রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রযুক্তি পরিবর্তন করা হচ্ছে by অরুণ কর্মকার
রূপপুর
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরের প্রযুক্তি পরিবর্তন করা হচ্ছে।
আগে নির্ধারণ করা হয়েছিল এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তৃতীয় প্রজন্মের
(জেনারেশন থ্রি) ‘ভিভিইআর-১০০০’ প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর। এখন তা পরিবর্তন
করে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ‘ভিভিইআর-টিওআই’ (থ্রি প্লাস জেনারেশন)
প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে।
সরকারের ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্স’-এর একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তি পরিবর্তন নীতিগতভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিনিধিদল রাশিয়া সফর করে এই প্রযুক্তির দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছে। এরপর ৫ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তাতে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টি চূড়ান্তই বলা যায়।
এ ছাড়া কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ দলের রাশিয়া সফর এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে রূপপুর প্রকল্পের অর্থায়ন ও চূড়ান্ত চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সইয়ের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে ওই সূত্রে জানা গেছে।
রূপপুর প্রকল্পের সূত্রগুলো জানায়, প্রকল্পটি বাংলাদেশের হলেও প্রযুক্তি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত রাশিয়া। প্রকল্পের শুরু থেকে দেশে এবং প্রবাসে কর্মরত ও অভিজ্ঞ বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি পরিবর্তনের কথা বলে এসেছেন। তাঁদের কথায় অবশ্য সরকার কখনোই কান দেয়নি। এখন সবুজ সংকেত দিয়েছে সরকার।
সূত্রগুলো জানায়, রূপপুর কেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ‘নিঝনি নভগোরাদ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’-এর (রুশ ভাষার আদ্যক্ষরে এনআইএইপি) মহাপরিচালক ভ্যালেরি লিমারেঙ্কো গত জুন মাসে কয়েক ঘণ্টার এক সফরে ঢাকা এসে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবহিত করেন। এরপর পূর্বোক্ত প্রতিনিধিদলের রাশিয়া সফর ও ঢাকায় সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এখন সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে নতুন প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে এনআইএইপি।
চুক্তি সইয়ের বিষয়ে সূত্রগুলো জানায়, আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি সই হবে। সেই চুক্তিতে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত হবে। ‘ভিভিইআর টিওআই’ রাশিয়ার ‘ভিভিইআর ১২০০’ মডেলের রিঅ্যাক্টরের রপ্তানি সংস্করণ। অর্থাৎ রাশিয়া তাদের ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ‘ভিভিইআর টিওআই’ নামে বিদেশে রপ্তানি করবে। রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক (থ্রি প্লাস জেনারেশন) প্রযুক্তির ওই রিঅ্যাক্টর এখন পর্যন্ত শুধু রাশিয়ার নভোভারোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া পৃথিবীর কোথাও স্থাপন করা হয়নি। নভোভারোনেঝ কেন্দ্রটি এখন পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেটি রাশিয়ার জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ ছাড়া, লেনিনগ্রাদে এই প্রযুক্তির একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে তারা। রাশিয়ার বাইরে সম্ভবত রূপপুরেই এই রিঅ্যাক্টর প্রথম স্থাপিত হতে যাচ্ছে। এটি এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত সবচেয়ে নিরাপদ পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বলে দাবি রুশ কর্তৃপক্ষের।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলের রিঅ্যাক্টর ইউরোপীয় মানসম্পন্ন। রূপপুরে এই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হলে নিরাপত্তা (সেফটি) নিয়ে আর আপত্তি উঠবে না। দুশ্চিন্তাও থাকবে না।
আবদুল মতিন বলেন, আগে যে মডেলটি নির্ধারণ করা হয়েছিল (ভিভিইআর ১০০০), সেটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মডেলের কোনো রিঅ্যাক্টর ছিল না। ওই মডেলের সঙ্গে একেকটি দেশ নিজেদের বা অন্য দেশ থেকে কিছু কিছু যন্ত্রাংশ এনে ব্যবহার করেছে। যেমন চীন রাশিয়ার কাছ থেকে ‘ভিভিইআর ১০০০’ মডেলের রিঅ্যাক্টর নিয়ে তা চালানোর কন্ট্রোল প্যানেল এনেছে ইউরোপ থেকে। ভারত কুদনকুলাম কেন্দ্রে ওই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টরের সঙ্গে নিজেদের উদ্ভাবিত কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। কিন্তু ইউরোপ ‘ভিভিইআর ১০০০’ মডেলটি গ্রহণ করেনি। তাই ইউরোপের বাজার ধরার জন্য রাশিয়া ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলটি উদ্ভাবন করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই পরমাণু প্রকৌশলী বলেন, ‘ভিভিইআর ১০০০’ ও ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলের রিঅ্যাক্টরের দামে খুব বড় একটা হেরফের হওয়ার কথা নয়। মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ও মডেলের দাম অপেক্ষাকৃত কম হয়। তা ছাড়া নতুন মডেলের রিঅ্যাক্টর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার হওয়ায় বিদ্যুৎ অনেক বেশি পাওয়া যাবে। সে তুলনায় দাম বেশি হবে না বলে তাঁর ধারণা।
সরকার রূপপুর প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি (১২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই প্রকল্পে রাশিয়া সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে (সমীক্ষার ব্যয় ৫৫ কোটি ডলারসহ)।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্সের সূত্র জানায়, সরকারের পূর্ব ধারণার চেয়ে রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। তবে এর কারণ শুধু প্রযুক্তি পরিবর্তন নয়, প্রকল্প এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং পানিস্বল্পতাও ব্যয় বৃদ্ধির বড় কারণ। রুশ বিশেষজ্ঞরা সরকারকে জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রূপপুরে তাঁদের বিশেষ কিছু কারিগরি কর্মকাণ্ড করতে হবে, যেগুলোকে সহজ কাজ বলা যায় না। সেখানে যে স্থাপনা করা হবে, তা হতে হবে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। কিন্তু রূপপুরের মাটি নরম ও বেলে প্রকৃতির।
এর আগে, গত ফেব্রুয়ারিতে রোসাতোমের আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান, রূপপুরে সমীক্ষা পরিচালনায় নিয়োজিত অ্যাটমপ্রয়েক্ট-এর বিশেষজ্ঞরা রূপপুর প্রকল্পের জন্য কুলিং টাওয়ার (বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা রাখতে সীমিত পরিমাণ পানি ব্যবহারের জন্য নির্মিত স্থাপনা) তৈরি করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ বর্তমানে পদ্মায় পানির যে প্রাপ্যতা, তা (কুলিং টাওয়ার করা না হলে) রূপপুর প্রকল্পের জন্য যথেষ্ট হবে না।
এ বিষয়েও দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকে বলে এসেছেন, পদ্মা নদীতে বর্তমানে পানির যে প্রাপ্যতা, তা দিয়ে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার (ভিভিইআর টিওআই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হলে ক্ষমতা হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। তাঁরা ‘ভিভিইআর ১০০০’ প্রযুক্তি পরিবর্তন এবং রূপপুরে ভূমিকম্পের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে এসেছেন। তবে সরকার কখনোই তাঁদের কথায় কান দেয়নি। এখন রুশদের সুপারিশের সঙ্গে ওই বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু একটি বিষয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ও অভিমত এখনো উপেক্ষিত আছে। বিষয়টি হলো রূপপুর প্রকল্পের জন্য দক্ষ জনবলের অভাব। আবদুল মতিন এবং আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আরও পরে এ বিষয়টি অনুধাবন করবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। কিন্তু ২০০৯-১০ সাল থেকে দক্ষ জনবল তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনায় দেশ যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারত, তা আর সম্ভব হবে না।
রূপপুর প্রকল্পের বর্তমান বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় দুই বছর মেয়াদি সমীক্ষার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নের কাজও (মস্কোতে) চলেছে। আগামী নভেম্বরে এসব কাজ শেষ হবে। তারপর সই হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত চুক্তি।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার চেষ্টা করছে, আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অতিথি করে আনার। তা সম্ভব হলে তখনই দুই দেশের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তিটি সই হবে। আর পুতিনের আসা সম্ভব না হলে নভেম্বরে চুক্তি হবে। এর আগে প্রকল্পের জন্য তিনটি আলাদা চুক্তি সই হয়েছে। প্রথম চুক্তির বিষয় হচ্ছে সমীক্ষা চালানো। দ্বিতীয় চুক্তি হয়েছে প্রকল্পের মৌলিক নকশা প্রণয়নের বিষয়ে। তৃতীয় চুক্তির বিষয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণস্থলে ভৌত অবকাঠামো তৈরি। এই তিনটি কাজই যুগপৎভাবে চলেছে।
২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ উদ্বোধন করেন। প্রকল্প এলাকার আবহাওয়া, ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, পানি পরিস্থিতি, ভূমিকম্প ও মাটির বিভিন্ন ধরনের অনুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম পর্যায় শেষে গত বছর নভেম্বরে সরকারকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের সমীক্ষাও এখন শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় নির্ধারিত হবে সমীক্ষার ফলাফল এবং ব্যবহৃত প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে।
সরকার ২০২০-২১ সালে প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিট চালু করার পরিকল্পনা ২০২৩ সালে।
সরকারের ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্স’-এর একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তি পরিবর্তন নীতিগতভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের একটি প্রতিনিধিদল রাশিয়া সফর করে এই প্রযুক্তির দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করেছে। এরপর ৫ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তাতে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টি চূড়ান্তই বলা যায়।
এ ছাড়া কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ দলের রাশিয়া সফর এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে রূপপুর প্রকল্পের অর্থায়ন ও চূড়ান্ত চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্ট) সইয়ের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে ওই সূত্রে জানা গেছে।
রূপপুর প্রকল্পের সূত্রগুলো জানায়, প্রকল্পটি বাংলাদেশের হলেও প্রযুক্তি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত রাশিয়া। প্রকল্পের শুরু থেকে দেশে এবং প্রবাসে কর্মরত ও অভিজ্ঞ বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রযুক্তি পরিবর্তনের কথা বলে এসেছেন। তাঁদের কথায় অবশ্য সরকার কখনোই কান দেয়নি। এখন সবুজ সংকেত দিয়েছে সরকার।
সূত্রগুলো জানায়, রূপপুর কেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নকারী রুশ প্রতিষ্ঠান ‘নিঝনি নভগোরাদ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’-এর (রুশ ভাষার আদ্যক্ষরে এনআইএইপি) মহাপরিচালক ভ্যালেরি লিমারেঙ্কো গত জুন মাসে কয়েক ঘণ্টার এক সফরে ঢাকা এসে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে প্রথম সরকারের নীতিনির্ধারকদের অবহিত করেন। এরপর পূর্বোক্ত প্রতিনিধিদলের রাশিয়া সফর ও ঢাকায় সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এখন সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে নতুন প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে এনআইএইপি।
চুক্তি সইয়ের বিষয়ে সূত্রগুলো জানায়, আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি সই হবে। সেই চুক্তিতে প্রযুক্তি পরিবর্তনের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত হবে। ‘ভিভিইআর টিওআই’ রাশিয়ার ‘ভিভিইআর ১২০০’ মডেলের রিঅ্যাক্টরের রপ্তানি সংস্করণ। অর্থাৎ রাশিয়া তাদের ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ‘ভিভিইআর টিওআই’ নামে বিদেশে রপ্তানি করবে। রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত সর্বাধুনিক (থ্রি প্লাস জেনারেশন) প্রযুক্তির ওই রিঅ্যাক্টর এখন পর্যন্ত শুধু রাশিয়ার নভোভারোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া পৃথিবীর কোথাও স্থাপন করা হয়নি। নভোভারোনেঝ কেন্দ্রটি এখন পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেটি রাশিয়ার জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এ ছাড়া, লেনিনগ্রাদে এই প্রযুক্তির একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে তারা। রাশিয়ার বাইরে সম্ভবত রূপপুরেই এই রিঅ্যাক্টর প্রথম স্থাপিত হতে যাচ্ছে। এটি এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত সবচেয়ে নিরাপদ পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর বলে দাবি রুশ কর্তৃপক্ষের।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলের রিঅ্যাক্টর ইউরোপীয় মানসম্পন্ন। রূপপুরে এই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হলে নিরাপত্তা (সেফটি) নিয়ে আর আপত্তি উঠবে না। দুশ্চিন্তাও থাকবে না।
আবদুল মতিন বলেন, আগে যে মডেলটি নির্ধারণ করা হয়েছিল (ভিভিইআর ১০০০), সেটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মডেলের কোনো রিঅ্যাক্টর ছিল না। ওই মডেলের সঙ্গে একেকটি দেশ নিজেদের বা অন্য দেশ থেকে কিছু কিছু যন্ত্রাংশ এনে ব্যবহার করেছে। যেমন চীন রাশিয়ার কাছ থেকে ‘ভিভিইআর ১০০০’ মডেলের রিঅ্যাক্টর নিয়ে তা চালানোর কন্ট্রোল প্যানেল এনেছে ইউরোপ থেকে। ভারত কুদনকুলাম কেন্দ্রে ওই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টরের সঙ্গে নিজেদের উদ্ভাবিত কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। কিন্তু ইউরোপ ‘ভিভিইআর ১০০০’ মডেলটি গ্রহণ করেনি। তাই ইউরোপের বাজার ধরার জন্য রাশিয়া ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলটি উদ্ভাবন করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট এই পরমাণু প্রকৌশলী বলেন, ‘ভিভিইআর ১০০০’ ও ‘ভিভিইআর টিওআই’ মডেলের রিঅ্যাক্টরের দামে খুব বড় একটা হেরফের হওয়ার কথা নয়। মানসম্পন্ন প্রযুক্তি ও মডেলের দাম অপেক্ষাকৃত কম হয়। তা ছাড়া নতুন মডেলের রিঅ্যাক্টর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার হওয়ায় বিদ্যুৎ অনেক বেশি পাওয়া যাবে। সে তুলনায় দাম বেশি হবে না বলে তাঁর ধারণা।
সরকার রূপপুর প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি (১২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। এই প্রকল্পে রাশিয়া সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ দেওয়ার কথা রয়েছে। সে হিসাবে প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে (সমীক্ষার ব্যয় ৫৫ কোটি ডলারসহ)।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্সের সূত্র জানায়, সরকারের পূর্ব ধারণার চেয়ে রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে। তবে এর কারণ শুধু প্রযুক্তি পরিবর্তন নয়, প্রকল্প এলাকার ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং পানিস্বল্পতাও ব্যয় বৃদ্ধির বড় কারণ। রুশ বিশেষজ্ঞরা সরকারকে জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রূপপুরে তাঁদের বিশেষ কিছু কারিগরি কর্মকাণ্ড করতে হবে, যেগুলোকে সহজ কাজ বলা যায় না। সেখানে যে স্থাপনা করা হবে, তা হতে হবে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল। কিন্তু রূপপুরের মাটি নরম ও বেলে প্রকৃতির।
এর আগে, গত ফেব্রুয়ারিতে রোসাতোমের আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান, রূপপুরে সমীক্ষা পরিচালনায় নিয়োজিত অ্যাটমপ্রয়েক্ট-এর বিশেষজ্ঞরা রূপপুর প্রকল্পের জন্য কুলিং টাওয়ার (বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টর ঠান্ডা রাখতে সীমিত পরিমাণ পানি ব্যবহারের জন্য নির্মিত স্থাপনা) তৈরি করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ বর্তমানে পদ্মায় পানির যে প্রাপ্যতা, তা (কুলিং টাওয়ার করা না হলে) রূপপুর প্রকল্পের জন্য যথেষ্ট হবে না।
এ বিষয়েও দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকে বলে এসেছেন, পদ্মা নদীতে বর্তমানে পানির যে প্রাপ্যতা, তা দিয়ে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার (ভিভিইআর টিওআই প্রযুক্তির রিঅ্যাক্টর ব্যবহার করা হলে ক্ষমতা হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট) পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। তাঁরা ‘ভিভিইআর ১০০০’ প্রযুক্তি পরিবর্তন এবং রূপপুরে ভূমিকম্পের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলে এসেছেন। তবে সরকার কখনোই তাঁদের কথায় কান দেয়নি। এখন রুশদের সুপারিশের সঙ্গে ওই বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যের হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু একটি বিষয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য ও অভিমত এখনো উপেক্ষিত আছে। বিষয়টি হলো রূপপুর প্রকল্পের জন্য দক্ষ জনবলের অভাব। আবদুল মতিন এবং আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার আরও পরে এ বিষয়টি অনুধাবন করবে বলে তাঁদের বিশ্বাস। কিন্তু ২০০৯-১০ সাল থেকে দক্ষ জনবল তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও পরিচালনায় দেশ যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারত, তা আর সম্ভব হবে না।
রূপপুর প্রকল্পের বর্তমান বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সম্পর্কে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, প্রকল্প এলাকায় দুই বছর মেয়াদি সমীক্ষার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি রিঅ্যাক্টরের নকশা প্রণয়নের কাজও (মস্কোতে) চলেছে। আগামী নভেম্বরে এসব কাজ শেষ হবে। তারপর সই হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত চুক্তি।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার চেষ্টা করছে, আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে অতিথি করে আনার। তা সম্ভব হলে তখনই দুই দেশের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তিটি সই হবে। আর পুতিনের আসা সম্ভব না হলে নভেম্বরে চুক্তি হবে। এর আগে প্রকল্পের জন্য তিনটি আলাদা চুক্তি সই হয়েছে। প্রথম চুক্তির বিষয় হচ্ছে সমীক্ষা চালানো। দ্বিতীয় চুক্তি হয়েছে প্রকল্পের মৌলিক নকশা প্রণয়নের বিষয়ে। তৃতীয় চুক্তির বিষয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণস্থলে ভৌত অবকাঠামো তৈরি। এই তিনটি কাজই যুগপৎভাবে চলেছে।
২০১৩ সালের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ উদ্বোধন করেন। প্রকল্প এলাকার আবহাওয়া, ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, পানি পরিস্থিতি, ভূমিকম্প ও মাটির বিভিন্ন ধরনের অনুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এর প্রথম পর্যায় শেষে গত বছর নভেম্বরে সরকারকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের সমীক্ষাও এখন শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় নির্ধারিত হবে সমীক্ষার ফলাফল এবং ব্যবহৃত প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে।
সরকার ২০২০-২১ সালে প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। দ্বিতীয় ইউনিট চালু করার পরিকল্পনা ২০২৩ সালে।
No comments