কূটনীতিতে বারবার হোঁচট খেয়েছে by কাফি কামাল
স্নায়ুযুদ্ধ
নেই। তবে লড়াই চলছে এখনও। দেশে দেশে সক্রিয় আন্তর্জাতিক ‘দাবার’
খেলোয়াড়রা। বাংলাদেশকে ঘিরে ক্রমেই জোরদার হচ্ছে এ লড়াই। কে নেই এখানে।
ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব। দৃশ্যত যোজন যোজন
ব্যবধানে এগিয়ে ভারত। আন্তর্জাতিক এ দাবা খেলায় বারবার কৌশল পরিবর্তন করেও
সুফল পাচ্ছে না বিএনপি। কোথায় যেন গোলমাল। ‘বিএনপির ময়নাতদন্তের’ চতুর্থ
পর্বে আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল অনুসন্ধান করেছেন বিএনপির কূটনৈতিক কৌশলের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে---
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কূটনীতিক ক্ষেত্রে বারবার হোঁচট খেয়েছে বিএনপি। সরকারে থাকাকালে নেয়া বহু সিদ্ধান্তই ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে পরবর্তীতে। ক্ষমতার বাইরে এসে বিএনপির জোর কূটনৈতিক তৎপরতা অনেকবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সাফল্য যে একেবারে নেই তা নয়। বিশেষত বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক শক্তিই বিএনপির অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবির প্রতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তবে ওইসব দেশ বিএনপির পক্ষে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। মুখে বলেই দায়িত্ব সেরেছে তারা। এক্ষেত্রে অবশ্য ভারতের অবস্থানই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি। ভারতবিরোধী হিসেবে ইমেজ প্রতিষ্ঠা, চীনকে চটিয়ে তাইওয়ানকে বাণিজ্য কেন্দ্র সুবিধা দেয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা ইস্যুতে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট করেছে বিএনপি। এরমধ্যে তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে চরমভাবে আঘাত দেওয়া ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। জামায়াতের সঙ্গে জোট করা ও হেফাজতকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়নি পশ্চিমা কূটনীতিক মহল। এ ছাড়া ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে সফলভাবে একের পর এক চাল দিয়েছে বর্তমান সরকার। হজ করেছেন বর্তমান সরকারের শরিক দুই বামপন্থি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। দেশের প্রেসিডেন্ট যখন হজে তখন যুক্তরাষ্ট্রে বসে হজের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করেন তৎকালীন তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগ তাকে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করলেও তার বিরুদ্ধে কোন আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।
ভৌগোলিক সীমারেখাভিত্তিক শহীদ জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামিক জাতীয়তাবাদকে গুলিয়ে ফেলেন বিএনপির কতিপয় নেতা। নানা ইস্যুতে অপপ্রচারণায় সৃষ্ট নেতিবাচক ইমেজ থেকে বিএনপি যেমন বেরিয়ে আসতে পারেনি, তেমনি ক্ষমতায় গেলে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তাও স্পষ্ট করতে পারেনি। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকা পশ্চিমাদের কাছেও অনেক বিষয় পরিষ্কার করতে পারেনি দলটি। সব মিলিয়ে দলটির কূটনৈতিক তৎপরতায় ঘাটতির বিষয়টি এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। অথচ কূটনীতিতে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ঢাকার মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতাবাসে ডিফেন্স অ্যাটাশে পদ সৃষ্টি করা ছিল তাঁরই সাফল্য। কারণ তিনি এই পদ সৃষ্টিতে ওই দুই দেশকে আগাম রাজি করিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ভারত-ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের দিকে চলে যায়। ফলে অন্যান্য বিশ্বশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না বাংলাদেশের। বিএনপি তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা ধারণ করে। একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি চীন ও আমেরিকার মতো দুই প্রভাবশালী দেশকে করেছিলেন বন্ধু রাষ্ট্র। হাত বাড়িয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকেও। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জিয়াউর রহমান যখন সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তা গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু এখন সার্কের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছেন সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
এদিকে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা আশা করেছিলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন গ্রহণযোগ্যতাই পাবে না। আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামী লীগ খুব শিগগিরই নতুন নির্বাচন দেবে বলেও আশান্বিত ছিলেন তারা। এমন ভাবনার যৌক্তিক কারণও ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্য কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ও দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে বড় দুই দলেরই হাইকমান্ডের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক চালিয়েছেন। বাংলাদেশ ইস্যুতে পর্যবেক্ষণ এবং সমঝোতার চেষ্টায় সক্রিয় ছিল জাতিসংঘ। খোদ জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহাসচিবের মধ্যে বৈঠকও হয়েছিল। সেখানে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল সাংবিধানিক নিয়মরক্ষার নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এটা সত্য যে, পশ্চিমা দুনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মনে করেনি। একটি নতুন নির্বাচনের আহ্বানও ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে শুধু লিপসার্ভিস ছাড়া বিএনপিকে কিছুই দেয়নি আন্তর্জাতিক বন্ধুরা। ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলাম মনে করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
ইতিহাসের নানা বাঁকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার সুযোগ তৈরি হলেও মোটাদাগে সেটা করতে পারেনি বিএনপি। ২০১৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি (তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ‘ভারত কোন দল নয়, দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়’ বলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, বিএনপির সামনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বন্ধু খ্যাত কংগ্রেস সরকারের আমলেই দিল্লি সফর করেন খালেদা জিয়া। এই সফরটি কোন সাদামাটা সফর ছিল না। ভারত আশা করেছিল বেগম জিয়া তাদেরকে এমন ধারণাই দেবেন যাতে ‘ভারত বিরোধী’ হিসেবে বিএনপির গায়ে যে লেবেলটা রয়েছে তা তারা একপাশে সরিয়ে রাখতে পারে। তাঁকে প্রটোকল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নের ছাপ ছিল। ভারত সফরের আগে বৃটেনের একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত লেখায় খালেদা জিয়া পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধাবোধ, ভৌগোলিক নৈকট্য এবং যৌথ ইতিহাসকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দুু’দেশের বিরাজমান বর্তমান সংকটের জন্য ঔপনিবেশিক নীতি ও ঘটনা পরম্পরায় ‘ভয়ের বিকার’কে দায়ী করেছিলেন তিনি। দিল্লি সফরকালে খালেদা জিয়াকে তাই সর্বোচ্চ আতিথেয়তা ও গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার। কেবল কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ছাড়া ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বিরোধী দলের নেতা সুষমা স্বরাজসহ কংগ্রেস ও বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। সেখানে কয়েকটি দর্শনীয় জায়গাও ঘুরিয়ে দেখানো হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের’ও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। দেশে ফিরে ভারত সরকারের আতিথেয়তার প্রশংসা ও দিল্লি মিশন সফল বলে বক্তব্য এসেছিল বিএনপির তরফে।
তবে খালেদা জিয়ার ভারত সফর ও ওইসময়ে তাঁর নানা বক্তব্যকে সমর্থন করতে পারেনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দল। পরের বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে একটি শিডিউল বৈঠক রাখেন তিনি। কিন্তু দলীয় ইস্যুতে জামায়াতের ডাকা হরতালের কারণে ওই বৈঠক বাতিল করেন খালেদা জিয়া। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুল আলোচনা হয়েছে। বৈঠক বাতিলের বিষয়টি বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের অবস্থান আনুষ্ঠানিক। দেশের সবার উপরে তাঁর স্থান। তাঁর সঙ্গে বৈঠক বাতিল করায় গোটা ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট হতবাক হয়। বিএনপির পক্ষে যারা লবি করছিলেন তারা কোণঠাসা হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি ভারত সরকার। এটা অপমান হিসেবে বিবেচনা করে দেশটি। বিষয়টি উপলব্ধি করতে অনেক সময় চলে যায় বিএনপির। তারই প্রেক্ষিতে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি দল আওয়ামী লীগকে সর্বোচ্চ সহায়তা ও কূটনীতিক সমর্থন দেয় ভারত। এমনকি নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে ধারাবাহিক বৈঠক করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে দুতিয়ালী করেন।
তবে ওই বৈঠক বাতিলের ভিন্নকারণ রয়েছে বলে একটি খবর ছিল। দুটি পক্ষ থেকেই নিরাপত্তা হুমকির কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে ওই বৈঠক বাতিল করতে বলা হয়। হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের দিকে ওই হোটেলের কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি ভারতের সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল। তাই আমি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি।’
সর্বশেষ ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসায় আশান্বিত হয় বিএনপি। চূড়ান্ত ফলাফলের আগেভাগেই বিজেপিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলো বিএনপি। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করে দলটি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে কংগ্রেস ও বিজেপির নীতি এখন পর্যন্ত অভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সাউথ ব্লক বিজেপিকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ভারতের লাভ বেশি হবে কিসে। বিজেপির এক বছরের শাসনামলে বিএনপির কোন প্রতিনিধি দল বিজেপি সরকারের সঙ্গে বৈঠক বা দৃশ্যমান যোগাযোগ করতে পারেনি। অতি সম্প্রতি ভিন্ন চ্যানেলে বিএনপি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিএনপি। সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র বিএনপি অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছে, ‘আমরা কখনও ভারত বিরোধী ছিলাম না’। রাজনৈতিক মহলের মতে, ভারতের ব্যাপারে বিএনপির নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে তাৎক্ষণিক বিবেচনার সুযোগ নেই। এটি বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঠাণ্ডা মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্য রয়েছে সঙ্গত কারণেই। দ্য সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমি ভারতবিরোধী হবো কেন? আমাকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে প্রচার করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার (আওয়ামী লীগ) পরিকল্পিতভাবে প্রপাগান্ডা করছে। বিএনপি ও আমাকে ভারতবিরোধী হিসাবে সবার সামনে চিহ্নিত করতে প্রপাগান্ডা করার জন্য একটি সু-সংগঠিত তেলবাজ চক্র (ওয়েল-অয়েলড প্রপাগান্ডা মেশিনারি) ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে।
বিএনপি নেতারা জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে বিএনপি। কিন্তু দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে না পারার পেছনে দলটির সাংগঠনিক ব্যর্থতার চেয়ে বড় বিষয় হিসেবে কাজ করেছে সরকারের কোন ধরনের কূটনৈতিক চাপ অনুভব না করা। বিশেষ করে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের নিশ্চুপ অবস্থান। এক্ষেত্রে বিএনপির ভেতরের আমলানির্ভর কূটনীতিকেই দোষারোপ করা হয়। বলা হয়, যে তিনজনের ওপর এ দায়িত্ব এদের সবাই সাবেক আমলা।
অন্যদিকে চীনের সঙ্গে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলেই সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশ। যদিও রাষ্ট্রদূত কায়সারের মাধ্যমে এই সম্পর্ক তৈরির সূচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই সূত্রেই চীনের সঙ্গে বিএনপির ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব হয়।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন গতি পেয়েছিল। কিন্তু গত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে চীনকে অগ্রাহ্য করে তাইওয়ানকে বাণিজ্য কেন্দ্র খোলার সুবিধা দেয় চারদলীয় জোট সরকার। এমনকি ঢাকায় তাইওয়ানের পতাকা উড়েছিল। বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি চীন। পরবর্তীতে বিএনপির তরফে ভুল স্বীকার করা হলেও চীনের আস্থার সংকটে পড়ে দলটি।
খালেদা জিয়া ২০১২ সালের মধ্য অক্টোবরে চীন সফরে গেলে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান ও উপ-প্রধানের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। চীনা নেতারা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে ‘আপনার ভবিষ্যৎ চীন সফরে এখন আলোচিত প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন দেখতে পাবেন’ বলেও মন্তব্য করেন। তবে খালেদা জিয়ার চীন সফরকালে প্রতিটি বৈঠকে তাইওয়ানের কথাটি মনে করিয়ে দেয়ার কথা একটি ঘরোয়া আড্ডায় স্বীকার করেছেন তাঁর একজন সফরসঙ্গী। পরে ২০১৪ সালে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় সার্কে চীনের পূর্ণ সদস্য পদের সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। ‘এক চীন’ নীতির প্রতিও বরাবরই সমর্থন করে আসছে দলটি। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা ঘটনা পরম্পরায় চীনের ভূমিকা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দেশটির সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিক সম্পর্ক আগের মতো মজবুত নয়। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপের কথা বললেও নির্বাচন মেনে নেয়ার কথা জানায় চীন। এ ছাড়া চীনা প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত চাই শি-র ঢাকা সফরকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হলেও সম্প্রতি চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ানদং-এর বাংলাদেশ সফরকালে বৈঠকের কোন শিডিউল পায়নি বিএনপি। এটা চীনের সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিতে গড়বরের লক্ষণ হিসেবেই দেখছে রাজনৈতিক মহল। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। দেখার বিষয় নরেন্দ্র মোদির পর চীনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ এবং কোন সমর্থন আদায় করতে পারে কিনা বিএনপি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কূটনীতিক ক্ষেত্রে বারবার হোঁচট খেয়েছে বিএনপি। সরকারে থাকাকালে নেয়া বহু সিদ্ধান্তই ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে পরবর্তীতে। ক্ষমতার বাইরে এসে বিএনপির জোর কূটনৈতিক তৎপরতা অনেকবারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সাফল্য যে একেবারে নেই তা নয়। বিশেষত বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক শক্তিই বিএনপির অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবির প্রতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তবে ওইসব দেশ বিএনপির পক্ষে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। মুখে বলেই দায়িত্ব সেরেছে তারা। এক্ষেত্রে অবশ্য ভারতের অবস্থানই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা ও সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি। ভারতবিরোধী হিসেবে ইমেজ প্রতিষ্ঠা, চীনকে চটিয়ে তাইওয়ানকে বাণিজ্য কেন্দ্র সুবিধা দেয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা ইস্যুতে আস্থার সম্পর্ক নষ্ট করেছে বিএনপি। এরমধ্যে তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে চরমভাবে আঘাত দেওয়া ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। জামায়াতের সঙ্গে জোট করা ও হেফাজতকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়নি পশ্চিমা কূটনীতিক মহল। এ ছাড়া ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদ ইস্যু নিয়ে সফলভাবে একের পর এক চাল দিয়েছে বর্তমান সরকার। হজ করেছেন বর্তমান সরকারের শরিক দুই বামপন্থি মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু। দেশের প্রেসিডেন্ট যখন হজে তখন যুক্তরাষ্ট্রে বসে হজের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করেন তৎকালীন তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগ তাকে দল ও মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার করলেও তার বিরুদ্ধে কোন আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।
ভৌগোলিক সীমারেখাভিত্তিক শহীদ জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামিক জাতীয়তাবাদকে গুলিয়ে ফেলেন বিএনপির কতিপয় নেতা। নানা ইস্যুতে অপপ্রচারণায় সৃষ্ট নেতিবাচক ইমেজ থেকে বিএনপি যেমন বেরিয়ে আসতে পারেনি, তেমনি ক্ষমতায় গেলে ভারত ও চীনের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তাও স্পষ্ট করতে পারেনি। ধর্মীয় জঙ্গিবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকা পশ্চিমাদের কাছেও অনেক বিষয় পরিষ্কার করতে পারেনি দলটি। সব মিলিয়ে দলটির কূটনৈতিক তৎপরতায় ঘাটতির বিষয়টি এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। অথচ কূটনীতিতে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ঢাকার মার্কিন ও ব্রিটিশ দূতাবাসে ডিফেন্স অ্যাটাশে পদ সৃষ্টি করা ছিল তাঁরই সাফল্য। কারণ তিনি এই পদ সৃষ্টিতে ওই দুই দেশকে আগাম রাজি করিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের ভারত-ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির ফলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের দিকে চলে যায়। ফলে অন্যান্য বিশ্বশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না বাংলাদেশের। বিএনপি তার পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা ধারণ করে। একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি চীন ও আমেরিকার মতো দুই প্রভাবশালী দেশকে করেছিলেন বন্ধু রাষ্ট্র। হাত বাড়িয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকেও। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। জিয়াউর রহমান যখন সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেন তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তা গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু এখন সার্কের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলছেন সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
এদিকে বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা আশা করেছিলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন গ্রহণযোগ্যতাই পাবে না। আন্তর্জাতিক চাপে আওয়ামী লীগ খুব শিগগিরই নতুন নির্বাচন দেবে বলেও আশান্বিত ছিলেন তারা। এমন ভাবনার যৌক্তিক কারণও ছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্য কয়েকটি দেশের কূটনীতিক ও দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত ও স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে বড় দুই দলেরই হাইকমান্ডের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক চালিয়েছেন। বাংলাদেশ ইস্যুতে পর্যবেক্ষণ এবং সমঝোতার চেষ্টায় সক্রিয় ছিল জাতিসংঘ। খোদ জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহাসচিবের মধ্যে বৈঠকও হয়েছিল। সেখানে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে সরকারের তরফে বলা হয়েছিল সাংবিধানিক নিয়মরক্ষার নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এটা সত্য যে, পশ্চিমা দুনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক মনে করেনি। একটি নতুন নির্বাচনের আহ্বানও ছিল তাদের পক্ষে। কিন্তু বাস্তবে শুধু লিপসার্ভিস ছাড়া বিএনপিকে কিছুই দেয়নি আন্তর্জাতিক বন্ধুরা। ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি. মাইলাম মনে করেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
ইতিহাসের নানা বাঁকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার সুযোগ তৈরি হলেও মোটাদাগে সেটা করতে পারেনি বিএনপি। ২০১৩ সালের মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি (তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ‘ভারত কোন দল নয়, দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়’ বলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, বিএনপির সামনে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে যাচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বন্ধু খ্যাত কংগ্রেস সরকারের আমলেই দিল্লি সফর করেন খালেদা জিয়া। এই সফরটি কোন সাদামাটা সফর ছিল না। ভারত আশা করেছিল বেগম জিয়া তাদেরকে এমন ধারণাই দেবেন যাতে ‘ভারত বিরোধী’ হিসেবে বিএনপির গায়ে যে লেবেলটা রয়েছে তা তারা একপাশে সরিয়ে রাখতে পারে। তাঁকে প্রটোকল দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নের ছাপ ছিল। ভারত সফরের আগে বৃটেনের একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত লেখায় খালেদা জিয়া পারস্পরিক স্বার্থ ও শ্রদ্ধাবোধ, ভৌগোলিক নৈকট্য এবং যৌথ ইতিহাসকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। দুু’দেশের বিরাজমান বর্তমান সংকটের জন্য ঔপনিবেশিক নীতি ও ঘটনা পরম্পরায় ‘ভয়ের বিকার’কে দায়ী করেছিলেন তিনি। দিল্লি সফরকালে খালেদা জিয়াকে তাই সর্বোচ্চ আতিথেয়তা ও গুরুত্ব দেয় ভারত সরকার। কেবল কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ছাড়া ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বিরোধী দলের নেতা সুষমা স্বরাজসহ কংগ্রেস ও বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। সেখানে কয়েকটি দর্শনীয় জায়গাও ঘুরিয়ে দেখানো হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের’ও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। দেশে ফিরে ভারত সরকারের আতিথেয়তার প্রশংসা ও দিল্লি মিশন সফল বলে বক্তব্য এসেছিল বিএনপির তরফে।
তবে খালেদা জিয়ার ভারত সফর ও ওইসময়ে তাঁর নানা বক্তব্যকে সমর্থন করতে পারেনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দল। পরের বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে একটি শিডিউল বৈঠক রাখেন তিনি। কিন্তু দলীয় ইস্যুতে জামায়াতের ডাকা হরতালের কারণে ওই বৈঠক বাতিল করেন খালেদা জিয়া। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিপুল আলোচনা হয়েছে। বৈঠক বাতিলের বিষয়টি বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে প্রেসিডেন্টের অবস্থান আনুষ্ঠানিক। দেশের সবার উপরে তাঁর স্থান। তাঁর সঙ্গে বৈঠক বাতিল করায় গোটা ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট হতবাক হয়। বিএনপির পক্ষে যারা লবি করছিলেন তারা কোণঠাসা হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি ভারত সরকার। এটা অপমান হিসেবে বিবেচনা করে দেশটি। বিষয়টি উপলব্ধি করতে অনেক সময় চলে যায় বিএনপির। তারই প্রেক্ষিতে ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি দল আওয়ামী লীগকে সর্বোচ্চ সহায়তা ও কূটনীতিক সমর্থন দেয় ভারত। এমনকি নির্বাচনের আগে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে ধারাবাহিক বৈঠক করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে দুতিয়ালী করেন।
তবে ওই বৈঠক বাতিলের ভিন্নকারণ রয়েছে বলে একটি খবর ছিল। দুটি পক্ষ থেকেই নিরাপত্তা হুমকির কথা বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে ওই বৈঠক বাতিল করতে বলা হয়। হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের দিকে ওই হোটেলের কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি ভারতের সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল। তাই আমি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারিনি।’
সর্বশেষ ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসায় আশান্বিত হয় বিএনপি। চূড়ান্ত ফলাফলের আগেভাগেই বিজেপিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলো বিএনপি। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করে দলটি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে কংগ্রেস ও বিজেপির নীতি এখন পর্যন্ত অভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সাউথ ব্লক বিজেপিকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ভারতের লাভ বেশি হবে কিসে। বিজেপির এক বছরের শাসনামলে বিএনপির কোন প্রতিনিধি দল বিজেপি সরকারের সঙ্গে বৈঠক বা দৃশ্যমান যোগাযোগ করতে পারেনি। অতি সম্প্রতি ভিন্ন চ্যানেলে বিএনপি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিএনপি। সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র বিএনপি অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছে, ‘আমরা কখনও ভারত বিরোধী ছিলাম না’। রাজনৈতিক মহলের মতে, ভারতের ব্যাপারে বিএনপির নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে তাৎক্ষণিক বিবেচনার সুযোগ নেই। এটি বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঠাণ্ডা মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্য রয়েছে সঙ্গত কারণেই। দ্য সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমি ভারতবিরোধী হবো কেন? আমাকে ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে প্রচার করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার (আওয়ামী লীগ) পরিকল্পিতভাবে প্রপাগান্ডা করছে। বিএনপি ও আমাকে ভারতবিরোধী হিসাবে সবার সামনে চিহ্নিত করতে প্রপাগান্ডা করার জন্য একটি সু-সংগঠিত তেলবাজ চক্র (ওয়েল-অয়েলড প্রপাগান্ডা মেশিনারি) ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে।
বিএনপি নেতারা জানান, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে বিএনপি। কিন্তু দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে না পারার পেছনে দলটির সাংগঠনিক ব্যর্থতার চেয়ে বড় বিষয় হিসেবে কাজ করেছে সরকারের কোন ধরনের কূটনৈতিক চাপ অনুভব না করা। বিশেষ করে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের নিশ্চুপ অবস্থান। এক্ষেত্রে বিএনপির ভেতরের আমলানির্ভর কূটনীতিকেই দোষারোপ করা হয়। বলা হয়, যে তিনজনের ওপর এ দায়িত্ব এদের সবাই সাবেক আমলা।
অন্যদিকে চীনের সঙ্গে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলেই সম্পর্ক গড়ে তোলে বাংলাদেশ। যদিও রাষ্ট্রদূত কায়সারের মাধ্যমে এই সম্পর্ক তৈরির সূচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই সূত্রেই চীনের সঙ্গে বিএনপির ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব হয়।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন গতি পেয়েছিল। কিন্তু গত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে চীনকে অগ্রাহ্য করে তাইওয়ানকে বাণিজ্য কেন্দ্র খোলার সুবিধা দেয় চারদলীয় জোট সরকার। এমনকি ঢাকায় তাইওয়ানের পতাকা উড়েছিল। বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি চীন। পরবর্তীতে বিএনপির তরফে ভুল স্বীকার করা হলেও চীনের আস্থার সংকটে পড়ে দলটি।
খালেদা জিয়া ২০১২ সালের মধ্য অক্টোবরে চীন সফরে গেলে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান ও উপ-প্রধানের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। চীনা নেতারা খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে ‘আপনার ভবিষ্যৎ চীন সফরে এখন আলোচিত প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন দেখতে পাবেন’ বলেও মন্তব্য করেন। তবে খালেদা জিয়ার চীন সফরকালে প্রতিটি বৈঠকে তাইওয়ানের কথাটি মনে করিয়ে দেয়ার কথা একটি ঘরোয়া আড্ডায় স্বীকার করেছেন তাঁর একজন সফরসঙ্গী। পরে ২০১৪ সালে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি রক্ষায় সার্কে চীনের পূর্ণ সদস্য পদের সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। ‘এক চীন’ নীতির প্রতিও বরাবরই সমর্থন করে আসছে দলটি। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নানা ঘটনা পরম্পরায় চীনের ভূমিকা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দেশটির সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিক সম্পর্ক আগের মতো মজবুত নয়। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপের কথা বললেও নির্বাচন মেনে নেয়ার কথা জানায় চীন। এ ছাড়া চীনা প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত চাই শি-র ঢাকা সফরকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হলেও সম্প্রতি চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী লিউ ইয়ানদং-এর বাংলাদেশ সফরকালে বৈঠকের কোন শিডিউল পায়নি বিএনপি। এটা চীনের সঙ্গে বিএনপির কূটনীতিতে গড়বরের লক্ষণ হিসেবেই দেখছে রাজনৈতিক মহল। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। দেখার বিষয় নরেন্দ্র মোদির পর চীনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ এবং কোন সমর্থন আদায় করতে পারে কিনা বিএনপি।
No comments