হিমালয়ের চ্যালেঞ্জ by দেব মুখার্জি
নেপাল–ভারত সীমান্তে আটকে পড়া খাদ্য ও জ্বালানিবাহী ট্রাক |
২০১৫
সালের ২০ সেপ্টেম্বর নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ যাদব নেপালের নতুন
সংবিধান ঘোষণা করেছেন। এর আগে ২০০৭ সালে দেশটির সংসদে অন্তর্বর্তীকালীন
সংবিধান পাস হয়েছিল, এই সংবিধান সেই সংবিধানকে প্রতিস্থাপিত করল। দেশটির
জনগণের সংবিধান প্রাপ্তির যে চেষ্টা ছিল, এর মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পেল।
১৯৪৮ সাল থেকে নেপালে ছয়টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রণয়ন করেছে রানারা বা রাজদরবার। রানাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন শেষ হওয়ার পর নেপালের রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজা মহেন্দ্র সেই বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন, তিনি সরকার ভেঙে দিয়ে ১৯৬২ সালে এক সংবিধান চাপিয়ে দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নিজের একক কর্তৃত্বে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ গঠন করেন। তারপর ১৯৯০ সালের সংবিধান পেতে নেপালি কংগ্রেসকে প্রায় ৩০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গণ–আন্দোলন করতে হয়েছে। সেই সংবিধান আসলে রাজদরবার ও রাজনৈতিক দলের আপসরফার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল। ওই সংবিধান নেপালকে পঞ্চায়েত-রাজের হাত থেকে মুক্তি দিলেও রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যে দ্বিতীয় গণ–আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে সংসদকে ফিরিয়ে আনা হয়, শাসনব্যবস্থার কাঠামো প্রণয়ন করতে তারা ২০০৭ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানটি আকর্ষণীয় ও প্রগতিশীল ছিল। এতে ওই সময়ের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছিল। একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল। শাসনব্যবস্থায় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল, যে জনগণ ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই শাসনব্যবস্থার বাইরে ছিল। ২০০৮ সালে যে সংবিধান সভা নির্বাচিত হয়, কথা ছিল, তারা দুই বছরের মধ্যে দেশটির জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করবে। তারা চার বছরের মধ্যেও তা করতে পারেনি। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার, আর রাজনৈতিক নেতারা ঐকমত্যও গড়ে তুলতে পারেননি। সম্ভবত মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যেমন নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট–লেনিনিস্ট) নির্বাচনে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মাওবাদীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। তাই তারা সামনে এগোতে ভয় পাচ্ছিল। আবার মাওবাদীরাও সময়-সময় যে ‘জনগণতন্ত্র’ গঠনের কথা বলেছে, সে ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারেনি। ইয়ুথ কমিউনিস্ট লিগের কার্যক্রমে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
মাঝখানে এক দফা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও ২০১৩ সালে একটি নতুন সংবিধান সভা ও সংসদ নির্বাচিত হয়। আর দেশটির সিংহভাগ মানুষই এখন মাওবাদী ও মদেশিদের ছেড়ে প্রথাগত দলগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এই প্রচেষ্টার ফল পাওয়া যায়। ১৯৫১ সালে যখন রাজা ত্রিভুবন ভারত থেকে ফিরে রানাদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল, ‘এখন থেকে সংবিধান সভা কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের আলোকে আমাদের দেশের জনগণ শাসিত হবে, জনগণই তাদের নির্বাচিত করবে।’ হ্যাঁ, শেষমেশ ছয় দশকেরও বেশি সময় পরে কষ্টকর সংগ্রামের পর তাঁর সেই কথা বাস্তবায়িত হলো।
এই সংবিধান করতে গিয়ে এর প্রণেতাদের অনেক প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিতে হয়েছে। তাঁদের শুধু এর নীতি ও লক্ষ্য নিয়েই মাথা ঘামাতে হয়নি, কম সুবিধাপ্রাপ্ত ও বৈষম্যের শিকার মানুষদের প্রবল ক্রোধও আমলে নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানে সেটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। নেপালে একই সঙ্গে একাধিক বিপ্লব হচ্ছে। রাজার ওপর দেবত্ব আরোপ করা হলেও শেষমেশ রাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি জাতিকে জাতিসত্তার নতুন সুলুক সন্ধান করতে হচ্ছে। রাজপ্রাসাদ থেকে যে দুই শতক ধরে সামন্তীয় ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে, সেটার অবসান ঘটেছে। জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এ ছাড়া নেপালের একটি পক্ষ দেশটিকে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারটা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেননি যে দেশটি মূলত ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের দেশ হলেও ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্রর সংবিধানের আগে দেশটি হিন্দু রাষ্ট্র ছিল না। নিশ্চিতভাবেই তাঁর লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক হাওয়ার মধ্যে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করা। না, সেটা শুধু জাতির প্রতীক ছিল না, ছিল বিশ্বাসের রক্ষাকবচ।
কিন্তু নেপালে আমলে নেওয়ার মতো বিষয় এখনো অনেক আছে। অনেকেই মনে করেন, রাজতন্ত্র উচ্ছেদের সঙ্গে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত। আবার এই সংবিধানের অনেক দিকই সাদরে গ্রহণ করার মতো। এই সংবিধান একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির, যার সদস্যরা প্রত্যক্ষ ও আনুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। আর ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
এমন একটি সংবিধানকে সবাই স্বাগত জানাবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। অনেক প্রশংসনীয় গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও এই সংবিধান দেশটির বড় একটি জনগোষ্ঠীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ করতে পারেনি। আবার ক্ষমতা প্রয়োগের বেলায় সংবিধান স্ট্যাটাসকো বা বিদ্যমান অবস্থা বজায় রেখেছে। ধারণা, কখনো কখনো বাস্তবতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বহু মানুষ মনে করছে, সুবিধাভোগী জাতিগোষ্ঠী যেমন বহুন ও ছত্রিরা নিজেদের আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে চাচ্ছে।
ওদিকে মদেশিরা তো আছেই। এরা হিন্দিভাষী; ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা এই মানুষদের নেপালের পাহাড়ি অভিজাতরা কখনোই নিজেদের সমকক্ষ মনে করেনি। ফলে নানা সময়েই তাদের নিপীড়ন করা হয়েছে, রাজধানীতে যেতে হলে তাদের একসময় গলায় পরিচয়পত্র ঝোলাতে হতো। তাদের মনে সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। মদেশিরা নেপালের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, দেশটির রাজস্ব আয়েরও বেশির ভাগই আসে তাদের কাছ থেকে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে ও সেনাবাহিনীর চাকরিতে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের অঞ্চলে বিনিয়োগও হয় কম। নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে, মদেশের ১২ থেকে ২০টি জেলা পাহাড়ি জেলাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যক্ষ নির্বাচনে সংসদীয় আসনের ভাগাভাগিতে মদেশিদের প্রতিনিধিত্ব ৮৩ থেকে ৬৩টিতে নেমে যাবে। ফলে বিপুলসংখ্যক মদেশি মানুষ ভোটাধিকার হারাবে। ২০০৮ সালে জি পি কৈরালার সরকার তাদের যে লিখিত নিশ্চয়তা দিয়েছিল, এটা স্পষ্টতই তার লঙ্ঘন। ফলে মদেশ ফুঁসে উঠেছে।
এদিকে ভারত চায় নেপালের সংবিধান নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব ও ভিন্নমত সৃষ্টি হয়েছে, তার যেন শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। তবে ভারতে একটি প্রশ্ন ওঠে, ভারত কেন অন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে? সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপালের বিষয়ে কয়েকবার বলেছেন, ভারত এক সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল নেপাল দেখতে চায়, যেখানে সব সম্প্রদায় সংবিধানকে নিজেদের মনে করবে। কিন্তু ভারত কেন এর ফলাফল নিয়ে এত উদ্বিগ্ন? সেটা নেপালের জনগণের ব্যাপার, ভারতের নয়। আবার ভারতের সঙ্গে নেপাল যেভাবে জড়িয়ে আছে, তাতে তার পক্ষে নেপালের ব্যাপারে নির্মোহ থাকাও সম্ভব নয়। উন্মুক্ত সীমান্ত ও চলাচল, ঘনিষ্ঠ পারিবারিক যোগাযোগ, পারস্পরিক রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা, নেপালিদের ভারতে কাজ করার লক্ষ্যে প্রণীত চুক্তি, গোর্খাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা প্রভৃতি কারণে ভারত হয়তো নেপালের ব্যাপারে চোখ বুজে থাকতে পারে না।
আবার নেপালেও ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙা হয়েছে। সেখানকার জনগণ ভারতীয় পতাকা পোড়াচ্ছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করছে। কিন্তু এসব করে কি লাভ হবে? ইতিহাস বলে, যোগাযোগের বিভিন্ন পথ খুলে দিলে ভুল-বোঝাবুঝি দূর হয়।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; ভারতের পাক্ষিক ফ্রন্টলাইন থেকে নেওয়া
দেব মুখার্জি: বাংলাদেশ ও নেপালে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
১৯৪৮ সাল থেকে নেপালে ছয়টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রণয়ন করেছে রানারা বা রাজদরবার। রানাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন শেষ হওয়ার পর নেপালের রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজা মহেন্দ্র সেই বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন, তিনি সরকার ভেঙে দিয়ে ১৯৬২ সালে এক সংবিধান চাপিয়ে দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নিজের একক কর্তৃত্বে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ গঠন করেন। তারপর ১৯৯০ সালের সংবিধান পেতে নেপালি কংগ্রেসকে প্রায় ৩০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গণ–আন্দোলন করতে হয়েছে। সেই সংবিধান আসলে রাজদরবার ও রাজনৈতিক দলের আপসরফার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল। ওই সংবিধান নেপালকে পঞ্চায়েত-রাজের হাত থেকে মুক্তি দিলেও রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চূড়ান্ত ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যে দ্বিতীয় গণ–আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে সংসদকে ফিরিয়ে আনা হয়, শাসনব্যবস্থার কাঠামো প্রণয়ন করতে তারা ২০০৭ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানটি আকর্ষণীয় ও প্রগতিশীল ছিল। এতে ওই সময়ের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছিল। একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল। শাসনব্যবস্থায় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল, যে জনগণ ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই শাসনব্যবস্থার বাইরে ছিল। ২০০৮ সালে যে সংবিধান সভা নির্বাচিত হয়, কথা ছিল, তারা দুই বছরের মধ্যে দেশটির জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান প্রণয়ন করবে। তারা চার বছরের মধ্যেও তা করতে পারেনি। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার, আর রাজনৈতিক নেতারা ঐকমত্যও গড়ে তুলতে পারেননি। সম্ভবত মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো, যেমন নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট–লেনিনিস্ট) নির্বাচনে জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মাওবাদীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। তাই তারা সামনে এগোতে ভয় পাচ্ছিল। আবার মাওবাদীরাও সময়-সময় যে ‘জনগণতন্ত্র’ গঠনের কথা বলেছে, সে ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারেনি। ইয়ুথ কমিউনিস্ট লিগের কার্যক্রমে শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে।
মাঝখানে এক দফা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলেও ২০১৩ সালে একটি নতুন সংবিধান সভা ও সংসদ নির্বাচিত হয়। আর দেশটির সিংহভাগ মানুষই এখন মাওবাদী ও মদেশিদের ছেড়ে প্রথাগত দলগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এই প্রচেষ্টার ফল পাওয়া যায়। ১৯৫১ সালে যখন রাজা ত্রিভুবন ভারত থেকে ফিরে রানাদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল, ‘এখন থেকে সংবিধান সভা কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের আলোকে আমাদের দেশের জনগণ শাসিত হবে, জনগণই তাদের নির্বাচিত করবে।’ হ্যাঁ, শেষমেশ ছয় দশকেরও বেশি সময় পরে কষ্টকর সংগ্রামের পর তাঁর সেই কথা বাস্তবায়িত হলো।
এই সংবিধান করতে গিয়ে এর প্রণেতাদের অনেক প্রত্যাশার চাপ মাথায় নিতে হয়েছে। তাঁদের শুধু এর নীতি ও লক্ষ্য নিয়েই মাথা ঘামাতে হয়নি, কম সুবিধাপ্রাপ্ত ও বৈষম্যের শিকার মানুষদের প্রবল ক্রোধও আমলে নিতে হয়েছে। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানে সেটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। নেপালে একই সঙ্গে একাধিক বিপ্লব হচ্ছে। রাজার ওপর দেবত্ব আরোপ করা হলেও শেষমেশ রাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ একটি জাতিকে জাতিসত্তার নতুন সুলুক সন্ধান করতে হচ্ছে। রাজপ্রাসাদ থেকে যে দুই শতক ধরে সামন্তীয় ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে, সেটার অবসান ঘটেছে। জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এ ছাড়া নেপালের একটি পক্ষ দেশটিকে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারটা হয়তো অনেকেই খেয়াল করেননি যে দেশটি মূলত ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের দেশ হলেও ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্রর সংবিধানের আগে দেশটি হিন্দু রাষ্ট্র ছিল না। নিশ্চিতভাবেই তাঁর লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক হাওয়ার মধ্যে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করা। না, সেটা শুধু জাতির প্রতীক ছিল না, ছিল বিশ্বাসের রক্ষাকবচ।
কিন্তু নেপালে আমলে নেওয়ার মতো বিষয় এখনো অনেক আছে। অনেকেই মনে করেন, রাজতন্ত্র উচ্ছেদের সঙ্গে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত। আবার এই সংবিধানের অনেক দিকই সাদরে গ্রহণ করার মতো। এই সংবিধান একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির, যার সদস্যরা প্রত্যক্ষ ও আনুপাতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। আর ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
এমন একটি সংবিধানকে সবাই স্বাগত জানাবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। অনেক প্রশংসনীয় গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও এই সংবিধান দেশটির বড় একটি জনগোষ্ঠীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবি পূরণ করতে পারেনি। আবার ক্ষমতা প্রয়োগের বেলায় সংবিধান স্ট্যাটাসকো বা বিদ্যমান অবস্থা বজায় রেখেছে। ধারণা, কখনো কখনো বাস্তবতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বহু মানুষ মনে করছে, সুবিধাভোগী জাতিগোষ্ঠী যেমন বহুন ও ছত্রিরা নিজেদের আধিপত্য চিরস্থায়ী করতে চাচ্ছে।
ওদিকে মদেশিরা তো আছেই। এরা হিন্দিভাষী; ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা এই মানুষদের নেপালের পাহাড়ি অভিজাতরা কখনোই নিজেদের সমকক্ষ মনে করেনি। ফলে নানা সময়েই তাদের নিপীড়ন করা হয়েছে, রাজধানীতে যেতে হলে তাদের একসময় গলায় পরিচয়পত্র ঝোলাতে হতো। তাদের মনে সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। মদেশিরা নেপালের জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, দেশটির রাজস্ব আয়েরও বেশির ভাগই আসে তাদের কাছ থেকে। কিন্তু সরকারি চাকরিতে ও সেনাবাহিনীর চাকরিতে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের অঞ্চলে বিনিয়োগও হয় কম। নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে, মদেশের ১২ থেকে ২০টি জেলা পাহাড়ি জেলাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যক্ষ নির্বাচনে সংসদীয় আসনের ভাগাভাগিতে মদেশিদের প্রতিনিধিত্ব ৮৩ থেকে ৬৩টিতে নেমে যাবে। ফলে বিপুলসংখ্যক মদেশি মানুষ ভোটাধিকার হারাবে। ২০০৮ সালে জি পি কৈরালার সরকার তাদের যে লিখিত নিশ্চয়তা দিয়েছিল, এটা স্পষ্টতই তার লঙ্ঘন। ফলে মদেশ ফুঁসে উঠেছে।
এদিকে ভারত চায় নেপালের সংবিধান নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব ও ভিন্নমত সৃষ্টি হয়েছে, তার যেন শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। তবে ভারতে একটি প্রশ্ন ওঠে, ভারত কেন অন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবে? সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেপালের বিষয়ে কয়েকবার বলেছেন, ভারত এক সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল নেপাল দেখতে চায়, যেখানে সব সম্প্রদায় সংবিধানকে নিজেদের মনে করবে। কিন্তু ভারত কেন এর ফলাফল নিয়ে এত উদ্বিগ্ন? সেটা নেপালের জনগণের ব্যাপার, ভারতের নয়। আবার ভারতের সঙ্গে নেপাল যেভাবে জড়িয়ে আছে, তাতে তার পক্ষে নেপালের ব্যাপারে নির্মোহ থাকাও সম্ভব নয়। উন্মুক্ত সীমান্ত ও চলাচল, ঘনিষ্ঠ পারিবারিক যোগাযোগ, পারস্পরিক রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা, নেপালিদের ভারতে কাজ করার লক্ষ্যে প্রণীত চুক্তি, গোর্খাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা প্রভৃতি কারণে ভারত হয়তো নেপালের ব্যাপারে চোখ বুজে থাকতে পারে না।
আবার নেপালেও ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙা হয়েছে। সেখানকার জনগণ ভারতীয় পতাকা পোড়াচ্ছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করছে। কিন্তু এসব করে কি লাভ হবে? ইতিহাস বলে, যোগাযোগের বিভিন্ন পথ খুলে দিলে ভুল-বোঝাবুঝি দূর হয়।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; ভারতের পাক্ষিক ফ্রন্টলাইন থেকে নেওয়া
দেব মুখার্জি: বাংলাদেশ ও নেপালে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments