আবার ব্লগার হত্যা
কাকে,
কেন খুন করা হচ্ছে, তার কিছুই জানা ছিল না মাদ্রাসাছাত্র জিকরুল্লাহ ও
আরিফুল ইসলামের। এমনকি যাঁকে হত্যা করা হলো, তিনি কোথায় কী লিখেছেন, তা-ও
জানতেন না। তাঁদের শুধু বলা হয়েছে, ধর্মের অবমাননা হয়েছে। এরপর ছবি
দেখানো হয়েছে, বাসা চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাতে দেওয়া হয়েছে চাপাতি। আর তা
দিয়ে কুপিয়ে একজন মানুষকে খুন করে ফেলেছেন তাঁরা। ব্লগার ও অনলাইন লেখক
ওয়াশিকুর রহমানকে (২৭) হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়া এই দুই
মাদ্রাসাছাত্র সাংবাদিকদের কাছে এমন কথা বলেছেন। পুলিশ ও
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর
তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ী দীপিকার মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়
ওয়াশিকুরকে। জিকরুল্লাহ, আরিফুলসহ তিনজন হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। ঘটনাস্থলে
থাকা কয়েকজন হিজড়া, স্থানীয় অন্যান্য মানুষ ও পুলিশ মিলে দুজনকে ধাওয়া দিয়ে
ধরে ফেলে। এঁদের বয়স ২০-এর কোঠায়।
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে শত শত মানুষ ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় আরেক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আর গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। তবে একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই শনাক্ত করতে পারেনি।
ঘটনার শুরু: গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের মধ্যে জিকরুল্লাহ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার আর আরিফুল রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। তবে পুলিশ গতকাল রাত পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি যে তাঁরা ওই দুটি মাদ্রাসার ছাত্র কি না।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিকরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর পূর্বপরিচিত ‘মাসুম ভাই’র কথামতো শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে একটি মাদ্রাসায় এক বন্ধুর কাছে রাত কাটান। এরপর রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে সেই ‘মাসুম ভাই’য়ের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে মাসুম, তিনি (জিকরুল্লাহ), আরিফুল ও তাহের মিলে আলোচনা হয়। এর আগে তিনি আরিফুল বা তাহেরকে চিনতেন না। মাসুম তাঁদের ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে বলেন, এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছেন, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাঁকে হত্যা করতে হবে। এরপর মাসুম তাঁদের সঙ্গে গিয়ে হাতিরঝিলের পাশে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেন। তিনি কখন বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হন, কোন দিক দিয়ে কীভাবে হামলা করা যাবে, সেসব বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। তাঁরা ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা ভালোভাবে চিনে নেন। মাসুম তাঁদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেন। এরপর গতকাল সকালে তাঁরা দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেন। ওয়াশিকুরকে দেখে জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি বের করে কোপ দেন। আরিফুল চাপাতি বের করার আগেই স্থানীয় মানুষ ধাওয়া দেয়। চাপাতিসহ ব্যাগ হাতে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, তিনি এর আগে কখনোই ওয়াশিকুরকে দেখেননি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও জানেন না। শুধু ‘মাসুম ভাই’য়ের কথাতেই তাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটান। তাঁরা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কোনো দল নাই।’ মাসুম ভাইয়ের পরিচয় জানতে চাইলেও কোনো তথ্য দেননি জিকরুল্লাহ।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, মতাদর্শগত কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ ওয়াশিকুরের লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। এই হত্যার ধরনের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার হত্যার মিল রয়েছে।
যেভাবে ঘটনা: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলচে ফুলশার্ট ও জিনস পরিহিত ওয়াশিকুর দীপিকার মোড়ের দিকে যেতেই গলির মধ্যে তিনজন লোকের মধ্যে দুজন তাঁকে হঠাৎ কোপাতে শুরু করেন। পাশেই কয়েকজন হিজড়া দাঁড়ানো ছিলেন। তাঁরাসহ কয়েকজন নারী ‘মাইরা ফেললো, মাইরা ফেললো’ বলে চিৎকার শুরু করলে হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই চাপাতি ফেলে দৌড় দেন। এ সময় হিজড়ারাও পিছু ধাওয়া করেন। এলাকার লোকজনও যোগ দেন তাতে। অল্প দূরত্বেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল ছিল। তারাও দৌড়ানো শুরু করে। হিজড়ারা প্রথমেই জিকরুল্লাহকে ধরে ফেলেন। এরপর জনতা ও পুলিশ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ব্যাগসহ আরিফুলকে ধরে ফেলেন।
জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিনস, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেক প্রস্থ গেঞ্জি ছিল। এ ছাড়া তাঁদের সঙ্গে চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবিও ছিল। খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁরা লাল পোশাক পরে এসেছিলেন বলে পুলিশের ধারণা। এরপর পোশাক বদলে খুব সহজে সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে যাওয়ার জন্য দুই প্রস্থ পোশাক পরেছিলেন তাঁরা। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পাঞ্জাবিও।
পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা নিহত ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ, নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পরিচয় ও লেখালেখি: নিহত ওয়াশিকুর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তেজগাঁও কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। বাবাকে নিয়ে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন ওয়াশিকুর।
ফারইস্ট এভিয়েশনের মহাব্যবস্থাপক শাহেদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর ধরে ওই অফিসে কাজ করতেন ওয়াশিকুর। গতকাল সকাল ১০টার দিকে দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতে তিনি ওয়াশিকুরকে ফোন করলে একজন পুলিশ সদস্য ফোন ধরে জানান, তিনি খুন হয়েছেন।
একটি গোষ্ঠীবদ্ধ ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে লিখতেন ওয়াশিকুর। সেখানে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছরের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।’ এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তাঁর পাতানো বোন তামান্না সেতু প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর শুধু ফেসবুকেই লিখতেন।
ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, তিনি ফেসবুকে ‘আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...’ শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা লিখতেন। সেই লেখাটি ১০৩ পর্ব পর্যন্ত পৌঁছেছে। ওই লেখায় মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়মকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন, ‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে।’
কেঁদে ফেলে তামান্না সেতু বলেন, ‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।’
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে শত শত মানুষ ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় আরেক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আর গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। তবে একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই শনাক্ত করতে পারেনি।
ঘটনার শুরু: গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের মধ্যে জিকরুল্লাহ চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার আর আরিফুল রাজধানীর মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। তবে পুলিশ গতকাল রাত পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি যে তাঁরা ওই দুটি মাদ্রাসার ছাত্র কি না।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিকরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর পূর্বপরিচিত ‘মাসুম ভাই’র কথামতো শনিবার তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে একটি মাদ্রাসায় এক বন্ধুর কাছে রাত কাটান। এরপর রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে সেই ‘মাসুম ভাই’য়ের সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে মাসুম, তিনি (জিকরুল্লাহ), আরিফুল ও তাহের মিলে আলোচনা হয়। এর আগে তিনি আরিফুল বা তাহেরকে চিনতেন না। মাসুম তাঁদের ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে বলেন, এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছেন, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তাঁকে হত্যা করতে হবে। এরপর মাসুম তাঁদের সঙ্গে গিয়ে হাতিরঝিলের পাশে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেন। তিনি কখন বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হন, কোন দিক দিয়ে কীভাবে হামলা করা যাবে, সেসব বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। তাঁরা ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা ভালোভাবে চিনে নেন। মাসুম তাঁদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেন। এরপর গতকাল সকালে তাঁরা দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেন। ওয়াশিকুরকে দেখে জিকরুল্লাহ ও তাহের চাপাতি বের করে কোপ দেন। আরিফুল চাপাতি বের করার আগেই স্থানীয় মানুষ ধাওয়া দেয়। চাপাতিসহ ব্যাগ হাতে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, তিনি এর আগে কখনোই ওয়াশিকুরকে দেখেননি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও জানেন না। শুধু ‘মাসুম ভাই’য়ের কথাতেই তাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটান। তাঁরা কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের কোনো দল নাই।’ মাসুম ভাইয়ের পরিচয় জানতে চাইলেও কোনো তথ্য দেননি জিকরুল্লাহ।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, মতাদর্শগত কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অর্থাৎ ওয়াশিকুরের লেখার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গোষ্ঠী এই হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। এই হত্যার ধরনের সঙ্গে অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার হত্যার মিল রয়েছে।
যেভাবে ঘটনা: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নীলচে ফুলশার্ট ও জিনস পরিহিত ওয়াশিকুর দীপিকার মোড়ের দিকে যেতেই গলির মধ্যে তিনজন লোকের মধ্যে দুজন তাঁকে হঠাৎ কোপাতে শুরু করেন। পাশেই কয়েকজন হিজড়া দাঁড়ানো ছিলেন। তাঁরাসহ কয়েকজন নারী ‘মাইরা ফেললো, মাইরা ফেললো’ বলে চিৎকার শুরু করলে হামলাকারী দুজন ঘটনাস্থলেই চাপাতি ফেলে দৌড় দেন। এ সময় হিজড়ারাও পিছু ধাওয়া করেন। এলাকার লোকজনও যোগ দেন তাতে। অল্প দূরত্বেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দল ছিল। তারাও দৌড়ানো শুরু করে। হিজড়ারা প্রথমেই জিকরুল্লাহকে ধরে ফেলেন। এরপর জনতা ও পুলিশ মিলে প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে একটি ব্যাগসহ আরিফুলকে ধরে ফেলেন।
জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিনস, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেক প্রস্থ গেঞ্জি ছিল। এ ছাড়া তাঁদের সঙ্গে চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবিও ছিল। খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য পরিকল্পিতভাবে তাঁরা লাল পোশাক পরে এসেছিলেন বলে পুলিশের ধারণা। এরপর পোশাক বদলে খুব সহজে সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে যাওয়ার জন্য দুই প্রস্থ পোশাক পরেছিলেন তাঁরা। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পাঞ্জাবিও।
পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা নিহত ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ, নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পরিচয় ও লেখালেখি: নিহত ওয়াশিকুর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তেজগাঁও কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। বাবাকে নিয়ে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন ওয়াশিকুর।
ফারইস্ট এভিয়েশনের মহাব্যবস্থাপক শাহেদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর ধরে ওই অফিসে কাজ করতেন ওয়াশিকুর। গতকাল সকাল ১০টার দিকে দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতে তিনি ওয়াশিকুরকে ফোন করলে একজন পুলিশ সদস্য ফোন ধরে জানান, তিনি খুন হয়েছেন।
একটি গোষ্ঠীবদ্ধ ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে লিখতেন ওয়াশিকুর। সেখানে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছরের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।’ এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে তাঁর পাতানো বোন তামান্না সেতু প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর শুধু ফেসবুকেই লিখতেন।
ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, তিনি ফেসবুকে ‘আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...’ শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা লিখতেন। সেই লেখাটি ১০৩ পর্ব পর্যন্ত পৌঁছেছে। ওই লেখায় মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়মকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন, ‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে।’
কেঁদে ফেলে তামান্না সেতু বলেন, ‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।’
No comments