অনিশ্চয়তার গভীর খাদে রাজনীতি by সাজেদুল হক
পরিস্থিতির
পরিবর্তন হয়েছে নাটকীয়ভাবেই। গেল বছরের শেষ দিন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম
খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ছিল অনেকটাই নিরুত্তাপ। কোন আল্টিমেটাম বা
হুঁশিয়ারি নয়, সাত দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন তিনি। দল ও জোটের মধ্যেই
অবশ্য নরম ওই বক্তব্য নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়। তবে ৩রা জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকেই
পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। নয়াপল্টন কার্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন দপ্তরের
দায়িত্বে থাকা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। তাকে দেখতে যেতে গুলশান
কার্যালয় থেকে বের হতে বাধা পান খালেদা জিয়া। এরই মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয়
কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। রিজভী আহমেদকে এ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যায়
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে, গুলশান কার্যালয়ে
‘অন্তরীণ’ করা হয় খালেদা জিয়াকে। শুরুতে ‘সরকারি অবরোধে’ কার্যত অচল হয়ে
পড়ে ঢাকা। সভা-সমাবেশের ওপর জারি করা হয় অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা। যদিও
দৃশ্যমানভাবে এ নিষেধাজ্ঞা শুধু বিরোধী দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ৫ই
জানুয়ারি সারা দেশে প্রত্যাবর্তন করে সংঘাতময় রাজনীতি। হিংসা-হানহানিতে
লিপ্ত হয় সরকার ও বিরোধী দল। পুলিশি বাধায় কার্যালয় থেকে বেরুতে ব্যর্থ হন
খালেদা জিয়া। অনির্দিষ্টকাল অবরোধের ডাক দেন অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া। এরপর
থেকে সংঘাত-সংঘর্ষে এ পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছে। সরকার ও বিরোধী উভয় শিবিরই
বর্তমান পরিস্থিতিতে এক ধরনের স্নায়ুচাপে ভুগছে বলে মনে করেন
পর্যবেক্ষকরা। পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে কারোরই স্পষ্ট
ধারণা নেই। তবে এত দিন বিরোধীদের আন্দোলন নিয়ে সরকারি পক্ষ থেকে
হাসি-তামাশা করা হলেও এখন পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। সর্বশক্তি প্রয়োগ
করেই বিরোধীদের সমাবেশ ঠেকানো হয়েছে। সরকারের কারও কারও ধারণা, ঢাকায় কোথাও
সমাবেশের সুযোগ পেলে বিরোধী নেতাকর্মীরা টানা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে
যেতে পারেন। অন্যদিকে, বিরোধী দলের আন্দোলন পটভূমিতে সব ফোকাস খালেদা জিয়ার
ওপর চলে যাওয়া নিয়েও চিন্তিত সরকারি নীতিনির্ধারকরা। যেকারণে বেসরকারি
টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যেন, খালেদা জিয়ার
বন্দিদশার খবর লাইভ সম্প্রচার না করা হয়। তরুণ নেতাকর্মীদের ওপর প্রভাব
বিবেচনায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও দলীয় নেতাকর্মীদের
কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। তার বক্তব্য লাইভ সম্প্রচারের বলি
হয়েছে একটি টিভি চ্যানেল। খালেদা জিয়াকে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ফোন করা
নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে আলোচনা চলছে। এ অবস্থায় আরও হার্ডলাইনে যাওয়ার
চেষ্টা করছে সরকার। পরিস্থিতি নিয়ে দলের নেতা এবং বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ
ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন সরকার প্রধান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে
তারা তাকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে মহাসড়কগুলো সচল করা নিয়ে সরকারি প্রচেষ্টা
এখন পর্যন্ত ব্যর্থ বলেই মনে হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান
খান যেকোন মূল্যে মহাসড়ক সচলের ঘোষণা দিলেও তার বাস্তবায়ন এখনও ঘটেনি।
অন্যদিকে, বিরোধী শিবিরেও আন্দোলন নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। ঢাকায় কঠোর
আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও কেন্দ্রীয় এবং ঢাকার নেতাদের তেমন কোন তৎপরতা দেখা
যাচ্ছে না। যদিও তৃণমূল আগের মতোই শক্তি প্রদর্শন করছে। মহাসড়ক বন্ধ রাখা
ছাড়াও ট্রেন যোগাযোগ ব্যাহত করারও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল বিএনপির
নেতাকর্মীরা। তবে জামায়াত-শিবিরকে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগের মতো সক্রিয়
দেখা যাচ্ছে না। বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে এরই মধ্যে এ ব্যাপারে জামায়াত
নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। চলমান আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অনেক নেতারই
স্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলেও তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এ
আন্দোলনের সফলতা নিয়ে তারা আশাবাদী। তারা মনে করেন, আন্দোলন যদিও চালিয়ে
যাওয়া যায় তাহলে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকবে। একপর্যায়ে সরকার
আলোচনা ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের
একজন উপদেষ্টা বলেন, সরকার খুবই আতঙ্কগ্রস্ত। অন্যদিকে, ম্যাডাম জিয়া
আন্দোলনে সফলতার ব্যাপারে দৃঢ়প্রত্যয়ী। এবার আন্দোলনে একটা ফল পাওয়া যাবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সঙ্কটকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা
বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এবারও সে চেষ্টা চলছে। তবে সরকার ও বিরোধী শিবিরের
স্নায়ুচাপে ভোগার বিষয়টি এখন একেবারেই স্পষ্ট। সারা দুনিয়াতেই বাংলাদেশ
পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের তৈরি হয়েছে। সংলাপের আহ্বানও এসেছে। তবে
এখন পর্যন্ত সরকারের নমনীয় হওয়ার কোন রকম আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে,
নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে অনড় অবস্থায় রয়েছে বিরোধী জোট। এ অবস্থায় একটি
বিষয়ই নিশ্চিত সামনের দিনগুলো হবে সংঘাত আর অনিশ্চয়তাময়। যদিও এ পরিস্থিতির
পরিণতি যে কারও জন্যই ভাল হবে না, সে হুঁশিয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকাও
উচ্চারণ করেছে।
No comments