সমাপনী দুটি বয়ান by হিলাল ফয়েজী
মানুষটিকে
প্রবল ঈর্ষা করি। এই তিরাশি পেরিয়েও এত নিরলস কাজের ক্ষমতা। দারুণ
ইচ্ছাশক্তি। সবচেয়ে জটিল মন্ত্রণালয়। ইদানীং কথায় সামাল দিতে পারেন কম।
তবুও যে হিম্মতে চলেন, ভাবা যায় না। সরকারের প্রতিপক্ষরা তার বেসামাল কথার
সুযোগ নেন। সরকারের ভেতরের একদল তো পারলে আজই নিষ্ক্রান্ত করে দেন ৫১ বছর
বয়সে আমলার দাপুটে চাকরি ছেড়ে দেয়া মানুষটিকে। বস্তুত সোজাসাপ্টা সাহসী
মানুষ তিনি। সাত শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জন বর্তমান
বাংলাদেশের জন্য কোনো ‘অসম্ভব কল্পনা’ কিংবা ‘অলীক স্বপ্ন’ নয় বলে মন্তব্য
করেছেন তিনি। বলছি আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথা।
সোমবার ২৯ জুন, ২০১৫ তারিখে জাতীয় সংসদে নিজের দেয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তৃতায় মুহিত বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধাকেই বড় করে দেখেছে। এটি হলো রাজনৈতিক সুস্থিতি। ‘দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সুবিবেচনা চলমান রাজনৈতিক সুস্থিতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এ প্রত্যাশা করা অমূলক হবে না বলেই আমি মনে করি। কাজেই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন বর্তমান বাংলাদেশের জন্য কোনো অসম্ভব কল্পনা কিংবা অলীক স্বপ্ন নয় বলে আমি মনে করি।’ গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই বাজেটের ওপর গত কয়েক দিন ২১৯ সংসদ সদস্য ৫৭ ঘণ্টা আলোচনা করেন।
ওই বাজেটে অর্থমন্ত্রী জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী ধরেছেন ৭ শতাংশ। বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশগুলো গ্রহণ করে ‘সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনে আনীত অর্থবিল-২০১৫’ সংসদে উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। আগামী ১ জুলাই নতুন অর্থবছরের শুরুতে এই বাজেট কার্যকর হবে। নিজের দেয়া বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ স্বীকার করে নিয়ে মুহিত বলেন, ‘আমাদের বিগত বছরের বাজেটের পরও একই সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে গড়ে প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ মেয়াদে বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে ২০১৯-২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি। এ লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের বাজেটের আকার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে হবে। কাজেই আমাদের বাজেট কিছুটা উচ্চাভিলাষী হবে সেটাই স্বাভাবিক।’ টানা সাতটি বাজেট দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করা মুহিত বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৪.৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে জিডিপির ১৭.২ শতাংশ করা হয়েছে।
বিগত অর্থবছরগুলোতে দক্ষতার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় সক্ষমতা ৯১ শতাংশ। এই সক্ষমতা এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের বাস্তবায়ন সক্ষমতা আছে বিধায় ২০০৮-০৯ সালে যে বাজেট ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার তাকে আমরা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত করতে পেরেছি।’ বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, অনেকে সংশয় প্রকাশ করলেও তাও পূরণে আশাবাদী মুহিত।
গত দু-তিন বছরে বিভিন্ন সময়কালে অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটা বাজেটের আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ করে না। অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রভাব প্রমিত প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করা দুরূহ। যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় ছিল তখন বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব হয়েছে বলে তথ্যও সংসদে উপস্থাপন করেন মুহিত। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৭ শতাংশই অর্জিত হয়েছিল। অর্থাৎ স্বাভাবিক বছরগুলোতে আর্থিক কাঠামোর তেমন কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়নি, এটাই তার প্রমাণ, বলেন তিনি। বাজেট ঘাটতি নিয়ে সমালোচনাকে ‘অহেতুক’ বলে উড়িয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বলা হচ্ছে, বাজেট ঘাটতির আকার অনেক বড়, ঘাটতি অর্থ সংস্থানে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ গ্রহণ করলে তাতে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইত্যাদি।’ এবারের বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। সরকারের প্রাজ্ঞ রাজস্বনীতি অনুসরণের ফলে বাজেট ঘাটতি কখনোই গত ছয় বছরে জিডিপির ৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। প্রকৃতপক্ষে, ২০০৯-১০ হতে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি ছিল গড়ে জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় পরিমিত বলেও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলেন মুহিত। ২০১৪ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত (৭.২), শ্রীলঙ্কা (৫.৯) ও মালদ্বীপ (১০.৬) বাজেটে ঘাটতির তুলনায় আমাদের বাজেট ঘাটতি বেশ কম। ঘাটতি অর্থায়নের মাধ্যমে প্রাক্কলিত বাজেট বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে সার্বিক সুরক্ষা ও কল্যাণমূলক অনেক কার্যক্রম সংকোচনের প্রয়োজন পড়ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মুহিত বলেন, ‘শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, বৈরিতা এবং এক ধরনের নির্বোধ দেশশত্রুতার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, সব প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে আমাদের কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সাধারণ জনগণ তাদের শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে এই অগ্রগতির চাকা সচল রেখেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের এই অগ্রযাত্রা থাকবে নিয়ত সঞ্চরণশীল। আমি বরাবরই এদেশের অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আবারো পুনরাবৃত্তি করব যে, আমি অশোধনীয় আশাবাদী।’ এমনি আশাবাদী বক্তৃতার পরদিন শুনুন একই ব্যক্তির আরেকটি সমাপনী বয়ান।
জালিয়াত ধরতে বাধা দলীয় লোকজন: মুহিত দলের মধ্য থেকে ‘বাধা’ পাওয়ায় হল-মার্ক জালিয়াতির আসামি সব ব্যাংক কর্মকর্তাকে ধরতে পারছেন না বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সরকারি দলের নেতারা জড়িত বলে অর্থমন্ত্রীর এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এলো।
মঙ্গলবার সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পাসের আগে ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মুহিত বলেন, ‘আমরা সোনালী ব্যাংকের একজন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জেলে নিতে সক্ষম হই। তিনি জেলেই মারা গেছেন। আরেকজন মনে হয়, ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জেলে নেয়া হয়েছে। আরো কয়েকজন ডিরেক্টরকে আমি কোনো মতেই জেলে নিতে পারছি না। এরা সবাই আসামি, জালিয়াতির আসামি। এরা আমাদের লোকজনের সমর্থনে বাইরে রয়েছে। আমি এটাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।’ ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর তার তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। ওই ঋণের আড়াই হাজার কোটি টাকাই নিয়েছে হল-মার্ক গ্রুপ, যার এমডি তানভির মাহমুদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক একেএম আজিজুর রহমান গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখনো পলাতক। সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ মঞ্জুরের দাবির বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। আমরা কিসের মাঝে আছি? এই টাকা জনগণের টাকা। এর বিচার হয়নি।’ কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থার জন্য আমার এই ছাঁটাই প্রস্তাব।’ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘৫৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ! সোনালী নাম শুনলে আঁতকে উঠি।’ সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই ব্যাংকে কাজ করলে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। সেটার যখন ঘাটতি হয়, তখন অনেক অসুবিধা হয়। আমাদের কিছু ঘাটতি হয়েছে সোনালী ব্যাংকে, বেসিক ব্যাংকে ...। তার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। এই ধরনের শাস্তি যেটা কোনোদিনই বাংলাদেশে হয়নি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর তো দূরের কথা, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর... আনথিংকেবল। এতদিন কেউ সাহস করেনি এদের টাচ্ করতে। আমি তাদের জেলে নিয়েছি।’ তবে ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কাজটি গতিশীল নয় বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একেবারে যে স্পিডে যাওয়া উচিত, সে স্পিডে যেতে পারছি না।’ বেসিক ব্যাংক প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ করেছি। তারা অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্ট ঠিক করছে। সে রিপোর্ট পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইতোমধ্যে আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুষ্টু লোক দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে।’ খেলাপি ঋণের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন করার আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি অবশ্যই তার জবাব দেবেন। পরপর দুদিনের মুহিতীয় দুটি বয়ান, একদিকে চিত্তহিল্লোলিত করে। অন্যদিকে ভয়াল আশঙ্কিত করে তুলছে। শাসকদলের লুটপাটপটু কাউকে কাউকে যতটুকু জানি, ওরা মুহিত-ওজারতির কাল ঘনিয়ে আনতে পাগলপারা। মুহিতের হিতভাবনা, হিতউদ্যোগের ইতি ঘটাতে ওরা ওই বাজেট-অন্তিম বক্তৃতাটিকে ব্যবহারে এতটুকু ছাড় দেবেন মনে হয় না।
লেখক: গবেষক ও রম্যলেখক
সোমবার ২৯ জুন, ২০১৫ তারিখে জাতীয় সংসদে নিজের দেয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তৃতায় মুহিত বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা তুলে ধরে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বাধাকেই বড় করে দেখেছে। এটি হলো রাজনৈতিক সুস্থিতি। ‘দেশের জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সুবিবেচনা চলমান রাজনৈতিক সুস্থিতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে, এ প্রত্যাশা করা অমূলক হবে না বলেই আমি মনে করি। কাজেই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন বর্তমান বাংলাদেশের জন্য কোনো অসম্ভব কল্পনা কিংবা অলীক স্বপ্ন নয় বলে আমি মনে করি।’ গত ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই বাজেটের ওপর গত কয়েক দিন ২১৯ সংসদ সদস্য ৫৭ ঘণ্টা আলোচনা করেন।
ওই বাজেটে অর্থমন্ত্রী জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্থমন্ত্রী ধরেছেন ৭ শতাংশ। বিদায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী, অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশগুলো গ্রহণ করে ‘সরকারের আর্থিক প্রস্তাবাবলি কার্যকরণ এবং কতিপয় আইন সংশোধনে আনীত অর্থবিল-২০১৫’ সংসদে উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। আগামী ১ জুলাই নতুন অর্থবছরের শুরুতে এই বাজেট কার্যকর হবে। নিজের দেয়া বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ স্বীকার করে নিয়ে মুহিত বলেন, ‘আমাদের বিগত বছরের বাজেটের পরও একই সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে গড়ে প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ মেয়াদে বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে ২০১৯-২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা আমরা নির্ধারণ করেছি। এ লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের বাজেটের আকার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে হবে। কাজেই আমাদের বাজেট কিছুটা উচ্চাভিলাষী হবে সেটাই স্বাভাবিক।’ টানা সাতটি বাজেট দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করা মুহিত বলেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৪.৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে জিডিপির ১৭.২ শতাংশ করা হয়েছে।
বিগত অর্থবছরগুলোতে দক্ষতার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়নের দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় সক্ষমতা ৯১ শতাংশ। এই সক্ষমতা এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের বাস্তবায়ন সক্ষমতা আছে বিধায় ২০০৮-০৯ সালে যে বাজেট ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার তাকে আমরা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত করতে পেরেছি।’ বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, অনেকে সংশয় প্রকাশ করলেও তাও পূরণে আশাবাদী মুহিত।
গত দু-তিন বছরে বিভিন্ন সময়কালে অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটা বাজেটের আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ করে না। অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রভাব প্রমিত প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করা দুরূহ। যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় ছিল তখন বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ সম্ভব হয়েছে বলে তথ্যও সংসদে উপস্থাপন করেন মুহিত। ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯২ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৭ শতাংশই অর্জিত হয়েছিল। অর্থাৎ স্বাভাবিক বছরগুলোতে আর্থিক কাঠামোর তেমন কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়নি, এটাই তার প্রমাণ, বলেন তিনি। বাজেট ঘাটতি নিয়ে সমালোচনাকে ‘অহেতুক’ বলে উড়িয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বলা হচ্ছে, বাজেট ঘাটতির আকার অনেক বড়, ঘাটতি অর্থ সংস্থানে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ গ্রহণ করলে তাতে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইত্যাদি।’ এবারের বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ। সরকারের প্রাজ্ঞ রাজস্বনীতি অনুসরণের ফলে বাজেট ঘাটতি কখনোই গত ছয় বছরে জিডিপির ৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। প্রকৃতপক্ষে, ২০০৯-১০ হতে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি ছিল গড়ে জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় পরিমিত বলেও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বলেন মুহিত। ২০১৪ সালে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত (৭.২), শ্রীলঙ্কা (৫.৯) ও মালদ্বীপ (১০.৬) বাজেটে ঘাটতির তুলনায় আমাদের বাজেট ঘাটতি বেশ কম। ঘাটতি অর্থায়নের মাধ্যমে প্রাক্কলিত বাজেট বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে সার্বিক সুরক্ষা ও কল্যাণমূলক অনেক কার্যক্রম সংকোচনের প্রয়োজন পড়ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মুহিত বলেন, ‘শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, বৈরিতা এবং এক ধরনের নির্বোধ দেশশত্রুতার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, সব প্রতিবন্ধকতা তুচ্ছ করে আমাদের কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সাধারণ জনগণ তাদের শ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও আন্তরিকতা দিয়ে এই অগ্রগতির চাকা সচল রেখেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের এই অগ্রযাত্রা থাকবে নিয়ত সঞ্চরণশীল। আমি বরাবরই এদেশের অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আবারো পুনরাবৃত্তি করব যে, আমি অশোধনীয় আশাবাদী।’ এমনি আশাবাদী বক্তৃতার পরদিন শুনুন একই ব্যক্তির আরেকটি সমাপনী বয়ান।
জালিয়াত ধরতে বাধা দলীয় লোকজন: মুহিত দলের মধ্য থেকে ‘বাধা’ পাওয়ায় হল-মার্ক জালিয়াতির আসামি সব ব্যাংক কর্মকর্তাকে ধরতে পারছেন না বলে ক্ষোভ জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সরকারি দলের নেতারা জড়িত বলে অর্থমন্ত্রীর এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এলো।
মঙ্গলবার সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পাসের আগে ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় মুহিত বলেন, ‘আমরা সোনালী ব্যাংকের একজন ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জেলে নিতে সক্ষম হই। তিনি জেলেই মারা গেছেন। আরেকজন মনে হয়, ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জেলে নেয়া হয়েছে। আরো কয়েকজন ডিরেক্টরকে আমি কোনো মতেই জেলে নিতে পারছি না। এরা সবাই আসামি, জালিয়াতির আসামি। এরা আমাদের লোকজনের সমর্থনে বাইরে রয়েছে। আমি এটাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।’ ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর তার তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। ওই ঋণের আড়াই হাজার কোটি টাকাই নিয়েছে হল-মার্ক গ্রুপ, যার এমডি তানভির মাহমুদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে সোনালী ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক একেএম আজিজুর রহমান গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখনো পলাতক। সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ মঞ্জুরের দাবির বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। আমরা কিসের মাঝে আছি? এই টাকা জনগণের টাকা। এর বিচার হয়নি।’ কুমিল্লা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থার জন্য আমার এই ছাঁটাই প্রস্তাব।’ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘৫৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ! সোনালী নাম শুনলে আঁতকে উঠি।’ সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই ব্যাংকে কাজ করলে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রয়োজন। সেটার যখন ঘাটতি হয়, তখন অনেক অসুবিধা হয়। আমাদের কিছু ঘাটতি হয়েছে সোনালী ব্যাংকে, বেসিক ব্যাংকে ...। তার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। এই ধরনের শাস্তি যেটা কোনোদিনই বাংলাদেশে হয়নি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর তো দূরের কথা, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর... আনথিংকেবল। এতদিন কেউ সাহস করেনি এদের টাচ্ করতে। আমি তাদের জেলে নিয়েছি।’ তবে ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কাজটি গতিশীল নয় বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘একেবারে যে স্পিডে যাওয়া উচিত, সে স্পিডে যেতে পারছি না।’ বেসিক ব্যাংক প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ করেছি। তারা অনুসন্ধান চালিয়ে রিপোর্ট ঠিক করছে। সে রিপোর্ট পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইতোমধ্যে আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুষ্টু লোক দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে।’ খেলাপি ঋণের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন করার আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি অবশ্যই তার জবাব দেবেন। পরপর দুদিনের মুহিতীয় দুটি বয়ান, একদিকে চিত্তহিল্লোলিত করে। অন্যদিকে ভয়াল আশঙ্কিত করে তুলছে। শাসকদলের লুটপাটপটু কাউকে কাউকে যতটুকু জানি, ওরা মুহিত-ওজারতির কাল ঘনিয়ে আনতে পাগলপারা। মুহিতের হিতভাবনা, হিতউদ্যোগের ইতি ঘটাতে ওরা ওই বাজেট-অন্তিম বক্তৃতাটিকে ব্যবহারে এতটুকু ছাড় দেবেন মনে হয় না।
লেখক: গবেষক ও রম্যলেখক
No comments