মুজিকা হতে পারেন এ প্রজন্মের আইকন by এম সাখাওয়াত হোসেন
নিজের গাড়ি ভক্সওয়াগন বিটল–এ পেপে মুজিকা |
বাল্যকালে
স্কুলের পাঠ্য হিসেবে এবং তার বাইরে বহু মহৎ আর বড় বড় নেতার জীবনী
পড়েছি। পড়েছি তাঁদের নেতৃত্বের মাহাত্ম্য আর অসাধারণ গুণের কথা। অনেককেই
সেই সময় এবং এখনো আদর্শ মনে হয়। অনেকের মধ্যে পড়েছি ইসলামের দ্বিতীয়
খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর অসাধারণ গুণ আর তাঁর নেতৃত্বের অনন্য দৃষ্টান্তের
কথা। সাধারণ মানুষের নেতা হওয়ার গুণাবলির বিষয়। আমাকে ছোটবেলা থেকেই হজরত
উমরের রাষ্ট্র পরিচালনা, তাঁর নেতৃত্ব, যতটুকু পড়েছি, দারুণভাবে নাড়া
দিয়েছিল। আজও দেয়। তেমনি বাগদাদের কিংবদন্তি খলিফা হারুনুর রশিদের ইতিহাস,
অনেকের সঙ্গে তিনিও আমার ভক্তি আর সমীহের প্রতীক। আব্রাহাম লিঙ্কনসহ অনেকেই
অনুপ্রাণিত করতেন আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে। হজরত উমরের সেই অসাধারণ
গল্পগুলো পাঠ্যপুস্তকে পড়ার পর থেকে গেঁথে গিয়েছিল আমার স্মৃতিতে। আজও
মনে হয় এমন নেতা কি হতে পারে, যিনি শুধু সাধারণের মতোই থাকবেন না, তাঁর
নেতৃত্ব রেখে যাবেন এক অনন্য উদাহরণ?
আজ বিংশ শতাব্দী পার হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিশ্বে এমনতর নেতৃত্ব খোঁজা যেন অবাস্তব মনে হতো। এখন নেতাদের আড়ম্বর মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহদেরও মাঝেমধ্যে হার মানায়। অফুরন্ত ক্ষমতাধর সব শীর্ষ নেতা দেশ পরিচালনায় অনেকে জার অথবা মোগলদেরও পিছে ফেলে দেয়। এমনকি বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিকমনা নেতাদেরও বাহ্যিক চাকচিক্য এমনভাবে গ্রাস করেছে যে সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার করাও ভুলে যান। ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষমতার দাপটে ভুলে যান যে সাধারণ মানুষই তাঁদের নেতা তৈরি করেন। আমাদের দেশের ছোট থেকে বড় নেতাদেরও ওই একই মন-মানসিকতা। বিশেষভাবে প্রটোকল তৈরি করতে হয়। কার কত গাড়ির বহর তার ওপর নির্ভর করে নেতা-নেত্রীর ওজন। ট্রাফিক রুল ভেঙে চলাচল নেতার গুরুত্ব বহন করে বলে মনে করেন। অহরহ এমনটা হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশের শুধু বড় নেতারাই নন, ছোটখাটো পাতিনেতাদের দাপটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো একরকম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। রাজধানীতে মাঝেমধ্যে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আমাদের দেশের নেতাদের গাড়ির বহরকে নির্বিঘ্নে পার হতে দেওয়ার জন্য। ফেরি থেকে বিমান পর্যন্ত মন্ত্রী বা নেতার আগমনের অপেক্ষায় থাকে, তাতে অন্যদের সুবিধা-অসুবিধা ধর্তব্য নয়। অপেক্ষায় থাকেন সাধারণ মানুষগুলো, যাঁরা তাঁদের নেতা বানিয়েছেন। নিজের এলাকায় আগমনে সংবর্ধনা দিতে শত শত তোরণ তৈরি করা হয়, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে নেতাকে স্বাগত জানাতে হয়। বিশ্বের কম দেশই আছে, যেখানে এমন নজির রয়েছে। তার ওপর রয়েছে উপঢৌকন।
শুধু যে আমাদের দেশে এমন হয়, তা নয়। তবে আমাদের দেশে এর মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের পাশের দেশের অতি সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে আসা নেতার অতি দামি পরিধেয় নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। অবশেষে বিক্রি হয়েছে চড়া মূল্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ভবনে থাকেন সে দেশের রাষ্ট্রের কর্ণধার। অথচ আমাদের অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন গান্ধীর মতো নেতা, যিনি সারা জীবন চাকচিক্য বর্জন করে চলেছেন। আমাদের দেশের অতীতের নেতাদের সেই জৌলুশ ছিল না। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কাটিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত এলাকার একটি সাধারণ বাড়িতে।
বিশ্বে যখন নেতাদের চাকচিক্য নিয়ে মুখরোচক রচনা রচিত হয়, তখনো পৃথিবীর আনাচকানাচে অনুসরণযোগ্য নেতাদের কথাও ক্ষীণ স্বরে হলেও শোনা যায়। খুব বড় প্রচার না হলেও প্রচারিত হয়। বিশ্বের এক কোনায় একটি ছোট আয়তনের মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতির কথা এমনই রূপকথার মতো ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন যে তাঁর জীবনধারণ তাঁর দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতো, সংখ্যালঘু বিত্তবান জনগোষ্ঠীর মতো নয়। তিনি হলেন লাতিন আমেরিকার বা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের দেশ উরুগুয়ের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি, ৮০ বছর বয়স্ক জোস, এলবার্তো ‘পেপে’ মুজিকা কোরডানো, সংক্ষেপে পেপে মুজিকা। একসময়ের অতি বাম ‘টুম্পারোস’ গেরিলা সদস্য বাম মোর্চা ব্রড ফ্রন্ট পার্টির হয়ে বিগত পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিনম্র নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি নিজেকে তাঁর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা শতকরা ৯৫ ভাগ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হতে অনীহা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই মৃত্যুবরণ করতে চাই।’
পেপে মুজিকার অতীত জীবন সুখকর ছিল না। স্প্যানিশ মুনের এই নেতা একসময়ের নিষিদ্ধঘোষিত বাম গেরিলা সংগঠনের সদস্য, ওই সময়কার অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। জীবন ফিরে পেলেও বহু বছর কারাগারে কাটাতে হয়। দুবার কারাগার থেকে পলায়ন করলেও প্রতিবারই তাঁকে কারাগারে ফিরতে হয়। কাটাতে হয়েছিল জীবনের আট বছর ‘সলিটারি কনফাইনমেন্টে’। ওই সময়কার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন যে জীবনের ওই আট বছরে তিনি বিশ্ব থেকে, এমনকি নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকেও ছিলেন বিচ্ছিন্ন। কারাগারের প্রকোষ্ঠ থেকে বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে কিছু জানতে পারতেন না। তবে তাঁর মতে, ওই আট বছর জীবন সম্বন্ধে তাঁর ধারণা পাল্টে দেয়। ওই আট বছরে খবরের কাগজ তো দূরের কথা, একটি বইও পড়েননি। ওই সময়েই তিনি তাঁর পরবর্তী জীবনের ছক তৈরি করেন।
উরুগুয়েতে গণতন্ত্রের ধারা পুনঃপ্রবর্তন হলে পেপে মুজিকা প্রথমে সাংসদ ও পরে কৃষিমন্ত্রী হন। অবশেষে তিনি ২০১০ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা ভোটে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৫ সালে বহু বছরের সংগ্রামী সঙ্গী ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত লুসি টপোলানস্কিকে বিয়ে করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এক দিনও রাজধানী মন্টেভিডিওর জৌলুশপূর্ণ প্রেসিডেন্ট ভবনে কাটাননি, এমনকি প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ যানবাহন এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবহার করেননি। ১২ হাজার মার্কিন ডলারের মাসিক বেতনের ৯০ শতাংশ দাতব্যকাজে দান করেছেন। থাকতেন, এখনো থাকেন, রাজধানীর বাইরে তাঁর স্ত্রীর ছোট খামারবাড়িতে, যেখানে এই নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গী ছিল, এখনো আছে ১৯৮৭ সালের তৈরি গাড়ি ভক্সওয়াগন বিটল, যা এখন আর ঢাকার এমনকি বাংলাদেশের কোনো রাস্তায়ও দৃশ্যমান নয়। যেন তিন পা–বিশিষ্ট বিকলাঙ্গ এক কুকুর। ২০১০ সালে যখন পেপে মুজিকা প্রেসিডেন্ট হন, তখন তাঁর ওই গাড়ির দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। প্রতিবছর তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাবে এমন তথ্যই রয়েছে। স্ত্রীর কৃষি খামারে উৎপাদিত ‘ক্রিসেনথিমাম’ ফুল বেচে আর বেতনের বাকি অংশ দিয়ে দুজনের সংসার চলে। উল্লেখ্য, উরুগুয়ে মধ্যম আয়ের দেশ, যার মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ৯৯৬ মার্কিন ডলার। এমন দেশের প্রেসিডেন্টের এমনই গল্প, মনে হয় কল্পকথা।
পেপে মুজিকার নিজস্ব গাড়ি ভক্সওয়াগন বিটল এখন বিশ্বপরিচিত। ইদানীং নির্মাতা সংস্থা ওই গাড়িটি এক মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনতে চেয়েছে। পেপে এখনো বিক্রির মন স্থির করেননি, তবে তিনি বলেছেন যে তাঁর এই বয়সে এ অর্থের প্রয়োজন নেই। তবে অর্থলাভ হলে তিনি পুরোটাই দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেবেন। তাঁর মতে, তিনি কোনো অসাধারণ ব্যক্তি নন। ছোটবেলা থেকেই কাঠের টুলে বসে লেখাপড়া করেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ওই কাঠের টুলে বসেই কাজ করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সব দেশের নেতাদের উচিত ওই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবন ধারণ করা। বিশেষ করে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর পূর্বপুরুষদের দেশের, স্পেন ও ইতালির নেতাদের উদ্দেশে এমন কথা বলেন।
পেপে মুজিকা যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে বিরল ঘটনা। বিরল ব্যক্তিত্ব পেপে মুজিকা। বিশ্বে যখন এমন ব্যক্তি ও নেতার অভাব, তখন পেপে মুজিকার জীবনবৃত্তান্ত আগামী প্রজন্মকে নিরহংকার, বিনয়ী ও সাধারণের নেতা হওয়ার প্রেরণা জোগাবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের তরুণদের অনুপ্রেরণা দেবে, যাদের সামনে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অভাবের কারণে কিংবদন্তি নেতা তৈরির পথ সুগম হচ্ছে না।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনুপ্রেরণা জোগানোর মতো নেতাদের অভাবে রাজনীতির প্রতি এই প্রজন্ম যেমন বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে, তেমনি বিপথগামী হওয়ার লক্ষণ বাড়ছে। আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে আমাদের দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য, শিক্ষণীয় হতে পারে জোস এলবার্তো ‘পেপে’ মুজিকা কোরডানো, সংক্ষেপে ‘পেপে’ মুজিকা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
আজ বিংশ শতাব্দী পার হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিশ্বে এমনতর নেতৃত্ব খোঁজা যেন অবাস্তব মনে হতো। এখন নেতাদের আড়ম্বর মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহদেরও মাঝেমধ্যে হার মানায়। অফুরন্ত ক্ষমতাধর সব শীর্ষ নেতা দেশ পরিচালনায় অনেকে জার অথবা মোগলদেরও পিছে ফেলে দেয়। এমনকি বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিকমনা নেতাদেরও বাহ্যিক চাকচিক্য এমনভাবে গ্রাস করেছে যে সাধারণ মানুষের মতো ব্যবহার করাও ভুলে যান। ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষমতার দাপটে ভুলে যান যে সাধারণ মানুষই তাঁদের নেতা তৈরি করেন। আমাদের দেশের ছোট থেকে বড় নেতাদেরও ওই একই মন-মানসিকতা। বিশেষভাবে প্রটোকল তৈরি করতে হয়। কার কত গাড়ির বহর তার ওপর নির্ভর করে নেতা-নেত্রীর ওজন। ট্রাফিক রুল ভেঙে চলাচল নেতার গুরুত্ব বহন করে বলে মনে করেন। অহরহ এমনটা হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশের শুধু বড় নেতারাই নন, ছোটখাটো পাতিনেতাদের দাপটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তো একরকম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। রাজধানীতে মাঝেমধ্যে জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আমাদের দেশের নেতাদের গাড়ির বহরকে নির্বিঘ্নে পার হতে দেওয়ার জন্য। ফেরি থেকে বিমান পর্যন্ত মন্ত্রী বা নেতার আগমনের অপেক্ষায় থাকে, তাতে অন্যদের সুবিধা-অসুবিধা ধর্তব্য নয়। অপেক্ষায় থাকেন সাধারণ মানুষগুলো, যাঁরা তাঁদের নেতা বানিয়েছেন। নিজের এলাকায় আগমনে সংবর্ধনা দিতে শত শত তোরণ তৈরি করা হয়, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে নেতাকে স্বাগত জানাতে হয়। বিশ্বের কম দেশই আছে, যেখানে এমন নজির রয়েছে। তার ওপর রয়েছে উপঢৌকন।
শুধু যে আমাদের দেশে এমন হয়, তা নয়। তবে আমাদের দেশে এর মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের পাশের দেশের অতি সাধারণ অবস্থা থেকে উঠে আসা নেতার অতি দামি পরিধেয় নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। অবশেষে বিক্রি হয়েছে চড়া মূল্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ভবনে থাকেন সে দেশের রাষ্ট্রের কর্ণধার। অথচ আমাদের অঞ্চলেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন গান্ধীর মতো নেতা, যিনি সারা জীবন চাকচিক্য বর্জন করে চলেছেন। আমাদের দেশের অতীতের নেতাদের সেই জৌলুশ ছিল না। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন কাটিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত এলাকার একটি সাধারণ বাড়িতে।
বিশ্বে যখন নেতাদের চাকচিক্য নিয়ে মুখরোচক রচনা রচিত হয়, তখনো পৃথিবীর আনাচকানাচে অনুসরণযোগ্য নেতাদের কথাও ক্ষীণ স্বরে হলেও শোনা যায়। খুব বড় প্রচার না হলেও প্রচারিত হয়। বিশ্বের এক কোনায় একটি ছোট আয়তনের মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতির কথা এমনই রূপকথার মতো ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন যে তাঁর জীবনধারণ তাঁর দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মতো, সংখ্যালঘু বিত্তবান জনগোষ্ঠীর মতো নয়। তিনি হলেন লাতিন আমেরিকার বা দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের দেশ উরুগুয়ের সদ্যবিদায়ী রাষ্ট্রপতি, ৮০ বছর বয়স্ক জোস, এলবার্তো ‘পেপে’ মুজিকা কোরডানো, সংক্ষেপে পেপে মুজিকা। একসময়ের অতি বাম ‘টুম্পারোস’ গেরিলা সদস্য বাম মোর্চা ব্রড ফ্রন্ট পার্টির হয়ে বিগত পাঁচ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিনম্র নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি নিজেকে তাঁর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা শতকরা ৯৫ ভাগ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হতে অনীহা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমি সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই মৃত্যুবরণ করতে চাই।’
পেপে মুজিকার অতীত জীবন সুখকর ছিল না। স্প্যানিশ মুনের এই নেতা একসময়ের নিষিদ্ধঘোষিত বাম গেরিলা সংগঠনের সদস্য, ওই সময়কার অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। জীবন ফিরে পেলেও বহু বছর কারাগারে কাটাতে হয়। দুবার কারাগার থেকে পলায়ন করলেও প্রতিবারই তাঁকে কারাগারে ফিরতে হয়। কাটাতে হয়েছিল জীবনের আট বছর ‘সলিটারি কনফাইনমেন্টে’। ওই সময়কার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন যে জীবনের ওই আট বছরে তিনি বিশ্ব থেকে, এমনকি নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকেও ছিলেন বিচ্ছিন্ন। কারাগারের প্রকোষ্ঠ থেকে বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে কিছু জানতে পারতেন না। তবে তাঁর মতে, ওই আট বছর জীবন সম্বন্ধে তাঁর ধারণা পাল্টে দেয়। ওই আট বছরে খবরের কাগজ তো দূরের কথা, একটি বইও পড়েননি। ওই সময়েই তিনি তাঁর পরবর্তী জীবনের ছক তৈরি করেন।
উরুগুয়েতে গণতন্ত্রের ধারা পুনঃপ্রবর্তন হলে পেপে মুজিকা প্রথমে সাংসদ ও পরে কৃষিমন্ত্রী হন। অবশেষে তিনি ২০১০ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা ভোটে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৫ সালে বহু বছরের সংগ্রামী সঙ্গী ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত লুসি টপোলানস্কিকে বিয়ে করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এক দিনও রাজধানী মন্টেভিডিওর জৌলুশপূর্ণ প্রেসিডেন্ট ভবনে কাটাননি, এমনকি প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ যানবাহন এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবহার করেননি। ১২ হাজার মার্কিন ডলারের মাসিক বেতনের ৯০ শতাংশ দাতব্যকাজে দান করেছেন। থাকতেন, এখনো থাকেন, রাজধানীর বাইরে তাঁর স্ত্রীর ছোট খামারবাড়িতে, যেখানে এই নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গী ছিল, এখনো আছে ১৯৮৭ সালের তৈরি গাড়ি ভক্সওয়াগন বিটল, যা এখন আর ঢাকার এমনকি বাংলাদেশের কোনো রাস্তায়ও দৃশ্যমান নয়। যেন তিন পা–বিশিষ্ট বিকলাঙ্গ এক কুকুর। ২০১০ সালে যখন পেপে মুজিকা প্রেসিডেন্ট হন, তখন তাঁর ওই গাড়ির দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। প্রতিবছর তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাবে এমন তথ্যই রয়েছে। স্ত্রীর কৃষি খামারে উৎপাদিত ‘ক্রিসেনথিমাম’ ফুল বেচে আর বেতনের বাকি অংশ দিয়ে দুজনের সংসার চলে। উল্লেখ্য, উরুগুয়ে মধ্যম আয়ের দেশ, যার মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার ৯৯৬ মার্কিন ডলার। এমন দেশের প্রেসিডেন্টের এমনই গল্প, মনে হয় কল্পকথা।
পেপে মুজিকার নিজস্ব গাড়ি ভক্সওয়াগন বিটল এখন বিশ্বপরিচিত। ইদানীং নির্মাতা সংস্থা ওই গাড়িটি এক মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনতে চেয়েছে। পেপে এখনো বিক্রির মন স্থির করেননি, তবে তিনি বলেছেন যে তাঁর এই বয়সে এ অর্থের প্রয়োজন নেই। তবে অর্থলাভ হলে তিনি পুরোটাই দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেবেন। তাঁর মতে, তিনি কোনো অসাধারণ ব্যক্তি নন। ছোটবেলা থেকেই কাঠের টুলে বসে লেখাপড়া করেছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ওই কাঠের টুলে বসেই কাজ করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সব দেশের নেতাদের উচিত ওই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবন ধারণ করা। বিশেষ করে তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর পূর্বপুরুষদের দেশের, স্পেন ও ইতালির নেতাদের উদ্দেশে এমন কথা বলেন।
পেপে মুজিকা যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে বিরল ঘটনা। বিরল ব্যক্তিত্ব পেপে মুজিকা। বিশ্বে যখন এমন ব্যক্তি ও নেতার অভাব, তখন পেপে মুজিকার জীবনবৃত্তান্ত আগামী প্রজন্মকে নিরহংকার, বিনয়ী ও সাধারণের নেতা হওয়ার প্রেরণা জোগাবে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের তরুণদের অনুপ্রেরণা দেবে, যাদের সামনে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অভাবের কারণে কিংবদন্তি নেতা তৈরির পথ সুগম হচ্ছে না।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনুপ্রেরণা জোগানোর মতো নেতাদের অভাবে রাজনীতির প্রতি এই প্রজন্ম যেমন বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে, তেমনি বিপথগামী হওয়ার লক্ষণ বাড়ছে। আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে আমাদের দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতাদের জন্য, শিক্ষণীয় হতে পারে জোস এলবার্তো ‘পেপে’ মুজিকা কোরডানো, সংক্ষেপে ‘পেপে’ মুজিকা।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments