উত্তরের শিল্পশহর বগুড়ার অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত by আশীষ-উর-রহমান ও আনোয়ার পারভেজ
বিএনপির
নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকে অবরোধ-হরতাল শুরুর পর বগুড়ায় মহাসড়কে
যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে
উঠেছিল। এমনকি ব্যবসায়ীদের সংগঠন জেলা চেম্বার অব কমার্স কার্যালয়েও দুই
দফা পেট্রলবোমা হামলা হয়েছে। নাশকতার কারণে দেখা দিয়েছিল আতঙ্ক।
দুই সপ্তাহ ধরে নাশকতা তেমন নেই। কাটছে আতঙ্কও। পুলিশের দাবি, বগুড়া শহর এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য এর আগেই উত্তরাঞ্চলের শিল্পশহর বগুড়ার অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। গত ৬ জানুয়ারি অবরোধ-হরতাল শুরুর পর বগুড়া শহর ও এর আশপাশে ঢাকা-বগুড়া-রংপুর এবং বগুড়া-রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থান যানবাহনে নাশকতার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছিল। অথচ দক্ষিণে মংলা বন্দর ও ভোমরা স্থলবন্দর থেকে উত্তরের বুড়িমারী ও হিলি স্থলবন্দর এবং রাজধানী ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু এই শহর। বগুড়ায় নাশকতার কারণে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ কার্যত প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২৬ মার্চ পর্যন্ত জেলায় ৬৯টি যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা বা আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ৩০টি যানবাহন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পরিসংখ্যানে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রায় ৮০টি। সব মিলিয়ে নাশকতা হয়েছে দুই শতাধিক যানে। তবে বগুড়ায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলা হয়নি। পেট্রলবোমা হামলা বেশি হয়েছে ট্রাকে। ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় প্রাণ গেছে ছয়জনের। পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৩৩ জন ভর্তি হয়েছেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বগুড়া সদরের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোকুল, মাটিডালি মোড়, ঝোপগাড়ি, বারপুর, চারমাথা, তিনমাথা, সিলিমপুর, লিচুতলা, শাজাহানপুরের ফটকি সাঁকো, মাঝিড়া বন্দর, শহরতলির নিশ্চিন্তপুর, সাবগ্রাম, বগুড়া-নওগাঁ সড়কের এরুলিয়া, বগুড়া-নাটোর-রাজশাহী সড়কের শাকপালা ও রূপিহার এলাকায় মার্চের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এমন দিন যায়নি, যেদিন যানবাহনে হামলা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অভিযানও হয়েছে ব্যাপক। জেলার ১২টি থানায় অনেক লোককে আটক করা হয়েছে। তাঁদের কাউকে কাউকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর অধিকাংশকেই বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। এঁদের সংখ্যা ৯০৭ জন। বিভিন্ন ঘটনায় করা ৭৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ১১৪ জনকে। পুলিশের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ চালু আছে জেলায়। বিশেষ করে শহরের সেউজগাড়ি আমতলা, তালুকদারপাড়া ও সবুজবাগ এলাকায় বিভিন্ন কলেজের ছাত্রাবাসে ব্যাপক ধরপাকড় ও টাকার বিনিময়ে পরে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ শোনা গেল অনেকের মুখে। তবে এই অভিযোগকারীরা নাম প্রকাশ করতে চান না।
একজন বললেন, ‘পুলিশের এখন ব্যাপক ক্ষমতা। কথাবার্তা তাদের মনমতো না হলেই ধরে নিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেবে চৌদ্দ শিকের ভেতর। এ কারণেই নাম জানাতে ভয়।’ অবশ্য পুলিশের অভিযানের কারণে নাশকতার ভয় কমেছে। শহরে ধীরে ধীরে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, যোগাযোগ—এসব ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের ব্যস্ত শহর বগুড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছিল স্থবির। বিপুল ক্ষতি হয়েছে কৃষির। অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত।
বগুড়ায় মাঝারি ও বড় ঢালাই কারখানা আছে ৩৮টি। ছোট কারখানা অনেক। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ সেচযন্ত্র এসব কারখানায় তৈরি হয়। ঢালাই কারখানার সঙ্গে সম্পর্কিত ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সংখ্যা হাজারের বেশি। ফাউন্ড্রি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আইনুল হক গত শুক্রবার প্রথম আলোকে জানান, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এসব কারখানার প্রধান মৌসুম। প্রতি মৌসুমে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এবার পুরো মৌসুম তাঁরা মার খেয়েছেন। শুধু ব্যাংকঋণের সুদ মেটাতেই যাবে ২০০ কোটি টাকার ওপর।
বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি সারা দেশে। এখানেও পড়েছে হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব। এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল বাশার বলেন, ‘প্রতিদিন শহরের দোকানগুলোতে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার কেজি দই বিক্রি হয়। অবরোধের প্রথম দুই মাস ব্যবসা প্রায় বন্ধ ছিল। এখন বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক।’
জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি এনামুল হকের মতে, স্বাধীনতার পর এ বছরই বগুড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে। শত শত চাতাল, ৩৫টি অটো, সেমি-অটো চালকল বন্ধ। বেকার হয়েছেন শ্রমিকেরা। প্রচুর দোকান-মার্কেটে ভরা এই শহর। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় মালিকদের পকেট থেকে কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে। কৃষির অবস্থা আরও ভয়াবহ। ভরা মৌসুম ছিল সবজির। পরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষকেরা তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারেননি। শিবগঞ্জের হাটে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে এক টাকায়। কৃষকেরা দাম পাননি, অথচ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় শহরের ক্রেতারা সবজি কিনেছেন চড়া দামে। কৃষির অর্থনীতি পুরোটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এ মুহূর্তে নিরূপণ করা না গেলেও তা যে বিপুল হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কয়েকজন শহরবাসী জানান, মার্চের শুরু থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। একটি-দুটি করে দোকানপাট খুলতে থাকে। পুলিশি অভিযান জোরদার থাকায় ভয়ও কাটতে থাকে। দিনে যান চলাচল, বিশেষ করে আন্তজেলা যান চলাচল বাড়তে থাকে। ঢাকাগামী বাস চলাচলও শুরু হয়। খোলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
বগুড়া মোটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাগর রায় জানান, ১৩টি বাস-মিনিবাস সম্পূর্ণ পুড়েছে। হরতাল-অবরোধের নাশকতায় জেলার মোটরযানের ক্ষতি হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার ওপর। এখন আন্তজেলা পথের ৮০ শতাংশ বাস চলাচল করছে। গত সপ্তাহ থেকে ঢাকাগামী নৈশ কোচও চলছে। মানুষের মনে চেপে বসা নাশকতার আতঙ্ক মুছে যাচ্ছে দ্রুত।
শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও হচ্ছে সচকিত। নাশকতার কারণে এবার একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। শহীদ খোকন পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লোকসমাগম ছিল কম।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান জানালেন, একুশের জমায়েত ও অনুষ্ঠান হয়েছে সীমিত পরিসরে। তাঁদের নিয়মিত বার্ষিক নাট্যোৎসবের কর্মসূচি ছিল ফেব্রুয়ারিতে, তা হয়নি। গত দুই মাসই কর্মসূচিশূন্য ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তবে তিন দিনব্যাপী স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে আগের মতোই উৎসাহ-উদ্দীপনায়। সামনেই বাংলা নববর্ষ। প্রস্তুতি চলছে মেলাসহ নানা আয়োজনে ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী উৎসবের।
শহরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অবরুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। লোকে জীবনযাপনের অনিবার্য প্রয়োজনেই সাহস নিয়ে দোকানপাট খুলেছেন, স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে নানা মহলের অভিযোগ থাকলেও তাদের ভূমিকা মানুষের এই মনোবল বাড়াতে সহায়ক হয়েছে, তা বলা যায়।’
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া শহর ও আশপাশের মহাসড়কের ১০০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ পুলিশের হাতে। গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ ঠিক নয়। শহরে যে বিভীষিকাময় অবস্থা ছিল, তা থেকে এখন মুক্ত। পুলিশও সহিংসতার শিকার হয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ দিনরাত সার্বক্ষণিক সক্রিয় রয়েছে।
দুই সপ্তাহ ধরে নাশকতা তেমন নেই। কাটছে আতঙ্কও। পুলিশের দাবি, বগুড়া শহর এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। অবশ্য এর আগেই উত্তরাঞ্চলের শিল্পশহর বগুড়ার অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। গত ৬ জানুয়ারি অবরোধ-হরতাল শুরুর পর বগুড়া শহর ও এর আশপাশে ঢাকা-বগুড়া-রংপুর এবং বগুড়া-রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থান যানবাহনে নাশকতার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছিল। অথচ দক্ষিণে মংলা বন্দর ও ভোমরা স্থলবন্দর থেকে উত্তরের বুড়িমারী ও হিলি স্থলবন্দর এবং রাজধানী ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু এই শহর। বগুড়ায় নাশকতার কারণে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ কার্যত প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল।
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২৬ মার্চ পর্যন্ত জেলায় ৬৯টি যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা বা আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ৩০টি যানবাহন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পরিসংখ্যানে যানবাহনে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রায় ৮০টি। সব মিলিয়ে নাশকতা হয়েছে দুই শতাধিক যানে। তবে বগুড়ায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলা হয়নি। পেট্রলবোমা হামলা বেশি হয়েছে ট্রাকে। ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় প্রাণ গেছে ছয়জনের। পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৩৩ জন ভর্তি হয়েছেন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বগুড়া সদরের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গোকুল, মাটিডালি মোড়, ঝোপগাড়ি, বারপুর, চারমাথা, তিনমাথা, সিলিমপুর, লিচুতলা, শাজাহানপুরের ফটকি সাঁকো, মাঝিড়া বন্দর, শহরতলির নিশ্চিন্তপুর, সাবগ্রাম, বগুড়া-নওগাঁ সড়কের এরুলিয়া, বগুড়া-নাটোর-রাজশাহী সড়কের শাকপালা ও রূপিহার এলাকায় মার্চের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এমন দিন যায়নি, যেদিন যানবাহনে হামলা হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অভিযানও হয়েছে ব্যাপক। জেলার ১২টি থানায় অনেক লোককে আটক করা হয়েছে। তাঁদের কাউকে কাউকে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর অধিকাংশকেই বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। এঁদের সংখ্যা ৯০৭ জন। বিভিন্ন ঘটনায় করা ৭৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ১১৪ জনকে। পুলিশের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ চালু আছে জেলায়। বিশেষ করে শহরের সেউজগাড়ি আমতলা, তালুকদারপাড়া ও সবুজবাগ এলাকায় বিভিন্ন কলেজের ছাত্রাবাসে ব্যাপক ধরপাকড় ও টাকার বিনিময়ে পরে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ শোনা গেল অনেকের মুখে। তবে এই অভিযোগকারীরা নাম প্রকাশ করতে চান না।
একজন বললেন, ‘পুলিশের এখন ব্যাপক ক্ষমতা। কথাবার্তা তাদের মনমতো না হলেই ধরে নিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দেবে চৌদ্দ শিকের ভেতর। এ কারণেই নাম জানাতে ভয়।’ অবশ্য পুলিশের অভিযানের কারণে নাশকতার ভয় কমেছে। শহরে ধীরে ধীরে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, যোগাযোগ—এসব ক্ষেত্রে উত্তরাঞ্চলের ব্যস্ত শহর বগুড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ছিল স্থবির। বিপুল ক্ষতি হয়েছে কৃষির। অর্থনীতি প্রায় বিধ্বস্ত।
বগুড়ায় মাঝারি ও বড় ঢালাই কারখানা আছে ৩৮টি। ছোট কারখানা অনেক। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ সেচযন্ত্র এসব কারখানায় তৈরি হয়। ঢালাই কারখানার সঙ্গে সম্পর্কিত ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের সংখ্যা হাজারের বেশি। ফাউন্ড্রি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আইনুল হক গত শুক্রবার প্রথম আলোকে জানান, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এসব কারখানার প্রধান মৌসুম। প্রতি মৌসুমে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এবার পুরো মৌসুম তাঁরা মার খেয়েছেন। শুধু ব্যাংকঋণের সুদ মেটাতেই যাবে ২০০ কোটি টাকার ওপর।
বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি সারা দেশে। এখানেও পড়েছে হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব। এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল বাশার বলেন, ‘প্রতিদিন শহরের দোকানগুলোতে প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার কেজি দই বিক্রি হয়। অবরোধের প্রথম দুই মাস ব্যবসা প্রায় বন্ধ ছিল। এখন বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক।’
জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি এনামুল হকের মতে, স্বাধীনতার পর এ বছরই বগুড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কৃষিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে। শত শত চাতাল, ৩৫টি অটো, সেমি-অটো চালকল বন্ধ। বেকার হয়েছেন শ্রমিকেরা। প্রচুর দোকান-মার্কেটে ভরা এই শহর। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় মালিকদের পকেট থেকে কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে। কৃষির অবস্থা আরও ভয়াবহ। ভরা মৌসুম ছিল সবজির। পরিবহন বন্ধ থাকায় কৃষকেরা তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে পারেননি। শিবগঞ্জের হাটে প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি হয়েছে এক টাকায়। কৃষকেরা দাম পাননি, অথচ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় শহরের ক্রেতারা সবজি কিনেছেন চড়া দামে। কৃষির অর্থনীতি পুরোটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এ মুহূর্তে নিরূপণ করা না গেলেও তা যে বিপুল হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কয়েকজন শহরবাসী জানান, মার্চের শুরু থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। একটি-দুটি করে দোকানপাট খুলতে থাকে। পুলিশি অভিযান জোরদার থাকায় ভয়ও কাটতে থাকে। দিনে যান চলাচল, বিশেষ করে আন্তজেলা যান চলাচল বাড়তে থাকে। ঢাকাগামী বাস চলাচলও শুরু হয়। খোলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
বগুড়া মোটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাগর রায় জানান, ১৩টি বাস-মিনিবাস সম্পূর্ণ পুড়েছে। হরতাল-অবরোধের নাশকতায় জেলার মোটরযানের ক্ষতি হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার ওপর। এখন আন্তজেলা পথের ৮০ শতাংশ বাস চলাচল করছে। গত সপ্তাহ থেকে ঢাকাগামী নৈশ কোচও চলছে। মানুষের মনে চেপে বসা নাশকতার আতঙ্ক মুছে যাচ্ছে দ্রুত।
শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও হচ্ছে সচকিত। নাশকতার কারণে এবার একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। শহীদ খোকন পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লোকসমাগম ছিল কম।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান জানালেন, একুশের জমায়েত ও অনুষ্ঠান হয়েছে সীমিত পরিসরে। তাঁদের নিয়মিত বার্ষিক নাট্যোৎসবের কর্মসূচি ছিল ফেব্রুয়ারিতে, তা হয়নি। গত দুই মাসই কর্মসূচিশূন্য ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তবে তিন দিনব্যাপী স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে আগের মতোই উৎসাহ-উদ্দীপনায়। সামনেই বাংলা নববর্ষ। প্রস্তুতি চলছে মেলাসহ নানা আয়োজনে ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী উৎসবের।
শহরের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অবরুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। লোকে জীবনযাপনের অনিবার্য প্রয়োজনেই সাহস নিয়ে দোকানপাট খুলেছেন, স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে নানা মহলের অভিযোগ থাকলেও তাদের ভূমিকা মানুষের এই মনোবল বাড়াতে সহায়ক হয়েছে, তা বলা যায়।’
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া শহর ও আশপাশের মহাসড়কের ১০০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ পুলিশের হাতে। গণগ্রেপ্তার ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগ ঠিক নয়। শহরে যে বিভীষিকাময় অবস্থা ছিল, তা থেকে এখন মুক্ত। পুলিশও সহিংসতার শিকার হয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ দিনরাত সার্বক্ষণিক সক্রিয় রয়েছে।
No comments