মিয়ানমারের নির্বাচনে জিতবে কে—গণতন্ত্র না জবরদস্তি? by সোহরাব হাসান
সামরিক
শাসনে রেকর্ড সৃষ্টিকারী মিয়ানমারে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ
নির্বাচন। দেশটির তিন কোটি ভোটার ৪৪০ আসনের নিম্ন পরিষদে ৩৩০ আসনের জন্য
ভোট দিলেও বাকি আসনগুলো পূরণ করবেন সেনাবাহিনীর প্রধান সংবিধানে প্রদত্ত
ক্ষমতাবলে। ২২৪ সদস্যের উচ্চকক্ষের ১৬৮টি আসনেও একই দিনে ভোট হতে যাচ্ছে।
সেখানেও বাকি আসনগুলো পূরণ করবেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এই নির্বাচনে ৯১টি
তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক দলের ছয় শতাধিক প্রার্থী অংশ নিলেও মূল
প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
পার্টি (ইউএসডিপি) ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ
ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মধ্যে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নির্বাচন
মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে এনএলডি জয়ী হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে কি না। কিংবা নির্বাচনে সু চির দল জয়ী হলেও প্রকৃত ক্ষমতা তাঁর হাতে দেওয়া হবে কি না। ১৯৯০ সালেও মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনগণ এনএলডির পক্ষে রায় দিলেও সেনাবাহিনী সেই নির্বাচনী ফল নাকচ করে দেয় এবং জনগণের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। তবে পর্যবেক্ষকেরা এ-ও মনে করেন যে সেই সময়ে যত সহজে নির্বাচনী ফলাফল নস্যাৎ করা গেছে, এখন সেটি তত সহজ হবে না। সেনাবাহিনীকে ইচ্ছায় হোক কিংবা বাইরের চাপেই হোক, বিরোধী দলের সঙ্গে কিছুটা আপসরফায় আসতে হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বহাল রাখতে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়, যাঁদের সেনাপ্রধানই মনোনীত করে থাকেন। সেই সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের নির্বাচন বর্জন করে এনএলডি; যদিও দলের কিছু লোককে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার। কিন্তু সেই নির্বাচনে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি। আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেইন সেইনই নতুন প্রেসিডেন্ট পদে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। বেসামরিক প্রশাসনের মতো সামরিক প্রশাসনেও কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে ৩০ সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো সেনাসদস্যদের হাতেই রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে কি না। কিংবা নির্বাচনে সু চির দল জয়ী হলেও প্রকৃত ক্ষমতা তাঁর হাতে দেওয়া হবে কি না। ১৯৯০ সালেও মিয়ানমারের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনগণ এনএলডির পক্ষে রায় দিলেও সেনাবাহিনী সেই নির্বাচনী ফল নাকচ করে দেয় এবং জনগণের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে। তবে পর্যবেক্ষকেরা এ-ও মনে করেন যে সেই সময়ে যত সহজে নির্বাচনী ফলাফল নস্যাৎ করা গেছে, এখন সেটি তত সহজ হবে না। সেনাবাহিনীকে ইচ্ছায় হোক কিংবা বাইরের চাপেই হোক, বিরোধী দলের সঙ্গে কিছুটা আপসরফায় আসতে হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বহাল রাখতে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়, যাঁদের সেনাপ্রধানই মনোনীত করে থাকেন। সেই সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের নির্বাচন বর্জন করে এনএলডি; যদিও দলের কিছু লোককে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিল সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার। কিন্তু সেই নির্বাচনে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি। আগের সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেইন সেইনই নতুন প্রেসিডেন্ট পদে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। বেসামরিক প্রশাসনের মতো সামরিক প্রশাসনেও কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে ৩০ সদস্য নিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলো সেনাসদস্যদের হাতেই রয়েছে।
জেনারেল
থেইন সেইন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিরোধী দল এনএলডির সঙ্গে
সমঝোতায় আসার উদ্যোগ নেন; যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে অং সান সু চির ১৫
বছরের অন্তরীণ অবস্থার অবসান হয় এবং পরের বছর ৪৫টি আসনে অনুষ্ঠিত
উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে এনএলডির ৪৩ জন সদস্য জয়ী হয়ে বিরোধী দলের আসনে
বসেন। অং সান সু চি হন বিরোধী দলের নেত্রী।
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে তৎকালীন নেউইন সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রবল ছাত্র গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, অসুস্থ মাকে দেখতে এসে অং সান সু চি তাতে জড়িয়ে পড়েন এবং একসময় তাঁর হাতেই নেতৃত্বের ভার পড়ে। এরপর তিনি বাবা মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের সহযোদ্ধা ও তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে এনএলডি গড়ে তোলেন। এই দলটি ১৯৯০ সালে নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ আসনে জয়ী হলেও সামরিক শাসকেরা সেই ফল মেনে নেননি। অং সান সু চিকে কখনো অন্তরীণ, কখনো নির্জন কারাবাসে কাটাতে হয়। তাঁর অধিকাংশ রাজনৈতিক সহযোদ্ধার ঠিকানাও হয় জেলখানা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও মিয়ানমার প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত নাজুক হতে থাকে।
গত তিন বছরে অং সান সু চি ও তাঁর দল একাধিকবার সংবিধানে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। কেননা, তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানের ৫৯ (এফ) ধারা অনুযায়ী কেউ বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করলে কিংবা তাঁর সন্তান অন্য দেশের নাগরিক হলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এই আইনটি করা হয়েছিল সু চিকে লক্ষ্য রেখেই। এ ছাড়া সংবিধানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর জন্য যে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত আছে, সেটি পরিবর্তন করতে না পারলে মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতেই থেকে যাবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে নন্দিত অং সান সু চি এবারের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে দারুণ আশাবাদী। ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়েডন প্যাগোডার সামনে আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচনে তাঁর দলই জয়ী হবে। যারা বলে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময় এটি নয়, তারা আসলে এনএলডির হাতে ক্ষমতা দিতে ভয় পায়। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও ধারণা, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে অং সান সু চিরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি। আর সু চির জয়ের অর্থ হবে সেনা নেতৃত্বের পরাজয়।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এই বলে ভোটারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে বিরোধী দল জয়ী হলে মিয়ানমারে আরব বসন্ত দেখা দেবে, যা দেশকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবে। তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন। নির্বাচিনী প্রচারের শুরু থেকে সু চির দল যাতে জয়ী হতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠীগুলো নানা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে।
এখানে কৌতূহলোদ্দীপক হলো, আশির দশকের শেষার্ধে এবং নব্বইয়ের দশকজুড়ে যে বৌদ্ধ মংরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে চালিত আন্দোলনে সু চিকে সমর্থন করেছেন, তাঁেদর অধিকাংশ এখন তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। শান্তির প্রতীক গৈরিক বসনধারীরা এখন ধর্মকে উগ্রপন্থার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাঁরা প্রচার চালাচ্ছেন যে সু চি জয়ী হলে ভবিষ্যতে দেশটিতে মুসলমানেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং বৌদ্ধরা সাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। যদিও এ ধরনের প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। বরং দেশটির জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও নিয়ত তারা ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গত কয়েক বছরে রাখাইন প্রদেশের বাইরেও একাধিকবার মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছে। আর মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের তো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি, তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। অনেকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সম্প্রতি রাখাইনে নির্বাচনী জনসভায় অং সান সু চি বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাসহ সব সমস্যার সমাধান হবে।
মুসলিমবিরোধী রাজনীতি সেখানে এতটাই তুঙ্গে যে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি ও বিরোধী এনএলডি কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি। যদিও বর্তমান সেনা প্রভাবিত সংসদেও বেশ কয়েকজন মুসলমান সদস্য আছেন। গত জানুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যখন মিয়ানমারে যাই, তখনই সু চি-বিরোধী ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করি। সেখানে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি বন্ধু আমাকে একটি ওয়েবসাইট দেখালেন, যাতে হিজাব পরিহিত অবস্থায় সু চিকে একজন মুসলমান নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায়। ছবিটি ছিল ইমপোজ করা। সু চিকে রোহিঙ্গা তোষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের ভয়ে তিনি রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের ওপর অব্যাহত হামলার বিষয়েও একপ্রকার নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। এ কারণে বহির্বিশ্বে সু চিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি ২০০৭ সালে সরকার-সমর্থকেরা সু চির গাড়িবহরে হামলা চালালে অন্যান্যের মধ্যে এনএলডির একজন মুসলিম নেত্রীও গুরুতর আহত হন, যিনি ছিলেন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সু চি তাঁকে মনোনয়ন দিতে সাহস পাননি।
অং সান সু চি সর্বশেষ নির্বাচনী সভায় দেওয়া ভাষণে বলেছেন, জনগণের রায়ে তাঁর দলই জয়ী হবে এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান প্রেসিডেন্টের ওপরে হবে। এখানেই আশঙ্কা যে সেই জয়কে ক্ষমতাসীনেরা মেনে নেবে কি না। যদি মেনে না নেয়, তাহলে কি ১৯৯০ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে? আর যদি মেনে নেয়, তাহলে কি সামরিক জান্তা সংবিধান সংশোধন করে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ উন্মুক্ত করবে?
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি হওয়ার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতি ও আন্তর্জাতিক জনমত। সেই সময়ে মিয়ানমার নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ঝুঁকি নিলেও এখন নিতে সাহস পাবে না। এই মুহূর্তে বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্যের সুফল কেবল সাধারণ মানুষই পাচ্ছে না, তার সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন সেনা শাসকেরাও। অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের মতো মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারির বড় অংশীদার বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। ফলে খুলে দেওয়া অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজা ফের বন্ধ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হবে।
সে ক্ষেত্রে সু চির দল জয়ী হলে সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে একটি আপসরফা বা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে আসতে পারে বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সু চিও এ ব্যাপারে নমনীয় বলে ধারণা করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি বলে দিয়েছেন, এনএলডি জয়ী হলে ‘সমঝোতার সরকার’ গঠনে প্রস্তুত আছে। সমঝোতার অর্থ ক্ষমতা ভাগাভাগি।
এখন প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে ক্ষমতা ভোগকারী সেনাবাহিনী সেই ভাগাভাগিতে রাজি হবে কি না। তাই নির্বাচনের চেয়েও পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি এখন নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে তৎকালীন নেউইন সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রবল ছাত্র গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, অসুস্থ মাকে দেখতে এসে অং সান সু চি তাতে জড়িয়ে পড়েন এবং একসময় তাঁর হাতেই নেতৃত্বের ভার পড়ে। এরপর তিনি বাবা মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের সহযোদ্ধা ও তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে এনএলডি গড়ে তোলেন। এই দলটি ১৯৯০ সালে নির্বাচনে ৮৫ শতাংশ আসনে জয়ী হলেও সামরিক শাসকেরা সেই ফল মেনে নেননি। অং সান সু চিকে কখনো অন্তরীণ, কখনো নির্জন কারাবাসে কাটাতে হয়। তাঁর অধিকাংশ রাজনৈতিক সহযোদ্ধার ঠিকানাও হয় জেলখানা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও মিয়ানমার প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্রুত নাজুক হতে থাকে।
গত তিন বছরে অং সান সু চি ও তাঁর দল একাধিকবার সংবিধানে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। কেননা, তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ২০০৮ সালে প্রণীত সংবিধানের ৫৯ (এফ) ধারা অনুযায়ী কেউ বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করলে কিংবা তাঁর সন্তান অন্য দেশের নাগরিক হলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এই আইনটি করা হয়েছিল সু চিকে লক্ষ্য রেখেই। এ ছাড়া সংবিধানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর জন্য যে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত আছে, সেটি পরিবর্তন করতে না পারলে মূল ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতেই থেকে যাবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে নন্দিত অং সান সু চি এবারের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে দারুণ আশাবাদী। ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়েডন প্যাগোডার সামনে আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেছেন, নির্বাচনে তাঁর দলই জয়ী হবে। যারা বলে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময় এটি নয়, তারা আসলে এনএলডির হাতে ক্ষমতা দিতে ভয় পায়। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদেরও ধারণা, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে অং সান সু চিরই জয়ের সম্ভাবনা বেশি। আর সু চির জয়ের অর্থ হবে সেনা নেতৃত্বের পরাজয়।
প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন এই বলে ভোটারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে বিরোধী দল জয়ী হলে মিয়ানমারে আরব বসন্ত দেখা দেবে, যা দেশকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবে। তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেছেন। নির্বাচিনী প্রচারের শুরু থেকে সু চির দল যাতে জয়ী হতে না পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠীগুলো নানা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে।
এখানে কৌতূহলোদ্দীপক হলো, আশির দশকের শেষার্ধে এবং নব্বইয়ের দশকজুড়ে যে বৌদ্ধ মংরা সেনাশাসনের বিরুদ্ধে চালিত আন্দোলনে সু চিকে সমর্থন করেছেন, তাঁেদর অধিকাংশ এখন তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। শান্তির প্রতীক গৈরিক বসনধারীরা এখন ধর্মকে উগ্রপন্থার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাঁরা প্রচার চালাচ্ছেন যে সু চি জয়ী হলে ভবিষ্যতে দেশটিতে মুসলমানেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে এবং বৌদ্ধরা সাগরে নিক্ষিপ্ত হবে। যদিও এ ধরনের প্রচারের কোনো ভিত্তি নেই। বরং দেশটির জনসংখ্যার পাঁচ ভাগ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও নিয়ত তারা ভয়ভীতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গত কয়েক বছরে রাখাইন প্রদেশের বাইরেও একাধিকবার মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছে। আর মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের তো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি, তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। অনেকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। সম্প্রতি রাখাইনে নির্বাচনী জনসভায় অং সান সু চি বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাসহ সব সমস্যার সমাধান হবে।
মুসলিমবিরোধী রাজনীতি সেখানে এতটাই তুঙ্গে যে ক্ষমতাসীন ইউএসডিপি ও বিরোধী এনএলডি কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি। যদিও বর্তমান সেনা প্রভাবিত সংসদেও বেশ কয়েকজন মুসলমান সদস্য আছেন। গত জানুয়ারিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যখন মিয়ানমারে যাই, তখনই সু চি-বিরোধী ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করি। সেখানে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি বন্ধু আমাকে একটি ওয়েবসাইট দেখালেন, যাতে হিজাব পরিহিত অবস্থায় সু চিকে একজন মুসলমান নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে দেখা যায়। ছবিটি ছিল ইমপোজ করা। সু চিকে রোহিঙ্গা তোষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের ভয়ে তিনি রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের ওপর অব্যাহত হামলার বিষয়েও একপ্রকার নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। এ কারণে বহির্বিশ্বে সু চিকে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি ২০০৭ সালে সরকার-সমর্থকেরা সু চির গাড়িবহরে হামলা চালালে অন্যান্যের মধ্যে এনএলডির একজন মুসলিম নেত্রীও গুরুতর আহত হন, যিনি ছিলেন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সু চি তাঁকে মনোনয়ন দিতে সাহস পাননি।
অং সান সু চি সর্বশেষ নির্বাচনী সভায় দেওয়া ভাষণে বলেছেন, জনগণের রায়ে তাঁর দলই জয়ী হবে এবং সে ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান প্রেসিডেন্টের ওপরে হবে। এখানেই আশঙ্কা যে সেই জয়কে ক্ষমতাসীনেরা মেনে নেবে কি না। যদি মেনে না নেয়, তাহলে কি ১৯৯০ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে? আর যদি মেনে নেয়, তাহলে কি সামরিক জান্তা সংবিধান সংশোধন করে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ উন্মুক্ত করবে?
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি হওয়ার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াবে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতি ও আন্তর্জাতিক জনমত। সেই সময়ে মিয়ানমার নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ঝুঁকি নিলেও এখন নিতে সাহস পাবে না। এই মুহূর্তে বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্যের সুফল কেবল সাধারণ মানুষই পাচ্ছে না, তার সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন সেনা শাসকেরাও। অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের মতো মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারির বড় অংশীদার বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারা। ফলে খুলে দেওয়া অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দরজা ফের বন্ধ করা তাঁদের পক্ষে কঠিন হবে।
সে ক্ষেত্রে সু চির দল জয়ী হলে সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে একটি আপসরফা বা ক্ষমতা ভাগাভাগিতে আসতে পারে বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সু চিও এ ব্যাপারে নমনীয় বলে ধারণা করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি বলে দিয়েছেন, এনএলডি জয়ী হলে ‘সমঝোতার সরকার’ গঠনে প্রস্তুত আছে। সমঝোতার অর্থ ক্ষমতা ভাগাভাগি।
এখন প্রশ্ন হলো, দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে ক্ষমতা ভোগকারী সেনাবাহিনী সেই ভাগাভাগিতে রাজি হবে কি না। তাই নির্বাচনের চেয়েও পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি এখন নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments