সুন্দলীর সুন্দর বাঁচতে চায় by ফারুক ওয়াসিফ
ঢাকায়
আশুরার রাতে হোসেনি দালানে গ্রেনেড হামলার ঠিক আগে, সন্ধ্যারাতে এক
গ্রামীণ মেলায় দেখি, দেব-দেবী ও নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে
কারবালার তিরবিদ্ধ দুলদুল ঘোড়ার ছবি। আশ্চর্য কাকতাল! পূজামণ্ডপ থেকে
মেলা—সবখানেই মানুষের সরগরম সমাবেশ। অনেক রাত পর্যন্ত মাইকে গান, রাস্তায়
চলাচল। সেই রাতেই হোসেনি দালানে হঠাৎ বিকট শব্দ। চিৎকার। তারপর কয়েক
সেকেন্ড নীরবতা। তারপর কোলাহল, আর্তনাদ। ছত্রভঙ্গ মানুষের পায়ের তলায় পড়ল
মানুষ আর মানুষের শিশুরা। একটি মর্মান্তিক মৃত্যুতে বেলুনের মতো ফেটে গেল
নিরাপত্তার আশ্বাস। হোসেনি দালান কিংবা রমনার বটমূল, কিংবা রামুর
বৌদ্ধমন্দির, কিংবা সাঁথিয়ার হিন্দু গ্রাম; বোমা বা আগুন বা হামলার পরের
দৃশ্য ও মানুষের মনোছবি সবখানেই এক।
কিন্তু সুন্দলীতে সেটা ছিল শান্তির রাত। বাজারের মোড় ছিল গমগম। ইজিবাইক আর ভ্যান লোক আনছে আর তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে। নদীর পাড়ে কুচলিয়া বিদ্যালয়ের মাঠে ষাঁড়ের লড়াই হয়ে গেল বিকেলবেলায়। মাঠ ঘিরে বাঁশের বেড়া। চারকোনা একটু খোলা। সেখান দিয়ে লড়াকু ষাঁড় ঢুকবে বা পরাস্ত হলে লেজ তুলে পালাবে। প্রায় ২০ হাজার দর্শক, গোটা পঞ্চাশেক যোদ্ধা ষাঁড়, ধুলা, ভাজাপোড়ার দোকান—হুল্লোড় শেষে সবাই তখন ফেরার তালে। পরাজিত ষাঁড়গুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে যাচ্ছে; দেখে মায়া হয়। এদিকে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিস্তর ইলিশ আর চুইঝাল। যষ্টিমধুর মতো কিন্তু বেশ চওড়া আর লম্বা চুইঝালের আঁশওয়ালা শাখা দিয়ে ইলিশ রান্না বেশ হয় এ এলাকায়।
উৎসবে যেভাবে পাশাপাশি ছিল হিন্দু আর মুসলমানে, কোনো সন্ত্রাস বা ভয় তাদের আলাদা করতে পারেনি। ঢাকা ও ঢাকাকেন্দ্রিক মিডিয়ায় যতই টেনশন বিরাজ করুক, সুন্দলী ও এর আশপাশের কোনো গ্রামে ভয়, উত্তেজনা, অবিশ্বাসের ছায়াটাও দেখা যায়নি। রাজধানী উত্তেজনা ও ভয়ের ডিপো, গণমাধ্যম দুঃসংবাদের ভগ্নদূত। কিন্তু সুন্দলী গ্রামের ওই উৎসব অমলিন অক্ষত সুন্দরই ছিল। হিংসার রাজনীতি নষ্ট করতে পারেনি এই সুন্দর: হরেনের মাটির পুতুল, রথীনের ঘরে ভাজা ঝাল চানাচুর, মোস্তফার চটপটি বিক্রির শেষ ছিল না। সস্তা গয়নার দোকানে হুলুস্থূল ভিড় ছিল মেয়েদের। অন্ধকার গ্রামপথ দিয়ে ছেলেমেয়েরা আসছিল–যাচ্ছিল। কোজাগরী পূর্ণিমা দেখাবে বলে আহ্লাদে ফুলে উঠছিল চাঁদ। পথে পড়ে ছিল জ্যোৎস্নার জালিকাটা আলো। বউ-জামাই, বন্ধু-বান্ধবীরা দল বেঁধে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘুরছিল। চেনা দুষ্কর কে হিন্দু কে মুসলমান।
এ এমন এক এলাকা, যেখানে গ্রামীণ মেলায় হাসিনা-খালেদা-তারেক-জয়-সালমান-সাকিব-গোলাপ-তাজমহল-দীপিকার ছবি শান্তিতে পাশাপাশি ঝোলে। ঠিক যেভাবে শান্তিতে বাস করে এখানকার মানুষ। জায়গাটা যশোরের নওয়াপাড়ায়।
এ এমন এক এলাকা, যেখানে শেষ কবে খুন বা ধর্ষণ বা রাহাজানি ঘটেছে, অনেকেই মনে করতে পারে না। এ এমন এক বসতি, যার নিরানব্বই ভাগ মানুষই নিম্নবর্ণের হিন্দু অথবা মতুয়া ধর্মাবলম্বী। এখানকার ৯৬টি গ্রাম যেন এক পরিবার। বাইরের মানুষের কাছে তারা জমি বিক্রি করে না। বাইরের সন্ত্রাসী বা চোর বা দস্যুরা এখানে উৎপাতের সাহসও করে না। এই ৯৬ গ্রামে হতদরিদ্র নেই আবার ধনীও বিরল। সবারই খণ্ড খণ্ড জমি আছে। আর আছে মাছ ধরার জন্য অবারিত জলাশয়। এখানে গ্রামের নাম সুন্দলী, ডহর, মহিষহাটি, ফুলেরগাতী, লেবুগাতী, লক্ষ্মীপুর; এখানে মানুষের নাম হীরামন বিশ্বাস, নদীর নাম মুক্তেশ্বরী। সরলতা এই জনপদের শক্তি।
সুন্দলীতে সেদিন দশমী পেরিয়েও উৎসব চলছিল। গান, নাটক আর শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা। ষাঁড়ের লড়াইয়ের মাঠ থেকে যাঁর তিন চাকার ভ্যানে উঠে বসি, তিনি যুবক বয়সে ডাকাতি করতেন। নাম দিল্লিশ্বর হলেও পেশায় ভ্যানচালক। ষাটোর্ধ্ব মানুষটির কাছে পূজার খবর জানতে চাইলে ‘কাকা’ সম্বোধনে বললেন, ‘আগেরবারের চাইতে ভালো। আমাগের গ্রামে তো মণ্ডপ হয় না। তায় মোসলমানরা বেজায় খ্যাপা। কয়, পূজা করবি না মানে, আমরা চাঁদা দিতেছি। সে-ই পূজা হইল ধুমধামে।’ দিল্লিশ্বরের আঠারোপাইয়া গ্রামটা ব্যতিক্রম। এ গ্রামেই কিছু মুসলমানের বাস। এর বাইরে বাকি সব গ্রামের প্রায় শতভাগই হিন্দু।
যাঁরা বাংলাদেশের আত্মার শক্তি ও সৌন্দর্য জানতে চান, তাঁরা এখানে আসতে পারেন। এ যেন সর্বজনের সামাজিক তীর্থ। হিংসা আর লোভে জর্জরিত শহরে যাঁদের প্রাণ আনচান করে, তাঁরা এখানে দুদণ্ড শান্তি খুঁজতে পারেন। আগেকার দিনে রোগ-ব্যাধি সারাতে হাওয়া বদলে যেত মানুষ—সে রকম, যাঁরা দেশ ও দশ নিয়ে হতাশ, তাঁরা মন বদলে আসতে পারেন সুন্দলীতে। এটি সরকারিভাবে যশোর জেলার আদর্শ ইউনিয়ন। শিশুদের প্রায় সবাই বিদ্যালয়ে যায়।
কিন্তু সুন্দলীতে সেটা ছিল শান্তির রাত। বাজারের মোড় ছিল গমগম। ইজিবাইক আর ভ্যান লোক আনছে আর তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে। নদীর পাড়ে কুচলিয়া বিদ্যালয়ের মাঠে ষাঁড়ের লড়াই হয়ে গেল বিকেলবেলায়। মাঠ ঘিরে বাঁশের বেড়া। চারকোনা একটু খোলা। সেখান দিয়ে লড়াকু ষাঁড় ঢুকবে বা পরাস্ত হলে লেজ তুলে পালাবে। প্রায় ২০ হাজার দর্শক, গোটা পঞ্চাশেক যোদ্ধা ষাঁড়, ধুলা, ভাজাপোড়ার দোকান—হুল্লোড় শেষে সবাই তখন ফেরার তালে। পরাজিত ষাঁড়গুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে যাচ্ছে; দেখে মায়া হয়। এদিকে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বিস্তর ইলিশ আর চুইঝাল। যষ্টিমধুর মতো কিন্তু বেশ চওড়া আর লম্বা চুইঝালের আঁশওয়ালা শাখা দিয়ে ইলিশ রান্না বেশ হয় এ এলাকায়।
উৎসবে যেভাবে পাশাপাশি ছিল হিন্দু আর মুসলমানে, কোনো সন্ত্রাস বা ভয় তাদের আলাদা করতে পারেনি। ঢাকা ও ঢাকাকেন্দ্রিক মিডিয়ায় যতই টেনশন বিরাজ করুক, সুন্দলী ও এর আশপাশের কোনো গ্রামে ভয়, উত্তেজনা, অবিশ্বাসের ছায়াটাও দেখা যায়নি। রাজধানী উত্তেজনা ও ভয়ের ডিপো, গণমাধ্যম দুঃসংবাদের ভগ্নদূত। কিন্তু সুন্দলী গ্রামের ওই উৎসব অমলিন অক্ষত সুন্দরই ছিল। হিংসার রাজনীতি নষ্ট করতে পারেনি এই সুন্দর: হরেনের মাটির পুতুল, রথীনের ঘরে ভাজা ঝাল চানাচুর, মোস্তফার চটপটি বিক্রির শেষ ছিল না। সস্তা গয়নার দোকানে হুলুস্থূল ভিড় ছিল মেয়েদের। অন্ধকার গ্রামপথ দিয়ে ছেলেমেয়েরা আসছিল–যাচ্ছিল। কোজাগরী পূর্ণিমা দেখাবে বলে আহ্লাদে ফুলে উঠছিল চাঁদ। পথে পড়ে ছিল জ্যোৎস্নার জালিকাটা আলো। বউ-জামাই, বন্ধু-বান্ধবীরা দল বেঁধে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে ঘুরছিল। চেনা দুষ্কর কে হিন্দু কে মুসলমান।
এ এমন এক এলাকা, যেখানে গ্রামীণ মেলায় হাসিনা-খালেদা-তারেক-জয়-সালমান-সাকিব-গোলাপ-তাজমহল-দীপিকার ছবি শান্তিতে পাশাপাশি ঝোলে। ঠিক যেভাবে শান্তিতে বাস করে এখানকার মানুষ। জায়গাটা যশোরের নওয়াপাড়ায়।
এ এমন এক এলাকা, যেখানে শেষ কবে খুন বা ধর্ষণ বা রাহাজানি ঘটেছে, অনেকেই মনে করতে পারে না। এ এমন এক বসতি, যার নিরানব্বই ভাগ মানুষই নিম্নবর্ণের হিন্দু অথবা মতুয়া ধর্মাবলম্বী। এখানকার ৯৬টি গ্রাম যেন এক পরিবার। বাইরের মানুষের কাছে তারা জমি বিক্রি করে না। বাইরের সন্ত্রাসী বা চোর বা দস্যুরা এখানে উৎপাতের সাহসও করে না। এই ৯৬ গ্রামে হতদরিদ্র নেই আবার ধনীও বিরল। সবারই খণ্ড খণ্ড জমি আছে। আর আছে মাছ ধরার জন্য অবারিত জলাশয়। এখানে গ্রামের নাম সুন্দলী, ডহর, মহিষহাটি, ফুলেরগাতী, লেবুগাতী, লক্ষ্মীপুর; এখানে মানুষের নাম হীরামন বিশ্বাস, নদীর নাম মুক্তেশ্বরী। সরলতা এই জনপদের শক্তি।
সুন্দলীতে সেদিন দশমী পেরিয়েও উৎসব চলছিল। গান, নাটক আর শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা। ষাঁড়ের লড়াইয়ের মাঠ থেকে যাঁর তিন চাকার ভ্যানে উঠে বসি, তিনি যুবক বয়সে ডাকাতি করতেন। নাম দিল্লিশ্বর হলেও পেশায় ভ্যানচালক। ষাটোর্ধ্ব মানুষটির কাছে পূজার খবর জানতে চাইলে ‘কাকা’ সম্বোধনে বললেন, ‘আগেরবারের চাইতে ভালো। আমাগের গ্রামে তো মণ্ডপ হয় না। তায় মোসলমানরা বেজায় খ্যাপা। কয়, পূজা করবি না মানে, আমরা চাঁদা দিতেছি। সে-ই পূজা হইল ধুমধামে।’ দিল্লিশ্বরের আঠারোপাইয়া গ্রামটা ব্যতিক্রম। এ গ্রামেই কিছু মুসলমানের বাস। এর বাইরে বাকি সব গ্রামের প্রায় শতভাগই হিন্দু।
যাঁরা বাংলাদেশের আত্মার শক্তি ও সৌন্দর্য জানতে চান, তাঁরা এখানে আসতে পারেন। এ যেন সর্বজনের সামাজিক তীর্থ। হিংসা আর লোভে জর্জরিত শহরে যাঁদের প্রাণ আনচান করে, তাঁরা এখানে দুদণ্ড শান্তি খুঁজতে পারেন। আগেকার দিনে রোগ-ব্যাধি সারাতে হাওয়া বদলে যেত মানুষ—সে রকম, যাঁরা দেশ ও দশ নিয়ে হতাশ, তাঁরা মন বদলে আসতে পারেন সুন্দলীতে। এটি সরকারিভাবে যশোর জেলার আদর্শ ইউনিয়ন। শিশুদের প্রায় সবাই বিদ্যালয়ে যায়।
No comments