‘সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক উদ্যোগ অপরিহার্য’ -পঙ্কজ ভট্টাচার্য
বর্তমান
রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক উদ্যোগ অপরিহার্য বলে
মনে করেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, চলমান সঙ্কট
নিরসনে জাতীয় সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়ার কোন বিকল্প
নেই। মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন প্রবীণ এই
রাজনীতিবিদ। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণ হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দায়ী
করে তিনি বলেন, হিমশৈলের ৯ ভাগের এক ভাগ থাকে ভাসমান, বাকি ৮ ভাগ থাকে
ডুবন্ত, তেমনি বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের উপরিতল হলো একটি সর্বসম্মত
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান দুটি দলসহ রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে
অব্যাহত ও ক্রমবর্ধিত বিরোধ যা দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। এই বিরোধ
চক্রাকারে জাতীয় সঙ্কট ও সহিংস সংঘাতের ভয়াবহ চেহারা নিয়ে বারবার হাজির
হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য দুই দলের ব্যর্থতা
অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্রে বিরাজিত অপরাজনীতির বাতাবরণও এর জন্য
দায়ী। ফলে জনকল্যাণের যে রাজনীতি আমাদের পূর্বসূরিরা করেছেন তা কার্যত
ছিনতাই হয়ে গেছে। নীতিহীন, গণহীন ও ক্ষমতামুখী হয়ে গণতন্ত্র এক শবযাত্রায়
পর্যবসিত হতে চলেছে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্তমান সঙ্কটের
অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতের
সহিংসতা-নাশকতার আন্দোলনে তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলার প্রেক্ষাপটে সাংবিধানিক ধারা
ও দায় রক্ষার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচিত সরকারও ক্ষমতাসীন হয়েছে।
কিন্তু বিপুল জনগণের অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি এই নির্বাচনে ধরা
পড়েছে। একই সঙ্গে বিগত নির্বাচন প্রতিরোধে বিএনপি-জামায়াতের অংশগ্রহণ না
করার ভুল কৌশল এবং কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্তির অভাব তাদের নাশকতা ও
সহিংসতা-নির্ভর করে তুলেছে। শিশু-নারী নির্বিশেষে পুড়িয়ে মারা, রেল লাইন
তুলে ফেলা, জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে জনগণকে আন্দোলনের প্রতিপক্ষ করা
হয়েছে। রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে এই বাম রাজনীতিক বলেন,
নাশকতা-সহিংসতা বন্ধে জনগণের নিরাপত্তা বিধানে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ যেমন
অনিবার্য, তেমনি সঙ্কট সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জাতীয় রাজনৈতিক
উদ্যোগ অপরিহার্য। একই সঙ্গে দেশের স্বার্থে জাতীয় সমঝোতা ও জাতীয় মতৈক্য
অত্যাবশ্যকীয়। এক্ষেত্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন সঙ্কট মোচনের পরীক্ষিত পথ
কি-না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে পাঁচ বছর
অন্তর ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ এক জনহীন যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি দেশবাসী আর
দেখতে চায় না। এর স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে সরকার
ব্যবস্থা কি ধরনের হওয়া উচিত এবং নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক শক্তিশালী
প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা বিষয়ে জাতীয় মতৈক্য অতি জরুরি। সাংবিধানিক
ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচন নিয়ে সার্বিক সমঝোতা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায়
সহিংসতা-নাশকতা বনাম কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের যোগফল হবে
জামায়াত-জঙ্গিবাদীদের উত্থান এবং অসাংবিধানিক ক্ষমতার ধারায় প্রত্যাবর্তনের
আশঙ্কা। বিএনপি জামায়াতের হরতাল-অবরোধ মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকার বিষয়ে
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি বলেন, দলবিশেষের সমাবেশের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ এবং
নেতাকর্মীদের ওপর অব্যাহত হামলা, মামলা ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই
পথযাত্রায় রাষ্ট্র ক্রমশ কর্তত্ববাদী হয়ে উঠছে। পুলিশ কর্তারা
রাজনীতিবিদদের মত ভাষণ দিচ্ছেন, আর রাজনীতিবিদরা অনেকে পুলিশি ভাষা ও আচরণ
আয়ত্ব করছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও
তৎপরতাকে কিভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, এটি
আমাদের জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যের প্রতি বিদেশীদের চপেটাঘাত মনে
করি। এটি দুঃখজনক, অনাকাঙিক্ষত, অপমানজনক এবং স্বার্বভৌমত্বের পরিপন্থি।
রাজনৈতিক নাশকতা ও সহিংসতা দমনে ‘ক্রসফায়ার’ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
সমালোচনা করে তিনি বলেন, ক্রসফায়ার ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোন মতেই
সমর্থন করা যায় না। আইনের শাসন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড স্ববিরোধী,
সংবিধান পরিপন্থি, মানবতাবিরোধী। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনও শুভ ফল
বয়ে আনতে পারে না। এটা হয়তো শাসক গোষ্ঠীর সাময়িক স্বস্তিবোধ, শান্তি ও
নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা
থাকে শতভাগ। প্রায় ৬ বছর দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের সফলতা ও ব্যর্থতার
মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?- এমন প্রশ্নে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ বলেন, আওয়ামী
লীগ শাসনের গত এক বছর এবং পূর্ববর্তী ৫ বছরে গড় আয় ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি,
মাতৃত্ব ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি
ও শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এছাড়া দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়,
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলেও সরকারের
ব্যর্থতার পাল্লাও ভারী। শেয়ার মার্কেট লুটপাট, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ
গ্রুপসহ কতিপয় রাঘব বোয়ালদের হাতে বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের কোন
বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি। বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে
কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি দুর্নীতিবাজ কেউ কেউ পুরস্কৃতও
হয়েছে। এর মধ্যে অপ্রতিরোধ্য রয়েছে দলীয় ও অঙ্গসংগঠনের দখলদারি, চাঁদাবাজি ও
টেন্ডারবাজি। বেড়েছে আন্তঃদলীয় সংঘাতজনিত মৃত্যুর ঘটনা। ধর্মীয় ও জাতীয়
সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন ও তাদের ভূমিদখল বেড়েছে। অনেক
ক্ষেত্রে কোন ঘটনার বিচারও হয়নি। এক্ষেত্রে প্রশাসনের বৈরী পদক্ষেপ সঙ্কটকে
আরও গভীর করেছে।
সাক্ষাতকার নিয়েছেন উৎপল রায়
সাক্ষাতকার নিয়েছেন উৎপল রায়
No comments