আমাদের ‘আইভী আপা’ by শরিফুল হাসান
২
মার্চ। ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। ঢাকা থেকে সরাসরি পৌঁছেছি নারায়ণগঞ্জের
সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাড়ির গেটে। এত সকালে আসার কারণ
জানতে চেয়ে একের পর এক প্রশ্ন করছেন নিরাপত্তা প্রহরী। তাঁকে কিছু না বলে
সরাসরি মেয়রের মুঠোফোনে কল দিলাম, যেই নম্বরটি জানেন নারায়ণগঞ্জের সবাই।
মেয়র ফোন ধরতেই বললাম, আজ সারা দিন আপনার কাজকর্ম দেখব। মেয়র সেই
প্রস্তাবে সহাস্যে রাজি হলেন। দিনশেষে যখন ঢাকায় ফিরছি, তখন জেনে গেছি কেন
আইভি নারায়ণগঞ্জের গণমানুষের নেতা। পুরো নাম সেলিনা হায়াৎ আইভী হলেও
নারায়ণগঞ্জের ছেলে–বুড়ো—সবার কাছে তিনি আইভী আপা হিসেবে পরিচিত। ২০১১
সালের ৩০ অক্টোবর বিপুল ভোটে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের কোনো মহানগরে তিনিই প্রথম নারী মেয়র।
পেছনে ফেরা
সেলিনা হায়াৎ–এর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দু-দুবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁরই মেয়ে আইভী ২০০২ সালের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলেন।
২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। আইভী যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। সূর্য ডুবলেই শহর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় বাতি জ্বলে না, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যায়। আছে আরও অনেক সংকট। আইভী যখন দায়িত্ব ছাড়লেন তখন পৌরসভায় জমা ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, আরও ৪০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছিল। সিটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাড়ে তিন বছরে আড়াই শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
পেছনে ফেরা
সেলিনা হায়াৎ–এর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দু-দুবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁরই মেয়ে আইভী ২০০২ সালের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হলেন।
২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আইভী নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। আইভী যখন মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন, তখন পৌরসভার দেনা ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। সূর্য ডুবলেই শহর ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তায় বাতি জ্বলে না, একটু বৃষ্টি হলেই শহরে হাঁটুপানি জমে যায়। আছে আরও অনেক সংকট। আইভী যখন দায়িত্ব ছাড়লেন তখন পৌরসভায় জমা ১২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, আরও ৪০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ চলছিল। সিটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাড়ে তিন বছরে আড়াই শ কোটি টাকার কাজ হয়েছে।
বন্দর ঘাটে বশির মাঝির নৌকায় মেয়র। ছবি: খালেদ সরকার |
‘আইভী আমাগো শক্তি’
সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাসায় যাওয়ার তিনি বললেন, বাসায় বাসায় বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবেন না। শহরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাবুরাইল এলাকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ’ সড়কের উদ্বোধনকাজ আছে সকাল ১০টায়।
নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই মেয়র পৌঁছালেন সেখানে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফকে ১৯৭৪ সালের ৮ জুন হত্যা করা হয়। তাঁর নামেই এই সড়কটি হচ্ছে। মেয়র এলাকায় এসেছেন শুনে ততক্ষণে সেখানে ভিড় জমে গেছে। ছোট ছোট শিশুর পাশাপাশি আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ির বারান্দা ও ছাদ থেকে অনেকেই দেখছেন আইভীকে। আশপাশের বাড়ির কয়েকজন বেরিয়েও এলেন। তাঁদেরই একজন বৃদ্ধ সুফিয়া বেগম। তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম কাকে দেখতে এসেছেন? উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বৃদ্ধার জবাব, ‘আইভী। আমাদের মেয়ে। আমাদের শক্তি।’ পাশে থাকা লুৎফা বেগমও একই কথা বললেন।
‘মেয়র না, আমাদের মা’
সড়ক উদ্বোধনের কাজ শেষে সেলিনা হায়াৎ আইভী গেলেন শহরের ঋষিপাড়া বস্তিতে। মেয়র বস্তিতে এসেছেন শুনে হঠাৎ যেন ঈদের আনন্দ দেখা গেল। ছোট ছোট গলির ভেতরে মেয়রের পিছু পিছু হাঁটছেন নারী-শিশু-ছেলে-বুড়োরা। তাঁদেরই একজন আসমা খাতুন। ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন। মেয়রকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে এই বস্তিতে পানির লাইন ছিল না। সব সময় দুর্গন্ধ থাকত। পানি জমে থাকত। লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আইভী আপা আমাদের জন্য সব করেছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
আসমার কথায় বোঝা গেল কেন আইভী এখানে এতটা জনপ্রিয়। বস্তির নারীদের প্রায় সবাই আইভীকে তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে চান। হাঁটতে হাঁটতেই একটি মেয়েকে দেখে থামলেন মেয়র। জানতে চাইলেন তোমার তো এখন স্কুলে থাকার কথা? মেয়েটি তাঁর নাম জানাল মেঘলা। তার বাবা বিদ্যাসাগর এই বস্তিতেই থাকেন। মেয়েটি জানাল, তার বাবা দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আইভী মেয়েটির বাবাকে ফের স্কুলে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন।
লাকি আক্তার নামে এক মেয়ে একটি ঘরে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। মেয়রকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘আপা, আপনি যখন পৌরসভার মেয়র ছিলেন তখন আমি প্রশিক্ষণ নিছিলাম সেলাইয়ের কাজের। এখন ভালো আছি।’ সাজেদা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘আইভী তো মেয়র না, ও আমাদের মা।’ একই কথা বললেন বস্তিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এই বস্তিতে আছি। আইভী আমাদের জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। এখানকার মেয়েরা নানা কাজ শিখছে।’ এলাকাবাসী জানালেন, একই রকমভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে সুইপার কলোনিতেও।
শিশুদের ‘আইভী আপা’
ঋষিপাড়া বস্তির মধ্যে একটি বেসরকারি সংস্থার স্কুল চলছিল। হঠাৎ করে মেয়র প্রবেশ করলেন সেই স্কুলে। সব শিশু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলাম কে এসেছে? তামান্না, তুলসী, বন্যা, অনিকসহ ছোট শিশুরা একযোগে বলল, ‘আইভী আপা’। মেয়রের সঙ্গে একটি ছবি তোলার প্রস্তাব দিতেই ছোট ছোট বাচ্চারা জড়িয়ে ধরল তাদের আইভী আপাকে। এ যেন তাদের কত
প্রিয় আপা।
নদী পেরিয়ে বন্দরে, আইভী এখন ডাক্তার আপা
শহর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। শীতলক্ষ্যা নদীর এপারে নারায়ণগঞ্জ আর ওপারে বন্দর। মেয়র জানালেন, বন্দর এলাকার একটি প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সেখানে যেতে হবে। আমরাও পিছু নিলাম মেয়রের। শহর থেকে মেয়রের গাড়ি নদীর পাড়ে এসে থামল। তাঁকে দেখে একসঙ্গে এগিয়ে এলেন কয়েকজন মাঝি। সবাই তাঁকে নৌকায় ওঠাতে চান। আইভী একজনের নৌকায় উঠলেন। বললেন, ফেরার সময় আরেকজনেরটায় উঠবেন। বশির মাঝি তাঁর নৌকায় মেয়রকে তুলতে পেরে মহাখুশি। নৌকায় করে নদী পার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভী। আশপাশের লোকজন যেই দেখছেন, সালাম দিচ্ছেন; উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। নদী পেরিয়ে বন্দরে পৌঁছে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠলেন মেয়র। তিনি সেখানকার ১০০ ফুট রাস্তার কাজ দেখবেন। পথে হঠাৎ করে এক জায়গায় অটোরিকশা থামাতে বললেন। তিনি বন্দর মাতৃসদনের সেবা দেখতে যেতে চান।
হুট করেই ওই মাতৃসদনে ঢুকে পড়লেন মেয়র। সদ্য জন্ম নেওয়া এক নবজাতককে দেখলেন। প্রসূতি মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। একসময় এই এলাকার মায়েদের নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হতো। এই মাতৃসদন হওয়ার পর তাঁদের দুর্ভোগ কমেছে। অনেক গ্রামের মায়েরাও আসছেন চিকিৎসা নিতে। এক প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকেরা মেয়রকে জানালেন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৬ জন এখানে মা হয়েছেন। ১৮টি শিশু স্বাভাবিকভাবে আর ১৮টি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে। এ সময় মেয়র চিকিৎসকদের বললেন, ‘চেষ্টা করবেন যেন স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা জন্মানো যায়। উন্নত বিশ্বে তা–ই হয়। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি এটা খুব ভালো।’
অদ্ভুত সব সমস্যা, নারীদের সিদ্ধান্তই ঠিক
মাতৃসদন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই মেয়রকে দেখতে লোকজনের ভিড়। একজন বললেন, আপা, এলাকায় কুকুর বাড়ছে। কুকুর মারতে হবে। হাসিমুখে মেয়র বললেন, হাইকোর্টের নির্দেশে কুকুর মারা বন্ধ। কী করব বলেন?
বন্দর এলাকার ব্যাপারীপাড়ায় পৌঁছে অদ্ভুত এক সমস্যার মুখোমুখি হতে দেখলাম মেয়রকে। একই সঙ্গে মানবিক আর নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরও দেখা মিলল। ব্যাপারীপাড়ায় মূল সড়কের পাশে একটি পাবলিক টয়লেট হবে। নারায়ণগঞ্জের সব পাবলিক টয়লেটেই নারী-পুরুষদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকে। এলাকার পুরুষ লোকজন পাবলিক টয়লেটটি যেখানে চাইছেন, নারীরা তা মানছেন না। মেয়রকে দেখে আশপাশের বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন নারী। তাঁরা সমস্বরে বললেন, ‘এখানে রাস্তার পাশে বাড়িঘরের সামনে পাবলিক টয়লেট করার প্রয়োজন নেই। বরং আরেকটু ভেতরে নিয়ে গিয়ে যদি পাবলিক টয়লেট এবং লাশ গোসলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে খুব ভালো হয়।’ সব শুনে মেয়র নারীদের সিদ্ধান্তই মেনে নিলেন। লাশের গোসলের ব্যবস্থায় পুরুষেরাও সায় দিলেন। এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মেয়র নির্দেশ দিলেন এলাকার নারীরা যেভাবে চান, সেভাবেই সব হবে। কয়েকজন পুরুষকে এ সময় হাসিমুখে বলতে শোনা গেল, আপা, সব সময় নারীদের কথা শোনেন।
সোনাকান্দা থেকে মেয়র ফের এলেন মাহমুদনগরের নদীর ঘাঁটে। মেয়রকে দেখে এগিয়ে এলেন কয়েক শ শ্রমিক। তাঁরা বললেন, নদীর পাড়ে যে বিশাল পার্ক হচ্ছে, সে কারণে এখানকার বাঁশ কেনাবেচার হাঁটটি উচ্ছেদ করা হতে পারে। এতে তাঁরা কর্মসংস্থান হারাবেন। কাজেই হাঁটটা যেন রাখা হয়। মেয়র তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেন।
নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন জরুরি
বন্দর ঘুরে মেয়র যখন তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছেছেন ততক্ষণে বেলা আড়াইটা। দুপুরে নিজের কার্যালয়েই সামান্য ভাত, ডাল আর লাউভাজি খেলেন। এরপর শুরু করলেন একের পর এক বৈঠক। জরুরি কাগজপত্রেও স্বাক্ষর করলেন। নানা ধরনের নির্দেশনা দিলেন। এভাবেই পেরিয়ে গেল বিকেল।
শেষ বিকেলে আবারও কিছুটা সময় দিলেন মেয়র। বললেন, ‘আমি মনে করি, নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের ক্ষমতায়নই জরুরি। আমি নারায়ণগঞ্জে দুটোই শুরু করেছি। নারায়ণগঞ্জের নারীরা যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন সে কারণে সিটি করপোরেশন থেকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া নগর অংশীদারির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ নামে একটি প্রকল্প আছে নারায়ণগঞ্জে। সেটি একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীদের ব্যাপক সহায়তা করছে।’
মেয়র জানালেন, এই প্রকল্পের আওতায় ৬৫টি সিডিসি (কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি) আছে। এর মধ্যে আবার ৫০১টি প্রাথমিক দল আছে। এর মোট সদস্যসংখ্যা ৮৯ হাজার ৫৬৬। তাঁরা প্রায় দুই কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি প্রতিটি ছোট ছোট দল ভোট দিয়ে তাদের নেতা নির্বাচন করছে। এভাবেই তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে।’
সেলিনা হায়াৎ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার চার লাখ। এর মধ্যে দুই লাখই নারী ভোটার। আমি মনে করি, পুরুষের পাশাপাশি এই দুই লাখ নারী যদি তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, যদি তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়, তাহলে নারায়ণগঞ্জ এগিয়ে যাবেই।’
একজন জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষের কতটা আপন হতে পারেন, আইভী যেন সবাইকে তা–ই দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র সবার প্রিয় আইভী আপা।
সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাসায় যাওয়ার তিনি বললেন, বাসায় বাসায় বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবেন না। শহরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাবুরাইল এলাকায় ‘মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ’ সড়কের উদ্বোধনকাজ আছে সকাল ১০টায়।
নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই মেয়র পৌঁছালেন সেখানে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফকে ১৯৭৪ সালের ৮ জুন হত্যা করা হয়। তাঁর নামেই এই সড়কটি হচ্ছে। মেয়র এলাকায় এসেছেন শুনে ততক্ষণে সেখানে ভিড় জমে গেছে। ছোট ছোট শিশুর পাশাপাশি আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়ির বারান্দা ও ছাদ থেকে অনেকেই দেখছেন আইভীকে। আশপাশের বাড়ির কয়েকজন বেরিয়েও এলেন। তাঁদেরই একজন বৃদ্ধ সুফিয়া বেগম। তাঁর কাছেই জানতে চাইলাম কাকে দেখতে এসেছেন? উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বৃদ্ধার জবাব, ‘আইভী। আমাদের মেয়ে। আমাদের শক্তি।’ পাশে থাকা লুৎফা বেগমও একই কথা বললেন।
‘মেয়র না, আমাদের মা’
সড়ক উদ্বোধনের কাজ শেষে সেলিনা হায়াৎ আইভী গেলেন শহরের ঋষিপাড়া বস্তিতে। মেয়র বস্তিতে এসেছেন শুনে হঠাৎ যেন ঈদের আনন্দ দেখা গেল। ছোট ছোট গলির ভেতরে মেয়রের পিছু পিছু হাঁটছেন নারী-শিশু-ছেলে-বুড়োরা। তাঁদেরই একজন আসমা খাতুন। ৩০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন। মেয়রকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে এই বস্তিতে পানির লাইন ছিল না। সব সময় দুর্গন্ধ থাকত। পানি জমে থাকত। লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আইভী আপা আমাদের জন্য সব করেছেন। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’
আসমার কথায় বোঝা গেল কেন আইভী এখানে এতটা জনপ্রিয়। বস্তির নারীদের প্রায় সবাই আইভীকে তাঁর ঘরে নিয়ে যেতে চান। হাঁটতে হাঁটতেই একটি মেয়েকে দেখে থামলেন মেয়র। জানতে চাইলেন তোমার তো এখন স্কুলে থাকার কথা? মেয়েটি তাঁর নাম জানাল মেঘলা। তার বাবা বিদ্যাসাগর এই বস্তিতেই থাকেন। মেয়েটি জানাল, তার বাবা দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আইভী মেয়েটির বাবাকে ফের স্কুলে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন।
লাকি আক্তার নামে এক মেয়ে একটি ঘরে সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। মেয়রকে দেখে ছুটে এলেন। বললেন, ‘আপা, আপনি যখন পৌরসভার মেয়র ছিলেন তখন আমি প্রশিক্ষণ নিছিলাম সেলাইয়ের কাজের। এখন ভালো আছি।’ সাজেদা বেগম নামে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘আইভী তো মেয়র না, ও আমাদের মা।’ একই কথা বললেন বস্তিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে এই বস্তিতে আছি। আইভী আমাদের জীবনটা সহজ করে দিয়েছে। এখানকার মেয়েরা নানা কাজ শিখছে।’ এলাকাবাসী জানালেন, একই রকমভাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে সুইপার কলোনিতেও।
শিশুদের ‘আইভী আপা’
ঋষিপাড়া বস্তির মধ্যে একটি বেসরকারি সংস্থার স্কুল চলছিল। হঠাৎ করে মেয়র প্রবেশ করলেন সেই স্কুলে। সব শিশু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলাম কে এসেছে? তামান্না, তুলসী, বন্যা, অনিকসহ ছোট শিশুরা একযোগে বলল, ‘আইভী আপা’। মেয়রের সঙ্গে একটি ছবি তোলার প্রস্তাব দিতেই ছোট ছোট বাচ্চারা জড়িয়ে ধরল তাদের আইভী আপাকে। এ যেন তাদের কত
প্রিয় আপা।
নদী পেরিয়ে বন্দরে, আইভী এখন ডাক্তার আপা
শহর, বন্দর ও সিদ্ধিরগঞ্জ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। শীতলক্ষ্যা নদীর এপারে নারায়ণগঞ্জ আর ওপারে বন্দর। মেয়র জানালেন, বন্দর এলাকার একটি প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সেখানে যেতে হবে। আমরাও পিছু নিলাম মেয়রের। শহর থেকে মেয়রের গাড়ি নদীর পাড়ে এসে থামল। তাঁকে দেখে একসঙ্গে এগিয়ে এলেন কয়েকজন মাঝি। সবাই তাঁকে নৌকায় ওঠাতে চান। আইভী একজনের নৌকায় উঠলেন। বললেন, ফেরার সময় আরেকজনেরটায় উঠবেন। বশির মাঝি তাঁর নৌকায় মেয়রকে তুলতে পেরে মহাখুশি। নৌকায় করে নদী পার হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের মেয়র আইভী। আশপাশের লোকজন যেই দেখছেন, সালাম দিচ্ছেন; উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। নদী পেরিয়ে বন্দরে পৌঁছে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় উঠলেন মেয়র। তিনি সেখানকার ১০০ ফুট রাস্তার কাজ দেখবেন। পথে হঠাৎ করে এক জায়গায় অটোরিকশা থামাতে বললেন। তিনি বন্দর মাতৃসদনের সেবা দেখতে যেতে চান।
হুট করেই ওই মাতৃসদনে ঢুকে পড়লেন মেয়র। সদ্য জন্ম নেওয়া এক নবজাতককে দেখলেন। প্রসূতি মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। একসময় এই এলাকার মায়েদের নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে হতো। এই মাতৃসদন হওয়ার পর তাঁদের দুর্ভোগ কমেছে। অনেক গ্রামের মায়েরাও আসছেন চিকিৎসা নিতে। এক প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকেরা মেয়রকে জানালেন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৬ জন এখানে মা হয়েছেন। ১৮টি শিশু স্বাভাবিকভাবে আর ১৮টি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে। এ সময় মেয়র চিকিৎসকদের বললেন, ‘চেষ্টা করবেন যেন স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা জন্মানো যায়। উন্নত বিশ্বে তা–ই হয়। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি এটা খুব ভালো।’
অদ্ভুত সব সমস্যা, নারীদের সিদ্ধান্তই ঠিক
মাতৃসদন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই মেয়রকে দেখতে লোকজনের ভিড়। একজন বললেন, আপা, এলাকায় কুকুর বাড়ছে। কুকুর মারতে হবে। হাসিমুখে মেয়র বললেন, হাইকোর্টের নির্দেশে কুকুর মারা বন্ধ। কী করব বলেন?
বন্দর এলাকার ব্যাপারীপাড়ায় পৌঁছে অদ্ভুত এক সমস্যার মুখোমুখি হতে দেখলাম মেয়রকে। একই সঙ্গে মানবিক আর নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিরও দেখা মিলল। ব্যাপারীপাড়ায় মূল সড়কের পাশে একটি পাবলিক টয়লেট হবে। নারায়ণগঞ্জের সব পাবলিক টয়লেটেই নারী-পুরুষদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকে। এলাকার পুরুষ লোকজন পাবলিক টয়লেটটি যেখানে চাইছেন, নারীরা তা মানছেন না। মেয়রকে দেখে আশপাশের বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কয়েকজন নারী। তাঁরা সমস্বরে বললেন, ‘এখানে রাস্তার পাশে বাড়িঘরের সামনে পাবলিক টয়লেট করার প্রয়োজন নেই। বরং আরেকটু ভেতরে নিয়ে গিয়ে যদি পাবলিক টয়লেট এবং লাশ গোসলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে খুব ভালো হয়।’ সব শুনে মেয়র নারীদের সিদ্ধান্তই মেনে নিলেন। লাশের গোসলের ব্যবস্থায় পুরুষেরাও সায় দিলেন। এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মেয়র নির্দেশ দিলেন এলাকার নারীরা যেভাবে চান, সেভাবেই সব হবে। কয়েকজন পুরুষকে এ সময় হাসিমুখে বলতে শোনা গেল, আপা, সব সময় নারীদের কথা শোনেন।
সোনাকান্দা থেকে মেয়র ফের এলেন মাহমুদনগরের নদীর ঘাঁটে। মেয়রকে দেখে এগিয়ে এলেন কয়েক শ শ্রমিক। তাঁরা বললেন, নদীর পাড়ে যে বিশাল পার্ক হচ্ছে, সে কারণে এখানকার বাঁশ কেনাবেচার হাঁটটি উচ্ছেদ করা হতে পারে। এতে তাঁরা কর্মসংস্থান হারাবেন। কাজেই হাঁটটা যেন রাখা হয়। মেয়র তাঁদের বিকল্প ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেন।
নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন জরুরি
বন্দর ঘুরে মেয়র যখন তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছেছেন ততক্ষণে বেলা আড়াইটা। দুপুরে নিজের কার্যালয়েই সামান্য ভাত, ডাল আর লাউভাজি খেলেন। এরপর শুরু করলেন একের পর এক বৈঠক। জরুরি কাগজপত্রেও স্বাক্ষর করলেন। নানা ধরনের নির্দেশনা দিলেন। এভাবেই পেরিয়ে গেল বিকেল।
শেষ বিকেলে আবারও কিছুটা সময় দিলেন মেয়র। বললেন, ‘আমি মনে করি, নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের ক্ষমতায়নই জরুরি। আমি নারায়ণগঞ্জে দুটোই শুরু করেছি। নারায়ণগঞ্জের নারীরা যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন সে কারণে সিটি করপোরেশন থেকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া নগর অংশীদারির মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ নামে একটি প্রকল্প আছে নারায়ণগঞ্জে। সেটি একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীদের ব্যাপক সহায়তা করছে।’
মেয়র জানালেন, এই প্রকল্পের আওতায় ৬৫টি সিডিসি (কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কমিটি) আছে। এর মধ্যে আবার ৫০১টি প্রাথমিক দল আছে। এর মোট সদস্যসংখ্যা ৮৯ হাজার ৫৬৬। তাঁরা প্রায় দুই কোটি টাকা সঞ্চয় করেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি প্রতিটি ছোট ছোট দল ভোট দিয়ে তাদের নেতা নির্বাচন করছে। এভাবেই তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে।’
সেলিনা হায়াৎ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার চার লাখ। এর মধ্যে দুই লাখই নারী ভোটার। আমি মনে করি, পুরুষের পাশাপাশি এই দুই লাখ নারী যদি তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, যদি তাঁদের আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়, তাহলে নারায়ণগঞ্জ এগিয়ে যাবেই।’
একজন জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষের কতটা আপন হতে পারেন, আইভী যেন সবাইকে তা–ই দেখিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণেই নারায়ণগঞ্জের মেয়র সবার প্রিয় আইভী আপা।
No comments