খালেদার দিন শুরু হয় যেভাবে by কাফি কামাল
গুলশানের
সড়ক নম্বর ৮৬। ৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে- একটি সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়। বাড়ির দোতলায় ১৫ ফুট বাই ১৫
ফুট আকারের একটি কক্ষ। ২০০৮ সালের শেষের দিক থেকে যা ব্যবহৃত হচ্ছিল
চেয়ারপারসনের কক্ষ হিসেবে। কিন্তু চলতি বছরের ৩রা জানুয়ারি থেকে ৭ই মার্চ।
গুনে গুনে ৬৪ দিন। বর্গের হিসেবে ২২৫ ফুটের এ কক্ষেই কাটছে বিএনপি
চেয়ারপারসনের দিনগুলো। ৩রা জানুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার কার্যালয়ের
সামনের সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে অবরুদ্ধ করার পর থেকে ছোট্ট এ কক্ষেই সীমিত হয়ে
পড়েছে খালেদা জিয়ার চলাফেরা। কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং প্রয়োজন ছাড়া ওই কক্ষ
থেকে বের হন না তিনি। বের হবেনই বা কোথায়? সামনের একটু বড় যে কক্ষটি, তা
আগে মিটিং রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবরুদ্ধ দিনগুলোতে সে কক্ষেই অবস্থান
করছেন দলের দুই সিনিয়র মহিলা নেত্রী সেলিমা রহমান ও শিরিন সুলতানা। দ্বিতীয়
তলার অন্য কক্ষ এবং নিচতলা বড় ব্রিফিং রুম তো এখন এক অর্থে পরিণত হয়েছে
কারাগারের ওয়ার্ডে। ত্রাণের কম্বল বিছিয়ে ও বালিশ বানিয়ে সেখানেই অবস্থান
করছেন কার্যালয়ে অবস্থানরত কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ২২৫
বর্গ ফুটের সে কক্ষে কিভাবে কাটছে খালেদা জিয়ার দিন-রাত? এমন প্রশ্ন ও
কৌতূহল এখন সবমহলে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবরুদ্ধ ও কৌশলগত অবস্থানের
দিনগুলোতে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি খালেদা জিয়ার জীবনযাত্রায়। মধ্যখানে
ছেলের মৃত্যুর কারণে দুটি সপ্তাহ তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে
পড়েছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের স্বার্থে দ্রুত তিনি পুত্রশোক বুকে পাথর চাপা
দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেছেন। সূত্র জানায়, রাত ২টায় ঘুমুতে গেলেও প্রতিদিন
ফজরের আজানের পর শুরু হয় খালেদা জিয়ার দিন। ঘুম থেকে উঠেই তিনি ফজরের নামাজ
পড়েন। তারপর এক গ্লাস ফলের জুস খান। এসময় তিনি দুই মহিলা নেত্রীর কাছ থেকে
সর্বশেষ তথ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় দফা ঘুমোতে যান
তিনি। বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠেন। কোন কোন দিন দুপুরের পর, তবে বেশির ভাগ
দিনই বিকালে সামনের ড্রয়িং রুমটিতে আসেন। সেখানে কার্যালয়ে অবস্থানরত
নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তারপর ফের চলে যান নিজের
কক্ষে। প্রতিদিনই তার বড় বোন সেলিনা ইসলাম ও ছোট দুই ভাইয়ের স্ত্রী
কার্যালয়ে যান। মাঝে-মধ্যে যান বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা
রহমানের বড় বোন শাহীনা খান বিন্দু। তাদের সঙ্গেই মূলত নিজের কক্ষে বেশির
ভাগ সময় কাটে তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। এছাড়া সর্বক্ষণ তার সঙ্গে
থাকেন দীর্ঘদিনের কাজের মেয়ে ফাতেমা। প্রতিদিন তার কক্ষে কয়েকটি জাতীয়
দৈনিক দেয়া হয়। তিনি সেগুলো ও দলের এবং আন্দোলনের নানা তথ্য-উপাত্ত পড়েন।
আগে ক্যাবল টিভির মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যানেলে সংবাদ এবং নানা অনুষ্ঠান দেখলেও
ক্যাবল সংযোগ বিচ্ছিন্নের পর সে সুযোগ পাচ্ছেন না। দুই সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন
রাখার পর মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু করা হলে তিনি মোবাইল যোগাযোগ করতে পারছেন।
তার খাবার আসে ছোট দুই ভাই সাঈদ এস্কান্দার ও শামীম এস্কান্দার এবং তারেক
রহমানের শ্বশুর বাড়ি থেকে। এদিকে কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খাবার
সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তার স্টাফদের অভুক্ত রেখে খালেদা জিয়া কয়েকদিন
খাবার খাননি বলে জানান, তার সঙ্গে কার্যালয়ে অবস্থানরত দলের ভাইস
চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। ওদিকে কার্যালয় অবরুদ্ধ, সরকার সমর্থক সংগঠনগুলোর
ঘেরাও কর্মসূচি, বিদ্যুৎ, ক্যাবল টিভি, ইন্টারনেট ও মোবাইল সংযোগ
বিচ্ছিন্ন, খাবার সরবরাহ বন্ধ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি, কার্যালয় তল্লাশির
অনুমতিসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখেও আন্দোলনের স্বার্থে ওই কার্যালয় ছেড়ে
যাননি তিনি। ফলে এখনও ছেলের কবর জেয়ারত করতে পারেননি তিনি। অবরুদ্ধ অবস্থায়
পালন করতে হয়েছে ছেলের চেহলাম। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল ঘোষিত ৫ই
জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গত ৩রা জানুয়ারি
সন্ধ্যার পর রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান তিনি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে দলের যুগ্ম
মহাসচিব অসুস্থ রিজভী আহমেদকে দেখতে যেতে চাইলে বাইরে তাৎক্ষণিকভাবে
মোতায়েন করা হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। সেই সঙ্গে তার
কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুইপাশে দেয়া হয় ব্যারিকেড। নিজের কার্যালয়ে
প্রথম রাত সোফায় বসেই কাটান খালেদা জিয়া। সেখানে ঘুমানোর ব্যবস্থা না থাকায়
পরদিন বাসা থেকে জাজিম, কম্বল, তোষক আনা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী গুলশান-২ এর ৮৬ নম্বর সড়কে যান ও লোক চলাচল বন্ধ করে দেয়। ২০ দলের
ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে ৫ই জানুয়ারি বিকালে কার্যালয় থেকে বের হওয়ার
চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। তিনি গাড়িতে ওঠে ফটকের কাছে এসে দীর্ঘক্ষণ
অপেক্ষা করেন। একপর্যায়ে সেখানে দাঁড়িয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশে
অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন তিনি। এ সময় তার ওপর প্রেপপার স্প্রে ছুড়ে
পুলিশ। এতে বমি, চোখ, নাক দিয়ে পানি ঝরা ও শারীরিক ব্যথায় গুরুতর অসুস্থ
হয়ে পড়েন তিনি। কার্যালয়েই চিকিৎসকরা একটি মেডিকেল টিম গঠন করে তার চিকিৎসা
করেন। ১৯শে জানুয়ারি ভোর রাতে বিনা ঘোষণায় খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে
অবরোধ তুলে নেয় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। খুলে দেয়া হয় কার্যালয়ের মূল ফটকের
তালা। তবে কার্যালয়ের তিনদিকে কিছু দূরে পুলিশ মোতায়েন ও গোয়েন্দা সংস্থার
সদস্যদের তৎপরতা অব্যাহত রাখা হয়। কার্যালয় থেকে পুলিশি অবরোধ তুলে নেয়ার
পর সন্ধ্যায় দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বৈঠকের পর
কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর প্রতি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে
বক্তব্য দেন তিনি। সেইসঙ্গে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ২৪শে
জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান
কোকো। আকস্মিক ছোট ছেলের মৃত্যুর সংবাদে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন খালেদা
জিয়া। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। এসময়
প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে গেলেও তিনি সাক্ষাৎ পাননি। এদিকে যখন ছেলে
হারিয়ে শোকাহত তখনই তাকে হুকুমের আসামি করে দায়ের করা হয় একের পর এক মামলা।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামসহ কয়েকটি জায়গায় যানবাহন
পোড়ানো ও মানুষ হত্যার ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে মামলা দায়ের হয়। ২৭শে
জানুয়ারি দেশে আনা হয় আরাফাত রহমান কোকোর লাশ। বিকালে তার কফিন গুলশান
কার্যালয়ে নেয়া হলে ‘আমার কোকো’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। ছেলের
মরদেহ শেষবারের মতো দেখেন তিনি। ২৯শে জানুয়ারি দলের স্থায়ী কমিটির ৭ জন
সদস্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৩০শে জানুয়ারি খালেদা জিয়ার
কার্যালয়ে যান গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক
মাহমুদুর রহমান মান্না। ৩০শে জানুয়ারি শেষ রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের
বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল
নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। নানা মহলের সমালোচনার মুখে ১৯ ঘণ্টা পর তার
কার্যালয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও অন্যান্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। ২রা
ফেব্রুয়ারি অবরোধ ও হরতালে ৪২ জনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগে ঢাকার মুখ্য
মহানগর হাকিমের আদালতে খালেদা জিয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি
প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমেদকে আসামি করে নালিশি মামলা দায়ের করেন জননেত্রী
পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী। পরদিন ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় দফায়
কড়াকাড়ি আরোপ করা হয়। এক পর্যায়ে ওই সংগঠনের মফিজুল নামে এক নেতা পিস্তল
হাতে কার্যালয়ের দিকে ছুটে যান। এ সময় তিনি খালেদা জিয়াকে গুলি করার হুমকি
দেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা ও পরদিন পঞ্চগড়ে খালেদা জিয়া হুকুমের আসামি
করে দুইটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিজেদের সংলাপের উদ্যোগ
প্রসঙ্গে খালেদা জিয়াকে একটি চিঠি দেয় নাগরিক সমাজ। ১০ই ফেব্রুয়ারি বিকালে
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুলশান কার্যালয়ে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত
বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। এদিকে ১১ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর খালেদা
জিয়ার কার্যালয়ে অবস্থানকারীদের জন্য নেয়া খাবার ভ্যানটি ফিরিয়ে দেয় পুলিশ।
সেই সঙ্গে কড়াকড়ি আরোপ করা হয় কার্যালয় ঘিরে। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই
কার্যালয়ের গেটে একটি টেবিল ও খাতা-কলম নিয়ে বসে স্পেশাল ব্রাঞ্চের
সদস্যরা। কার্যালয়ের আশপাশের দূতাবাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুই সপ্তাহ পর
ওই এলাকায় সচল করা হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক। ওদিকে ১১ই ফেব্রুয়ারির পর থেকে
কেবল খালেদা জিয়ার ছাড়া অন্যদের খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। যা এখনও
অব্যাহত রয়েছে। এতে চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে তার কার্যালয়ে অবস্থানকারী ৩০-৩৬
জন লোক। ১৫ই ফেব্রুয়ারি নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার
কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। এদিকে জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিশেষ আদালত ২৫শে
ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর যে
কোন মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে
সবখানে। এরই মধ্যে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের সমাবেশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায়
দায়ের করা মামলায় গুলশান থানা পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার
কার্যালয় তল্লাশির অনুমতি দেয় আদালত। যখন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের
ব্যাপারে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে তখনই ৩রা মার্চ তার কার্যালয়ে যান মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী ৯ দেশ ও সংস্থার
কূটনীতিকরা। হঠাৎ করে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কূটনীতিকদের এ সাক্ষাতের পর
অনেকটাই চাপা পড়ে গ্রেপ্তারের গুঞ্জন। তবে এখনও তিনি গুলশান কার্যালয়েই
অবস্থান করছেন। আগের মতোই তার কার্যালয়ের সামনে টেবিল পেতে স্পেশাল ব্রাঞ্চ
ও আশপাশে অব্যাহত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ গোয়েন্দা সংস্থার
সদস্যদের তৎপরতা।
No comments