সিলেটে খালেদ হত্যা- ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট by ওয়েছ খছরু
১২
লাখ টাকা লুটের জন্য অপহরণ করা হয় সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ছাত্র
খালেদুজ্জামানকে। পরে স্কুলছাত্র আবু সাঈদ খুনের স্টাইলে তাকেও খুন করে লাশ
গুম করার চেষ্টা চালিয়েছিল ঘাতকরা। খালেদ হত্যার ৭ মাস পর পুলিশ আলোচিত এ
হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে। রোববার আদালতে দেয়া চার্জশিটে
পুলিশ মূল ঘাতক কবির ও তার পরিবারের ৫ সদস্য সহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করেছে। এর
আগে দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল ঘাতকরা। মামলার তদন্তকারী
কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবিএম বদরুজ্জামান সিলেটের আদালতে এই
চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ২১শে জুলাই গোলাপগঞ্জ উপজেলার নিমাদল
গ্রামের ছালেহ আহমদ ছলকু মিয়ার পুত্র ও সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির
ছাত্র খালেদুজ্জামান খালেদ (২০) ও তার খালাতো ভাই জহিরুল ইসলাম তাদের পূর্ব
পরিচিত হুমায়ুন কবির ও তার সহযোগীরা নগরীর বন্দরবাজার থেকে অপহরণ করে।
অপহরণকারীরা খালেদ ও জহিরুলকে মুক্তির বিনিময়ে ১২ লাখ টাকা দাবি করে।
জহিরুল ৩ লাখ টাকা জোগাড় করে দেয়ার শর্তে ছাড়া পায়। টাকা না পেয়ে
অপহরণকারীরা খালেদকে হত্যা করে এবং বিয়ানীবাজার উপজেলার সেওলা ব্রিজের উপর
থেকে নিহত খালেদের লাশ কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দেয়। অপহৃত হওয়ার ৪ দিন পর ২৫শে
জুলাই সকালে ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীতে স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো হাত-পা বাঁধা
অবস্থায় খালেদের লাশ পাওয়া যায়। খালেদ নিখোঁজ হওয়ার পর তার পিতা প্রথমে
গোলাপগঞ্জ মডেল থানায় ও পরবর্তী পর্যায়ে বিয়ানীবাজার থানায় যোগাযোগ করেন।
লাশ পাওয়ার পর খালেদের পিতা ছলুছ মিয়া বিয়ানীবাজার থানায় ৮ জনকে অভিযুক্ত
করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে বিয়ানীবাজার উপজেলার উত্তর চন্দ্র
গ্রামের আসামি হুমায়ুন কবির (২৫), মৃত বশারত আলীর পুত্র কবিরের পিতা সাইব
উদ্দিন (৫০), গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী ইউপির উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুছ
ছত্তারের পুত্র ফাহিম আহমদ (২৫) ১৬৪ ধারায় হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা
স্বীকার করে সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক
জবানবন্দি দেয়। পরে পুলিশ তদন্ত শেষে চার্জশিট আদালতে প্রেরণ করে।
চার্জশিটে অভিযুক্ত আসামিরা হচ্ছে বিয়ানীবাজার উপজেলার উত্তর চন্দ্র
গ্রামের হুমায়ুন কবির (২৫), মৃত বশারত আলীর পুত্র সাইব উদ্দিন (৫০),
জকিগঞ্জ উপজেলার বিলেরবন্দ গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নানের পুত্র মোহাম্মদ
মুকিত আল মাহমুদ (২২), বিয়ানীবাজার থানার মোহাম্মদপুর এলাকার মৃত হাজী
যোয়াদ আলীর পুত্র মোহাম্মদ গৌছ উদ্দিন (৫০), গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী
ইউপির উত্তরপাড়া গ্রামের আব্দুছ ছত্তারের পুত্র ফাহিম আহমদ (২৫),
বিয়ানীবাজার উপজেলার উত্তর চন্দ্র গ্রামের ঘাতক কবিরের মা রিনা বেগম (৪৫),
কবিরের বোন লাকী (২০) ও ফারজানা ডলি (১৯)। তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এদিকে পুলিশের তদন্তের
পর ন্যায় বিচার দাবি করেছেন খালেদুজ্জামানের পিতা সালেহ আহমদ ছলুছ মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমি ন্যায় বিচার চাই। আর কিছু না। আমার নিষ্পাপ সন্তানটিকে
কেবলমাত্র টাকার জন্যই মেরে ফেলা হয়েছে।’ আদালতে দেয়া আসামিদের জবানবন্দি ও
সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে ঘটনার বিশদ বিবরণ।
সেটি চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র
খালেদুজ্জামানের সঙ্গে গোলাপগঞ্জ বাজারের নুর ম্যানশনের স্পাইডার অ্যান্ড
ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে পরিচয় হয় কবিরের। সেই সুবাদে মাঝে মধ্যে কম্পিউটার ও
ল্যাপটপের কাজ করাতে খালেদ কবিরের দোকানে প্রায়ই আসতো। গত ১৭ই জুলাই
খালেদের বন্ধু জহিরুল মোবাইল ফোনে কবিরকে জানায় সে একটি ল্যাপটপ বিক্রি
করবে। ঠিক সেই মুহূর্তে কবির তার সহযোগীদের নিয়ে পরিকল্পনা করে যে
জহিরুলকে আটক করে মুক্তিপণের জন্য কিছু টাকা চাইবে। পরিকল্পনা মোতাবেক গত
২০শে জুলাই কবিরের সঙ্গে জহিরুলের কথা হয়। পরদিন সকালে পরিকল্পনা অনুযায়ী
কবির সিলেট করিমউল্লাহ মার্কেটের নিচতলায় দাঁড়িয়ে জহিরুল ইসলামকে ফোন করে
তার ল্যাপটপ সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলে। তখন মার্কেটের ৫ম তলায় কাজে আসা
জহিরুল ও খালেদুজ্জামান মার্কেটের নিচ তলায় এসে কবিরের সঙ্গে দেখা করে ও
জহিরুল তার ল্যাপটপ দেখায়। এ সময় কবির জানায়, ল্যাপটপ ক্রয়ের কাস্টমার তার
এলাকায় আছে। তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে খালেদুজ্জামান ও জহিরুল
বিয়ানীবাজার থানাধীন রামধাস্থ উত্তর চন্দ্রগ্রাম কবিরের বাড়িতে যায়।
পরিকল্পনা মোতাবেক আগে থেকে কবিরের বাড়িতে সহযোগী মুকিত ও ফাহিম তার কক্ষে
অবস্থান করছিল। জহিরুল ও খালেদ কবিরের ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই ফাহিমের হাতে
থাকা ছুরি দ্বারা জহিরুল ও খালেদকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করতে থাকে।
পরে তাদের দুইজনকে ২টি চেয়ারে বসিয়ে রামদা ও খেলনা পিস্তল দ্বারা জীবননাশের
ভয়ভীতি দেখায় মুকিত ও ফাহিম। এ সময় তারা স্কচটেপ দ্বারা দুইজনের সারা শরীর
পেচিয়ে বাঁধে। এক পর্যায়ে কবির মুক্তিপণের জন্য তাদের কাছে ১২ লাখ টাকা
দাবি করে। জহিরুল ৩ লাখ টাকা দিতে সম্মত হয়। ৩ লাখ টাকা দিলে খালেদকে ছেড়ে
দেবে বলে খালেদুজ্জামানকে আটক রেখে জহিরুল ইসলামকে ছেড়ে দেয়। জহিরুল
গোলাপগঞ্জ থানাধীন হেতিমগঞ্জ তার মামা সবুজের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানায়।
জহিরুল কবিরের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আটক থাকা খালেদুজ্জামানকে রুমের মধ্যে
মুকিত ও ফাহিম দুইজনে দুই পাশে ধরে রাখে এবং খালেদকে স্কচটেপ দিয়ে শক্তভাবে
নাক-মুখ পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলায় শ্বাসরোধ হয়ে কবির মারা যায়। তখন তার লাশ
কবিরের খাটের পাশে রেখে দেয়া হয়। পরে কবির জহিরুল ইসলামকে মুক্তিপণের টাকা
নিয়ে আসার জন্য ফোন করলে তখন জহিরের মামা সবুজ ফোন ধরে বলে যে, তারা টাকা
নিয়ে আসছে। এরপর কবির, মুকিত ও ফাহিম ইফতারের পর পর সড়ক ফাঁকা থাকায় লাশ
প্রাইভেট কারে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয়।
No comments