তারা কেন দেশান্তরি হয়? by হাসান ফেরদৌস
এল পাসোর বন্দিশিবিরে এক দল বাংলাদেশি যুবক। তাঁরা অনশনের পর গত সপ্তাহে মুক্তি পান |
নিজের
পরিচিত আবাস, স্বজন, নিকট বন্ধুবান্ধব—সব ছেড়ে মানুষ কেন অজানার উদ্দেশে
দেশ ছাড়ে? কোন কুহকী আশার নেশা তাকে অজ্ঞাতবাসে নিয়ে যায়?
দেশান্তরি নামের একটি তথ্যচিত্রে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন মৃদুল চৌধুরী। সেটা ২০০৭ সালের কথা, তখন তিনি হার্ভার্ডের ছাত্র। আনিসুল হকের উপন্যাস দুঃস্বপ্নের যাত্রী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সেই তথ্যচিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। গল্পের কেন্দ্রে ছিল একদল বাংলাদেশি যুবক, যারা সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে স্পেনে পৌঁছানোর এক অভাবিত যুদ্ধে নেমেছিল। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা জিপে চেপে তারা ঠিকই সাহারা জয় করে। তারপর আসে ভূমধ্যসাগর। সামান্য এক রাবারের ডিঙি নৌকায় চেপে উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। কিছুদূর যাওয়ার পর সেই নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। খাবার নেই, এক ফোঁটা পানি নেই, উদ্ধারের আশা নেই। চোখের সামনে তাদের দেখতে হয় একের পর এক অভুক্ত-অসুস্থ বন্ধুর মৃত্যু। সেই মৃত বন্ধুদের কাঁচা মাংস, কখনো কখনো নিজেদের প্রস্রাব খেয়ে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল তারা। দশ দিন পর আলজেরীয় এক নৌযান তাদের দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪২ জন বন্ধু নিয়ে, তা শেষ হয় ১৭ জনের মৃত্যু দিয়ে। যে ২৫ জন বেঁচে থাকে, তাদের কারোরই স্পেন যাওয়া হয় না, ফিরে আসতে হয় দেশে।
একদল প্রবাসীর সঙ্গে আমি সেই ছবি দেখেছিলাম নিউইয়র্কে। তখনই এই প্রশ্ন উঠেছিল, ঠিক কতটা বেপরোয়া হলে এমন নিশ্চিত মৃত্যুর পথ পাড়ি দিতে নামে কেউ? সহজ উত্তর মেলেনি, তবে এ ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম, খুব সানন্দে, শুধু অ্যাডভেঞ্চারের আশায় কেউ এমন দুর্লঙ্ঘ্য যাত্রায় নামে না। একই কথা বলা যায় হাজার হাজার সিরীয় উদ্বাস্তুকে নিয়ে, যারা মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে চেষ্টা করছে। অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ফলে তাদের নিজ বাসভূমি এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত, জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসী লড়াইেয় তারা নামে, কারণ অন্য কোনো বিকল্প তাদের জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মানুষ কেন পালাবে? তারা কি এতটা অসহায়, এতটা আশাহীন?
এই প্রশ্নটি নতুন করে জাগল টেক্সাসের এল পাসোতে ৮২ জন আটক বাংলাদেশির কথা জানতে পেরে। দেশান্তরির যুবকদের অভিজ্ঞতার তুলনায় এদের অভিজ্ঞতা যে খুব ভিন্ন তা নয়, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত হলো সমুদ্রে তাদের না খেয়ে মরতে হয়নি। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তারা ঠিকই আমেরিকায়, তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছিল। সে প্রায় ছয় মাসে আগের কথা। মেক্সিকো ও আমেরিকার সীমান্তপথে অবৈধ উপায়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা আটক হয় মার্কিন সীমান্ত পুলিশের হাতে। মাত্র কয়েক দিন আগে তারা শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া পেয়েছে, কিন্তু আমেরিকায় যে তারা আশ্রয় পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই ৮২ জনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকায়। একদল মানব পাচারকারীর মাধ্যমে তারা প্রথম পৌঁছায় ব্রাজিল। সেখান থেকে পেরু ও ইকুয়েডর ঘুরে হাজির হয় মেক্সিকোয়। আসতে না আসতেই মেক্সিকো পুলিশ তাদের আটক করে। এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সবই পূর্বপরিকল্পিত, এমনকি আটকের ব্যাপারটি পর্যন্ত। দিন সাতেক জেল খাটার পর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয় এই শর্তে যে এক সপ্তাহের ভেতর তাদের দেশ ছাড়তে হবে। এবার আরেক দল মানব পাচারকারী তাদের বাসে, ট্রেনে, হাঁটা পথে নিয়ে আসে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে। ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা সীমান্ত পার হয়ে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসোতে। আসতে না আসতেই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
অনুমান করি, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন এখন ধনী-দরিদ্র সবার চোখে। তারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। যারা সবচেয়ে সচ্ছল, তারা একই সঙ্গে বিদেশে টাকা আর নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাচার করে। যারা দরিদ্র, ঘটিবাটি বেচে তারা ছোটে মধ্যপ্রাচ্যে এদের কথা হয়তো আমরা কখনোই জানতাম না। এমন অসংখ্য অবৈধ অভিবাসী এই এল পাসোর জেলখানায় দীর্ঘদিন থেকে পচে মরছে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর উপায়ান্তর না দেখে এসব বাংলাদেশি আমরণ অনশনের পথ বেছে নেয়। ব্যাপারটায় পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভড়কে গেলে তারা যোগাযোগ করে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে। কনস্যুলার বিষয়ে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল আলম চৌধুরী ছুটে যান এল পাসোতে। তাঁরই মধ্যস্থতায় বাংলাদেশি যুবকেরা অনশন ভাঙতে রাজি হয়, তবে তার আগে কর্তৃপক্ষকে কথা দিতে হবে তাদের এখান থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে তারা আমেরিকা ছেড়ে যাবে, এই শর্তে অবশেষে তাদের মুক্তি দিতে সম্মত হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষ। আপাতত তারা মুক্ত, যে সামান্য সময় হাতে আছে, তার মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ের চেষ্টা করবে। তাতে ব্যর্থ হলে তাদের ফিরতে হবে বাংলাদেশে।
আটক বাংলাদেশিদের নিয়ে শামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলো। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, মাথাপিছু ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার দিয়ে এসব যুবক দেশ ছেড়েছে এই বিশ্বাসে যে আমেরিকায় পৌঁছানোমাত্রই স্বর্গের দরজা তাদের জন্য খুলে যাবে। এদের অধিকাংশই খুব সামান্য ইংরেজি জানে, বিশেষ কোনো কারিগরি দক্ষতাও নেই। অধিকাংশেরই কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, যেখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় মিলবে।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোথাও আশ্রয় মিলবে—এই আশায় ডিঙি নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। টহলদার নৌসেনাদের সহায়তায় তাদের অনেককে তীরে টেনে তোলা হয়েছে, অন্যরা সাগরেই তলিয়ে গেছে। এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও কেউ কেউ পালানোর চেষ্টা করেছে। রোহিঙ্গারা নিজের দেশে পরদেশি, তাদের ন্যূনতম মানবাধিকারটুকুও বর্মি সরকার মানতে রাজি নয়। তারা পালাবে, আমরা তা বুঝি, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পালাবে কেন?
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে এক গবেষণা পরিচালনা করে। প্রধানত কক্সবাজার ও টেকনাফে পরিচালিত এই গবেষণায় দুটো জিনিস বেরিয়ে এসেছে। এক, বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও দেশটির সব মানুষ সেই উন্নয়ন থেকে সমানভাবে লাভবান হয়নি। অন্যদিকে, বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে উপকূলবর্তী মানুষ ক্রমেই তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। দেশ ছেড়ে যারা পালাচ্ছে, তাদের অনেকেই এই শ্রেণিভুক্ত মানুষ। এল পাসোতে যারা আটকে ছিল, তাদের অধিকাংশ ঠিক এই সব ছিন্নমূল মানুষ নয়। অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা গুনে গুনে দালালের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা কেন দেশ ছাড়বে?
এক কারণ, অনুমান করি, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন এখন ধনী-দরিদ্র সবার চোখে। তারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। যারা সবচেয়ে সচ্ছল, তারা একই সঙ্গে বিদেশে টাকা আর নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাচার করে। যারা দরিদ্র, ঘটিবাটি বেচে তারা ছোটে মধ্যপ্রাচ্যে। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ এখন দেশের বাইরে। এদের অধিকাংশই বৈধ পথে বিদেশে এসেছে। যারা বৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তারা বেছে নেয় অবৈধ পথ। তাদের এ কাজে মদদ দিতে সদা প্রস্তুত একদল অসাধু মানব পাচারকারী।
চাইলেই বিদেশে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো যাবে না। কিন্তু নিদেনপক্ষে যে কাজটা আমরা করতে পারি, তা হলো অসাধু মানব পাচারকারীদের কার্যকলাপ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সরকার নানা আইনকানুন করেছে, কিন্তু সরষের ভেতরেই যে ভূত ঘাপটি মেরে থাকে, সে কথাও আমাদের জানা। এ বছর যে কয়েক হাজার হজযাত্রী যথারীতি টাকাপয়সা জমা দিয়েও হজে যেতে পারেননি, তা ওই সব সরষের ভেতরের ভূতের জন্য। এই ভূত খেদানোর কাজটা একা সরকারকে দিয়ে হবে না, দেশের মানুষকেও পথে নামতে হবে, তাদের প্রতিবাদের আওয়াজটা উঁচু করতে হবে।
অন্য যা দরকার, তা হলো অভিবাসনের সঠিক চিত্রটি তুলে ধরা। যারা অবৈধ পথে বিদেশে যেতে চায়, তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া, যে কঠিন পথে তারা নামার কথা ভাবছে, কী অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে! এই কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে দেশের তথ্যমাধ্যম। এখন দেশে রেডিও-টিভির অভাব নেই। তারা যদি চোখে আঙুল দিয়ে সত্যটা তুলে ধরে, তাতে কেউ কেউ হয়তো ডিঙি নৌকায় ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। এতে যদি একটি জীবনও বাঁচে, তাহলে বলতে পারবে একটি জীবন বাঁচানো গেছে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
দেশান্তরি নামের একটি তথ্যচিত্রে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন মৃদুল চৌধুরী। সেটা ২০০৭ সালের কথা, তখন তিনি হার্ভার্ডের ছাত্র। আনিসুল হকের উপন্যাস দুঃস্বপ্নের যাত্রী পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সেই তথ্যচিত্র নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। গল্পের কেন্দ্রে ছিল একদল বাংলাদেশি যুবক, যারা সাহারা মরুভূমি পেরিয়ে স্পেনে পৌঁছানোর এক অভাবিত যুদ্ধে নেমেছিল। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা জিপে চেপে তারা ঠিকই সাহারা জয় করে। তারপর আসে ভূমধ্যসাগর। সামান্য এক রাবারের ডিঙি নৌকায় চেপে উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। কিছুদূর যাওয়ার পর সেই নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। খাবার নেই, এক ফোঁটা পানি নেই, উদ্ধারের আশা নেই। চোখের সামনে তাদের দেখতে হয় একের পর এক অভুক্ত-অসুস্থ বন্ধুর মৃত্যু। সেই মৃত বন্ধুদের কাঁচা মাংস, কখনো কখনো নিজেদের প্রস্রাব খেয়ে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল তারা। দশ দিন পর আলজেরীয় এক নৌযান তাদের দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪২ জন বন্ধু নিয়ে, তা শেষ হয় ১৭ জনের মৃত্যু দিয়ে। যে ২৫ জন বেঁচে থাকে, তাদের কারোরই স্পেন যাওয়া হয় না, ফিরে আসতে হয় দেশে।
একদল প্রবাসীর সঙ্গে আমি সেই ছবি দেখেছিলাম নিউইয়র্কে। তখনই এই প্রশ্ন উঠেছিল, ঠিক কতটা বেপরোয়া হলে এমন নিশ্চিত মৃত্যুর পথ পাড়ি দিতে নামে কেউ? সহজ উত্তর মেলেনি, তবে এ ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম, খুব সানন্দে, শুধু অ্যাডভেঞ্চারের আশায় কেউ এমন দুর্লঙ্ঘ্য যাত্রায় নামে না। একই কথা বলা যায় হাজার হাজার সিরীয় উদ্বাস্তুকে নিয়ে, যারা মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে চেষ্টা করছে। অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ফলে তাদের নিজ বাসভূমি এখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত, জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসী লড়াইেয় তারা নামে, কারণ অন্য কোনো বিকল্প তাদের জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মানুষ কেন পালাবে? তারা কি এতটা অসহায়, এতটা আশাহীন?
এই প্রশ্নটি নতুন করে জাগল টেক্সাসের এল পাসোতে ৮২ জন আটক বাংলাদেশির কথা জানতে পেরে। দেশান্তরির যুবকদের অভিজ্ঞতার তুলনায় এদের অভিজ্ঞতা যে খুব ভিন্ন তা নয়, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তফাত হলো সমুদ্রে তাদের না খেয়ে মরতে হয়নি। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তারা ঠিকই আমেরিকায়, তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছিল। সে প্রায় ছয় মাসে আগের কথা। মেক্সিকো ও আমেরিকার সীমান্তপথে অবৈধ উপায়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা আটক হয় মার্কিন সীমান্ত পুলিশের হাতে। মাত্র কয়েক দিন আগে তারা শর্ত সাপেক্ষে ছাড়া পেয়েছে, কিন্তু আমেরিকায় যে তারা আশ্রয় পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই ৮২ জনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকায়। একদল মানব পাচারকারীর মাধ্যমে তারা প্রথম পৌঁছায় ব্রাজিল। সেখান থেকে পেরু ও ইকুয়েডর ঘুরে হাজির হয় মেক্সিকোয়। আসতে না আসতেই মেক্সিকো পুলিশ তাদের আটক করে। এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সবই পূর্বপরিকল্পিত, এমনকি আটকের ব্যাপারটি পর্যন্ত। দিন সাতেক জেল খাটার পর তাদের সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয় এই শর্তে যে এক সপ্তাহের ভেতর তাদের দেশ ছাড়তে হবে। এবার আরেক দল মানব পাচারকারী তাদের বাসে, ট্রেনে, হাঁটা পথে নিয়ে আসে মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে। ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে রাতের অন্ধকারে তারা সীমান্ত পার হয়ে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের এল পাসোতে। আসতে না আসতেই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
অনুমান করি, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন এখন ধনী-দরিদ্র সবার চোখে। তারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। যারা সবচেয়ে সচ্ছল, তারা একই সঙ্গে বিদেশে টাকা আর নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাচার করে। যারা দরিদ্র, ঘটিবাটি বেচে তারা ছোটে মধ্যপ্রাচ্যে এদের কথা হয়তো আমরা কখনোই জানতাম না। এমন অসংখ্য অবৈধ অভিবাসী এই এল পাসোর জেলখানায় দীর্ঘদিন থেকে পচে মরছে। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর উপায়ান্তর না দেখে এসব বাংলাদেশি আমরণ অনশনের পথ বেছে নেয়। ব্যাপারটায় পুলিশ কর্তৃপক্ষ ভড়কে গেলে তারা যোগাযোগ করে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে। কনস্যুলার বিষয়ে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামসুল আলম চৌধুরী ছুটে যান এল পাসোতে। তাঁরই মধ্যস্থতায় বাংলাদেশি যুবকেরা অনশন ভাঙতে রাজি হয়, তবে তার আগে কর্তৃপক্ষকে কথা দিতে হবে তাদের এখান থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে তারা আমেরিকা ছেড়ে যাবে, এই শর্তে অবশেষে তাদের মুক্তি দিতে সম্মত হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষ। আপাতত তারা মুক্ত, যে সামান্য সময় হাতে আছে, তার মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ের চেষ্টা করবে। তাতে ব্যর্থ হলে তাদের ফিরতে হবে বাংলাদেশে।
আটক বাংলাদেশিদের নিয়ে শামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলো। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, মাথাপিছু ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার দিয়ে এসব যুবক দেশ ছেড়েছে এই বিশ্বাসে যে আমেরিকায় পৌঁছানোমাত্রই স্বর্গের দরজা তাদের জন্য খুলে যাবে। এদের অধিকাংশই খুব সামান্য ইংরেজি জানে, বিশেষ কোনো কারিগরি দক্ষতাও নেই। অধিকাংশেরই কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, যেখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় মিলবে।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোথাও আশ্রয় মিলবে—এই আশায় ডিঙি নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। টহলদার নৌসেনাদের সহায়তায় তাদের অনেককে তীরে টেনে তোলা হয়েছে, অন্যরা সাগরেই তলিয়ে গেছে। এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকেও কেউ কেউ পালানোর চেষ্টা করেছে। রোহিঙ্গারা নিজের দেশে পরদেশি, তাদের ন্যূনতম মানবাধিকারটুকুও বর্মি সরকার মানতে রাজি নয়। তারা পালাবে, আমরা তা বুঝি, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পালাবে কেন?
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্ট এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার লক্ষ্যে এক গবেষণা পরিচালনা করে। প্রধানত কক্সবাজার ও টেকনাফে পরিচালিত এই গবেষণায় দুটো জিনিস বেরিয়ে এসেছে। এক, বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সত্ত্বেও দেশটির সব মানুষ সেই উন্নয়ন থেকে সমানভাবে লাভবান হয়নি। অন্যদিকে, বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে উপকূলবর্তী মানুষ ক্রমেই তাদের ভিটেমাটি হারিয়ে দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। দেশ ছেড়ে যারা পালাচ্ছে, তাদের অনেকেই এই শ্রেণিভুক্ত মানুষ। এল পাসোতে যারা আটকে ছিল, তাদের অধিকাংশ ঠিক এই সব ছিন্নমূল মানুষ নয়। অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল, ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা গুনে গুনে দালালের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা কেন দেশ ছাড়বে?
এক কারণ, অনুমান করি, বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন এখন ধনী-দরিদ্র সবার চোখে। তারা দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। যারা সবচেয়ে সচ্ছল, তারা একই সঙ্গে বিদেশে টাকা আর নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাচার করে। যারা দরিদ্র, ঘটিবাটি বেচে তারা ছোটে মধ্যপ্রাচ্যে। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ এখন দেশের বাইরে। এদের অধিকাংশই বৈধ পথে বিদেশে এসেছে। যারা বৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তারা বেছে নেয় অবৈধ পথ। তাদের এ কাজে মদদ দিতে সদা প্রস্তুত একদল অসাধু মানব পাচারকারী।
চাইলেই বিদেশে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানো যাবে না। কিন্তু নিদেনপক্ষে যে কাজটা আমরা করতে পারি, তা হলো অসাধু মানব পাচারকারীদের কার্যকলাপ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সরকার নানা আইনকানুন করেছে, কিন্তু সরষের ভেতরেই যে ভূত ঘাপটি মেরে থাকে, সে কথাও আমাদের জানা। এ বছর যে কয়েক হাজার হজযাত্রী যথারীতি টাকাপয়সা জমা দিয়েও হজে যেতে পারেননি, তা ওই সব সরষের ভেতরের ভূতের জন্য। এই ভূত খেদানোর কাজটা একা সরকারকে দিয়ে হবে না, দেশের মানুষকেও পথে নামতে হবে, তাদের প্রতিবাদের আওয়াজটা উঁচু করতে হবে।
অন্য যা দরকার, তা হলো অভিবাসনের সঠিক চিত্রটি তুলে ধরা। যারা অবৈধ পথে বিদেশে যেতে চায়, তাদের খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া, যে কঠিন পথে তারা নামার কথা ভাবছে, কী অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে! এই কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারে দেশের তথ্যমাধ্যম। এখন দেশে রেডিও-টিভির অভাব নেই। তারা যদি চোখে আঙুল দিয়ে সত্যটা তুলে ধরে, তাতে কেউ কেউ হয়তো ডিঙি নৌকায় ভারত মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। এতে যদি একটি জীবনও বাঁচে, তাহলে বলতে পারবে একটি জীবন বাঁচানো গেছে।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments