‘বাংলাদেশ অ্যান্ড ইটস ফিউচার’ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যে
বিষয় নিয়ে আজ বাংলাদেশের প্রতিটি পল্লিতে আলোচনা হওয়ার কথা, আদৌ হচ্ছে
না তাও নয়—চুপে চুপে হচ্ছে, সেই বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের
ওয়েস্টমিনস্টার হলে আলোচনা হলো ১৭ জুন। ‘বাংলাদেশ অ্যান্ড ইটস ফিউচার’
(বাংলাদেশ এবং এর ভবিষ্যৎ) শীর্ষক বিতর্কে ২০ জনের বেশি এমপি উপস্থিত
ছিলেন। আলোচনায় অংশ নেন আটজন। তিনজন সদ্য নির্বাচিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত
এমপি শ্রোতা হিসেবেও উপস্থিত ছিলেন না।
উল্লিখিত শিরোনামে আলোচনায় বসার কথা বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের। তা ছাড়া, ওই বিষয়ে বিতর্ক করার কথা দেশের একাডেমিশিয়ানদের। জনগণের সামনে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার কথা আজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা মঠবাসী সন্ন্যাসীদের মতো মৌনতা অবলম্বন করেছেন, সুফি-দরবেশের মতো তাঁদের কথাবার্তায় মরমি ভাবটাই বেশি—রূঢ় বাস্তবতার বিচার-বিশ্লেষণ নেই। দেশের বর্তমান অবস্থায় এবং ভবিষ্যতের প্রশ্নে তাঁরা খুবই পরিতৃপ্ত।
আলোচনাটা হয়েছে তখন, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে উপস্থিত। হাউস অব কমন্সের ওয়েস্টমিনস্টার হলে বিতর্কের উদ্যোক্তা পার্লামেন্টের বাংলাদেশ-বিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির সভাপতি অ্যান মেইন। বেশির ভাগ এমপি আগের দিন পার্লামেন্টে এক সভায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন। এমপিদের প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার। ব্রিটিশ এমপিরা কেউই ভবিষ্যদ্বক্তা কিরোর শিষ্য নন যে কোনো দেশের রাশিফল গুনে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে দিতে পারেন।
বাংলাদেশটার কোনো দোষ নেই। এককালে সত্যিই ছিল ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়, নদী বা পুকুরঘাট থেকে কলসে পানি ভরে যখন কোনো নারী ঘরে ফিরত, তখন তাকে ‘মা বলিতে প্রাণ’ আনচান করত যেকোনো মানুষের। আজ ঘর থেকে রাস্তায় বেরোলে যেকোনো বয়সী নারীর বুকই যে শুধু কাঁপে তা-ই নয়, পুরুষেরাও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকে দলবিশেষের ছাত্র ও যুবনেতারা রোমান সৈন্যদের মতো বীরবিক্রমে তার ওপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কী কারণে যুদ্ধ ঘোষণা তা জানার আগেই ২০-২৫ জনের ফাটবে মাথা এবং দৌড়াতে গিয়ে পড়ে ভাঙবে হাঁটু। সব সময়ই যে টেন্ডারের বাক্স নিয়ে হবে তা নয়, কখনো হবে ইফতারির প্যাকেট নিয়ে, কখনো সভাপতি ও প্রধান অতিথি হওয়া নিয়ে। সভায় সামনের সারির চেয়ারে বসা নিয়ে বিবাদে চেয়ারগুলো ঘরের মধ্যেই যে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ব্যবহৃত হয় তা-ই নয়, আশপাশের রাস্তায় পথচারীর মাথার ওপর দিয়ে মাঝারি পাল্লার মিসাইলের মতো উড়তে থাকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আলোচ্য সভায় এমপিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশের অসহিষ্ণু রাজনীতি বিদেশে থাকা দলীয় সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন লন্ডনে স্থানীয় বিএনপির বিক্ষোভ এবং সবশেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে দুই পক্ষের জব্বারের বলীখেলা দূর থেকে দেখেই তাঁরা ভয় পেয়েছেন। অতিসহিষ্ণু ব্রিটিশ পুলিশ দু-একজনকে আটক পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
হিথরো বা জন এফ কেনেডি কুর্মিটোলা বিমানবন্দর নয়, বাংলাদেশের কোনো নেতা সেখানে গিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সমর্থকদের দল বেঁধে সেখানে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হবে, এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। প্রধানমন্ত্রী দেশের সব মানুষের প্রধানমন্ত্রী, শুধু তাঁর দলের লোকদের নন। তাই সবচেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ফুলের তোড়া নিয়ে বিমানবন্দরে গিয়ে স্বাগত জানালে। আরও সম্মানজনক হয় যদি ওই সব দেশের নেতাদের কেউ স্বাগত জানান। দুই বিবদমান গোত্রের ভাড়াটে লোকেরা সেখানে গিয়ে অশ্রাব্য স্লোগান দেবেন, ঘুষাঘুষি করবেন, নেতার গাড়িতে হামলা করতে চাইবেন বা পাদুকা নিক্ষেপ করবেন, তা খুবই নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট অপকর্ম।
গত পঁচিশ বছরে বিভিন্ন সরকারপ্রধানের ব্রিটেন-আমেরিকা সফরের সময় অসভ্য আচরণ করেছে ওই সব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কোনো কোনো গোত্র। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দৌড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেউ কোমরে ও হাঁটুতে চোট পেয়েছেন, পুলিশের হান্টারের বাড়ি পড়েছে কারও পাঁজরের হাড়ে, নিজেদের ঘুষাঘুষিতে থুতনির হাড় ভেঙেছে কারও কারও। কেউ কেউ রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে করেছেন পরস্পরকে চপেটাঘাত।
বিতর্কে হুগো সয়্যার বলেছেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। বিরোধী পক্ষের বহু লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি সুযোগ নষ্ট হয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়। এই নির্বাচন জালিয়াতি ও সহিংসতার দোষে দুষ্ট ছিল। বিতর্কের সূচনা বক্তব্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলীয় এমপি অ্যান মেইন রাজনৈতিক সংঘাত এবং অস্থিরতাকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, রক্তপাতহীন নির্বাচনের নজির বাংলাদেশে নেই। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সিটি মেয়র নির্বাচনটি ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক। যুক্তরাজ্য প্রতিবছর বাংলাদেশকে ২৫ কোটি পাউন্ড সাহায্য দেয়, তাতে দুর্নীতি হচ্ছে কী পরিমাণ, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা।
লেবার দলের এমপি জিম ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, আওয়ামী লীগ একসময় জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। এখন বিএনপি তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছে। অ্যান মেইন বলেন, তিনি শুনেছেন যে পাকিস্তানের অর্থায়নে জামায়াত পরিচালিত হয়। তবে এ বিষয়ে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কনজারভেটিভ এমপি মার্ক ফিল্ড অতীতমুখী রাজনীতি অগ্রগতির জন্য শুভ নয় মন্তব্য করে বলেন, ৪৪ বছর আগে যে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিচার একটা পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি সমঝোতার মাধ্যমে এর ইতি টানার বিষয়টিও জরুরি।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সমস্যা, মানব পাচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেন ব্রিটিশ এমপিরা। মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে সয়্যার বলেন, যুক্তরাজ্য মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না। প্রায় সব এমপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার যে অভিযোগ করছে, তার উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, অভিযোগের ও ঘটনাবলির নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
সমগ্র মহাজগতে পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দল ও সরকারবিরোধী দল থাকতেই হবে। মহাজোট সরকার সাংবিধানিক, কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার নেই। অসংখ্য বিরোধী নেতা-কর্মী হয় জেলে, নয়তো গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথবা হয়রানির শিকার। সমাবেশ-বিক্ষোভ করা, সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা গণতান্ত্রিক অধিকার। দ্বিতীয় মেয়াদের ক্যামেরন সরকারের বয়স দুই মাসও হয়নি। এই সপ্তাহে তাঁর বিরুদ্ধে লন্ডনে লাখ লাখ লোক উত্তাল বিক্ষোভ করছে। সরকার তাদের নির্মূল করার উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, ওদেশে গণতন্ত্র আছে।
হঠাৎ হঠাৎ অতীতের দু-একটি স্মৃতি মনে পড়ে। বাহাত্তরের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু মস্কো সফরে যান। যেদিন ফেরেন সেদিন আমরা অনেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে ছিলাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের অনেকে। যেমন তাঁর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শাহ কিবরিয়া, ফারুক চৌধুরী, প্রেস সচিব আবুল হাশেম, এইচ টি ইমাম, আমিনুল হক বাদশা, শেখ কামাল প্রমুখ। রয়টারের একজন সংবাদদাতা ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর তুষার পণ্ডিত রফিকুল্লাহ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলেন, সরকারব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হবে কি না? জনাব চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধু সংসদীয় পদ্ধতি থেকে একচুলও নড়তে চান না। ‘একচুল’ কথাটি আমার মনে আছে।
বিএনপি হিতার্থীরা কয়েক দিন যাবৎ বলাকওয়া করেছেন, জিয়ার আদর্শ থেকে সরে যাওয়াই দলের বিপর্যয়ের কারণ। তাঁরা বিএনপিকে জিয়ার আদর্শে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন। যা হোক, সেটা তাঁরা বুঝবেন। আমার এই রচনাটি এমন একটি দিনে প্রকাশিত হবে, যেটি আওয়ামী লীগের জন্মদিন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস ও আওয়ামী লীগ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। অত বড় দলকে আমার মতো সামান্য মানুষের উপদেশ দেওয়া ধৃষ্টতা। বাংলাদেশকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগ যদি ফিরে যেত ১৯৪৯-এর ২৩ জুন এবং বঙ্গবন্ধুর ১১ জানুয়ারি ’৭২-এর মতাদর্শে! ভাসানীর বাংলা ডিকটেশনে শামসুল হকের ইংরেজিতে লেখা আওয়ামী লীগের মূল দলিলটি আমার কাছে আছে। তাতে লেখা আছে—রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ‘...অব দ্য প্রিন্সিপালস অব ট্রু ডেমোক্রেসি’ এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল—‘টু সেফগার্ড সিভিল লিবার্টিজ, সাচ অ্যাজ ইনডিভিজুয়াল অ্যান্ড কালেকটিভ ফ্রিডম অব বিলিফ, এক্সপ্রেশন, অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড অর্গানাইজেশন।’
সে ছিল এক অন্য রকম সময়। ’৭২-এর ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবন, হেয়ার রোড ও ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে ছোটাছুটি করেছি। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে। তখন প্রাণহীন শহরে গাড়ি ছিল অল্প, যানজট শব্দটি উদ্ভাবিত হয়নি। হেয়ার রোড থেকে ৩২ নম্বরে যেতে লাগত রিকশায় ১০ মিনিট, বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে বঙ্গভবন ১৫ মিনিট। ১১ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র বিষয়ে বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটিই হওয়া উচিত বাংলাদেশের স্থায়ী নীতি।
বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতিতে এবং আওয়ামী লীগের ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলব, ১১ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু যে নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষতি স্বীকার করেও সেই নীতি-আদর্শে ফিরে যেতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তা না হলে এ জাতির ভাগ্যবিপর্যয় সম্ভবত রোধ করা যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
উল্লিখিত শিরোনামে আলোচনায় বসার কথা বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাদের। তা ছাড়া, ওই বিষয়ে বিতর্ক করার কথা দেশের একাডেমিশিয়ানদের। জনগণের সামনে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার কথা আজ দেশের বুদ্ধিজীবীদের। তাঁরা মঠবাসী সন্ন্যাসীদের মতো মৌনতা অবলম্বন করেছেন, সুফি-দরবেশের মতো তাঁদের কথাবার্তায় মরমি ভাবটাই বেশি—রূঢ় বাস্তবতার বিচার-বিশ্লেষণ নেই। দেশের বর্তমান অবস্থায় এবং ভবিষ্যতের প্রশ্নে তাঁরা খুবই পরিতৃপ্ত।
আলোচনাটা হয়েছে তখন, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে উপস্থিত। হাউস অব কমন্সের ওয়েস্টমিনস্টার হলে বিতর্কের উদ্যোক্তা পার্লামেন্টের বাংলাদেশ-বিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির সভাপতি অ্যান মেইন। বেশির ভাগ এমপি আগের দিন পার্লামেন্টে এক সভায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন। এমপিদের প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার। ব্রিটিশ এমপিরা কেউই ভবিষ্যদ্বক্তা কিরোর শিষ্য নন যে কোনো দেশের রাশিফল গুনে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে দিতে পারেন।
বাংলাদেশটার কোনো দোষ নেই। এককালে সত্যিই ছিল ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়, নদী বা পুকুরঘাট থেকে কলসে পানি ভরে যখন কোনো নারী ঘরে ফিরত, তখন তাকে ‘মা বলিতে প্রাণ’ আনচান করত যেকোনো মানুষের। আজ ঘর থেকে রাস্তায় বেরোলে যেকোনো বয়সী নারীর বুকই যে শুধু কাঁপে তা-ই নয়, পুরুষেরাও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকে দলবিশেষের ছাত্র ও যুবনেতারা রোমান সৈন্যদের মতো বীরবিক্রমে তার ওপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কী কারণে যুদ্ধ ঘোষণা তা জানার আগেই ২০-২৫ জনের ফাটবে মাথা এবং দৌড়াতে গিয়ে পড়ে ভাঙবে হাঁটু। সব সময়ই যে টেন্ডারের বাক্স নিয়ে হবে তা নয়, কখনো হবে ইফতারির প্যাকেট নিয়ে, কখনো সভাপতি ও প্রধান অতিথি হওয়া নিয়ে। সভায় সামনের সারির চেয়ারে বসা নিয়ে বিবাদে চেয়ারগুলো ঘরের মধ্যেই যে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ব্যবহৃত হয় তা-ই নয়, আশপাশের রাস্তায় পথচারীর মাথার ওপর দিয়ে মাঝারি পাল্লার মিসাইলের মতো উড়তে থাকে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আলোচ্য সভায় এমপিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বাংলাদেশের অসহিষ্ণু রাজনীতি বিদেশে থাকা দলীয় সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন লন্ডনে স্থানীয় বিএনপির বিক্ষোভ এবং সবশেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে দুই পক্ষের জব্বারের বলীখেলা দূর থেকে দেখেই তাঁরা ভয় পেয়েছেন। অতিসহিষ্ণু ব্রিটিশ পুলিশ দু-একজনকে আটক পর্যন্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
হিথরো বা জন এফ কেনেডি কুর্মিটোলা বিমানবন্দর নয়, বাংলাদেশের কোনো নেতা সেখানে গিয়ে অবতরণ করলে তাঁর সমর্থকদের দল বেঁধে সেখানে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হবে, এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। প্রধানমন্ত্রী দেশের সব মানুষের প্রধানমন্ত্রী, শুধু তাঁর দলের লোকদের নন। তাই সবচেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ফুলের তোড়া নিয়ে বিমানবন্দরে গিয়ে স্বাগত জানালে। আরও সম্মানজনক হয় যদি ওই সব দেশের নেতাদের কেউ স্বাগত জানান। দুই বিবদমান গোত্রের ভাড়াটে লোকেরা সেখানে গিয়ে অশ্রাব্য স্লোগান দেবেন, ঘুষাঘুষি করবেন, নেতার গাড়িতে হামলা করতে চাইবেন বা পাদুকা নিক্ষেপ করবেন, তা খুবই নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট অপকর্ম।
গত পঁচিশ বছরে বিভিন্ন সরকারপ্রধানের ব্রিটেন-আমেরিকা সফরের সময় অসভ্য আচরণ করেছে ওই সব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কোনো কোনো গোত্র। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দৌড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেউ কোমরে ও হাঁটুতে চোট পেয়েছেন, পুলিশের হান্টারের বাড়ি পড়েছে কারও পাঁজরের হাড়ে, নিজেদের ঘুষাঘুষিতে থুতনির হাড় ভেঙেছে কারও কারও। কেউ কেউ রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে করেছেন পরস্পরকে চপেটাঘাত।
বিতর্কে হুগো সয়্যার বলেছেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। বিরোধী পক্ষের বহু লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি সুযোগ নষ্ট হয়েছে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময়। এই নির্বাচন জালিয়াতি ও সহিংসতার দোষে দুষ্ট ছিল। বিতর্কের সূচনা বক্তব্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলীয় এমপি অ্যান মেইন রাজনৈতিক সংঘাত এবং অস্থিরতাকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, রক্তপাতহীন নির্বাচনের নজির বাংলাদেশে নেই। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সিটি মেয়র নির্বাচনটি ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক। যুক্তরাজ্য প্রতিবছর বাংলাদেশকে ২৫ কোটি পাউন্ড সাহায্য দেয়, তাতে দুর্নীতি হচ্ছে কী পরিমাণ, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা।
লেবার দলের এমপি জিম ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, আওয়ামী লীগ একসময় জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। এখন বিএনপি তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করছে। অ্যান মেইন বলেন, তিনি শুনেছেন যে পাকিস্তানের অর্থায়নে জামায়াত পরিচালিত হয়। তবে এ বিষয়ে তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কনজারভেটিভ এমপি মার্ক ফিল্ড অতীতমুখী রাজনীতি অগ্রগতির জন্য শুভ নয় মন্তব্য করে বলেন, ৪৪ বছর আগে যে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিচার একটা পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি সমঝোতার মাধ্যমে এর ইতি টানার বিষয়টিও জরুরি।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সমস্যা, মানব পাচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেন ব্রিটিশ এমপিরা। মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে সয়্যার বলেন, যুক্তরাজ্য মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না। প্রায় সব এমপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার যে অভিযোগ করছে, তার উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, অভিযোগের ও ঘটনাবলির নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
সমগ্র মহাজগতে পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দল ও সরকারবিরোধী দল থাকতেই হবে। মহাজোট সরকার সাংবিধানিক, কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার নেই। অসংখ্য বিরোধী নেতা-কর্মী হয় জেলে, নয়তো গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথবা হয়রানির শিকার। সমাবেশ-বিক্ষোভ করা, সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করা গণতান্ত্রিক অধিকার। দ্বিতীয় মেয়াদের ক্যামেরন সরকারের বয়স দুই মাসও হয়নি। এই সপ্তাহে তাঁর বিরুদ্ধে লন্ডনে লাখ লাখ লোক উত্তাল বিক্ষোভ করছে। সরকার তাদের নির্মূল করার উদ্যোগ নেয়নি। কারণ, ওদেশে গণতন্ত্র আছে।
হঠাৎ হঠাৎ অতীতের দু-একটি স্মৃতি মনে পড়ে। বাহাত্তরের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু মস্কো সফরে যান। যেদিন ফেরেন সেদিন আমরা অনেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে ছিলাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের অনেকে। যেমন তাঁর সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শাহ কিবরিয়া, ফারুক চৌধুরী, প্রেস সচিব আবুল হাশেম, এইচ টি ইমাম, আমিনুল হক বাদশা, শেখ কামাল প্রমুখ। রয়টারের একজন সংবাদদাতা ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর তুষার পণ্ডিত রফিকুল্লাহ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলেন, সরকারব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন হবে কি না? জনাব চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধু সংসদীয় পদ্ধতি থেকে একচুলও নড়তে চান না। ‘একচুল’ কথাটি আমার মনে আছে।
বিএনপি হিতার্থীরা কয়েক দিন যাবৎ বলাকওয়া করেছেন, জিয়ার আদর্শ থেকে সরে যাওয়াই দলের বিপর্যয়ের কারণ। তাঁরা বিএনপিকে জিয়ার আদর্শে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন। যা হোক, সেটা তাঁরা বুঝবেন। আমার এই রচনাটি এমন একটি দিনে প্রকাশিত হবে, যেটি আওয়ামী লীগের জন্মদিন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস ও আওয়ামী লীগ অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। অত বড় দলকে আমার মতো সামান্য মানুষের উপদেশ দেওয়া ধৃষ্টতা। বাংলাদেশকে বাঁচাতে আওয়ামী লীগ যদি ফিরে যেত ১৯৪৯-এর ২৩ জুন এবং বঙ্গবন্ধুর ১১ জানুয়ারি ’৭২-এর মতাদর্শে! ভাসানীর বাংলা ডিকটেশনে শামসুল হকের ইংরেজিতে লেখা আওয়ামী লীগের মূল দলিলটি আমার কাছে আছে। তাতে লেখা আছে—রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ‘...অব দ্য প্রিন্সিপালস অব ট্রু ডেমোক্রেসি’ এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল—‘টু সেফগার্ড সিভিল লিবার্টিজ, সাচ অ্যাজ ইনডিভিজুয়াল অ্যান্ড কালেকটিভ ফ্রিডম অব বিলিফ, এক্সপ্রেশন, অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড অর্গানাইজেশন।’
সে ছিল এক অন্য রকম সময়। ’৭২-এর ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবন, হেয়ার রোড ও ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে ছোটাছুটি করেছি। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছেন দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে। তখন প্রাণহীন শহরে গাড়ি ছিল অল্প, যানজট শব্দটি উদ্ভাবিত হয়নি। হেয়ার রোড থেকে ৩২ নম্বরে যেতে লাগত রিকশায় ১০ মিনিট, বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে বঙ্গভবন ১৫ মিনিট। ১১ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র বিষয়ে বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটিই হওয়া উচিত বাংলাদেশের স্থায়ী নীতি।
বাংলাদেশের আজকের পরিস্থিতিতে এবং আওয়ামী লীগের ৬৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলব, ১১ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু যে নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষতি স্বীকার করেও সেই নীতি-আদর্শে ফিরে যেতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তা না হলে এ জাতির ভাগ্যবিপর্যয় সম্ভবত রোধ করা যাবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments