কুরআনে মহান স্রষ্টাই আমাদের উদ্দেশে কথা বলছেন by প্রফেসর ওয়াল্টার ওয়াগনার
[অনেক
বছর ধরে কুরআন শরিফ সতর্কতার সাথে অধ্যয়ন করে নেতৃস্থানীয় আমেরিকান গবেষক
প্রফেসর ওয়াগনার এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে, এই পবিত্র গ্রন্থের মাধ্যমে
আল্লাহ তায়ালা বিশ্বের সব মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। এই বক্তব্যই
ওয়াগনার পাঠক, শিক্ষার্থী এমনকি নিজেকেও জানাতে চেয়েছেন গভীরতর উপলব্ধির
জন্য। তার লেখা ওপেনিং দি কুরআন (কুরআনকে উন্মুক্ত করা) একটি বিস্ময়কর বই,
যা মুসলিম-অমুসলিম এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী নির্বিশেষে সবাইকে প্রেরণা জোগাবে।
বইটিতে অনন্যভঙ্গিতে ধাপে ধাপে আল কুরআনের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি আংকারা থেকে প্রকাশিত সানডে’জ জামান পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে
কুরআনের সাথে তার পরিচয় সম্পর্কে বিশদ বলেছেন।]
প্রশ্ন : প্রথমে আপনি খ্রিষ্টধর্মের আদিযুগের ওপর কাজ করছিলেন। তাই জানতে ইচ্ছা করে, আল কুরআন সম্পর্কে বই লেখার প্রেরণা পেলেন কিভাবে?
উত্তর : বিশ বছরেরও বেশি দিন ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে এটি লিখেছি। আমি মনে করি, মাত্র কুরআন বুঝতে শুরু করেছি। তবে প্রকৃতপক্ষে ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে শুধু ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতি নয়, ইতিহাসের দিক দিয়েও সম্পর্ক রয়েছে।
অতীতে কোনো কোনো সময়ে আমরা একে অন্যের মাথায় মাথা লাগিয়ে ধাক্কা মেরেছি, অন্যান্য সময়ে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে হয়েছি লিপ্ত। তবে আমরা একই স্রষ্টার উপাসনা করি। অভিজ্ঞতা থেকে বলব, এই উপাসনার জন্য অন্যের ধর্মকে বোঝার পথ খোলা রাখা চাই।
আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, মুসলিম নারী-পুরুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি! বিশেষ করে তুর্কি সম্প্রদায়কে জেনেছি গত সাত বছর। পূর্বোক্ত বইটি লেখার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, পরস্পরকে বোঝা যখন জরুরি, তখন প্রথমে নিজেকে বিষয়টি বুঝানো এবং এরপর অন্যদেরকে বুঝিয়ে বলা।
প্রশ্ন : আপনি যখন কুরআন শরিফ পড়ছিলেন, তখন কার কণ্ঠের কথা আপনার মনে পড়েছিল? কথা বলছিলেন কে?
উত্তর : আমি বিশ্বাস করি, কুরআন প্রত্যাদেশমূলক গ্রন্থ। বিধাতা অনেক ব্যক্তি, অনেক নবী-রাসূল, বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন। কুরআনে আমাদের উদ্দেশে কথা বলে মহান স্রষ্টারই কণ্ঠ। এটি শান্তি ও সুবিচারের কণ্ঠ। এই কণ্ঠ সে সব মানুষের কথা বলে যারা শান্তিতে একত্রে থাকা দরকার মনে করে আর প্রয়োজন বোধ করে বিশ্বের অন্য সবার জন্য এক হয়ে কাজ করার। আমি সেই কণ্ঠ শুনেছি। সেই কণ্ঠ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের এবং আমার উপলব্ধি গভীর করার জন্য নিজেকেও শোনাতে চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনি আরবি পড়তে পারেন কি না নিশ্চিত নই। সম্ভবত অনুবাদের ওপর জোর দিয়েছেন। কিভাবে কাজ করেছেন, অধ্যয়ন করলেন?
উত্তর : অমুসলিম হিসেবে কুরআন প্রথম কয়েক দফা পড়াটা সম্ভবত বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমরা যারা বাইবেলের ঐতিহ্য থেকে এসেছি, তাদের প্রত্যাশা হলো কুরআনেও বাইবেলের জেনেসিস, এক্সোডাস কিংবা গসপেল অব মার্কের মতো বিভিন্ন অধ্যায়ের দেখা পাবো। হ্যাঁ, কুরআনেও বিভিন্ন অংশে ভাগ করা আছে। সবগুলো মিলে একটি পূর্ণরূপ পেয়েছে। কুরআন বারবার পড়তে হয়। এ বিষয়ে চিন্তা করতে হয় বারবার আর বোঝার জন্য মাথা চুলকাতে হয় বহুবার। তবে আমি মনে করি, প্রথম পদক্ষেপ হলো, উৎসাহ না হারানো। পয়লা পরামর্শ দেবো, কুরআনকে পেছন থেকে শুরু করে সামনের দিকে পড়–ন নবীকে বোঝার জন্য। তাঁর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। কুরআনের সাথে অন্যরা কী বলেছেন, তা-ও পড়তে হয়।
প্রশ্ন : বাইবেলীয় ঐতিহ্য ও কুরআনের মিলগুলো কী কী, আর গরমিলই বা কী, আমাদের বলুন।
উত্তর : মৌলিক পার্থক্য হলো, বাইবেল ও কুরআনের পরস্পর থেকে ভিন্ন প্রকৃতি। অবশ্য বাইবেল ও কুরআনে অভিন্ন ত্রিশজন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। একটি বিষয় হলো (মুসলিম শিক্ষার্থীরাও যার সাক্ষ্য দেবে), উভয় গ্রন্থে কোনো কোনো সময়ে আমরা একই ভাষা ও শব্দ পাই। তবে মূলনীতি ও ধারণা পরস্পর পৃথক।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে, কুরআনের প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেক বর্ণ আল্লাহ-প্রদত্ত। বাইবেল সম্পর্কে খ্রিষ্টানরা এটা মনে করে না। নির্দিষ্ট কোনো ভাষার প্রতি খ্রিষ্টানদের বিশেষ আকর্ষণ বা শ্রদ্ধা নেই। আমরা বাইবেলের অনুবাদ পড়তেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এর পাণ্ডুলিপির বিভিন্নতা এবং একই কাহিনীর নানারকম বয়ান দেখেও আমি অস্বস্তি বোধ করি না। মুসলিম ছাত্রছাত্রী জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘আসল ঘটনা কী?’ খ্রিষ্টান হিসেবে আমার কাছে এটা সমস্যা নয়। তবে শিক্ষক হিসেবে মুসলমানদের কাছে এর ব্যাখ্যা দেয়া এবং মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা অভিন্ন অনেক নবীর ওপর বিশ্বাস রাখি। তবুও তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা পৃথক। আমাদের উভয়ের একই বিশ্বাস যা, তা হলো একজন মহান সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি তাঁর প্রতি বাধ্য থাকতে বলেন। তিনি বিশ্বাসীদের একটি সমাজ নির্মাণ করতে বলেন, যারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ ও উপাসনার জন্য উৎসর্গিত। অবশ্য, বার্তাবাহক ও নবী বলতে কী বুঝায়, সে ব্যাপারে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মাঝে বড় পার্থক্য আছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন নবী শুধু ঐশী প্রত্যাদেশপ্রাপ্তই নন, তাঁকে পরিপূর্ণও হতে হবে। তাই বাইবেল পড়ে মুসলমানরা কারো কারো ব্যভিচার ও খুন করা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কারণ এগুলো ঘৃণ্য অপরাধ। তাদের প্রশ্ন, ‘যারা এমন পাপী, তোমরা তার অনুসরণ কিভাবে করতে পারো?’
প্রশ্ন : খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে ঈসা আ:, মুহাম্মদ সা: এবং অন্যদের কিভাবে চিত্রিত করা হয়েছে? তাঁদের মিল-অমিল কী কী?
উত্তর : আমার মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সব সময়ই তাদের খ্রিষ্টান সহপাঠীদের অবাক করে দেয়, যখন তারা জানায়, ‘ভালো মুসলিম হতে হলে ঈসা আ:-এর ওপরও ঈমান আনতে হবে।’ তিনি কুমারী মাতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। অলৌকিক কাজকর্ম করেছেন; তিনি ক্ষুধার্তকে খাইয়েছেন, রুগ্ণকে করেছেন সুস্থ, মৃতকে করেছিলেন পুনর্জীবিত। তাঁকে মসিহ বলা হয়। পৃথিবীর শেষ যুগে তিনি আসবেন আবার। তিনি ছিলেন শিক্ষক; তাঁর ছিল শিষ্য। তিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথ অনুসরণের দিকে। কুরআনে ঈসা আ:-কে এভাবে তুলে ধরার সাথে বাইবেলের মিল রয়েছে। অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মূল পার্থক্য হলো, ঈসা আ:-কে ক্রুশে বিদ্ধ করা এবং তাঁর পুনরুত্থান প্রসঙ্গ।
মূসা আ:-সহ অন্য নবীদের কয়েকজন প্রসঙ্গে কুরআনে যা বলা হয়েছে, তার সাথে মিল আছে ইহুদিদের বিশ্বাসে। অর্থাৎ এই দুইয়ের মাঝে সঙ্ঘাত নয়, সম্পর্ক বিদ্যমান। আর আমি সহজ কথায় যা বুঝি, তা হচ্ছে মূসা আ: এলেন এবং সরকারকাঠামো প্রতিষ্ঠা করলেন। অপর দিকে ঈসা আ: এসে মানুষকে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াই। খ্রিষ্টানরা পরবর্তীকালে এটা যোগ করেছে। নবী মুহম্মদ সা: এলেন। তিনি এমন একজন, যাঁর ‘পার্থিব’ ও ‘আধ্যাত্মিক’ দু’টি দিকই আছে। তিনি উভয়কে একত্র করেছেন। স্রষ্টা বিশ্বকে ভালোবাসেন এবং এর পরিচর্যা করেন। অতএব আপনাদেরকেও অবশ্যই এ কাজ করতে হবে। একই বিধাতা নবীদেরকে পাঠিয়েছেন।
প্রশ্ন : কুরআন অধ্যয়ন করে কিভাবে প্রভাবিত হয়েছেন? এটা কি আপনার জীবনে কোনোভাবে পরিবর্তন এনেছে?
উত্তর : এর মাধ্যমে যে ক’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে, তার একটি হলো আমি নামাজের ভিত্তিতে ইসলাম ও কুরআন বুঝতে পেরেছি। নামাজের খুবই পবিত্র একটা অনুভূতি আছে এবং নামাজের মধ্য দিয়ে একটি জীবন গড়ে তোলা যায়। ইসলাম সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ বুঝেছি। এতে ধারণা হয়েছে, এই ধর্মের ভিত্তি হলো সৃষ্টিতত্ত্ব। আমার ওপর এ বিষয়টির প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে নৈতিকভাবে।
লেখক : মার্কিন ধর্মতত্ত্ববিদ; ‘যিশুর শিষ্যদের যুগের পরে দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিষ্টধর্ম’সহ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
প্রশ্ন : প্রথমে আপনি খ্রিষ্টধর্মের আদিযুগের ওপর কাজ করছিলেন। তাই জানতে ইচ্ছা করে, আল কুরআন সম্পর্কে বই লেখার প্রেরণা পেলেন কিভাবে?
উত্তর : বিশ বছরেরও বেশি দিন ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে এটি লিখেছি। আমি মনে করি, মাত্র কুরআন বুঝতে শুরু করেছি। তবে প্রকৃতপক্ষে ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যে শুধু ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতি নয়, ইতিহাসের দিক দিয়েও সম্পর্ক রয়েছে।
অতীতে কোনো কোনো সময়ে আমরা একে অন্যের মাথায় মাথা লাগিয়ে ধাক্কা মেরেছি, অন্যান্য সময়ে সশস্ত্র সঙ্ঘাতে হয়েছি লিপ্ত। তবে আমরা একই স্রষ্টার উপাসনা করি। অভিজ্ঞতা থেকে বলব, এই উপাসনার জন্য অন্যের ধর্মকে বোঝার পথ খোলা রাখা চাই।
আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, মুসলিম নারী-পুরুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছি! বিশেষ করে তুর্কি সম্প্রদায়কে জেনেছি গত সাত বছর। পূর্বোক্ত বইটি লেখার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, পরস্পরকে বোঝা যখন জরুরি, তখন প্রথমে নিজেকে বিষয়টি বুঝানো এবং এরপর অন্যদেরকে বুঝিয়ে বলা।
প্রশ্ন : আপনি যখন কুরআন শরিফ পড়ছিলেন, তখন কার কণ্ঠের কথা আপনার মনে পড়েছিল? কথা বলছিলেন কে?
উত্তর : আমি বিশ্বাস করি, কুরআন প্রত্যাদেশমূলক গ্রন্থ। বিধাতা অনেক ব্যক্তি, অনেক নবী-রাসূল, বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রত্যাদেশ দিয়েছেন। কুরআনে আমাদের উদ্দেশে কথা বলে মহান স্রষ্টারই কণ্ঠ। এটি শান্তি ও সুবিচারের কণ্ঠ। এই কণ্ঠ সে সব মানুষের কথা বলে যারা শান্তিতে একত্রে থাকা দরকার মনে করে আর প্রয়োজন বোধ করে বিশ্বের অন্য সবার জন্য এক হয়ে কাজ করার। আমি সেই কণ্ঠ শুনেছি। সেই কণ্ঠ পাঠক ও শিক্ষার্থীদের এবং আমার উপলব্ধি গভীর করার জন্য নিজেকেও শোনাতে চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন : আপনি আরবি পড়তে পারেন কি না নিশ্চিত নই। সম্ভবত অনুবাদের ওপর জোর দিয়েছেন। কিভাবে কাজ করেছেন, অধ্যয়ন করলেন?
উত্তর : অমুসলিম হিসেবে কুরআন প্রথম কয়েক দফা পড়াটা সম্ভবত বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমরা যারা বাইবেলের ঐতিহ্য থেকে এসেছি, তাদের প্রত্যাশা হলো কুরআনেও বাইবেলের জেনেসিস, এক্সোডাস কিংবা গসপেল অব মার্কের মতো বিভিন্ন অধ্যায়ের দেখা পাবো। হ্যাঁ, কুরআনেও বিভিন্ন অংশে ভাগ করা আছে। সবগুলো মিলে একটি পূর্ণরূপ পেয়েছে। কুরআন বারবার পড়তে হয়। এ বিষয়ে চিন্তা করতে হয় বারবার আর বোঝার জন্য মাথা চুলকাতে হয় বহুবার। তবে আমি মনে করি, প্রথম পদক্ষেপ হলো, উৎসাহ না হারানো। পয়লা পরামর্শ দেবো, কুরআনকে পেছন থেকে শুরু করে সামনের দিকে পড়–ন নবীকে বোঝার জন্য। তাঁর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। কুরআনের সাথে অন্যরা কী বলেছেন, তা-ও পড়তে হয়।
প্রশ্ন : বাইবেলীয় ঐতিহ্য ও কুরআনের মিলগুলো কী কী, আর গরমিলই বা কী, আমাদের বলুন।
উত্তর : মৌলিক পার্থক্য হলো, বাইবেল ও কুরআনের পরস্পর থেকে ভিন্ন প্রকৃতি। অবশ্য বাইবেল ও কুরআনে অভিন্ন ত্রিশজন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। একটি বিষয় হলো (মুসলিম শিক্ষার্থীরাও যার সাক্ষ্য দেবে), উভয় গ্রন্থে কোনো কোনো সময়ে আমরা একই ভাষা ও শব্দ পাই। তবে মূলনীতি ও ধারণা পরস্পর পৃথক।
মুসলমানরা বিশ্বাস করে, কুরআনের প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেক বর্ণ আল্লাহ-প্রদত্ত। বাইবেল সম্পর্কে খ্রিষ্টানরা এটা মনে করে না। নির্দিষ্ট কোনো ভাষার প্রতি খ্রিষ্টানদের বিশেষ আকর্ষণ বা শ্রদ্ধা নেই। আমরা বাইবেলের অনুবাদ পড়তেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এর পাণ্ডুলিপির বিভিন্নতা এবং একই কাহিনীর নানারকম বয়ান দেখেও আমি অস্বস্তি বোধ করি না। মুসলিম ছাত্রছাত্রী জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘আসল ঘটনা কী?’ খ্রিষ্টান হিসেবে আমার কাছে এটা সমস্যা নয়। তবে শিক্ষক হিসেবে মুসলমানদের কাছে এর ব্যাখ্যা দেয়া এবং মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা খ্রিষ্টান ও মুসলিমরা অভিন্ন অনেক নবীর ওপর বিশ্বাস রাখি। তবুও তাদের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যাশা পৃথক। আমাদের উভয়ের একই বিশ্বাস যা, তা হলো একজন মহান সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি তাঁর প্রতি বাধ্য থাকতে বলেন। তিনি বিশ্বাসীদের একটি সমাজ নির্মাণ করতে বলেন, যারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ ও উপাসনার জন্য উৎসর্গিত। অবশ্য, বার্তাবাহক ও নবী বলতে কী বুঝায়, সে ব্যাপারে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মাঝে বড় পার্থক্য আছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, একজন নবী শুধু ঐশী প্রত্যাদেশপ্রাপ্তই নন, তাঁকে পরিপূর্ণও হতে হবে। তাই বাইবেল পড়ে মুসলমানরা কারো কারো ব্যভিচার ও খুন করা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। কারণ এগুলো ঘৃণ্য অপরাধ। তাদের প্রশ্ন, ‘যারা এমন পাপী, তোমরা তার অনুসরণ কিভাবে করতে পারো?’
প্রশ্ন : খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থে ঈসা আ:, মুহাম্মদ সা: এবং অন্যদের কিভাবে চিত্রিত করা হয়েছে? তাঁদের মিল-অমিল কী কী?
উত্তর : আমার মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সব সময়ই তাদের খ্রিষ্টান সহপাঠীদের অবাক করে দেয়, যখন তারা জানায়, ‘ভালো মুসলিম হতে হলে ঈসা আ:-এর ওপরও ঈমান আনতে হবে।’ তিনি কুমারী মাতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। অলৌকিক কাজকর্ম করেছেন; তিনি ক্ষুধার্তকে খাইয়েছেন, রুগ্ণকে করেছেন সুস্থ, মৃতকে করেছিলেন পুনর্জীবিত। তাঁকে মসিহ বলা হয়। পৃথিবীর শেষ যুগে তিনি আসবেন আবার। তিনি ছিলেন শিক্ষক; তাঁর ছিল শিষ্য। তিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথ অনুসরণের দিকে। কুরআনে ঈসা আ:-কে এভাবে তুলে ধরার সাথে বাইবেলের মিল রয়েছে। অবশ্য খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মূল পার্থক্য হলো, ঈসা আ:-কে ক্রুশে বিদ্ধ করা এবং তাঁর পুনরুত্থান প্রসঙ্গ।
মূসা আ:-সহ অন্য নবীদের কয়েকজন প্রসঙ্গে কুরআনে যা বলা হয়েছে, তার সাথে মিল আছে ইহুদিদের বিশ্বাসে। অর্থাৎ এই দুইয়ের মাঝে সঙ্ঘাত নয়, সম্পর্ক বিদ্যমান। আর আমি সহজ কথায় যা বুঝি, তা হচ্ছে মূসা আ: এলেন এবং সরকারকাঠামো প্রতিষ্ঠা করলেন। অপর দিকে ঈসা আ: এসে মানুষকে আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধান দিয়েছেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছাড়াই। খ্রিষ্টানরা পরবর্তীকালে এটা যোগ করেছে। নবী মুহম্মদ সা: এলেন। তিনি এমন একজন, যাঁর ‘পার্থিব’ ও ‘আধ্যাত্মিক’ দু’টি দিকই আছে। তিনি উভয়কে একত্র করেছেন। স্রষ্টা বিশ্বকে ভালোবাসেন এবং এর পরিচর্যা করেন। অতএব আপনাদেরকেও অবশ্যই এ কাজ করতে হবে। একই বিধাতা নবীদেরকে পাঠিয়েছেন।
প্রশ্ন : কুরআন অধ্যয়ন করে কিভাবে প্রভাবিত হয়েছেন? এটা কি আপনার জীবনে কোনোভাবে পরিবর্তন এনেছে?
উত্তর : এর মাধ্যমে যে ক’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে, তার একটি হলো আমি নামাজের ভিত্তিতে ইসলাম ও কুরআন বুঝতে পেরেছি। নামাজের খুবই পবিত্র একটা অনুভূতি আছে এবং নামাজের মধ্য দিয়ে একটি জীবন গড়ে তোলা যায়। ইসলাম সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ বুঝেছি। এতে ধারণা হয়েছে, এই ধর্মের ভিত্তি হলো সৃষ্টিতত্ত্ব। আমার ওপর এ বিষয়টির প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে নৈতিকভাবে।
লেখক : মার্কিন ধর্মতত্ত্ববিদ; ‘যিশুর শিষ্যদের যুগের পরে দ্বিতীয় শতাব্দীতে খ্রিষ্টধর্ম’সহ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম
No comments