার মামুলি ব্যাপার। সব ঝক্কি- ঝামেলা তার কাছে মামুলি বলেই হয়তো তিনি সবার কাছে ‘মামা’। এক সময় দালাল, এরপর লাইন, জ্যাক কিংবা লিঙ্ক নানা নামে পরিচিত ছিল। এখন সবকিছুকে ছাপিয়ে সবার কাছে ‘মামা’ হয়ে উঠেছে তারা। কে না জানে মামার শক্তির কথা? সমাজের আগা থেকে গোড়া, উপর থেকে নিচ, অভিজাত থেকে নিম্নশ্রেণি সবার কাছে পরিচিত এই মামা। কোথায় নেই তাদের প্রভাব? চাকরির বাজার, ভালো পোস্টিং, অফিসের ফাইল ছাড়ানো, বাস-ট্রেনের টিকিট, ডাক্তারের সিরিয়াল নেয়া, হাসপাতালে সিট বরাদ্দ, থানা থেকে ছাড়িয়ে আনা, কারাগারে ভালো থাকা? সবই সম্ভব মামার কাছে। শুধু কি তাই? না! আরো আছে। ভালো স্কুলে ভর্তি, মহাসড়কে বাস নামানো? সড়কে নিরাপদে বাস চলা। সেখানেও প্রয়োজন মামার। বাড়ি বানাতে জমি কিনবেন? মামা না হলে সম্ভব নয়। আবার নতুন বাড়ি করতে গিয়ে বিদ্যুৎ, পানির লাইনের সংযোগ বন্ধ থাকে মামার অভাবে। মামার নাগাল পেলে সহজেই মেলে সব। কোনো কাজের ঠিকাদারি পেতে, আবার ঠিকাদারির বিল তুলতেও লাগে মামার প্রয়োজন। সংঘর্ষে আহত হয়েছে কেউ, কিংবা প্রতিপক্ষ আঘাত করেছে। মামলা করতে প্রয়োজন ডাক্তারি সার্টিফিকেট। এখানেও লাগবে মামা। ইদানীং বাসা বাড়িতে কাজের বুয়া পেতেও লাগে মামা। রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি পেতেও মামার ভূমিকা সবার আগে। নেশার জগতেও থাবা মেলেছে সেই মামারা। ইয়াবা, ফেনসিডিল নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিতে কাজ করছে মামা। প্রশাসনের সঙ্গে সখ্য রেখে কোনো কোনো মামা নিজের প্রভাব দেখাচ্ছে সমাজে। দেন-দরবার আর সালিশেও এখন মামার দাপট। বিয়ে-শাদিতেও মামার জুড়ি মেলা। দু’পক্ষকে এক করে দিতে চলে মামার নানা কসরৎ। বিদেশে লোক পাঠাতে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে, থানায় জিডি করতে, বাজারে মাছ কুটতে বসে আছে মামা। ‘অ্যাই মামা, কইরা দেন। যা লাগে দিমুনে।’ এই দুটি বাক্যই যথেষ্ট। মামা হয়ে যায় আপন। মামা হয়ে যায় নিজের। দৌড় শুরু। কাজ সম্পন্ন। অবশ্য এ জন্য ডিল করতে হয়। নানা কাজের নানা রেট। কোটি থেকে লাখ, লাখ থেকে হাজার, হাজার থেকে শ’। যেখানে যা প্রয়োজন তাই নেবে মামা। বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল বকেয়া? লাইন কেটে দিয়েছে? কোনো ব্যাপারই না। মামার দ্বারস্থ হলে সমাধান সহজ। একটু ব্যাখ্যা করে বললে, কারো চাকরির ইন্টারভিউর কার্ড এসেছে। সবার আগে খুঁজতে হয় মামা। মামা পেলে চাকরি হবে। তবে এর আগে চলবে দর কষাকষি। কথায় মিললে মিলবে চাকরি। কোনো কোনো চাকরির রেট ওঠে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। ঈদ যাত্রায় আপনার বাস-ট্রেনের টিকিট প্রয়োজন। রেল বা বাসস্ট্যান্ডে গেলেই ঘিরে ধরবে মামা। উপরি পেলেই হাতে আসবে টিকিট। সরকারি হাসপাতালে সিট খালি নেই। কিন্তু মামার দেখা পেলে সহজেই মিলে যায় সিট। নামি চিকিৎসকের সিরিয়াল প্রয়োজন। দিনের পর দিন ঘুরেও সিরিয়াল পাওয়া ভার। কিন্তু যেই মাত্র মামার দেখা মেলে সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়াল পকেটে। পুলিশ বেহুদা ধরে নিয়ে গেছে। থানায় আটক। ছাড়াতে হবে তাকে। থানার সামনে ওত পেতে আছে মামা। গেলেই ঘিরে ধরে। তারপর দরদাম। খুলে যায় হাজতখানার দরজা। প্রথম কারাগারে গিয়ে পড়তে হয় মামার কব্জায়। পুরাতন বন্দি ‘মেট’ নামধারী মামা কেনে নেবে আসামিকে। ওই আসামির ভালো থাকা না থাকা ওই মামার ইচ্ছার উপর। ইদানীং প্রশ্নপত্র ফাঁসেও শুরু হয়েছে মামার কারবার। রাজধানীর ১০টি স্কুলের বেশক’জন শিক্ষকের নাম ওঠে এসেছে তালিকায়। সবকিছু মিলিয়ে সমাজে এখন ‘মামা’ একটি অপরিহার্য নাম। অপরিহার্য অঙ্গ। আত্মীয়তার মামা নয়, মারফতি মামার প্রভাব গোটা সমাজে।
No comments