দেশের অর্থনীতি কোন পথে? by এমাজউদ্দীন আহমদ
মাত্র কিছু দিন আগেও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকেই (Economic Growth) বলা হতো অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Economic Development)। GNP (Gross National Product) ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং কোনো কোনো সময় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে চিহ্নিত করা হতো। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলেছেন, একটি দেশ উন্নত হয় যখন দেশটির তার নিজের উদ্যোগেই এক উন্নত পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত তার দ্বিতীয় উন্নয়ন দশকের (Second Development Decade) প্রস্তাবে মাথাপিছু আয়ের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন হিসেবে। ওই সময়ে অর্থনীতিবিদদের ধারণা বা প্রতীতি ছিল ‘উন্নত জীবনের সূচনা হয় উন্নত পর্যায়ের মাথাপিছু আয়ের বিশ্বে’ (Real life begins at a higher level of per capital income), কেননা অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তখন নিচের দিকে চুঁইয়ে পড়ে (Filter down) এবং দেশে দরিদ্রদের জীবনমান উন্নত করে। অর্থনীতিবিদদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। উচ্চতর মাথাপিছু আয়ের পেছনে ছুটতে যাওয়াটা শেষ পর্যন্ত অলীক প্রমাণিত হয়েছে। এই ধরনের অর্থনীতির দেশের এক দিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে আয়ের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য, দারিদ্র্য, অপুষ্টি-ব্যাধি-অশিক্ষা-নিরক্ষরতা-অস্বাস্থ্যকর অবস্থানে বসবাস, তেমনি বেড়েছে বেকারত্ব, আধা-বেকারত্ব এবং জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ যা চূড়ান্তপর্যায়ে রূপ গ্রহণ করতে পারে বিস্ফোরণধর্মী রাজনীতিতে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ হওয়া উচিত দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে ওইসব ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ ঘটানো, আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে নিজের ভাগ্য রচনায় উদ্যোগী করানো, সম্মানজনক কর্মের জন্য প্রণোদিতকরণ, বিশেষ করে সমাজব্যাপী এমন রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি করা যাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন ত্বরান্বিত হতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হতে পারে। এ জন্য সব ধরনের সামন্তবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সমাজে গণতন্ত্রের শিকড়কে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের (Participatory) মানসিকতা সুদৃঢ় করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশে এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি, কেননা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে প্রায় সব নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে ছোটখাটো বৈষম্য বিপ্লবাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কেননা জনগণ এসব বিষয়ে ভীষণ সচেতন। তা ছাড়া, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অনুপস্থিতি তথা কার্যত একদলীয় শাসন এবং দলীয় নেতাদের উচ্চবাচ্য ও পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে পারে।
২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় পেশকৃত বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে জনগণের মাথাপিছু আয় ১৪৬ ডলার বৃদ্ধি পেয়ে এ বছরে তা হয়েছে এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ হয়েছে ২১ হাজার ৫০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা অনেকে আশাও করি, দু-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এসবই ভালো কথা। আশার কথা। কিন্তু অন্য দিকে দৃষ্টি দিলে ভীত হই। দেশে প্রতি বছর যে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে তা কুক্ষিগত হচ্ছে অল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, মাত্র ১৬ ব্যক্তির মালিকানায় রয়েছে দেশের মোট সম্পদের সাড়ে ১০ শতাংশের অধিক। আবার আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট (Ultra Wealth Report) অনুযায়ী মাত্র ৯০ জনের মালিকানায় রয়েছে দেশের ১১ শতাংশ সম্পদ। এই ক’জন ব্যক্তির সম্পদ ১৬ কোটি মানুষের মাথায় ফেলে মাথাপিছু আয় হিসাব করা হচ্ছে। করারোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদ বণ্টনের চেষ্টা করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। কর ফাঁকির মাধ্যমে তা অকার্যকর থেকেই যাচ্ছে। রাজস্ব বোর্ডের এক হিসাবে দেখা যায়, শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টি রাজস্ব খেলাপি। বিশ্ব আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৩ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫০ কোটি টাকা সম্পদের মালিকদের সংখ্যা ৯৫। তাদের কাছে গচ্ছিত মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ১১ শতাংশ। এক বছর আগে এমন ধনীর সংখ্যা ছিল ৮৫ জন। তাদের কাছে গচ্ছিত সম্পদ ছিল এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা। অন্য কথায়, এক বছরের ব্যবধানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার আড়াই গুণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ হলেও কিছু সম্পদ কুক্ষিগতকারীর প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি। ২০০৯ সালে ২৫০ কোটি টাকার মালিকদের সংখ্যা ছিল ৫০ জনের মতো।
২০১৫ সালের অর্থনৈতিক খাতে আলোচিত ঘটনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের কাহিনী। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএফআই (Global Financial Integrity-GFI) ২০০৪-২০১৩ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে এক বছরেই প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা পাচারের সংবাদ প্রকাশ করে তার ৮ ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন- 'Illicit Financial close from Developing countries'এ। প্রতিবেদন মতে ২০০৯-২০১৩ সময়কালে পাচার হয়েছে দুই লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পাঁচটি ব্যাংকের তথ্য দিয়ে দুদককে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশন এসব বিষয়ে চুপ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কোনো দৃশ্যমান বিনিয়োগ না থাকলেও গত অর্থবছরের ১০ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ১৫ শতাংশ। যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালু ও পাথর। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালি কনটেইনারও পাওয়া গেছে। শুধু আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে তা-ই নয়, রফতানি নামেও টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিরা টাকা পাচার করেছেন, বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, এনজিও ব্যক্তিত্ব। এই টাকা দিয়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে তারা বাড়ি বানিয়েছেন অথবা ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত সম্পদশালীদের ‘লুটেরা’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই দুর্বৃত্তরা’ কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না, বরং অন্যের বিত্ত ‘দখল-হরণ ও আত্মসাৎ’ করে নিজেরা বিত্তশালী হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় তারা এখন জনসমষ্টির ওপর তলার ১ (এক) শতাংশ লোক যারা দেশের বেশির ভাগ সম্পদের মালিক। অধ্যাপক বারকাত তার লোক বক্তৃতা ২০১৪ তে বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো বিকাশ প্রবণতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, গত ২৪ বছরে ‘সার্বিক দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা’ অবস্থার অধোগতি হয়েছে। অন্য কথায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দারিদ্রের হার গতিধারা সুস্পষ্ট। এক দিকে এই গণ-দরিদ্র এবং ব্যাপক অসমতা আর অন্য দিকে মধ্যবিত্তের অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এবং নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পদ সমগ্র সমাজব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে যা কালে বিস্ফোরণধর্মী রাজনীতির জন্ম দেবে। তাই বলি, এখনো সময় আছে, সমবণ্টন, দারিদ্র্যদূরীকরণ ও বিত্তশালীদের ওপর উচ্চহারে কর আরোপের মাধ্যমে দেশে সামগ্রিকভাবে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ হওয়া উচিত দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে ওইসব ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের উন্মেষ ঘটানো, আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে নিজের ভাগ্য রচনায় উদ্যোগী করানো, সম্মানজনক কর্মের জন্য প্রণোদিতকরণ, বিশেষ করে সমাজব্যাপী এমন রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি করা যাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুষম বণ্টন ত্বরান্বিত হতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষেত্রে সব ধরনের বৈষম্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হতে পারে। এ জন্য সব ধরনের সামন্তবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সমাজে গণতন্ত্রের শিকড়কে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের (Participatory) মানসিকতা সুদৃঢ় করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশে এই ধরনের পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি, কেননা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে প্রায় সব নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশে ছোটখাটো বৈষম্য বিপ্লবাত্মক হয়ে উঠতে পারে। কেননা জনগণ এসব বিষয়ে ভীষণ সচেতন। তা ছাড়া, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অনুপস্থিতি তথা কার্যত একদলীয় শাসন এবং দলীয় নেতাদের উচ্চবাচ্য ও পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পরিবেশকে উত্তপ্ত করতে পারে।
২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় পেশকৃত বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে জনগণের মাথাপিছু আয় ১৪৬ ডলার বৃদ্ধি পেয়ে এ বছরে তা হয়েছে এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ হয়েছে ২১ হাজার ৫০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা অনেকে আশাও করি, দু-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এসবই ভালো কথা। আশার কথা। কিন্তু অন্য দিকে দৃষ্টি দিলে ভীত হই। দেশে প্রতি বছর যে সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে তা কুক্ষিগত হচ্ছে অল্পসংখ্যক ব্যক্তির হাতে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, মাত্র ১৬ ব্যক্তির মালিকানায় রয়েছে দেশের মোট সম্পদের সাড়ে ১০ শতাংশের অধিক। আবার আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট (Ultra Wealth Report) অনুযায়ী মাত্র ৯০ জনের মালিকানায় রয়েছে দেশের ১১ শতাংশ সম্পদ। এই ক’জন ব্যক্তির সম্পদ ১৬ কোটি মানুষের মাথায় ফেলে মাথাপিছু আয় হিসাব করা হচ্ছে। করারোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদ বণ্টনের চেষ্টা করলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। কর ফাঁকির মাধ্যমে তা অকার্যকর থেকেই যাচ্ছে। রাজস্ব বোর্ডের এক হিসাবে দেখা যায়, শীর্ষ করদাতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫টি রাজস্ব খেলাপি। বিশ্ব আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৩ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫০ কোটি টাকা সম্পদের মালিকদের সংখ্যা ৯৫। তাদের কাছে গচ্ছিত মোট সম্পদের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা যা মোট জিডিপির ১১ শতাংশ। এক বছর আগে এমন ধনীর সংখ্যা ছিল ৮৫ জন। তাদের কাছে গচ্ছিত সম্পদ ছিল এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা। অন্য কথায়, এক বছরের ব্যবধানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার আড়াই গুণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ হলেও কিছু সম্পদ কুক্ষিগতকারীর প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের বেশি। ২০০৯ সালে ২৫০ কোটি টাকার মালিকদের সংখ্যা ছিল ৫০ জনের মতো।
২০১৫ সালের অর্থনৈতিক খাতে আলোচিত ঘটনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের কাহিনী। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএফআই (Global Financial Integrity-GFI) ২০০৪-২০১৩ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে এক বছরেই প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা পাচারের সংবাদ প্রকাশ করে তার ৮ ডিসেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন- 'Illicit Financial close from Developing countries'এ। প্রতিবেদন মতে ২০০৯-২০১৩ সময়কালে পাচার হয়েছে দুই লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া যায়। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন পাঁচটি ব্যাংকের তথ্য দিয়ে দুদককে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু দুঃখের বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশন এসব বিষয়ে চুপ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কোনো দৃশ্যমান বিনিয়োগ না থাকলেও গত অর্থবছরের ১০ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় প্রায় ২৫ শতাংশ। আর আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় ১৫ শতাংশ। যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালু ও পাথর। শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে খালি কনটেইনারও পাওয়া গেছে। শুধু আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে তা-ই নয়, রফতানি নামেও টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সমাজের উঁচু স্তরের ব্যক্তিরা টাকা পাচার করেছেন, বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, এনজিও ব্যক্তিত্ব। এই টাকা দিয়ে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে তারা বাড়ি বানিয়েছেন অথবা ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন।
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত সম্পদশালীদের ‘লুটেরা’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এই দুর্বৃত্তরা’ কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না, বরং অন্যের বিত্ত ‘দখল-হরণ ও আত্মসাৎ’ করে নিজেরা বিত্তশালী হয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় তারা এখন জনসমষ্টির ওপর তলার ১ (এক) শতাংশ লোক যারা দেশের বেশির ভাগ সম্পদের মালিক। অধ্যাপক বারকাত তার লোক বক্তৃতা ২০১৪ তে বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো বিকাশ প্রবণতা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, গত ২৪ বছরে ‘সার্বিক দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা’ অবস্থার অধোগতি হয়েছে। অন্য কথায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দারিদ্রের হার গতিধারা সুস্পষ্ট। এক দিকে এই গণ-দরিদ্র এবং ব্যাপক অসমতা আর অন্য দিকে মধ্যবিত্তের অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা এবং নগণ্য সংখ্যক ব্যক্তির হাতে অঢেল সম্পদ সমগ্র সমাজব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে যা কালে বিস্ফোরণধর্মী রাজনীতির জন্ম দেবে। তাই বলি, এখনো সময় আছে, সমবণ্টন, দারিদ্র্যদূরীকরণ ও বিত্তশালীদের ওপর উচ্চহারে কর আরোপের মাধ্যমে দেশে সামগ্রিকভাবে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প নেই।
No comments