নগর প্রশাসন নির্বাচনে প্রত্যাশা by ইকবাল হাবিব
যদিও
বর্তমান বাস্তবতায় ও বিদ্যমান আইনের আলোকে দ্বিখণ্ডিত ঢাকার উত্তর বা
দক্ষিণের ‘মেয়র’ পদের যে ক্ষমতায়ন, তাতে সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে
পরিকল্পিত, জনবান্ধব নগর উন্নয়ন ও তার ব্যবস্থাপনা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি
প্রত্যাশা করাও যথার্থ হবে না;
তবু আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সিটি করপোরেশনগুলোর মেয়র ও কাউন্সিলর পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদের দ্বারাই আইনের যথাযথ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের উদ্যোগে প্রকৃত ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার ‘নগর সরকার’ব্যবস্থা গড়ে তুলে ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনগণেরই সরকার’ পদ্ধতির গণতান্ত্রিক নগর সরকার প্রতিষ্ঠার প্রকৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে;
এই বিশ্বাসে বর্তমানে মেয়র-কাউন্সিলরদের ‘সিটি করপোরেশন’ আইনানুযায়ী যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, তার আলোকে তাঁদের কাছে নির্বাচন-পরবর্তী জনপ্রত্যাশা এরূপ হতে পারে:
পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সহযোগে একটি ‘কার্যকর সেল’ গঠনের মধ্য দিয়ে:
এক. ইতিমধ্যে প্রণীত বিশদ পরিকল্পনাসমূহের আলোকে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা। এই অ্যাকশন প্ল্যানের আলোকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ‘উদ্যোগী ও সমন্বয়কারী’র ভূমিকা গ্রহণ করা এবং এতে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তার দ্রুত বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা রাখা;
দুই. ‘স্থানিক’ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণের মতামতকে উন্নয়নের সব কার্যক্রমে যুক্ত করা এবং যুক্ত করার মাধ্যমেই কেবল তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব—এ লক্ষ্যে ‘আঞ্চলিক কমিটি’কে সর্বদা সচল রাখার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া;
তিন. জনসম্পৃক্ততার শক্তি কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সব নগর উন্নয়ন কর্মসূচির ‘বাস্তবায়ন-পূর্ব জনশুনানির ব্যবস্থা’ চালু করা, তা সে যেকোনো ‘সেবা এজেন্সির’ই কার্যক্রম হোক না কেন। বিশেষ করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের আগে ‘প্রকল্প চলাকালীন জনস্বাস্থ্য ও জনহয়রানি নিরসনে নেওয়া ব্যবস্থাসমূহ’ ও প্রকল্প-পরবর্তী প্রাপ্তি বিষয়ে যথেষ্ট পর্যালোচনার সুযোগ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা;
চার. এসব কাজে ‘জনচাহিদা’ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রতি অঞ্চলভিত্তিক ‘সুপারিশ গ্রহণ কেন্দ্র’ চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং একটি সুযোগ্য তরুণ কর্মী দলের মাধ্যমে এর ‘পরিশীলিত সংস্করণ’ প্রস্তুতপূর্বক সব গৃহীত কার্যক্রমে তা ধারণ করার ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নিচের পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রা বা রূপকল্প প্রত্যাশিত বলে বিবেচিত হতে পারে:
১. পথচারী প্রাধান্য ও সর্বজন সুগম্য নগর:
(ক) সব সড়কসংলগ্ন ফুটপাত পথচারীবান্ধব করার লক্ষ্যে, অর্থাৎ প্রশস্ত, বৃক্ষ ও ছাউনিসমৃদ্ধ, যথাযথ ঢাল ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা সম্মিলিতভাবে পুনর্গঠন বা ঢেলে সাজানো;
(খ) রাস্তা পারাপারসহ চলাচলের সিগন্যাল-ব্যবস্থায় পথচারীদের প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি সবার সহজগম্যতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা (জেব্রা ক্রসিং, পথচারী সংকেত ইত্যাদি);
(গ) হকারসমৃদ্ধ কিন্তু পথচারীবান্ধব ‘চর্চাকে’ প্রাধান্য দিয়ে একটি পরস্পর নির্ভরশীল ব্যবস্থাপনার আয়োজন করে নগরের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে এরূপ ব্যবস্থা গড়ে তোলা;
(ঘ) গণপরিবহনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সব কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং তাতে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট থাকা, বিশেষ করে যথাযথ স্থানে বাস বে ও বাসস্টপ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া;
(ঙ) এ বিষয়ে নিয়মিত জনসংযোগ কার্যক্রমের ঐতিহ্য গড়ে তোলা এবং এলাকার বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়কে তাতে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া, সেই সঙ্গে নিবিড় ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসবের বাস্তবায়নে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে নিয়মিত অঞ্চলভিত্তিক সভার ব্যবস্থা করা।
২. জলজট ও যানজটমুক্ত পরিচ্ছন্ন নগর:
ক) এতদঞ্চলের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, জলাধার, খাল, জলাশয় উদ্ধার করা এবং উদ্ধার কার্যক্রম সচল রাখতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট ‘সেবাদানকারী সংস্থা’সমূহকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্দীপ্ত করা, এ ক্ষেত্রে স্ব-উদ্যোগী কার্যক্রমের জন্য বিশেষ প্রয়াস নেওয়ার চেষ্টা করা;
খ) উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, জলাধার, খাল, জলাশয়সমূহ সংরক্ষণে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি এর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় জনগণ ও তাদের সংগঠনসমূহকে ‘কো-ম্যানেজমেন্ট’-এর ভিত্তিতে সম্পৃক্ত করে ‘যৌথ তত্ত্বাবধানব্যবস্থা’র প্রচলন করার উদ্যোগী হওয়া;
গ) ইতিমধ্যে নেওয়া কমিউনিটি পুলিশের মতো সৃজনশীল উদ্যোগের পাশাপাশি ‘কমিউনিটি ট্রাফিক’ গঠন করা। এদের কার্যকর সহযোগে যানজটমুক্ত চলাচলের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণে অগ্রণী হওয়ার পাশাপাশি অবৈধ পার্কিং ও এর উৎসসমূহ নির্মূলে জনগণের সহায়তায় একটি বিশদ কর্মসূচি গ্রহণ করা;
ঘ) যথাযথ পরীক্ষণ শেষে পানিনিষ্কাশনে কার্যকর ভূমিকা পালনে ‘ওয়াসা’কে প্রণোদিত করার পাশাপাশি পয়ঃ ও কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থায় বাস্তবোচিত আমূল পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে ওয়েস্ট কনসার্ন-এর ‘বর্জ্য থেকে সার’ প্রকল্পের মতো অন্যান্য সৃজনশীল ও কার্যকর উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা বাস্তবায়নে স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে আঞ্চলিক উদ্যোগের ব্যবস্থা নেওয়া;
ঙ) প্রতিটি অঞ্চলের বা ওয়ার্ডের জনচলাচল ও জনসমাগম অঞ্চলভিত্তিক নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর যথোপযুক্ত স্থানে বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নান্দনিকতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ ‘গণশৌচাগার’সমূহ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ;
৩. শব্দ ও দৃষ্টিদূষণমুক্ত নগর:
ক) জনসচেতনতা কার্যক্রমকে ভিত্তি করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ এবং পাশাপাশি ‘শব্দসীমা’ বিষয়ে প্রণীত আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে কার্যকর কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা;
খ) নগরের যেখানে-সেখানে অনিয়ন্ত্রিত ‘বিলবোর্ড অরাজকতার’ বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক’ বিলবোর্ড কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘যথাযথ’ রাজস্ব আয়ের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে একে কাজে লাগানো এবং এর পাশাপাশি ‘জনসচেতনতা কার্যক্রমে’ও এই বিলবোর্ড ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৪. ধুলা ও বায়ুদূষণমুক্ত নগর:
ক) ‘অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা’র ওপর ভিত্তি করে কলকারখানার দূষণ কার্যক্রম পরিশীলিতকরণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রমকে যথাযথকরণ, দূষণকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মতো উদ্যোগ নেওয়া এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা;
খ) নতুন বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি বর্তমান বৃক্ষরাজির যথাযথ পরিচর্যা, সংরক্ষণ ও বৃক্ষবিরোধী ক্ষতিকর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে (যেমন: গাছের গায়ে বিজ্ঞাপন, উন্নয়ন অজুহাতে বৃক্ষ নিধন, বৃক্ষের গোড়া পাকাকরণ ইত্যাদি) প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
গ) নগরের অবহেলিত উন্মুক্ত স্থানসমূহ সবুজীকরণের পাশাপাশি ‘সূর্যোদয়ের আগেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম’ নিশ্চিতকরণ, শীতের শুকনো দিনগুলোতে সড়কে ও সড়কের পাশের বৃক্ষরাজিতে ‘জল সিঞ্চনের’ মাধ্যমে ধূলি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৫. সবার বসবাসযোগ্য আবাসনের নগর:
ক) ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’-এর আওতায় নির্মাণ-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্তদের আবাসন নির্মাণের ক্ষেত্রকে কর্মোদ্দীপ্ত করার কার্যকর ‘সমন্বয়কের’ ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে ‘সব পক্ষের জন্য লাভজনক’ উদ্যোগ হিসেবে এই খাতটিকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া;
খ) ‘সাইট ও সার্ভিস’–ব্যবস্থার অধীনে বর্তমানের ‘ইনফরমাল’ বা অ-আনুষ্ঠানিক আবাসন অঞ্চলসমূহের সার্বিক উন্নয়নে এবং এ খাতে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সৃজনশীল উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করায় ভূমিকা রাখা;
গ) এ ক্ষেত্রে ‘উদ্যোগী প্রয়াস’কে প্রণোদিত ও উৎসাহিত করার পাশাপাশি বাসস্থান, পরিবেশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দেওয়ার কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা;
ঘ) ‘স্থানিক’ পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ‘কালচার’ তৈরি করার বিশেষ মনোযোগী উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে খাসজমি ব্যবহারের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে সব মহলকে প্রণোদিত করায় সচেষ্ট থাকা বা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে তার ‘বাস্তবায়ন রূপরেখা’ প্রণয়ন করা।
ইকবাল হাবিব: সদস্যসচিব, নগরায়ণ ও সুশাসন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
তবু আসন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সিটি করপোরেশনগুলোর মেয়র ও কাউন্সিলর পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন, তাঁদের দ্বারাই আইনের যথাযথ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের উদ্যোগে প্রকৃত ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার ‘নগর সরকার’ব্যবস্থা গড়ে তুলে ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা এবং জনগণেরই সরকার’ পদ্ধতির গণতান্ত্রিক নগর সরকার প্রতিষ্ঠার প্রকৃত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে;
এই বিশ্বাসে বর্তমানে মেয়র-কাউন্সিলরদের ‘সিটি করপোরেশন’ আইনানুযায়ী যতটুকু ক্ষমতা রয়েছে, তার আলোকে তাঁদের কাছে নির্বাচন-পরবর্তী জনপ্রত্যাশা এরূপ হতে পারে:
পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সহযোগে একটি ‘কার্যকর সেল’ গঠনের মধ্য দিয়ে:
এক. ইতিমধ্যে প্রণীত বিশদ পরিকল্পনাসমূহের আলোকে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা। এই অ্যাকশন প্ল্যানের আলোকে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ‘উদ্যোগী ও সমন্বয়কারী’র ভূমিকা গ্রহণ করা এবং এতে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে তার দ্রুত বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা রাখা;
দুই. ‘স্থানিক’ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণের মতামতকে উন্নয়নের সব কার্যক্রমে যুক্ত করা এবং যুক্ত করার মাধ্যমেই কেবল তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব—এ লক্ষ্যে ‘আঞ্চলিক কমিটি’কে সর্বদা সচল রাখার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া;
তিন. জনসম্পৃক্ততার শক্তি কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সব নগর উন্নয়ন কর্মসূচির ‘বাস্তবায়ন-পূর্ব জনশুনানির ব্যবস্থা’ চালু করা, তা সে যেকোনো ‘সেবা এজেন্সির’ই কার্যক্রম হোক না কেন। বিশেষ করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের আগে ‘প্রকল্প চলাকালীন জনস্বাস্থ্য ও জনহয়রানি নিরসনে নেওয়া ব্যবস্থাসমূহ’ ও প্রকল্প-পরবর্তী প্রাপ্তি বিষয়ে যথেষ্ট পর্যালোচনার সুযোগ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা;
চার. এসব কাজে ‘জনচাহিদা’ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রতি অঞ্চলভিত্তিক ‘সুপারিশ গ্রহণ কেন্দ্র’ চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং একটি সুযোগ্য তরুণ কর্মী দলের মাধ্যমে এর ‘পরিশীলিত সংস্করণ’ প্রস্তুতপূর্বক সব গৃহীত কার্যক্রমে তা ধারণ করার ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নিচের পাঁচটি লক্ষ্যমাত্রা বা রূপকল্প প্রত্যাশিত বলে বিবেচিত হতে পারে:
১. পথচারী প্রাধান্য ও সর্বজন সুগম্য নগর:
(ক) সব সড়কসংলগ্ন ফুটপাত পথচারীবান্ধব করার লক্ষ্যে, অর্থাৎ প্রশস্ত, বৃক্ষ ও ছাউনিসমৃদ্ধ, যথাযথ ঢাল ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা সম্মিলিতভাবে পুনর্গঠন বা ঢেলে সাজানো;
(খ) রাস্তা পারাপারসহ চলাচলের সিগন্যাল-ব্যবস্থায় পথচারীদের প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি সবার সহজগম্যতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা (জেব্রা ক্রসিং, পথচারী সংকেত ইত্যাদি);
(গ) হকারসমৃদ্ধ কিন্তু পথচারীবান্ধব ‘চর্চাকে’ প্রাধান্য দিয়ে একটি পরস্পর নির্ভরশীল ব্যবস্থাপনার আয়োজন করে নগরের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে এরূপ ব্যবস্থা গড়ে তোলা;
(ঘ) গণপরিবহনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সব কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং তাতে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট থাকা, বিশেষ করে যথাযথ স্থানে বাস বে ও বাসস্টপ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া;
(ঙ) এ বিষয়ে নিয়মিত জনসংযোগ কার্যক্রমের ঐতিহ্য গড়ে তোলা এবং এলাকার বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়কে তাতে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া, সেই সঙ্গে নিবিড় ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসবের বাস্তবায়নে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে নিয়মিত অঞ্চলভিত্তিক সভার ব্যবস্থা করা।
২. জলজট ও যানজটমুক্ত পরিচ্ছন্ন নগর:
ক) এতদঞ্চলের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, জলাধার, খাল, জলাশয় উদ্ধার করা এবং উদ্ধার কার্যক্রম সচল রাখতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট ‘সেবাদানকারী সংস্থা’সমূহকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্দীপ্ত করা, এ ক্ষেত্রে স্ব-উদ্যোগী কার্যক্রমের জন্য বিশেষ প্রয়াস নেওয়ার চেষ্টা করা;
খ) উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, জলাধার, খাল, জলাশয়সমূহ সংরক্ষণে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি এর তত্ত্বাবধানে স্থানীয় জনগণ ও তাদের সংগঠনসমূহকে ‘কো-ম্যানেজমেন্ট’-এর ভিত্তিতে সম্পৃক্ত করে ‘যৌথ তত্ত্বাবধানব্যবস্থা’র প্রচলন করার উদ্যোগী হওয়া;
গ) ইতিমধ্যে নেওয়া কমিউনিটি পুলিশের মতো সৃজনশীল উদ্যোগের পাশাপাশি ‘কমিউনিটি ট্রাফিক’ গঠন করা। এদের কার্যকর সহযোগে যানজটমুক্ত চলাচলের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণে অগ্রণী হওয়ার পাশাপাশি অবৈধ পার্কিং ও এর উৎসসমূহ নির্মূলে জনগণের সহায়তায় একটি বিশদ কর্মসূচি গ্রহণ করা;
ঘ) যথাযথ পরীক্ষণ শেষে পানিনিষ্কাশনে কার্যকর ভূমিকা পালনে ‘ওয়াসা’কে প্রণোদিত করার পাশাপাশি পয়ঃ ও কঠিন বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থায় বাস্তবোচিত আমূল পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে ওয়েস্ট কনসার্ন-এর ‘বর্জ্য থেকে সার’ প্রকল্পের মতো অন্যান্য সৃজনশীল ও কার্যকর উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা বাস্তবায়নে স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে আঞ্চলিক উদ্যোগের ব্যবস্থা নেওয়া;
ঙ) প্রতিটি অঞ্চলের বা ওয়ার্ডের জনচলাচল ও জনসমাগম অঞ্চলভিত্তিক নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর যথোপযুক্ত স্থানে বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নান্দনিকতা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ ‘গণশৌচাগার’সমূহ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ;
৩. শব্দ ও দৃষ্টিদূষণমুক্ত নগর:
ক) জনসচেতনতা কার্যক্রমকে ভিত্তি করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ এবং পাশাপাশি ‘শব্দসীমা’ বিষয়ে প্রণীত আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থাগুলোকে নিয়ে কার্যকর কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা;
খ) নগরের যেখানে-সেখানে অনিয়ন্ত্রিত ‘বিলবোর্ড অরাজকতার’ বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক’ বিলবোর্ড কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘যথাযথ’ রাজস্ব আয়ের উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে একে কাজে লাগানো এবং এর পাশাপাশি ‘জনসচেতনতা কার্যক্রমে’ও এই বিলবোর্ড ব্যবহার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৪. ধুলা ও বায়ুদূষণমুক্ত নগর:
ক) ‘অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা’র ওপর ভিত্তি করে কলকারখানার দূষণ কার্যক্রম পরিশীলিতকরণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কার্যক্রমকে যথাযথকরণ, দূষণকারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের মতো উদ্যোগ নেওয়া এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা;
খ) নতুন বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি বর্তমান বৃক্ষরাজির যথাযথ পরিচর্যা, সংরক্ষণ ও বৃক্ষবিরোধী ক্ষতিকর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে (যেমন: গাছের গায়ে বিজ্ঞাপন, উন্নয়ন অজুহাতে বৃক্ষ নিধন, বৃক্ষের গোড়া পাকাকরণ ইত্যাদি) প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
গ) নগরের অবহেলিত উন্মুক্ত স্থানসমূহ সবুজীকরণের পাশাপাশি ‘সূর্যোদয়ের আগেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম’ নিশ্চিতকরণ, শীতের শুকনো দিনগুলোতে সড়কে ও সড়কের পাশের বৃক্ষরাজিতে ‘জল সিঞ্চনের’ মাধ্যমে ধূলি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা;
৫. সবার বসবাসযোগ্য আবাসনের নগর:
ক) ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’-এর আওতায় নির্মাণ-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্তদের আবাসন নির্মাণের ক্ষেত্রকে কর্মোদ্দীপ্ত করার কার্যকর ‘সমন্বয়কের’ ভূমিকা গ্রহণের মাধ্যমে ‘সব পক্ষের জন্য লাভজনক’ উদ্যোগ হিসেবে এই খাতটিকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া;
খ) ‘সাইট ও সার্ভিস’–ব্যবস্থার অধীনে বর্তমানের ‘ইনফরমাল’ বা অ-আনুষ্ঠানিক আবাসন অঞ্চলসমূহের সার্বিক উন্নয়নে এবং এ খাতে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সৃজনশীল উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করায় ভূমিকা রাখা;
গ) এ ক্ষেত্রে ‘উদ্যোগী প্রয়াস’কে প্রণোদিত ও উৎসাহিত করার পাশাপাশি বাসস্থান, পরিবেশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দেওয়ার কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা;
ঘ) ‘স্থানিক’ পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ‘কালচার’ তৈরি করার বিশেষ মনোযোগী উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ ক্ষেত্রে খাসজমি ব্যবহারের বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণে সব মহলকে প্রণোদিত করায় সচেষ্ট থাকা বা সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে তার ‘বাস্তবায়ন রূপরেখা’ প্রণয়ন করা।
ইকবাল হাবিব: সদস্যসচিব, নগরায়ণ ও সুশাসন কমিটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
No comments