শিক্ষকের ভগ্ন কাঁধ এবং এসডিজির গুরুভার by গোলাম ফারুক

এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় দুটি: শিক্ষক ও এসডিজি। প্রথমেই শিক্ষক প্রসঙ্গটি নাট্যকার বার্নার্ড শয়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি তাঁর ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান নাটকে লিখেছিলেন, ‘যিনি পারেন তিনি করেন, আর যিনি পারেন না তিনি শেখান।’ ছাত্রাবস্থায় এই বাক্যটি যখন পড়েছিলাম, মনে হয়েছিল এটা শয়ের স্বভাবসুলভ রসিকতামাত্র। অনেক দিন পর আমি নিজে যখন শিক্ষক, ছোট্ট একটা ঘটনায় টের পেলাম, এটা নিতান্ত ঠাট্টা নয়। ঘটনাটা এ রকম: কাপড় কিনতে গেছি। দর-কষাকষি করতে যাওয়ায় দোকানি বিরক্ত হয়ে বললেন, আগের দিন এক বিশেষ কর্মকর্তা হাসিমুখে অনেক বেশি দাম দিয়ে একই কাপড় কিনে নিয়ে গেছেন। আমি বলতে চাইলাম, ওনার তো...। দোকানদার কী বুঝলেন জানি না, আমাকে থামিয়ে মুখ বাঁকিয়ে শব্দগুলোকে অবজ্ঞার সঙ্গে চিবিয়ে ফেলে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ওরা পারে, পায়; আপনারা পারেন না, তাই মাস্টারি করেন।’
পরে লক্ষ করলাম, ওই দোকানির মতো যাঁরা ‘বুদ্ধিমান’, তাঁরা এমনটাই ভাবেন। তাঁদের ধারণা, শিক্ষকেরা শিক্ষকতা করেন বাধ্য হয়ে—ক্ষমতা ও অর্থের বিচারে এর চেয়ে ভালো চাকরি পাননি বলে। নিজে শিক্ষক বলে কিনা জানি না, এটা মানতে আমার কষ্ট হয় এবং আমার ধারণা, যেকোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে এটা মানা কঠিন। যা হোক, অপমান করলেও তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই ওই দিন ওই দোকানি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের ‘বুদ্ধিমান’ মানুষদের কাছে শিক্ষকদের মান-মর্যাদা কেমন।
এবার আসা যাক এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) প্রসঙ্গে। এই গেল সেপ্টেম্বরে আমরা এসডিজি পূরণ করব বলে স্বাক্ষর করেছি। অর্থাৎ আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, এমডিজির ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ আগামী ১৫ বছরে অর্জন করার জন্য এসডিজির যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, আমরা তা পূরণে সচেষ্ট থাকব। এই ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে চার নম্বরটিতে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। শিক্ষা-সম্পর্কিত এই লক্ষ্যে পৌঁছানো দুষ্কর হলেও এত চমৎকার যে তা যদি অর্জন করা যায়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যেই অন্য কিছুতে না হোক, অন্তত শিক্ষায় আমরা উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে যাব। অনেকের কাছে বিষয়টা উচ্চাভিলাষী কিংবা অলীক মনে হতে পারে, কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এটা উচ্চাভিলাষী বটে, তবে অলীক নয়। পরিকল্পনা মাফিক এগোলে বাংলাদেশ অবশ্যই এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, যদি না পারে, এই প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে সে এমন পিছিয়ে পড়বে যে ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত স্বপ্নই থেকে যাবে।
খুব সংক্ষেপে এসডিজির শিক্ষা-সম্পর্কিত লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এখন দেখা যাক মানসম্পন্ন শিক্ষা বলতে আসলে কী বোঝায়। ইউনেসকো তাদের একটি রিপোর্টে মানসম্পন্ন শিক্ষার সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে: মানসম্পন্ন শিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তার উন্নয়ন; তাদের ব্যক্তিত্ব, মেধা, মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন; ওরা জ্ঞান লাভ করবে, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হবে, দক্ষতা অর্জন করবে, সৃজনশীল হবে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্রতী হবে, সর্বোপরি বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠবে। উপরন্তু, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যেন শেষ কথা না হয়, এ কারণে ছাত্রদের এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যেন তাদের ভেতর জীবনব্যাপী নিরন্তর শেখার একটা আগ্রহ তৈরি হয়।
এই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ইউনেসকো কিছু পূর্বশর্ত পূরণের কথা বলেছে। ইউনেসকোর মতে, মানসম্পন্ন শিক্ষা মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: ১. শিক্ষক, ২. শিক্ষাক্রম এবং ৩. শিক্ষার পরিবেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা বা তার একিলিসের গোড়ালি হচ্ছে প্রথমটি: ‘শিক্ষক’। তাই অন্য দুটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করার পর এ বিষয়ে ফিরে আসব।
স্বাভাবিক নিয়মে যেকোনো শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী হতে হয়। তবে ইউনেসকো সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে যে তাকে হতে হবে বাস্তবসম্মত ও বোধগম্য, যা শিক্ষার্থীকে সাম্য, মৈত্রী, সহনশীলতা, মানবাধিকার, লিঙ্গসমতা, সবুজ অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় করে তুলবে। আমাদের পাঠ্যবইগুলোয় হয়তো সবকিছু খুব নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয়নি, তবে চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১০–এর ভিত্তিতে ২০১২ সালে যে শিক্ষাক্রম সংস্কার হয়, তার সঙ্গে ইউনেসকো প্রস্তাবের যথেষ্ট মিল আছে। শুধু তা-ই নয়, এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে রচিত হয়েছে শতাধিক নতুন পাঠ্যবই। বোঝাই যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য প্রায় সুনিশ্চিত।
মানসম্পন্ন শিক্ষার আরেকটি শর্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। ইউনেসকো বলছে, লেখাপড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের যেকোনো একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিলেই হবে না, কক্ষটিকে হতে হবে সত্যিকারের শ্রেণিকক্ষ। বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কক্ষকে শ্রেণিকক্ষে রূপান্তরের গতি প্রশংসার যোগ্য। যেমন ২০১১ সালে যেখানে বাংলাদেশের কোনো মাধ্যমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ছিল না, সেখানে ২০১৫ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ স্কুল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করতে পারবে এবং একই সংখ্যক স্কুল বিদ্যুতের সংযোগ পাবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ স্কুলে থাকবে সৌরবিদ্যুৎ, ৮৫ দশমিক ০৫ শতাংশ স্কুল পাবে কম্পিউটার ব্যবহার করার সুবিধা, ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ স্কুল ইন্টারনেট-সংযোগ পাবে, ৯১ শতাংশ স্কুলে থাকবে নিরাপদ পানীয় জল এবং ৯৯ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা হবে। যদিও শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এখনো একটু বেশি, তবু শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে সরকার যে সচেষ্ট, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় এবং এই গতিতে চললে ২০৩০ সালের মধ্যে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে, যা এসডিজির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই সব জায়গায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অনেক এগিয়ে আছে। যেমন প্রায় সব স্কুলে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, প্রায় সব ছেলেমেয়েকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করা (৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ) এবং ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায় সমতা আনা। যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে এখন ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে তা আরও বেশি—৫৩ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ ছাত্রের চেয়ে এখন ছাত্রীসংখ্যা বেশি।
তার মানে, এসডিজির যাত্রারম্ভে উপর্যুক্ত বিষয়াদিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি বেশ ভালো। তবে শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, এসব প্রস্তুতি শেষ পর্যন্ত সুকুমার রায়ের ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাইয়ের’ জীবনের মতো ‘ষোলোআনাই মিছে’ হয়ে যাবে, যদি ‘শিক্ষক’ মানসম্পন্ন না হন। একটি জাতি যত চেষ্টাই করুক, সে তার শিক্ষাব্যবস্থার মান কখনোই শিক্ষকের মানের চেয়ে উন্নত করতে পারে না। ২০১৪ সালে আইএলও, ইউনেসকো, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ ও ‘এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল’-এর কর্তাব্যক্তিরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘একটি দেশের শিক্ষকেরা যেমন, তার শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক তেমনই। সবার জন্য বিশ্বজনীন ও মানসম্পন্ন শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান; নতুন নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও সুযোগকে মোকাবিলা বা সদ্ব্যবহার করার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন ও মানসিকতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁরাই মূল ভূমিকা পালন করতে পারেন...।’ এই উদ্ধৃতির যে জায়গায় বলা হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার মান কার্যত সমান, সেখান থেকে আরেকটা অনুসিদ্ধান্ত টানা যায়: আর কিছু থাক বা না থাক, কেবল ভালো শিক্ষক থাকলেই মোটামুটি মানসম্পন্ন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্কটা তো বোঝা গেল। অর্থনীতিবিদেরা যেহেতু বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আবার অর্থনীতির গাঁটছড়া বাঁধা, তাই সাধারণ বুদ্ধিতে অর্থনীতিতে শিক্ষকের মান-মর্যাদার ভূমিকা কী হতে পারে, তা আন্দাজ করা যায়। কিছু কিছু দেশে তার সাক্ষাৎ প্রমাণও মেলে। যেমন চীন। চীনের অর্থনীতি সবাই জানি, কিন্তু চীনা শিক্ষকদের বেতন ও মান-মর্যাদা অনেকের কাছেই অজানা।
২০১৩ সালে প্রকাশিত এক গ্লোবাল ইনডেক্সে দেখা যায়, পৃথিবীতে চীনা শিক্ষকদের মর্যাদাই সবচেয়ে বেশি। সেখানে চিকিৎসক আর শিক্ষকেরা সমান মর্যাদা ভোগ করেন; ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করেন, ছাত্ররা শিক্ষকদের সত্যিকার অর্থে সম্মান করে; ৫০ শতাংশ মানুষ চান যে তাঁর সন্তান শিক্ষক হোন এবং শিক্ষকদের গড় বেতন হচ্ছে ১৭ হাজার ৭৩০ ডলার। উল্লেখ্য, অনেক দেশ আছে, যেখানে শিক্ষকেরা এর চেয়েও অনেক বেশি বেতন পান, কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, এত মর্যাদা পান না। অর্থাৎ চীন জানে শুধু বেতন নয়, আরও অনেকভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা বাড়ানো যায়। আমার ধারণা, মহিরুহরূপে যে চীনকে আমরা এখন দেখি, তার বীজটা এখানেই প্রোথিত।
এসব কারণেই বাংলাদেশ যদি এসডিজি পূরণ করতে চায়, যেমন সফলভাবে সে এমডিজি পূরণ করেছে, তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষায়, অর্থাৎ শিক্ষকের ওপর। এমডিজির ক্ষেত্রে শিক্ষক এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না, কারণ সেখানে শিক্ষার প্রসার নিয়ে যতটা ভাবা হয়েছিল, মান নিয়ে ততটা নয়। মনে রাখতে হবে, এবারের লক্ষ্য হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষা, যার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক অপরিহার্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তা উপলব্ধি করা শুরু করেছে। যেমন শিক্ষক প্রশিক্ষণের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার ইতিমধ্যে প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
সচেতন নাগরিকেরা আশা করেন, সরকার আরও উদ্যোগ নেবে, বেসরকারি খাত এগিয়ে আসবে, জনগণ এই পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে, শিক্ষকেরা নিজেরাও আত্মোন্নয়নে ব্রতী হবেন; যাতে জগদ্বিখ্যাত বার্নার্ড শ কিংবা বিষয়বুদ্ধিতে পাকা সেই দোকানির ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। সবচেয়ে মেধাবী মানুষ যেন শিক্ষকতা পেশায় আসেন এবং এখনকার শিক্ষকেরা যেন আরও অনেক যোগ্য হয়ে ওঠেন। না হলে মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের যে গুরুভার ন্যুব্জদেহ শিক্ষকদের ভগ্ন কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে, তার ভারে তাঁরা হুমড়ি খেয়ে পড়বেন, সেই সঙ্গে আছড়ে পড়বে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ।
গোলাম ফারুক: ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।
faruk.golam@yahoo.com
তথ্যসূত্র:
১। Pocket Book on Bangladesh Education Statistics-2014 (2015)
২। The Right to Education and the Teaching Profession (2015)
৩। 2013 Global Teacher Status Index (2013)
৪। Making Education for all a Reality: Beyond 2015 (2013)

No comments

Powered by Blogger.