সত্য যেন খুন হয়ে না যায় by সোহরাব হাসান

সিজার তাবেলা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা চার আসামি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’
ইংরেজি ইনভেস্টিগেশন শব্দের অর্থ তদন্ত, অনুসন্ধান, অন্বেষণ, সংবীক্ষণ। এর উদ্দেশ্য সত্য উদ্ঘাটন। যে সত্য লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, সেটি জনগণের সামনে নিয়ে আসাই হলো তদন্তকারী সংস্থা বা কর্মীদের দায়িত্ব। এটি হতে হবে সম্পূর্ণ রাজনীতি–নিরপেক্ষ। তদন্তকারীদের দেখার বিষয় ঘটনাটি কীভাবে ঘটল, কারা ঘটাল, কেন ঘটাল? সাধারণ মানুষের পক্ষে এ ধরনের কাজ সম্ভব নয় বলেই রাষ্ট্র তদন্তকাজে প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীদের সমন্বয়ে একাধিক সংস্থা বা কর্মী বাহিনী তৈরি করে।
আধুনিক রাষ্ট্রে অপরাধ দমনের প্রথম ও প্রধান উপায় হলো, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে অপরাধীদের প্রস্তুতি, ষড়যন্ত্র বা নীলনকশা ভন্ডুল করে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে অপরাধীরা যাঁকে বা যাঁদের টার্গেট করে, তাঁরা রক্ষা পান। আর সেটি সম্ভব না হলে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধীদের পাকড়াও করে আইনানুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
যে রাষ্ট্র এই কাজটি যত দক্ষতার সঙ্গে করে, সেই রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতা তত কমে যায়। আর যে রাষ্ট্রে অপরাধীরা ছাড় কিংবা পার পেয়ে যায়, সেই রাষ্ট্রে অপরাধ আরও জেঁকে বসে, আইনের শাসন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এই বিবেচনায় কেবল ধর্মীয় জঙ্গি নয়, সব ধরনের অপরাধীদের প্রতি রাষ্ট্র তথা সরকারের জিরো টলারেন্স থাকা প্রয়োজন। আমরা সেদিনই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হব, যেদিন অপরাধীদের আওয়ামী লীগার বা বিএনপিওয়ালা হিসেবে দেখা হবে না। দেখা হবে অপরাধী হিসেবেই।
সাম্প্রতিক কালে সিলেটে শিশু রাজন ও খুলনায় কিশোর রাকিব হত্যার আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের ব্যাপারে সরকার যে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে, সব ক্ষেত্রে তা অনুসৃত হলে বাংলাদেশে অপরাধ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু সব ক্ষেত্রে আইন নিজস্ব গতিতে চলে না বলেই দেশজুড়ে অপরাধীদের আস্ফালন ও দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে।
সম্প্রতি মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে আততায়ীদের হাতে খুন হন ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। ঘটনার পর থেকেই এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা বাহাসে লিপ্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ‘হাত’ আছে। বিএনপি বলছে, আসল অপরাধীদের আড়াল করতেই সরকার বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা যদি অপরাধের ‘হাত’ না খুঁজে পুরো শরীরটি খুঁজত, তাহলে রহস্য উদ্ঘাটন সহজ হতো বলে আমরা মনে করি।
সিজার তাবেলা হত্যার প্রায় এক মাসের মাথায় ঢাকার পুলিশ কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করে সন্দেহভাজন ঘাতক হিসেবে যাঁদের চিহ্নিত করলেন, তাঁরা কেউ মাদক ব্যবসায়ী, কেউ অস্ত্রের জোগানদাতা, কেউ পাড়ার বখাটে। এঁদের মধ্যে তামজিদ আহমেদ রুবেল নামের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে তাঁর পরিবার বলছে, নির্যাতনের মুখে এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। অপর তিন আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ২৬ অক্টোবর আসামিদের আদালতে হাজির করা হলেও অনেক আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তাহলে এত দিন আসামিরা কোথায় ছিলেন? আইন অনুযায়ী কাউকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটি মেনে চলেছে কি? পুলিশের দাবি, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি তারা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করেছে। এর আগে সিসিটিভির ফুটেজে দুই আরোহীসহ একটি মোটরসাইকেল ও টেলিফোনে আলাপরত এক যুবককে দেখা গিয়েছিল। সিসি টিভিতে ধরা পড়া যুবকদেরই কি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, না অন্য কাউকে?
পুলিশের হাতে আটক চারজনের চেয়ে আলোচনায় এসেছে তাঁদের কথিত বড় ভাই, যাঁর বা যাঁদের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কমিশনার কোনো বড় ভাইয়ের নাম না বললেও পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়ে দিলেন, ‘বড় ভাই’ বিএনপির মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুম। তিনি বিদেশে পলাতক, কেউ বলছেন মালয়েশিয়ায়, কেউ বলছেন লন্ডনে। পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বললেন, কাইয়ুমকে তিনি ‘বড় ভাই’ বলেননি। কাইয়ুম সন্দেহের তালিকায় আছেন। তাহলে কি সরকার ‘বড় ভাই’ সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না, না বড় ভাইয়ের ওপরের কোনো বড় ভাইকে তারা খুঁজছে?
পুরো বিষয়টির মধ্যে একটি রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দুই বিদেশি নাগরিক খুন হলেন বাংলাদেশে। সন্দেহভাজন খুনিরাও এখানে ধরা পড়লেন। কিন্তু তাঁদের মদদদাতারা কেউ মালয়েশিয়ায়, কেউ লন্ডনে। আবার টাকাও আসছে নাকি লন্ডন থেকে। কে কীভাবে টাকা পাঠাল, সেটিও খুঁজে বের করা দরকার। আগে খুনিদের খুঁজে বের করতে পারলে তাঁদের সঙ্গে থাকা বড় ভাইকে পাওয়া কঠিন হবে না। কিন্তু আগে বড় ভাইকে খুঁজে পরে খুনিদের বের করা দুরূহ হবে।
আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ এখন পর্যন্ত দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লুক সরকার হত্যাচেষ্টা ও তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় গ্রেনেড হামলা—এই চার ঘটনার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডগুলো যে একই গোষ্ঠী ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নয়। অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে। হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ও কুশীলব ভিন্ন হলে যোগসূত্র পাওয়া যাবে না। বিএনপি-জামায়াত আমলে কিংবা তার আগে আওয়ামী লীগ আমলে যতগুলো বোমা-গ্রেনেড হামলা হয়েছে, সেসবের লক্ষ্যবস্তু ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সংস্কৃতিসেবী, সংগীতশিল্পী, বাংলা নববর্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা তাদের উপাসনালয়। আর কুশীলব ছিল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ বা হুজির নেতা-কর্মী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় পদে ছিলেন এবং বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত, এমন একজন ব্যক্তি আলাপ প্রসঙ্গে বলেছেন, স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্ত করতে হয় অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে। রাজনৈতিক বাগ্বিতণ্ডা তদন্তকে সহায়তা করে না; বরং বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জঙ্গিগোষ্ঠীর ব্যাপারে সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিকতায় ঘাটতি না থাকলেও সামর্থ্যে ঘাটতি আছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি মিরপুরে তল্লাশির সময় দুর্বৃত্তদের হাতে এএসআই ইব্রাহিম মোল্লার নিহত হওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের টহল কখনোই এককভাবে দেওয়া উচিত নয়। যিনি তল্লাশি করবেন, তাঁর সঙ্গী কর্মকর্তাকে অবশ্যই সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। মিরপুরের ঘটনায় সেটি থাকলে এভাবে ছুরিকাঘাতে এএসআইকে মরতে হতো না।
তাঁর মতে, হোসেনি দালানের ঘটনায়ও পুলিশের কর্তব্য ছিল বিষয়টি রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। ঘটনাস্থলে যথেষ্টসংখ্যক পুলিশ সদস্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তল্লাশি করে সবাইকে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। স্বাভাবিক অবস্থায় সেটি ঠিক থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়। কয়েক শ লোককে তল্লাশি করে ভেতরে ঢোকানো কঠিন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যুক্তি দেখাতে পারেন যে সেখানে যেহেতু অতীতে অঘটন ঘটেনি, তাই তাঁদের মাথায় সেটি ছিল না। এখানেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদারির বিষয়টি সামনে চলে আসে। কোথাও সন্ত্রাসী ঘটনা না ঘটলে সেটি নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে থাকতে পারে না। সন্ত্রাসীরা তাদের দুষ্কর্ম সম্পাদন করতে একই জায়গা বা একই পদ্ধতি ব্যবহার করে না। তাই পেশাদারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেবল রুটিন কাজ করলে হবে না। তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে সৃজনশীলতার সঙ্গে।
তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখার পরও অনেক সময় অঘটন এড়ানো যায় না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও মারাত্মক অঘটন ঘটে থাকে। কিন্তু সেখানে এসব নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে কেউ জজ মিয়া কাহিনি ফাঁদেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেশাদারি মনোভাব নিয়ে ঘটনার তদন্ত করতে পারবে, সেই অভয় দেওয়া হয় সব পক্ষ থেকেই।
মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যেন আমরা অপরাধীকে আড়াল না করি। রাজনৈতিক বাহাসে যেন সত্য খুন না হয়ে যায়। সন্ত্রাসীদের হাতে মানুষ খুন হলে তার বিচার পাওয়া যায়। অপরাধীকে ধরে কঠিন শাস্তি দেওয়া যায়। অপরাধের শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও বিধান আছে। কিন্তু সত্য খুন হলে তার প্রতিকার পাওয়া যায় না। ঘাতক চিহ্নিত না হলে, বা তার শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়; যা একটি আধুনিক রাষ্ট্রে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.