তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারক ও দেশপ্রেমিক by কাজী সালাহ উদ্দীন
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ। সংক্ষেপে লিখতেন এসএম
মোরশেদ। বিচারপতি মোরশেদ নামে তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
বিচারপতি মোরশেদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার অম্লান স্মৃতি ও আত্মার প্রতি
শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
পেশাগত জীবনে আইন এবং বিচারাসনে বসে এত বেশি জনপ্রিয়তা এ দেশে কেউ আর লাভ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। জনগণের চেতনার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছা এবং সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, অগাধ ভালোবাসা লাভ করা।
১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে শপথ নেন। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের তদর্থক বিচারক হন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারাসনে বসে সবচেয়ে বিখ্যাত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার সময় পদত্যাগ করে। অন্যান্য মামলার মধ্যে সমাবর্তন মামলা, মন্ত্রী সংঘটিত মামলাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের বাবা সৈয়দ আবদুস সালেক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। এক সময় তিনি বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯২৬ সালে রাজমাহ বিভাগে সব প্রার্থীর মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন এসএম মোরশেদ। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিশাস্ত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স পাস করেন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও এলএলবি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন এবং তিনিই একমাত্র ছাত্র ছিলেন যিনি অনার্সসহ বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ সংকলনে তিনি ছিলেন প্রথম মুসলমান সম্পাদক। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। ১৯৪২ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হলে প্যালেস্টাইন এবং আরব-বিশ্বে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সংস্থার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাঙ্গা নিরসনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রতিষ্ঠিত লন্ডনস্থ পাকিস্তান সোসাইটির অন্যতম সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সোসাইটির তৎপরতা থেকে তিনি অব্যাহতি নেন।
১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তিনি পরোক্ষভাবে পথ নির্দেশনার মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে তার উল্লেখযোগ্য অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৬২ সালে ডাকসুর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন : বিশ্ববিদ্যালয় হবে অবশ্যই স্বাধীন আশার ও চিন্তাধারার প্রতীক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে এবং ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। সে সময় আইয়ুব খানের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে তার বক্তব্য সমগ্র পাকিস্তানে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি একজন বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারক এবং উদার ও উচ্চমানের বিচারক। বিখ্যাত আইনবিদ মি. বীরেন সরকার মন্তব্য করেছিলেন, তিনিই একমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য দাবি আদায়ের ব্যাপারে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, লায়ন্স ক্লাব, রোটারি ক্লাব, পাক-চীন মৈত্রী সমিতি, বাংলা-চীন মৈত্রী সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলা একাডেমি, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। ১৯৫৬ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রেডক্রস সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমাদের শোকাভিভূত করে বিদায় নেন। তার আদর্শের মৃত্যু নেই। আমাদের নিত্যদিনের পথ চলায় তার আদর্শ চলার পথের পাথেয় হোক। তাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে আসুন আমরা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলি। আমরা যেন তার উজ্জ্বল প্রতিভা ও আদর্শের সত্যিকার উত্তরাধিকার হই।
কাজী সালাহ উদ্দীন : বিচারপতি মোরশেদ স্মৃতি সংসদের সেক্রেটারি, কবি ও কলামিস্ট
পেশাগত জীবনে আইন এবং বিচারাসনে বসে এত বেশি জনপ্রিয়তা এ দেশে কেউ আর লাভ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। জনগণের চেতনার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছা এবং সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, অগাধ ভালোবাসা লাভ করা।
১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে বিচারক হিসেবে শপথ নেন। ১৯৬২-৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের তদর্থক বিচারক হন। ১৯৬৪ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। বিচারাসনে বসে সবচেয়ে বিখ্যাত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার সময় পদত্যাগ করে। অন্যান্য মামলার মধ্যে সমাবর্তন মামলা, মন্ত্রী সংঘটিত মামলাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের বাবা সৈয়দ আবদুস সালেক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস)। এক সময় তিনি বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ১৯২৬ সালে রাজমাহ বিভাগে সব প্রার্থীর মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন এসএম মোরশেদ। ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিশাস্ত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স পাস করেন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও এলএলবি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন এবং তিনিই একমাত্র ছাত্র ছিলেন যিনি অনার্সসহ বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ সংকলনে তিনি ছিলেন প্রথম মুসলমান সম্পাদক। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তিনি অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। ১৯৪২ সালে স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হলে প্যালেস্টাইন এবং আরব-বিশ্বে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সংস্থার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাঙ্গা নিরসনে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রতিষ্ঠিত লন্ডনস্থ পাকিস্তান সোসাইটির অন্যতম সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে অন্য সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সোসাইটির তৎপরতা থেকে তিনি অব্যাহতি নেন।
১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তিনি পরোক্ষভাবে পথ নির্দেশনার মাধ্যমে অনন্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে তার উল্লেখযোগ্য অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৬২ সালে ডাকসুর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন : বিশ্ববিদ্যালয় হবে অবশ্যই স্বাধীন আশার ও চিন্তাধারার প্রতীক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে এবং ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়। সে সময় আইয়ুব খানের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে তার বক্তব্য সমগ্র পাকিস্তানে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি একজন বলিষ্ঠ ন্যায়বিচারক এবং উদার ও উচ্চমানের বিচারক। বিখ্যাত আইনবিদ মি. বীরেন সরকার মন্তব্য করেছিলেন, তিনিই একমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য দাবি আদায়ের ব্যাপারে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, লায়ন্স ক্লাব, রোটারি ক্লাব, পাক-চীন মৈত্রী সমিতি, বাংলা-চীন মৈত্রী সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলা একাডেমি, বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের তিনি ছিলেন আজীবন সদস্য। ১৯৫৬ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রেডক্রস সোসাইটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমাদের শোকাভিভূত করে বিদায় নেন। তার আদর্শের মৃত্যু নেই। আমাদের নিত্যদিনের পথ চলায় তার আদর্শ চলার পথের পাথেয় হোক। তাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে আসুন আমরা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলি। আমরা যেন তার উজ্জ্বল প্রতিভা ও আদর্শের সত্যিকার উত্তরাধিকার হই।
কাজী সালাহ উদ্দীন : বিচারপতি মোরশেদ স্মৃতি সংসদের সেক্রেটারি, কবি ও কলামিস্ট
No comments